কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

০৩ রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়

ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে আছো তুমি
রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়


সেই ছাতিমতলা যেখানে উচ্চারিত হয়েছিল ‘আনন্দম অনন্তং শুভম’। যার অলখদুয়ার থেকে মহামানবের যাত্রা। যিনি শিল্প আর জীবনকে মিশিয়েছিলেন অভূতপূর্ব রসায়নে। সেই জীবনশিল্পী রবীন্দ্রনাথ।

আমি আনন্দের কবি –- এমনটাই ভাবতে ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথ। তাই উপনিষদের সেই শ্লোকটি –- ‘আনন্দাদ্ধেব খল্লিমানি ভূতানি জয়তে’ বারবার ধ্বনিত হয়েছে তাঁর কাব্যে তাঁর গানে। আনন্দধারা বহিছে ভুবনে / দিনরজনী কত অমৃতরস উথলি যায় অনন্ত গগনে। হয়তো আনন্দবাণী ছাড়িয়ে গেছে দুঃখের পরিসংখ্যানকে। তবু সত্যি কি তিনি শুধু আনন্দের বাণী বহন করেছেন? কিছুই তো হল না / সেই সব সেই সব সেই হাহাকাররব / সেই অশ্রুবারিধারা, হৃদয়বেদনা। আনন্দধারা থেকে সরে সরে তাঁর সেই রোমান্টিক অ্যাগনি; প্রেমের প্রাপ্তিতে পূর্ণ হৃদয় তীব্র বিষাদেও হাহাকার করেছে।

>

‘শান্তং শিবম অদ্বৈতম’ –- এই মন্ত্রটিকে রবীন্দ্রনাথ গেঁথেছিলেন তাঁর কাব্যে তাঁর গানে। শান্ত অর্থাৎ যেখানে সকল বিরুদ্ধগতি শান্তির মধ্যে দিয়ে ঐক্যলাভ করে। শিবম অর্থাৎ যার মধ্যে দিয়ে সকলের স্বার্থ মঙ্গলে নিহিত। আর অদ্বৈতম হলো সে, যেখানে তুমি আমি চেতন অচেতন এক দেহে হলো লীন। আর তাই বুঝি আশৈশব ঈশ্বরবিশ্বাসী রবীন্দ্রনাথের দুঃখবাণীতে কোথাও বিশ্ববিধানের প্রতি বিদ্রোহের আভাস নেই। বরং অন্ধকার ভেদ করে জেগে থাকে এক স্নিগ্ধ আলোর কিরণ। দুঃখের মধ্যে আনন্দকে ছুঁয়ে ফেলার দুর্বার কল্পনায়; যাপনের মধ্যে সত্ত্বাকে স্পর্শ করার তীব্র আকাঙ্ক্ষায় নিরন্তর নিরবধি তাঁর চলন। হয়তো কখনো সত্য-শিব-সুন্দরের পথে নিরুদ্বেগ আস্থার তরীখানি হঠাৎ ডুবে যায়। আপন অন্তর্যামীর কাছ থেকে নোঙর তুলে নেওয়ার যন্ত্রণায় উত্তাল হয়ে ওঠে হৃদয়। তবু গান উঠেছে আকাশভরা সূর্য তারা বিশ্বভরা প্রাণ। সংশয় থেকে বিশ্বাসে আর বিশ্বাস থেকে সংশয়ে অবিরাম যাতায়াত তবু প্রাণ নিত্যধারা হাসে সূর্য চন্দ্রতারা।

উপনিষদের অধ্যাত্মরস রবীন্দ্রকাব্যেও। নির্ভার স্বচ্ছতা ছন্দের মদিরতা দিয়ে দীর্ঘ রাবীন্দ্রিক যুগ। মুগ্ধ করে রাখলেন পথিককে তাঁর অন্তর্লীন শিক্ষা আর সংযমের মন্ত্রে। কাব্যরূপে তিনি দুর্গম গিরি রচনা করেননি। পার হতে চাননি কোনো বৈতরণীও। মোহিনী মায়ায় রিনিঠিনি ছন্দ বাজলেও সেই আপাত সরল জলধর্মী কাব্যের গভীরে বিরাজ করত আবর্তের নিত্যমন্থন। সেই মোহিনীমায়ায় ঘর ছেড়ে কূল হারানো নয়; অসহায় উচ্ছ্বাসের চোরাবালিতে নিমজ্জন নয়, বরং প্রাণ ও মনের দ্বন্দ্ব, প্রকৃতি ও সংস্কৃতির দ্বন্দ্ব নিয়েও সত্য-শিব-সুন্দরের সন্ধান করতে হবে। আঁধার থেকে ক্রমশ আলোতে উত্তরণের জীবনদর্শন নিয়ে আধুনিক যন্ত্রণাকে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে উচ্ছ্বসিত করতে হবে। তবেই সার্থক হবে রবিসম্মিলন।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন