কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ২০ আগস্ট, ২০১৩

০১ অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা – আটানা
অমিতাভ প্রামাণিক


২. আহ্বান, শোনো আহ্বান...

চারানা-আটানা-র প্রথম কিস্তির লেখা পড়ে অনেকেই ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বলছেন, আমি যা লিখেছি সব নাকি অযৌক্তিক, বিশেষ করে গরু-ছাগল নিয়ে প্রলাপটা। আমি প্রথমে ভাবলাম, ‘অজ’ বিষয়ে ‘উক্তি’ করেছি, তাই হয়তো ওরা একে ‘অজৌক্তিক’ বলছেন। কিন্তু না, তা নয়। যাঁরা ‘গার্হস্থ্য’ পালন করছেন, তাঁরা ‘গরু’-র গৌরব ‘অস্ত’ যাওয়া নিয়ে মন্তব্য একেবারেই পছন্দ করছেন না। ‘গ্রামের মাটি’ থেকে ‘ক্যাল’কাটার ধুলো, সব নিয়ে যারা দুর্ধর্ষ পঞ্চায়েতী রাজনীতি করছেন, তাঁরা আমার ব্যাকরণচর্চায় ‘গ্রামাটিক্যাল’ মিস্টেক দেখতে পাচ্ছেন। যদিও তাঁরাও ছাগলের মতোই ‘ব্যা-অ্যা-অ্যা’ করছেন ‘লট’-এ, যাতে ‘ব্যালট’বক্সে তাঁদের প্রতীকে ছাপ মারা কাগজটাই ঢোকে।

এইসব ছিদ্রান্বেষীদের জন্যে বাণী দেওয়ার মতো আমার স্টকে কিছু নেই। আমি তো আর রামকৃষ্ণ পরমহংস বা বিবেকানন্দ নই! খিদে পেলে রাম বা কৃষ্ণ কী করতেন, তা নিয়ে আমি ভাবি না; পরম আনন্দে হংস চিবিয়ে খেয়ে ফেলি, তাতে আমার বিবেকে খুব আনন্দ হয়। ব্যাস্‌, এইটুকুই যা মিল।

আমার লেখায় ছিদ্র খুঁজছেন, অথচ ছাগছিদ্রপথে যে বস্তু নিস্ক্রান্ত হয়, নাদি নামক সেই ইঞ্জিনীয়ারিং বিস্ময়টি নিয়ে বহুকাল ধরে যে চর্চা হয়ে আসছে, তা তাঁরা মানতে পারছেন না। ‘আসুন, বসুন, কী খাবেন, বোঁদে? / বাটি নিয়ে চলে যান ছাগলের ইয়েতে’, মানে বোঁদের সঙ্গে যার সুসংবদ্ধ অন্ত্যমিল হয় তাতে। এই রসোত্তীর্ণ ছড়াটি শোনেন নি, এমন বাঙালি কি একটিও আছেন? কিন্তু দিনকাল যা পড়েছে, এখন এসব বললে লোকে অসংস্কৃত বলে। ভাবে অসভ্য, ইতর, নিরক্ষর, গ্রাম্য। বাংলা সাহিত্য থেকে পেচ্ছাপ-পায়খানা উঠেই যাচ্ছে, তার বদলে এসে যাচ্ছে টয়লেট-পটি জাতীয় শব্দগুলো। যেন ইংরেজি করে বললে প্রস্রাব মনে হবে আমপোড়ার সরবৎ, পূরীষ থেকে হাস্নুহানার সুগন্ধ বেরোবে!

ইংরেজরা বলে, ‘নেচার্স কল’। তা থেকে বাংলা করা হলো, প্রকৃতির ডাক। এই সংখ্যার চারানা-আটানার বিষয় এটাই – আদি, অকৃত্রিম, প্রাকৃতিক আহ্বান। বাজে গন্ধ বেরোতে পারে, নাকে রুমাল চাপা দিয়ে পড়ুন।

মনে করুন, একটা ফুটফুটে বাচ্চা দেখে আপনার খুব কোলে নিতে ইচ্ছে হলো। কী নরম নরম তার গাল, কী বড় বড় গোল গোল তার চোখদুটো, কী মিষ্টি তার হাসিটা। আপনি তাকে কোলে নিয়ে এসব দেখছেন, তার নাকের ডগায় নাক ঘষে চর্যাপদ বা তারও পুরনো ভাষায় আদর করছেন, সেই ফাঁকে সে কখন নিঃশব্দে নামিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ খেয়াল হলো, তাই তো, জামাটা ভিজে ভিজে, কেমন যেন সন্দেহজনক গন্ধ বেরোচ্ছে! হাসিমুখেই বাচ্চাটাকে স্থানান্তরিত করার চান্স খুঁজছেন, আর মনে মনে ঝাল ঝাড়ছেন, ভারি অসভ্য বাচ্চা তো!

শহুরে বাচ্চাদের এর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যে আছে ‘হাগিস’। মানে, ঠিক আছে বাবা, হাগা পেলে তুই এর মধ্যেই হাগিস। যে মহিলারা নিজের বাচ্চাদের এই বস্তু পরিয়ে রাখেন, তাঁরা নিশ্চয় খেয়াল করেছেন, অদম্য প্রতিভায় বাচ্চাটি এটি এমনভাবে ব্যবহার করে যে, ওটা খোলার সময় দেখা যায় নিষ্ক্রান্ত বস্তুসমূহে বাচ্চাটির পশ্চাদ্দেশ একেবারে মাখামাখি হয়ে আছে। তবে শহুরে বাচ্চারা নিজেদের পটি নিয়ে হাত দিয়ে চটকে সারা গায়ে মাখামাখি করার বিশেষ সুযোগ পায় না। ঘা এবং পটি ওদের থেকে ঘাপটি মেরে দূরে থাকে বলে ওরা অন্যপ্রাণীর পটি-ও সহ্য করতে পারে না। গরুর পটি গোবর এবং গোমূত্র যে পঞ্চগব্যের অন্তর্গত, ব্রাহ্মণসন্তানদের উপনয়নের সময় যে ওই বস্তুসমূহের কন্‌কক্‌শন মুখে ছোঁয়াতে হয়, বলে দেখুন এইসব বাচ্চাদের, ভির্মি খাবে।

যেমন আমাদের গাবলু। টিপিক্যাল শরৎচন্দ্রের নতুনদার ন্যানো সংস্করণ। কলকাতার অভিজাত পল্লী থেকে বেড়াতে এসেছে তার পিসির বাড়ি, ধ্যাদ্ধেড়ে গোবিন্দপুরে। এখন তো অনেকটা অবধি বাস চলে আসে, লাইটের পোলও পোঁতা হয়ে আছে বছর দশেক। হুক মেরে কেউ কেউ ইলেক্ট্রিসিটিকে পৈতৃক সম্পত্তি গণ্য করে টিভিও দেখে বাড়িতে। সেখানে রাস্তার পাশে প্রাচীন মহীরুহের কাণ্ড বেষ্টন করে শুঁয়োপোকার মতো সেঁটে আছে –- সারি সারি ঘুঁটে! গাবলু এসব আগে দেখেনি, এখানে দেখে তার গা ঘিনঘিন করতে লাগল।

গাবলু ছেলে খারাপ নয় মোটেই। বেশ চালাক-চতুর, শহরের বাচ্চারা যেমন হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে আর রাত্রে শুতে যাবার আগে সে ব্রাশ করে, খাওয়ার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধোয়। তার জামার কলারের ভেতরে দামী ব্র্যাণ্ডের লেবেল। রবীন্দ্রনাথের ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ আর ‘অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে’ তার মুখস্থ, সে স্টেজে উঠে তার বালকসুলভ গলায় বেশ আবৃত্তি করে দিতে পারে।


কিন্তু পায়খানার ব্যাপারটা অন্যরকম। গাবলুর তিনটে সিচুয়েশনের উদাহরণ দেওয়া যাক। যারা ভাবছেন, কী ছাইপাঁশ গদ্য লিখছে, এর চে’ লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়াও ভালো, তাদের সুবিধার্থে এই উদাহরণগুলো পদ্য বানিয়ে দিলাম, পাঁচ লাইনের লিমেরিকে।

গাবলু-১

শহুরে বালক গাবলুচন্দ্র, কী চঞ্চল, কী নটি।
গ্রামে এসে এক বাচ্চা মেয়েকে বলে, “তুই খুব হটি!”
খাবে না কিছু সে, সবে হতবাক।
চেপে ধরি; বলে সিঁটকিয়ে নাক,
“ওদের বাড়িতে হাত দিয়ে মাখে কাউ-বাফেলোর পটি!”

‘ওদের’ বাড়িতে, বুঝলেন তো? যাদের বাড়ি বড়-বৌ আর মেজ-বৌ মিলেমিশে থাকত। ঘরের পাঁচিল থেকে মেহগনির প্রকাণ্ড কাণ্ড, সব ভরিয়ে রাখত ঘুঁটেতে, দেখলে মনে হতো দেওয়ালের গায়ে দাদ-রা যেন দাদরা বাজাচ্ছে! ওরা তো পাশের বাড়ি, গাবলুকে ডেকে দুধকলা চটকে গুড়-মুড়ি দিয়েছিল হয়তো। গাবলু তো পালাতে পারলে বাঁচে! যে হাত দিয়ে গরুর পটি চটকে মাখে, সেই হাত দিয়ে –- ম্যাগো!

নেক্স্‌ট!

গাবলু-২

দাঁড়িয়ে গলির মোড়ে গাবলুটা কাঁদছিলো, ভ্যাঁ!
“কী হয়েছে, কাঁদছিস! কে বকেছে? কে মেরেছে, হ্যাঁ?
পেটে ব্যথা? বিকু খাবি?
বাজারে বেড়াতে যাবি?”
“দ্যাখো না গো, চটিটাতে লেগে গেছে কুকুরের অ্যা!”

গ্রামের ছেলে হলে পাত্তাই দিত না, চটি ঘাসে ঘষটে বা কোনো পুকুরের জলে ধুয়ে নিলেই সাফ। গাবলু তো মহা মুশকিলে পড়ে গেছে, এত সুন্দর ওর বাহারি চটিতে কুকুরের পটি! এখন কী হবে? চেনা চেনা মনে হচ্ছে, এই দৃশ্য?

যাই হোক, পিসির বাড়ি বেড়ানো শেষ করে গাবলু নিজের বাড়ি ফিরে এল, কলকাতায়। এর কিছুদিন পরের ঘটনা এটা।

গাবলু-৩

গাবলু ফিরছে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, স্কুল থেকে বাড়ি এমন কী দূর!
বলি, “কী রে, পা’টা টেনে হাঁটছিস, কামড়েছে নাকি নেংটি ইঁদুর?
না কি প্যান্টখানা গেছে তোর ফেঁসে?
ফোঁড়া উঠেছে কি দেওয়ালটা ঘেঁষে?
এ কী রে, পেছন ভিজে ভিজে দেখি, সমীরণ বড় গন্ধবিধুর!”

ওয়েল, এই ব্যাপারটাতে গ্রাম-শহরের ভেদ নেই। যার এই কাণ্ড হয়েছে, সেই জানে! ওঃ, কী অসম্ভব লম্বা মনে হয় পথ তখন!

একটা বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে এইসব আজেবাজে রসিকতা করে পাতা ভরিয়ে দিলে সম্পাদক কাজলদা আমার চাকরি খেয়ে নেবেন। বলবেন, অনেক হয়েচে, রাস্তা দ্যাকো এবার। সুতরাং, একটু উচ্চাঙ্গে ওঠা যাক। স্থান – শহরতলীর রাস্তা। নায়ক – রাম-শ্যাম-যদু-মধু-আমি-আপনি, অর্থাৎ যে কোনো পুরুষ মানুষ। মহিলারা এখনো এই ব্যাপারটাতে পুরুষের সমকক্ষ হতে পারেন নি। আশা রাখি, যেন কোনোদিন না পারেন। অন্তত এই একটা ব্যাপারে তো পুরুষের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় থাক!

দেওয়াল

ছড়ানো রাস্তা, দাঁড়ানো দেওয়াল, জায়গাটা বেশ রম্য।
এই পরিবেশে কী দারুণ হয় প্র্যাকটিশ করা ধম্মো।
তা নয়, লোকটা লাজ-ভয় ভুলে,
হেথা হোথা চেয়ে, জিপখানা খুলে,
কুকুরে যা করে তুলসীগাছেতে, করে দিল সেই কম্মো!

বলবেন না যে, এই দৃশ্য দেখেন নি! সবাই দেখেছেন, সব্বাই। আমি আজীবন ভেবে গেছি, এর হাত থেকে পরিত্রাণের পথ কী? এ তো এক ধরনের টেররিজ্‌ম্‌-ই, সামাজিক-মানসিক-আধ্যাত্মিক উগ্রপন্থা, তাই না? বিষে বিষে বিষক্ষয়ের সনাতন রীতি মনে পড়ে গেছিল, তাই কিছুদিন আগে আমি রাষ্ট্রপতি প্রণববাবুকে খোলা মনে এই রকম একটা খোলা চিঠি লিখেছিলাম –

চাকরি

ডেথ সেন্টেন্স দিয়ে কী হবে গো? কাসবটাকে না মারিয়া
রাস্তা-টাস্তা ক্লীন করানোর কাজে দাও না গো ছাড়িয়া!
হাতে টিপ আছে, আসবে তা কাজে
রাস্তা-গলিতে সকালে বা সাঁঝে
জিপ খুলে যারা ‘হিসু’ করে, ব্যাটা তাদেরকে দেবে ‘নাড়িয়া’!

আজমল কাসব আর নেই। বিপথগামী কাসব কা শব মাটির নিচে চলে গেছে। কিন্তু যারা আমার এই প্রচারের সঙ্গে একমত, আসুন তাঁরা একজোট হয়ে দেওয়ালগুলো হিসির হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করি! আরও তো ভোট আসবে!

আগের পদ্যটাতে কুকুরের উপমা টেনে আনলাম বলে সারমেয়প্রেমীরা নির্ঘাৎ গালমন্দ শুরু করবেন। সত্যি, কুকুরের মতো নির্ভেজাল জীব আর হয় না। কী মহামহিম প্রভুভক্তি! কী অসম্ভব বুদ্ধিমত্তা! ডারউইন যে কেন বাঁদরকে মানুষ বানালেন, কুকুরকে না করে!

ট্রেনিং দিলে কুকুর যে অনেক ব্যাপারে মানুষকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবে, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। ডগ-শো আজ সারা পৃথিবীতেই এক দুর্ধর্ষ এন্টারটেনমেন্ট। সেই ট্রেনিং-এর এক টুকরো ছবি দিয়েই শেষ করবো আজকের চারানা-আটানা-র পাতা।

ট্রেনিং

ইস্কুলে দিদিমণি, ও পাড়ার বেবি মিস
কুকুরকে করাচ্ছে টয়লেট প্র্যাকটিশ।
“দ্যাখ্‌, এইখানে বসে
এটা করে, ওটা ঘষে
বেরোবি। এ কী রে, ছিঃ! ফের মেঝেতেই, ইস্‌!”

2 কমেন্টস্: