কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৩ অক্টোবর, ২০১৩

০৮ অজিত দাশ

সুখদর্শন
অজিত দাশ



(১)

সে বসেছিল পুরনো ঘাটটায়। দিঘির পূর্ব দিকে। রাস্তার পার ঘেষে কোনো গাছপালা নেই। সন্ধ্যার আলোয় বাতি জ্বলে উঠছে একেকটি ছোট ছোট সংসারে। এখানকার রাস্তাঘাট এমনকি ঘাটটার কোণা কোণা মুখস্ত হয়ে গিয়েছিলো তার। জলের উদ্দেশ্যে কতদিন কত কথা বলেছে সে। দুই পা ডুবিয়ে কী রকম অদ্ভুত সুখে আওড়ালো, ‘এই যে স্বচ্ছ তুমি প্রাণহীন, আড়াল করে রেখেছো কিছু জীবনের ছবি, তোমাকে মানিয়েছে। জীবনের ক্লান্ত মায়া ছেড়ে একদিন পালাতে হয়। এই অপূর্ব দৃশ্যে মুগ্ধ আমি।’ তারপর অনেক কিছু ভাবার চেষ্টা করে। কিন্তু অত সব জটিলতার মধ্যে যেতে চায় না সুবিমল। অনেক নীরবতার শেষে কিছু একটা ভাবার চেষ্টা করে, আবারও ফিরেও আসে। আজ একেবারে ফাঁকা, শূন্য মাথায় কিছুতেই পার পেয়ে উঠতে না পেরে মাথায় ঝিম ধরে আসে। ঘুরে ফিরে পরমার কথা মনে পড়ে। শৈশবের এক চিলতে উঠোনে পরমার গা ছুঁতে না পেরে সে কী রাগ! এলোপাথাড়ি ভাবনায় বাড়ির কথা ভুলে যায় সে।

মণীষা চলে যাবে। এক ঝাপটায় চার বছরের সংসার যাত্রার সব টুকিটাকি সুবিমলের চোখ এলোমেলো করে দেয়। মানুষের অন্তরঙ্গ বিষাদ থেকে যে অভিমান উঠে আসে, তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে দিনরাত। ভেতরে ভেতরে মণীষার কাছ থেকে বিদায়ের পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করে নিচ্ছিলো সে। যে শিকড় উপড়ে ফেললে পুরুষের শুদ্ধতা ম্লান হয়ে আসে, তার জমকালো আয়োজনেও ক্লান্ত হয়ে ওঠে। অথচ শারীরিক ও মানসিক এই দুই দিক থেকে এত পরিচ্ছন্ন বিদায় নেবে, তা আগে ভেবে উঠতে পারেনি।



(২)

মাঝের ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সুবিমল। মণীষা বিছানায়। কিছুতেই কিছু বুঝে উঠতে না পেরে একটু একটু করে বিছানার দিকে পা বাড়ায় সে। পুজোর ঘর থেকে ভেসে আসা ধূপ চন্দনের চেয়ে মণীষার গায়ের গন্ধ তার কাছে অনেক পবিত্র মনে হয়। বিছানায় বসে সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশুর মতো মণীষার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। আলগোছে পায়ের পাতায় চুমো খেয়ে বলে, ‘তুমি চলে গেলে বাড়িটা বেচে দেব। এত বড় বাড়ি দিয়ে কী হবে আমার! আমি একলা মানুষ!’ মণীষা চুপ করে থাকে। কোনো উত্তর না পেয়ে নিজেকে পাথরের চেয়ে ভারি মনে করে সুবিমলের। মাঝের ঘর ছেড়ে বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে থাকে। ভেতরের গুমোট অভিমান থেকে গান ভেসে আসে -- ‘ওগো ভোলা ভালো তবে কাঁদিয়া কী হবে মিছে আর / যদি যেতে হলো হায় প্রাণ কেন চায় পিছে আর।’



(৩)

বিকেলে উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকে মণীষা। পরিপাটি সাজগোছে ঠোঁটের এক কোণে অভিমানের স্পষ্ট চিহ্ন বোঝা যায়। বাড়ির চারপাশে লাগানো গাছগাছালির দিকে দ্রুত গতিতে এমনভাবে তাকিয়ে নিচ্ছিল, যেন আজন্মের ছবি তুলে রাখবে তার স্মৃতির ভিতর। হঠাৎ বাগানের শ্যাওলা মাখানো ইঁটের পাশে লাগানো গাছটির দিকে নজর পড়ে তার। কতগুলো কলির মাঝখানে ধবধবে একটি সাদাফুল। অনেক চেষ্টা করে ফুলের নাম মনে করে, ‘সুখদর্শন’। তারপর বিড়বিড়িয়ে নিজের ভিতরে বলতে থাকে, ‘মানুষের টিকে থাকাটাই সব। টিকে থাকতে পারলেই হলো। ভালোবাসা আর ঘৃণার দিব্যি অভিনয় করে বাঁচা যায়।।’ একটা নিস্তেজ হয়ে যাওয়া মায়ার কথা ভেবে নিজেকে কেমন একা ভাবে সে। ভাবতে ভাবতে দাঁড়িয়ে থাকে। আর কিছুক্ষণ মাত্র, তারপর কোনো একটা গতি হবে!

ঘরের দরজায় তালা দিয়ে মণীষার পেছনে এসে দাঁড়ায় সুবিমল। নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকে। অপ্রতিম মুগ্ধতার নেশা ধরে যায় তার চোখে। হঠাৎ নীরবতা ভঙ্গ করে পেছনের দিকে তাকায় মণীষা। সুবিমল আঁতকে উঠে। কী রকম একটা বজ্রপাতের শব্দ শুনে ভেতরে ভেতরে। নিজেকে নিছক দর্শক মনে হয় তার। হাঁটতে হাঁটতে মৃদু স্বরে সুবিমল বলে -- ‘তোমার লাল-কালো শাড়িটা রেখে দিয়েছি। একেবারে ঘর খালি হলে লক্ষী নারাজ হবেন।’ মণীষা মাথা নাড়িয়ে সন্মতি জানায়। দরজা খুলে রাস্তার একপাশে এসে দাঁড়ায় দুজন। রিক্সা ঠিক করে ওঠে পড়ে। প্রচন্ড গরমে বিরক্তির ভাব ভুলে যায় সুবিমল। ঝাপসা অন্ধকারে সমগ্র চৌধুরি পাড়া ফাঁকা লাগে তার কাছে। এক মুহূর্তে দূরত্বের একটা গোপন মূল্য গেঁথে যায় তার মনে। ভেতরে ভেতরে নামতা পড়ার মতো বার বার প্রতিধ্বনিত হতে থাকে, ‘মাত্র আধাঘন্টা লাগবে ঠাকুড়পাড়া যেতে। কী আশ্চর্য! মানুষকে দু’ভাবে বিদায় দিতে হয়, জীবিত অথবা মৃত।’ সে নিশ্চিত হতে পারে না, কোন্‌টা বেশি দুঃখের। মুখ ফুটে মণীষাকে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে আবার থেমে যায়। আচমকা মণীষার হাত চেপে ধরে সুবিমল। ভাঙা গলায় মিনিমিনিয়ে বলে -- ‘মাঝে মাঝে তোমাকে দেখতে আসবো। ইচ্ছে না হলেও একটু দেখা দিও, কেমন!’



(৪)

জলপাই রঙ্গের গেট পার হয়ে হাঁটতে শুরু করে সুবিমল। চারপাশে করতালের আওয়াজ হতে থাকে। বটতলার পাশ দিয়ে যেতে মন্দিরের কীর্তন সুর বিচ্ছিরি লাগে তার কাছে। দ্রুত গতিতে অন্ধকার ঠেলে রাস্তার আলোর দিকে ছুটে আসে । চারপাশে তাকায়। আজ তার কোনো তাড়া নেই বাড়ি ফেরবার। মানুষের ভীড়ে মিশে গিয়ে মনে মনে বলে, ‘হে অনন্ত আমি তোমার গোপন ফাঁদে পা দিয়েছি। আমাকে দীক্ষা দাও। আমাকে শুদ্ধ কর তোমার সমস্ত বেদনার রঙ দিয়ে।’




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন