কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৯ আগস্ট, ২০১৩

০২ অলোকপর্ণা

ঝিঁঝিঁরা
অলোকপর্ণা


তিনঘণ্টা হাঁটার পর ঋজুর খেয়াল হলো, তার কব্জির ষোলোহাজারি ঘড়িটা উবে গেছে। রাস্তার ধারে ঋজু থেমে গেল। তাকে না ছুঁয়ে পাশ কাটিয়ে চলেছে খালি পা, কমলা গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট আর গামছার দল। তাদের কাঁধের বাঁক থেকে ভেসে আসা ঘুঙুরের ঝিঁঝিঁ ঋজুর চিন্তার মেঘ ছিঁড়ে দিলে, ঘড়ি হারিয়েও সে নিশ্চিন্ত হয়ে পড়ল। এরপরও আশে পাশের ভিড় ‘ভোলে বাবা পার করেগা!’ চেঁচিয়ে উঠলে ঋজু গলা মেলাতে পারে না। কুণ্ঠা হয় তার, ভিড়ে মিশে যাওয়ার শঙ্কাও হয়। রাস্তার পাশে একটু দূরত্ব রেখে বিষণ্ণ সে স্রোতের সাথে এগিয়ে চলে, তারকেশ্বরের দিকে।

ঋজু জানে না, সে হাঁটছে কেন! তবু নিজেকে ‘ফরেস্ট গাম্প’ বলে ভাবতে ভালোই লাগছে তার। ফর্সা খালি পা, থ্রি কোয়ার্টারস আর টাওয়েল ঋজুকে বাকিদের থেকে আলাদা করে দিচ্ছে। কাঁধের ব্যাগের স্যুইচড্‌ অফ ফোন থেকে স্বস্তি ভেসে আসছে তার দিকে, ঋজু এখন সমস্ত নাগালের বাইরে! অচেনা, অশিক্ষিত মানুষগুলোর সান্নিধ্যে এসে সে নিরাপদ বোধ করে; বাবার বিজনেস, মায়ের পরকীয়া, বন্ধুদের মত্ত হাতছানি থেকে মুক্ত বোধ হয় তার।

গতরাতে শেওড়াফুলির ছাউনিগুলোয় খিচুড়ির গন্ধ লেগে ছিল। ঋজু খেতে পারেনি। দূরে দাঁড়িয়ে কলা খেতে খেতে সে দেখেছিল, কীভাবে মানুষেরা খিচুড়ি খেয়ে আনন্দ পায়, আনন্দ পেতে পারে আর আনন্দের সঙ্গে বলে ওঠে, ‘বাবা তারকনাথের চরণের সেবা লাগে, মহাদেব!’ ওর পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা খাওয়ার পর বিড়ি ধরিয়ে ওকে কাউন্টার দিতে চেয়েছিল। ঋজু পাত্তা দেয়নি। ছেলেটার কথা ভেবে এখন তার করুণা হলো। কে জানে কোথায় মিশে গেছে, ঋজু চারপাশ খোঁজে, দিস গাই? অর দ্যাট ওয়ান? ঋজুর গুলিয়ে যায়। এদের সবারই মুখ এক রকম, কাউকে আলাদা করা যাচ্ছে না। ঋজু দীর্ঘশ্বাস ফেলে গতি বাড়িয়ে ঝিঁঝিঁর প্রকাণ্ড লাইন ধরে উপরে উঠতে থাকে।

‘মানুষেরা এমনই বাঁক কাঁধে জন্মায়, ঝিঁঝিঁর মতো বাঁচে, সকাল হলে দুধ পুকুরে নেমে গায়ে লেগে থাকা সুতোগুলো ঝেড়ে উঠে এসে কোথায় চলে যায়, কেউ জানে না’-- শেষ দু’মাইল হাঁটতে হাঁটতে ঋজুর এরকমই ভ্রম হতে শুরু করে। পাশের লোকগুলো কোন্‌ সময় মায়ের বয়ফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছে, সে খেয়াল করেনি। সে খেয়াল করেনি, তার ফুলে ওঠা বাঁ পায়ের ফোস্কাটা অভিগত গোলকের আকার নিয়েছে কখন! ঘামের দুর্বিষহ গন্ধ উপেক্ষা করে তার কানে ঝিঁঝিঁর ডাক ঢুকে আসছে। চারপাশে স্তবের মত ‘ব্যোম ভোলে’ সহ নানান অস্ফুট গালিগালাজ। ঋজু অজ্ঞাতসারে আওড়ে চলছে ‘ভোলে বাবা পার করেগা’। আকাশে আলো দেখা দিতে শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাওয়া ঋজুর আনন্দ হয়। মন্দির আর আধঘণ্টার পথ। মায়ের বয়ফ্রেন্ডদের সাথে পাল্লা দিয়ে ঋজু ছুটে চলে, ঋজু ঝিঁঝিঁ বনে যায়।

লাল তেলে ভাসা আলুর দম মুখে ভরতে ঋজুর ঘুম পায়। পাশের লোকগুলো কত ফর্সা হয়ে গেছে স্নানের পর, সবার মুখে এখন কোটি টাকার হাসি। কচুরি মুখে ওঠে না ঋজুর। হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলে সে। পাশের ছেলেরা অবাক হয়ে তাকিয়ে কেমন মিইয়ে যায়। কোত্থেকে বেরিয়ে এসে কাউন্টার দিতে আসা ছেলেটা ঋজুর কাঁধে হাত রাখে। ঋজু শোনে তার তামাটে কব্জিতে থাকা ষোলোহাজারি সময়ের টিক্‌ টক্‌, টিক্‌ টক্‌। ঋজু কেঁদে চলে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন