কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ১৪ জুন, ২০১৩

০২ সুবীর সরকার

অরুণেশ : বহুপ্রজ এক আবহমানতা
সুবীর সরকার
বসন্ত ঋতুতে কবে খুন হয়ে গিয়েছিল রাধা
বয়স বাহান্ন হলে একা কাঁদে কিশোরী ধর্ষিতা...

                                            (অরুণেশ ঘোষ)

(ক)

অরুণেশ ঘোষ (১৯৪১-২০১১)। সারাজীবন উত্তরবাংলার প্রান্ততম নিভৃত গ্রামে জীবন কাটিয়েও মেধামনন ও লেখালেখি দিয়ে আলোড়ন তুলেছেন বাংলা সাহিত্যচর্চার ভরকেন্দ্রে। কলকাতা কেন্দ্রিক হাততালি তোষামোদ-প্রিয়তার বৃত্তকে প্রান্তের নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য দিয়ে বরাবর চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন তিনি। আর ক্রমে এভাবেই নির্মাণ করেছেন নিজস্ব ভাষাবিশ্ব। কবিতা, গদ্য,‌ অনুবাদকর্ম, নাটক রচনায় তিনি আজীবন সৎ থেকেছেন। কথা বলেছেন সরাসরি। জীবনের অন্ধকারময় নরক ঘেঁটে তুলে এনেছেন আশ্চর্য এক জীবনের গল্প। ধারাবাহিকতাহীন আদ্যন্ত এক ধারাবাহিকতাই যেন। ‘শব ও সন্নাসী’, ‘গুহা মানুষের গান’, ‘বিপথিক’, ‘দীর্ঘ নীরবতা’ তাঁর উল্লেখ্য কাব্যগ্রন্থ। পাশাপাশি লিখেছেন ‘সন্তদের রাত’, ‘অপরাধ আত্মার নিষিদ্ধ যাত্রা’, ‘জীবনের জার্নাল’, ‘জীবনানন্দ’-এর মতোন অসামান্য সব গদ্যের বই। জীবন, মিথ, ইতিহাস, কিংবদন্তী মেশানো থরে থরে সাজানো প্রশ্নের ভিতর তুলে ধরা ভয়াবহ মানবজীবন, সভ্যতার জলছবি সেই সব গদ্যগ্রন্থের ভিতর খুঁজে যাই আমরা। র‍্যাঁবোর কবিতার অনুবাদ করেছেন তিনি –- ‘মাতাল তরণি’। রয়েছে ছোটগল্পের সংকলন, যে বইটির অন্যতম সম্পদ অরুণেশের দিনলিপি টুকরো। এছাড়া নাটকও লিখেছেন – ‘বর্বরের তীর্থযাত্রা’ । রয়েছে প্রবন্ধের বই -- ‘কবিতার অন্ধকার যাত্রা’। বহুপ্রজ এই মানুষটি প্রয়াত হন ২৪ আগষ্ট,২০১১।



(খ)

অরুণেশ সেই বিরল প্রজাতির লেখক, যিনি পাঠকের চিন্তাবিশ্বে আলোড়ন তুলে অনিবার্য সব প্রশ্নের সামনে দ্বিধাহীন দাঁড় করিয়ে দেন। ঘুম, ঘাম ও থোরবড়িখাড়া মৈথুননিদ্রাআহারসর্বস্ব জীবনের বাইরে আরো আরো সুপ্রসারিত জীবনের দিকে বুঝি যাত্রা শুরু হয় পাঠকের। অরুণেশের কবিতাকে অনেকেই অশ্লীলতায় আটকে দিতে চেয়েছেন, যা পুরোটাই আদতে যুক্তিহীন এক অশ্লীলতাই যেন।

(গ)

কত বিচিত্র সব চরিত্র অরুণেশের লেখায় ভিড় করে আসে। বেশ্যা, বেশ্যার দালাল, গণিকাপলীর বৃদ্ধা মা। কমরেড কেরু, সুহাসিনি মাসী, নির্বাসিত কুষ্ঠরোগীনি, সুবলের চাটের দোকান, বিশাল মাঠের ওপর দিয়ে ছুটন্ত বিপন্ন এক মানুষ যাকে তাড়া করছে আততায়ীর কুড়ুল। ত্রাস, নরকের নারকীয়তাকে তুমুল তুলে আনেন অরুণেশ। উত্তরবাংলার মিথ, লোকসংস্কৃতি, ইতিকথা, প্রান্তিক মানুষেরা বরাবরই সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তাঁর লেখায়। রাজবংশী ও দেশীয় মুসলিম জীবনের যাপনবৃত্তকে মেলে ধরেছেন তিনি। বাল্যকালে বহুবার গিয়েছেন পূর্ববাংলার টাঙ্গাইল – এর দাদুবাড়িতে। তার প্রভাব পড়েছে অরুণেশের জীবন ও কবিতায়। তাঁর গড়ে ওঠায়। মানুষ ও প্রকৃতির অত্যাশ্চর্য বর্ণময়তা। সংশয় সংকট আর মাথা-ভর্তি হাহাকার নিয়ে ছুটে গেছেন তিনি জীবন ও নিম্নবর্গীয়দের মাঝে। এখানেই তাঁর স্বকীয়তা।

এলুয়া ফুটিল আসিল বান
কাশিয়া ফুটিল গেইল বান।
                                   
(উত্তরবাংলার লোকপ্রবাদ)
(ঘ)

অরুণেশ প্রয়াত হয়েছেন। কিন্তু রেখে গেছেন তাঁর সৃষ্টিকর্ম। তাঁর জীবনবোধ ও দর্শনকে বুঝতে হলে জরুরী তাঁর সৃষ্টিকর্মকে স্পর্শ করা। গল্পসমগ্র–এর শেষে অরুণেশের দিনলিপি পড়লে আবিষ্ট হয়ে যেতে হয়। অরুণেশ হাংরি কিনা, অ্যাংরি কিনা, অশ্লীল কিনা -- সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর হয় না; শুধু এটুকুই বলা যায়, অরুণেশ বহুপ্রজ আবহমানতা নিয়ে আদ্যন্ত এক অকপট মানুষ, জীবন ও সৃষ্টিকর্মে।

2 কমেন্টস্:

  1. অরুণেশকে নিয়ে লেখা থামতেই চায় না। সুবীর, থামলি কেন ?

    উত্তরমুছুন
  2. অরুণেশকে নিয়ে লেখা থামতেই চায় না। সুবীর, থামলি কেন ?

    উত্তরমুছুন