কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

০৩ অলোকপর্ণা

নুনচে
অলোকপর্ণা



গগনের বউ চোখ খোলে না। ঝপঝপ আওয়াজ হচ্ছে বাগানে। গগন ঘর থেকে একটু আগেই কোদাল নিয়ে গেছে, মাটিতে ভারি ধাতুর আওয়াজে তা টের পেয়েছে গগনের বউ। বাইরে গাছের পাতা থেকে চুঁইয়ে পড়া বৃষ্টির প্রতিটা জলের ফোঁটার আওয়াজ গগনের অন্ধ বউ পায়। সে ভেবে নেয় ওগুলোই তার চোখের জল, ভেবে শান্ত হয়, দায় মুক্তি ঘটে তার।

গগনের এবারের বাচ্চাটাও বাঁচল না। মাটিতে চার ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে গগন থামে। বৃষ্টির ফোঁটা আর ঘাম মিশে গগনের জিভ লবণাক্ত স্বাদ পায়। ঘরের আলো বন্ধ, তবু বউ জেগেই আছে -- টের পাচ্ছে সে। শেষ বিকেলের আলোয় তার মৃত চোখভরা অভিমানের কাছে গগন হেরে গিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়েছে।

গগনের বউ তৃতীয়বার থেকে বাচ্চার নাম রাখা ছেড়ে দিল। মায়া বেড়ে যায় নামের সাথে সাথে। যার নামই নেই, মনে মনে তাকে কি নামে ভাবা যাবে আর! ‘ও’ সর্বনাম গগনের জন্য প্রযোজ্য হওয়ায় শিশুর সেটিও জুটবে না, -- গগনের বউয়ের দীর্ঘশ্বাস আসে, মন খুলে শ্বাস নিতে পারে না সে, আবার পাশ ফিরে শোয়। নাম নেই, অতএব স্মৃতি নেই -- এমন সিদ্ধান্তেও তার ঘুম আসে না।

কোদাল নামিয়ে গগন পায়ের পাশ থেকে নরম ভার তুলে নেয়। যতটা সম্ভব মায়া করে হাত থেকে কিছু ফেলা যায়, পালকের মতোই শিশুকে ছেড়ে দেয় সে। আলতো আওয়াজে অন্ধকার গহ্বর যেন লুফে নিল দেহটা। গগন ভাবল, সে আওয়াজ অন্ধ নারীর কান পর্যন্ত পৌছাল কি না! মনে মনে বৃষ্টিকে ধন্যবাদ দিল সে।

বাগান থেকে মাটি ফেলার আওয়াজ আসছে, গগনের বউ সেই আওয়াজের তালে তালে মনে মনে গুনগুন করে ফেলে, ‘আয় আয় আয়/ আয়রে ছেলের দল/ তোরা মাছ ধরতে নিয়ে যাবি...’। চমকে ওঠে গগনের বউ। দ্বিতীয়বারের পর থেকে সে এই ঘুমপাড়ানিও পরিত্যাগ করেছিল, আজ কী কারণে... চোখ খুলে ফেলে সে। তার এই অন্ধকারে কেউ নেই, কোনোদিনই থাকে না, তাহলে সে যে কেন চোখ খোলে, তাও বোঝে না গগন বা গগনের বউ। কোন্‌ শিশুর কান্না দেখার জন্য, কোন্‌ শিশুর দেয়ালা দেখার জন্য, কোন্‌ শিশুর গন্ধ দেখার জন্য গগনের বউ আজ রাতে চোখ খুলল, কেউ জানে না।

শেষ মাটিটা ফেলার আগে জামার বুক পকেট থেকে সিমবীজগুলো গগন ছুঁড়ে দেয়, তার ওপর মাটি চাপা দিয়ে বলে, “গাছ হ, তুই গাছ হয়ে থাক।” বৃষ্টির জলের সাথে কান্না মিশে এদিনের জন্য সদ্য যে স্মৃতিটা তৈরি হচ্ছে, তা লবণাক্ত শোক হয়ে থেকে যায় গগনের মনে, চিরকাল।

গগনের পায়ের আওয়াজ দেখতে পায় গগনের বউ, কোদালের ধাতব উপস্থিতি দেখতে পায়, গগনের ভেজা জামা ছাড়ার আওয়াজ দেখে, খাটে এসে শুয়ে পড়ার উষ্ণতা দেখে ধূসর -- নীল চোখে। গগনকে দেখার জন্য গগনের বউ তার বুকের ওপর মাথা রাখে, ঘামের গন্ধ ছাড়া তার বুকে কোনো আওয়াজ দেখে না গগনের বউ। নীলচে চোখে গগনের নিশ্চুপ বুকের দিকে সে অবাক হয়ে তাকায়। বাগানে গর্তের মধ্যে গগনের হৃৎপিণ্ডের শেষ টুকরোটা ধকধক করে ওঠে তখন, আর তার চোখে শুধুই একটা সিমগাছের ছায়া লেগে থাকে।


1 কমেন্টস্: