কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০১৩

০৪ জাহ্নবী দাশ

ফ্যাশনেবল বাঙালি, আজকের শৈশব এবং রবীন্দ্রনাথের মাতৃভাষা চিন্তা
জাহ্নবী দাশ

বাংলা পৃথিবীর সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা –- UNESCO থেকে কিছুদিন আগে প্রকাশিত এই খবরে জয়োল্লাসে মেতে উঠেছিল বাঙালি। তবে এই তথ্য কিন্তু মোটেই পালটে দিচ্ছে না আমবাঙালির মানসচিন্তাকে। ইংরেজির একাধিপত্য এবং হিন্দি বলয়ের অসাধারণ মার্কেটিঙের ফলে বাংলা কিন্তু কোণঠাসাই। না, দোষটা ইংরেজি বা হিন্দির নয়। নিজেদের অস্তিত্বকে নড়বড়ে করে দেওয়ার দায় নিতে হয় আমাদেরই। মধ্যবিত্ত বাঙালি বিশ্বাস করে, বাংলা মাধ্যম স্কুল আসলে বাড়ির ঝি-এর ছেলেমেয়েদের জন্যই। বাঙালি মা তার ছেলেকে ডাকে –- ‘বাবা, come, come, grapesকটা খেয়ে নাও!’ আর তাই “দিনের আলো নিবে এল, সূয্যি ডোবে ডোবে” কিংবা “বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান”-এর সঙ্গে আজকের শিশুমন পরিচিত নয়।

আসলে আজকের দিনটাই show of করার। তাই reality showতে প্রতিযোগীর ট্যালেন্ট বিচার্য নয়। সে রোগা না মোটা, cool না hot, সেটাই হয়ে দাঁড়ায় মুখ্য আলোচনার বিষয়। ছাঁচে ঢালা মনুষ্যত্ব কখনও টেঁকে না, বলেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘রাশিয়ার চিঠি’তে। অভিভাবকদের বোধহীনতায় আজকের শৈশব শুধু “ভয়ে ভয়ে যাই, ভয়ে ভয়ে চাই / ভয়ে ভয়ে শুধু পুঁথি আওড়াই” (‘শিক্ষা’)। আমরা ভুলে যাই, সিংহের চামড়া দিয়ে গৃহসজ্জা সম্ভব হলেও চামড়া বদল কিন্তু সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন –- “ আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা যেমন মাতৃক্রোড়ে জন্মেছি, তেমনি মাতৃভাষার ক্রোড়ে আমাদের জন্ম। এই উভয় জননীই আমাদের পক্ষে সজীব ও অপরিহার্য” (‘সভাপতির ভাষণ’)।


আর এখানেই অত্যন্ত জরুরী হয়ে ওঠে রবীন্দ্রনাথের ‘সহজপাঠ’। খোলা আকাশের নিচে শিশুদের সঙ্গে হাত মেলায় তাদেরই মাতৃভাষা –- “ছোট খোকা বলে অ আ / শেখেনি সে কথা কওয়া” অথবা “হ্রস্ব উ দীর্ঘ ঊ / ডাক ছাড়ে ঘেউ ঘেউ”। কিংবা “ঘন মেঘ বলে ঋ / দিন বড়ো বিশ্রী”। রবীন্দ্রনাথ জানতেন, শিশুদের সমস্ত কিছুই গেলানো হয় তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। ফলে বাধাপ্রাপ্ত হয় তাদের মনের স্বাভাবিক বিকাশ। ‘তোতাকাহিনী’তেও একথাই বলেছেন তিনি। চেয়েছেন শিশুদের জন্য এমন একটা আকাশ, যেখানে ইচ্ছেডানা মেলে দিয়ে প্রয়োজনীয় ওড়াটুকু শিখে নেবে তারা আনন্দের সঙ্গে –- স্বেচ্ছায়। যেখানে সিন্ডরেলার গল্প শুনিয়েও মায়েরা গাইবে ঘুমপাড়ানী গান –- “হাট্টিমাটিম টিম / তারা মাঠে পাড়ে ডিম / তাদের খাড়া দুটো শিং / তারা হাট্টিমাটিম টিম”। “Baba black sheep have you any wool” আজকের শিশুরা নিশ্চয়ই আওড়াবে, কিন্তু একইসঙ্গে শিখবে –- “আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে / বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে”।

শুদ্ধ মাতৃভাষা নয়, ভুলভাল ইংরেজি বা গোঁজামিল হিন্দি বলাটাই আজকের বাঙালির ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। স্বজাতীয় নাড়ীর যোগ থেকে বাঙালির জেনারেশন ‘Y’ আজ তাই বিচ্ছিন্ন। এই প্রসঙ্গেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, --“আমার ভাবা যখন আমার নিজের মনোভাবের প্রকৃষ্ট বাহন হয়, তখনই অন্য ভাষার মর্মগত ভাবের সঙ্গে আমার সহজ ও সত্য সম্বন্ধ স্থাপিত হতে পারে” (‘সাহিত্যের পক্ষে’)। একটি শিশু তার সব রকম দুরন্তপনার পর ফিরে আসে তার মায়ের কাছে। মায়ের স্পর্শ, মায়ের গন্ধ শিশুর জীবনীশক্তি। যার সে-মা নেই, কথা শেখার প্রথম শব্দে যে নির্দিষ্ট কাউকে সম্বোধন করতে পারে না, সে শিশু বড় অসহায়। এই ফাঁককে –- অপূর্ণতাকে কেউ কখনো পূর্ণ করতে পারে না। কারণ মায়ের তো কোনো বিকল্প নেই! মাতৃভাষারও হয় না।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন