কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর, ২০১৩

০১ অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা
অমিতাভ প্রামাণিক


(৪) পুজো


অক্টোবরের মাঝামাঝি এই সংখ্যার চারানা আটানার বিষয়বস্তু আর কী হতে পারে, পুজো ছাড়া? কেসটা হচ্ছে, এটা যখন লেখা হচ্ছে, তখনও পুজো শুরু হয়নি। আর আপনারা যখন পড়ছেন, তখন পুজো খতম। মাঝখানে কী যে হলো, মা-ই জানেন!

পুজো আসছে মানেই পুজো সংখ্যা এসে গেছে। আগে মাত্র কয়েকটা পত্রিকারই পুজো সংখ্যা বের করার সামর্থ ছিল। এখন রাম-শ্যাম-যদু-মধু সবাই পুজো সংখ্যা বের করছে। যে কাগজ না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হয়, যে কাগজ ভগবান ছাড়া কাউকে ভয় পায় না, যে কাগজ পড়ুন ও পড়ান বলে দেওয়ালে দেওয়ালে চেটানো থাকে (আচ্ছা, ঐ কাগজটা দু’পিঠে কেন ছাপানো হয়, এক সাইড ব্ল্যাঙ্ক রাখলেই তো পারে, যদি দেওয়ালে আঠা দিয়ে সাঁটানোই তার মুখ্য ব্যবহার হয়) – সবার পুজো সংখ্যা রমরমিয়ে বেরোয়। সেখানে সার্ত্র, দস্তয়ভস্কি, গুয়েভারা – এই সব গালভরা নামের ব্যক্তিত্বদের নিয়ে গূঢ় আলোচনা হয়। কেননা, তাঁরা যা যা বলে গেছেন, সেসব না মানলে বাংলা ভাষা জাতে উঠবে না। দাদু সেই কবে দেহ রেখেছেন, এখন সেই ঘি থেকে নাকি আর সুবাস বেরোয় না। তবে যাবার আগে ভাগ্যিস লিখে গেছেন – ‘তোমার শঙ্খ ধূলায় পড়ে, কেমন করে সইব’ অথবা ‘প্রভু বুদ্ধ লাগি আমি ভিক্ষা মাগি’। তাই দাদুকে ছেড়ে শঙ্খ ঘোষ আর বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে আলোচনা হলে সেটা কিঞ্চিৎ মডার্ণ বলে গণ্য করা হয়। আর তার সাথে, ইয়েস, কার পেছনে কাঠি করতে হবে, এই নিয়ে প্রবল আঁতলামোও। জাত বাঙালির ধর্ম এটাই। তাই দেখা যায়--

পাতায় পাতায় চর্চা হচ্ছে শঙ্খ ঘোষ আর বুদ্ধ বসুর।
দুদিন পরেই মা আসবে, তার সঙ্গে আসবে ক্রুদ্ধ অসুর।
কবিতা রয়েছে, শিল্পকলাও, কত গুণ আছে এ মৃত্তিকার।
তবুও বাতাসে হানাহানি, বলো রক্ত ঝরাতে প্রবৃত্তি কার?

তবে কিনা, শরৎ তো এসে গেছে বহুদিন। শরৎচন্দ্র পণ্ডিত আর শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ও এসে চলে গেছেন কম দিন হলো না। এঁরা অবশ্য শরৎ নিয়ে তত আদিখ্যেতা দেখাননি, যতটা দেখিয়েছিলেন দ্য গ্রেট দাদু। শরৎকে নিয়ে কত নির্ভেজাল গান! বোটে বসে বসে প্রকৃতি দেখতেন আর গান বেরিয়ে আসত। উনি কি আর জানতেন, তখনকার শিলাইদহে পুজোর সময় সোনালি রোদ, পেঁজা তুলোর মেঘের বদলে আজকের শিয়ালদহে আকাশ ছেয়ে থাকবে বাদলায়? আর জনগণ হাঁসফাস করবে গরমে, মরে যাবে মরমে, তাদের দশা চরমে উঠে হবে এই রকম –

‎'অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ-মধুর হাওয়া...'
কচি পাঁঠা হয়ে ঝুলে আছি তারে
কেটে রেঁধে সারো খাওয়া!

আমাদের দশা কি এর চেয়ে খুব আলাদা? দাদু রোমান্টিক হয়ে শারদ সকালের গান লিখে গেছেন, আর আমরা সকালে উঠে কী ভাবি?

"শারদপ্রাতে আমার রাত পোহালো ..."
খিদে পেয়ে গেছে, ব্রেকফাস্ট দে, নিয়ে আয় পোহা, লো।
বাড়ি ঘর দোর নোংরা, যেন ঘর না, গোয়াল ও!

এ রকম চ্যাটাং চ্যাটাং চালাতে থাকলে দাদুর চ্যালারা চ্যালাকাঠ দিয়ে আমার মাথায় মারবে। তাই একটু বিরতি দিই। আশা করা যাক, বৃষ্টিটা ধরে আসবে আর দূরের মাঠের বা নদীর তীরের কাশবন থেকে ছুটে আসবে পুজোর গন্ধ, সকালের বাতাসে মিশে থাকবে শিউলির সুবাস।

কাল বৃষ্টিতে ভিজেছি, আজকে শুকনো বাতাসে ছন্দ –
ঢাকে কাঠি প'লো? কাশবন থেকে এলো শিউলির গন্ধ?
আসতেই হবে। সব্বাই তাই দরজা রেখো না বন্ধ,
মা আসছে, তার সাথে আলো-হাসি সুখ-শান্তি-আনন্দ!

শরৎ এলেই পুজো চলে আসে, আর অবশ্যম্ভাবী তার আগে এসে যায় মহালয়া। খুব ভদ্র-সভ্য একটা অনুষ্ঠান হয় সেদিন ভোরবেলা রেডিওতে, তার পুরো ক্রেডিটটা চলে যায় ভদ্রবাবুর ঝোলায়। স্ক্রিপ্টটা যে লিখেছিলেন বাণীকুমার বলে এক ভদ্রলোক, আর গানের সুর দিয়েছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক নামে আর এক ভদ্রজন, তা অনেকে খেয়াল করেন না। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের ভাষ্যে মধুকৈটভ নামের দুই অসুরের সৃষ্টির বর্ণনা নিশ্চয় ভুলে যাননি। অবশ্য আজকের দিনে সেটা একটু অন্যরকম –

বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের দৌলতে অবিরাম বর্ষণে কলকাতার রাস্তাঘাট যখন কারণসলিলে পরিণত হলো, তখন নগরীর রাজপথের ওপর নতুন প্রযুক্তিতে তৈরি হাওয়া-ফুলানো এক ভাসমান আরামনৌকা পেতে বিপিনবাবু সকালের কাগজ খুলে বসলেন। তাঁর এ টি এমের পিন হারিয়ে গেছে, তাই তিনি বি-পিন। বিপন্নমুখে নিউজপেপার খুলেই তিনি দেখলেন পাপের শাস্তির মতো প্রথম পাতায় খবর 'অবিরাম বর্ষণে নগরী বেহাল'। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়লো তাঁর। যাক বাবা, বহুদিন পরে 'ধ'-টা 'ব' হয়েছে!

তবে বীরেনবাবুর ঐ উদাত্ত চণ্ডীপাঠের কোনো তুলনা হয় না। ইয়া দেবী সর্বভূতেষু সিরিজ শুরু হয়ে গেলে আমাদের গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। মা তখন কখনো শক্তি, কখনো ভক্তি, কখনো দয়া, কখনো মায়া, এই সব বিভিন্ন রূপ নিয়ে হাজির হচ্ছেন। মা-র দশ হাতে দশটা অস্ত্র, একটাও তুলি নেই, পায়েও নেই মুগুর ছাপ অজন্তা হাওয়াই চপ্পল। তখন বলতে ইচ্ছে করে –

সব পুড়ে যাক, যত জঞ্জাল, যেন পশু না জ্বালায় চিতা –
এই দেবী... সর্বভূতে... শক্তিরূপে... সংস্থিতা।
আজ ঘুচে যাক যত দৈন্য, যত কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ –
নমি তোমাকে, নমি তোমাকে, নমি তোমাকে, নমো, নমোহ।

দেখতে দেখতে মা এসে যায়। একা না, সঙ্গে দু’ছেলে দু’মেয়ে। ভুঁড়ি বাগিয়ে আসে গণেশ, আর ভাই রমণীমোহন কার্তিক। এদের দাপটে লক্ষ্মী-সরস্বতী কেঁদে কূল পায় না, তাই তারা রেগেমেগে বলে, আমরা আলাদা করে এসে পেসাদ খেয়ে যাব। প্যাঁচা- ইঁদুর জাতীয় নক্টারন্যাল এনিম্যালদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে নগরীর প্যান্ডেলে রাত জেগে ভিড় করে যাবতীয় যুবক-যুবতী। তারা মুখে বলে, রথ দেখতে যাচ্ছি, আসল উদ্দেশ্য কলা বেচা। শরৎ এলে মন উড়ু উড়ু হয়, গরমে ভিড়ে পুজোপ্যান্ডেলে এমনি এমনি কি কেউ ঢোকে, একটু চারানা আটানা না হলে? মূর্তি একচালা হোক বা আলাদা আলাদা, কতজন যে তা খেয়াল করে কে জানে। করলে দেখতে পেত –

দুগ্‌গা মায়ের সঙ্গে এলো সিঙ্গিটা আর অসুর –
দেখতে যেন শ্যামবাজারের নগেনবাবুর শ্বশুর।
এক সাইডে সরস্বতী, তার পাশেতে কেতো –
যাত্রাদলে নায়ক হলে দু’দশ টাকা পেতো।
অন্যদিকে লক্ষ্মীরাণীর পায়ের নিচে প্যাঁচা –
ড্যাবড্যাবিয়ে রথ দ্যাখে, তার সঙ্গে কলা বেচা।
তার পাশে শ্রীগণশা বসে, সঙ্গে মিনি মাউস,
সিক্সপ্যাক তার কভার করে চর্বিপাহাড় ঢাউস।
তার পাশে কে, গামছা-ঢাকা ঘোমটায় একগলা?
আজও তেমনি লাজুক আছো, হায়, শ্রীমতী ‘কলা’!

দেবীর এজেন্ট মানে পুরোহিত এসে পুজো শুরু করেন। মন্ত্রে দেবীর বোধন হয়, টলিউডের বা টিভি সিরিয়ালের বগলকাটা ড্রেস-পরা কোনো এক দেবীর কাঁচিতে পুজোর উদ্বোধন হয়। মন্ত্রপাঠ হতে থাকে, ঢাকে কাঠি পড়ে, কালিপটকা, দোদমা আর উড়ন্ত হাউইয়ের আওয়াজের মাঝে কেউ খেয়াল করে না একচালার প্রতিমায় অসুর আর গণেশের মধ্যে ইন্টারেস্টিং কথাবার্তা হচ্ছে। মহিষাসুর গণেশকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে কিছু বলছে, আর গণেশ তার উত্তর দিচ্ছে বলিউডি ভাষায়।

মহিষাসুর –
আমার গলা ভেজাই আধেক রাতে
তোমার শুঁড়ে শুঁড়ে, শুঁড় মেলাতে
আমার গলা ভেজাই...

গণেশ –
শালে কুত্তে কামিনে মোষ, খামোশ!

ষষ্ঠী গড়িয়ে সপ্তমীতে পড়ে, তারপরে অষ্টমী। সন্ধিপুজো, নবমী, ব্যাস, যায় যায় রব উঠে যায়। বিসর্জনের বাজনা বাজতে আরম্ভ হলেই লোকজনের মুখ ভার। পরদিন এয়োস্ত্রীরা সিঁদুর ফিদুর মেখে শারদীয় হোলিখেলা খেলে নেয়। মাল ফাল টেনে পাড়ার দাদারা লরি নিয়ে ঠাকুর ভাসান দিতে যায়। রাস্তায় লরি দাঁড় করিয়ে লুঙ্গিডান্স। ট্রাফিক পুলিশ হাঁ করে দেখে যায়, কিছু বলার নেই, সিগন্যালে অবশ্য দাদুর গান বাজছে, সেটা বন্ধ করে দিলে দিদি খচে যাবে।

পুজোর মধ্যে উন্নাসিক কিছু আছে, যারা বাংলার বাইরে বেড়াতে চলে যায়। আর এক দল আছে, যারা ভিড়ে যেতে আগ্রহী নয়, তারা টিভিতে পুজো দেখে। ইয়েট অ্যানাদার আঁতেলগোষ্ঠী এখন অনলাইন পুজোতে মেতেছে। ইউটিউব-ফেসবুক। নিউইয়র্কের পুজো কলকাতার আগেই হয়ে যায়, ওরা সব ব্যাপারেই অনেক অ্যাড্‌ভান্স্‌ড্‌ কিনা! তখন বলতে হয় –

পুজো তো এখন পরীক্ষা, কেউ পড়ে পাশ, কেউ টুকে –
এতদিন ছিলো টিভি-পুজো, আর এ বছর ফেসবুকে।
দরকার নেই ভিড়ে হুড়োহুড়ি, ঘেমো বগলেতে সেন্ট
ফেসবুকে জানা যাবে কাকে দিলো প্রাইজ এশিয়ান পেন্ট।
বাইরে বৃষ্টি, শাড়ি কাদামাখা, নেটের পুজোতে বাড়তি
সেভ হবে কিছু ই-পুজোতে, দেবী হরে সর্বেস্যার্তি।
পাপ-ভাণ্ডার ফুলে ফেঁপে গেছে, শুনে গসিপ আর কেচ্ছা -
পুজো শেষ হলে ফেসবুকে দিও বিজয়া প্রীতি-শুভেচ্ছা।

এই অধমের পক্ষ থেকেও আপনাদের সবার জন্যে বিজয়ার প্রীতি ও শুভেচ্ছা রইল। এই লেখা যখন আপলোড হবে, তখন অনেক প্রতিমারই বিসর্জন হয়ে গেছে। আর আমি মনশ্চক্ষে দেখছি –

গাঙের জলে ভাসছে আমার চিৎ-হওয়া মা –
উল্লাসে তাও নাচছে মানুষ, গায়ে তাদের নতুন জামা!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন