কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

০৬ তন্ময় বীর

হাইয়েস্ট পসিবল ব্রাঞ্চ অব পোয়েট্রি
তন্ময় বীর



‘হাইয়েস্ট পসিবল ব্রাঞ্চ অব ম্যাথেমাটিকস্‌ আমি বিনয় এখন অশ্বিনী তারায় বসে আছি’ তারপর স্বয়ং গণিতই উদ্বেলিত হয়ে বলে গেল - “আমি হাইয়েস্ট পসিবল ব্রাঞ্চ অব ম্যাথেমাটিকস্‌ বলছি, বিনয় মজুমদার, তুমি অশ্বিনী তারায়।” নক্ষত্রের সাথে বিনয়ের চেনা-শোনা তো একদিনের নয়, সেই কবে অত্রি শুনিয়েছিল কবিতার আঙ্গিক আর বিষয়ের অচিন্ত্যভেদাভেদ তত্ত্বের কথা গণিতের এককের উপমায়--

........................‘বিনয়, শোনো, যে-কোনো যন্ত্রের তত্ত্ব পরিবর্তনের
চেষ্টা যদি করো, যদি পরিবর্তিতই করো তবে সেই যন্ত্রটির অবয়বটিও
স্বঃতই সমমুহূর্তে নিজেই পরিবর্তিত হ’য়ে যায় যথোচিত রূপ পেতে পেতে।
ফের বিপরীতভাবে আকার পরিবর্তিত করো যদি তবে তাতে নিহিত তত্ত্বও
স্বঃতই তদনুরূপ হ’তে-হ’তে যেতে থাকে, কবিতার সঙ্গে তার ভাবের ব্যাপার,
এই একই চিরকাল এই একই সৃষ্টি আর সৃষ্টিধৃত ভাবটির সম্পর্ক ও যোগ।
ভাব আর অবয়ব – এ-দুটিকে কোনোক্রমে পৃথক, বিচ্ছিন্ন করা অসম্ভব ব’লে
ও-দুটি প্রকৃতপক্ষে দুই নামে এক বস্তু, কেবল অদৃশ্য ব’লে ভাবা হ’লে ভাব,
আর দৃশ্য ব’লে যদি ভাবো তবে অবয়ব এবং হয়তো এই প্রকৃত বস্তুটি
অবয়ব নয় কিংবা ভাবও নয় – অন্য-কিছু গণিতের এককের মতো অন্য কিছু।’
এই লাইন লেখার কিছু আগের অনুভব মনে করা যেতে পারে, যা তাঁর কাব্যচেতনার বিশেষণে পরিণত হয়েছে--
‘আমাদের জ্ঞানদণ্ডে এক প্রান্ত শুদ্ধতম গণিত নামক শাস্ত্র আর
অন্য প্রান্ত আমাদের সকলের পরিচিত কবিতা ও কাব্য – কাব্যগুলি।
এ এক নিয়মমাত্র, গণিত যেধারে থাকে আসলে বিশ্বের সব রস–
বিশ্বের সকল রস জড়ো হ’য়ে এসে জমা হ’য়ে থাকে রসের আকারে।
অন্য ধার যেই ধারে কবিতা হয়েছে তার মুখ দিয়ে এই রস পড়ে,
...
খুব ভালো ক’রে যদি এমন মিলিয়ে দিই, দিতে পারি যাতে
মনে হয় মোহনাই, মোহনার বর্ণনাই আসলে সে গণিত কবিতা--
গণিতের কবিতার হুবহু বর্ণনামাত্র,...’

মেলাতে কী পারলেন! একদিন সব নক্ষত্রপরিত্যক্ত হয়ে বিরতিচিহ্নহীন উচ্চারণ করলেন নক্ষত্রবাণী--

‘কবিতা লিখলেই মানুষ, গণিত আবিষ্কার করলেই বিশ্বের মালিক’
একই জ্ঞানদণ্ডে গণিত-কবিতার পারস্পরিক সহবস্থানের বিষয়টি বিষময় হয়ে উঠল। যেভাবে তাঁরই সমসময়ের আর একজনের অভিজ্ঞতা হয়েছিল--
‘...কবিতা এসে আমার মাথা থেকে তাড়িয়ে দেয় অঙ্ককে। তার ফলে আমাকে অনেক ক্ষতি সহ্য করতে হয়েছে। কবিতার সঙ্গে অঙ্কের সম্পর্ক যেন সপত্নীবৎ।’
বিনয়ের দাবি ‘এই খানাই আমার একমাত্র গদ্য-কবিতার বই।’ এবং পাঠকের সমীপে তাঁর নিবেদন-- ‘লক্ষ্য করবেন তো এই বইয়ের কোনও কবিতা সারাজীবন মনে থাকে কিনা।’ মনে রবে কিনা রবে এই দ্বন্দ্ব নিয়ে দু’শটি কবিতা সমন্বিত ‘এক পঙ্‌ক্তির কবিতা’-র প্রথম কবিতা ‘কবিতা লিখলেই মানুষ, গণিত আবিষ্কার করলেই বিশ্বের মালিক’ পড়ার পর যদি পাঠক একদিকে রচয়িতার চেতনার বৃহত্তর অংশের সঙ্গে উপরোক্ত ভাবনাবিন্যাসে জড়িয়ে পড়েন এবং অন্যদিকে একটি নির্মম সত্যের সহজ গোলায় বিধ্বস্থ হন, তাহলে চট্‌ করে ভোলার উপায় থাকে না সে উচ্চারণ।

যদিও বলেছি নক্ষত্রবাণী, কারুর দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে, এরকমটাই লিখতে ইচ্ছে হলো। কারণ, কী সংজ্ঞা দেব এই কবিতাগুলির! কবিতা কণিকা, নীতিকণিকা, অণু কবিতা, ম্যাক্সিম? নীতির প্রসঙ্গটি অস্বীকার করাই যায়। ম্যাক্সিম বা প্রবচনের মাত্রা ছুঁয়ে যাচ্ছে কোনও কোনও উচ্চারণ, যেমন ধরা যাক এই লাইনটি —

‘পৃথিবীর সম্রাটের ভয় ভিক্ষা করতে যেন না হয়’

বা, ‘খেজুরগাছে কাঁটা খেজুরগাছেরই সবচেয়ে বেশি কষ্ট’

বা, ‘মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরলে তবে অমর হওয়া যায় — যেমন এভারেস্টে ওঠা’

কিম্বা, ‘মাটি থেকে ফল এইটুকু তো দূরত্ব, কিন্তু কত তফাৎ’
উপরের উদ্ধৃতিগুলিতে তবুও যে যৎসামান্য নীতিদর্শন আছে, নিচেরটিতে তার বিন্দু বিসর্গও নেই, নিবিড় প্রকৃতিপাঠ —
‘যা ঘটে তাই স্বাভাবিক’
কিন্তু তার পাশে যখন দাঁড়িয়ে থাকে —
“আমার দালানে লেখা ‘শান্তিনিকেতন’, শান্তিনিকেতনে আছে বিনয় ভবন”
সামান্য ধর্মের অত্যন্ত সুকৌশলী মেধাবী বিন্যাসের দীপ্তি ঝক্‌মকিয়ে ওঠে। আবার
‘আম ও আমগাছ — আমাদেরই অংশ’
এখানে অনুপ্রাসের নিতান্ত স্বাভাবিক নিরীহ শয়ানে যে প্রকৃতিবিজ্ঞান, তা চোখ এড়িয়ে যাবার নয়। আত্মভোলা স্বভাবোক্তির মোড়কে প্রবঞ্চিত হতেও পারেন তবু কেউ। সে পথ কেটে রাখা আছে এই পঙ্‌ক্তিমালার কোথাও কোথাও, যেমন ধরা যাক্‌ নিম্নোক্ত কয়েকটি পঙ্‌ক্তি —
৭৪.
চীন দেশে চিনি আবিষ্কার হয়েছিল

৭৫.
গাছের পাতা সবুজ সাধারণত

৭৬.
রোদ কিছুতে পড়লে দেখা যায়

৭৭.
নারকেল গাছের নিচে পথ থাকে

৭৮.
দূর্বা ঘাসে ফল হয় না

৭৯.
দূর্বা ঘাসে ফুল হয় না

৮০.
বৃষ্টির জল অধিকাংশ মাটির নিচে যায়

৮১.
গাঁদা ফুল নানা রকমের

৮২.
অনেক গোলাপকে গোলাপ বলে চেনা কষ্ট

৮৩.
শিউলি ফুল সব এক রকমের
সহজ প্রকৃতিপাঠের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে খেয়ালই থাকে না, জ্যোতির্ময় স্ফুলিঙ্গ কখন উড়াল দিয়েছে। ৮২ সংখ্যক পঙ্‌ক্তিতে অত্যন্ত নিরীহ সেই ঈশ্বর শুয়ে আছেন। মনে করুন রবীন্দ্র উচ্চারণ, যে জন্তুকে জন্তু বলে চেনা যায় না, সেই জন্তুই ভয়ঙ্কর। এখানে বিনয়োক্তি বহুমাত্রিক বিন্যাসে দ্যুতিময়।

হ্যাঁ, স্ফুলিঙ্গ, এই বিশেষণটি ভাবা যেতে পারে। কবিতাগুলিকে নক্ষত্রবাণী বলার পশ্চাতে যে স্বতোঃদীপ্ত প্রাকৃতিক পটভূমিটি ভেতরে সক্রিয় ছিল, সেরকমই রবীন্দ্রনির্দেশিত শব্দটিও মনে আসতে পারে, কিন্তু উড়ে গিয়ে ফুরিয়ে যাবার বহিরাবরণীয় ক্ষীণায়ুর প্রসঙ্গটি ঠিক মনে ধরে না। অগত্যা ফিরে যেতেই হয় স্বয়ং রচয়িতার কাছে। বলতে ইচ্ছা করে কবিতাগুলি প্রকৃতই ‘জ্যোতির্ময়’। ১৬০ সংখ্যক পঙ্‌ক্তিতে লেখা হচ্ছে —

‘জোনাকি পোকাই প্রকৃত জ্যোতির্ময়’
আত্ম-আলোকে ভাস্বর এই কবিতাগুলির প্রেরণা জাপানি হাইকু হলেও, অসীম সাহসিকতায় এদের নিজস্ব সম্বলে পথ চলা সমীহযোগ্য। ধাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসতে যাঁরা সততই স্পন্দিত, তাঁরা এই বইটি অবশ্যই পাশে রাখতে পারেন। আরও কয়েকটা জ্যোতির্ময় খদ্যোৎ হাতের তালুতে রাখা যাক এবার—
১০১.
সৎ কথাটার মানে যে বেঁচে আছে

১০২.
অসৎ কথাটার মানে যে বেঁচে নেই

১৫৬.
এক নামে একাধিক নদী আছে

১১৬.
আমরা ফুলের গন্ধকে মধুর বলি

৮৫.
কাঁটা বরং খেজুরের চারাতেই থাকা উচিত ছিল

৮৬.
কোনো গাছের চারাতেই কাঁটা থাকে না

৮৭.
ফল পাকলে কখনোই নীল হয় না

৮৮.
সব ফল পাকলে মাটিতে ঝরে পড়ে
পাকা ফল-এর মাটির দিকে ফিরে আসা যেমন শাশ্বত, তেমনি একজন আনতশির কবিতামগ্ন যে হসপিটালে বসে কবিতা লিখবেন, তাতে আর আশ্চর্য কী! কেননা এতো এই এরকমই চিরন্তন--
১৯.
পেঁপে গাছে তক্তা হয় না

২০.
সব মাছই জলে থাকে

২১.
সব গরুই ডাঙায় থাকে

২২.
হাঁস জলে ভাসে

২৩.
মানুষ জলে ডুবে যায় কিন্তু হাত-পা নেড়ে ভাসে

২৪.
কলমীলতা জলে ভাসে, ডোবে না

কাব্যটির রচনার স্থানকাল মেডিকেল কলেজ হসপিটাল, এজরা ওয়ার্ড; ডিসেম্বর ১৯৮৭।



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন