কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

০৭ প্রশান্ত গুহমজুমদার

সূর্যাস্তের পরে
প্রশান্ত গুহমজুমদার



--তোমার জন্যই এত সব।

এইরূপ বলিয়া সে সামান্য ভাবে। ভাবিতে থাকে। ঠিক হইল! কতখানি? শতাংশ ধরিয়া সে হিসাব করে না। ইহাতে কিছু গোল হয়। অতীতের বিনিময়ে সে ভাবিতে সচেষ্ট হইল। দেখিল, জবরদস্ত ভুল হইয়া গিয়াছে গোড়ায়। বস্তুত কাহারও জন্যই সে কোনো কালে কিছু করে নাই। কেবল সূর্যাস্তের বহু পরে নিভৃতে অংক করিয়া দেখিয়াছে, নিজের কতখানি হইল। সুতরাং তাহার ভুল হইয়াছে। এক্ষনে, এই সামান্য প্রাণের সম্মুখে, বিনীত স্বরে বলিল,

--আমাদের জন্যই তো এই সব।

ও সন্তুষ্ট হইল কি না, প্রকাশ পাইল না। তবে বসিল। নিতান্ত নিকটে। তাহার সামান্য লেজখানি ঈষৎ নড়িল।

একে একে সে বাহির করিল। একখানি স্টিলের বাটি, চামচ, নরম টাওয়েল উজ্জল লাল, ১৫০ মিলি-র মাল্টিভিটামিনের শিশি, দুই বাই তিন রেডিমেড তোষক এক খানি, কিছু শীত আছে তাই সস্তার ভুটানি চাদর, লোকাল বিস্কুটের প্যাকেট এবং দুধের প্যাকেট।

শাবকটি উঠিয়া বসিল। আজ সকালে ও আসিয়াছে। পুত্র তাহাকে আনিয়াছে। কেন আনিল? তাহার একা লাগিবে, তাই। কথাটা ভাবিয়া কেমন এক হাসির ভঙ্গি ঠোঁটে আসিল। একা লাগিলে কী হয়? মৃত্যুভাবনা হয়? মৃত্যু কি খুব খারাপ কিছু! মৃত্যু আছে বলিয়াই না সে এখনো টিকিয়া আছে। নতুবা কবেই সে ধাঁ। হাতঘড়ি খুলিয়া রাখিল বেডসাইড টেবিলে। জামা বিছানায়। প্যাকেটটি খুলিল। বিস্কুটের। ও এইবার কিছু নিকটে আসিল। লিক্‌লিকে। কত আর বয়স! পুত্র বলিয়া গেল, তিন মাস। নাকি ভালো ব্রিড। ভা্লো হইলেই ভালো। অন্তত হিসাবমতো বছর দশ এগারো টিকিলেই চলিবে। যেহেতু তাহারও অতখানি, এইরূপ ভাবিতে তাহার স্বস্তি বোধ হয়। যেহেতু সে কিঞ্চিৎ আকাশ দেখিয়াছে। এ কারণে ইতিমধ্যে জানিয়াছে, প্রভাত সকল কথা ঠিকঠাক বলে না। যেহেতু তাহার নিজের শুরু অতীব ঈর্ষণীয় হইয়াছিল।

ইতিমধ্যে শাবকটি নিকটে। মনে হইল, তিন কাল। আকাঙ্ক্ষা, আনন্দ, বিষাদ। অতঃপর তাহার আঙুলে মুখ। খাদ্য আছে, তাই। মুঠো খুলিয়া ধরিল। প্রথমে বিস্কিট, অতঃপর দুইটি আঙুল। উষ্ণ, সামান্য খড়খড়ে। মিঠুর জিহ্বা, মনে পড়িল, এইরূপ ছিল। সামান্য নীলচে, খড়খড়ে। তাহার বড় আরাম হইত। এইরূপে অন্তত দুই বছর। শেষবার, মনে আছে, মিঠু সামান্য কান্নাকাটি এবং উচ্চন্ড আদর। ইত্যাদির পরে সে বিদেশী কম্বলের নিচে মিঠুর প্যান্টি আবিষ্কার করিয়াছিল। অদ্যাবধি উহা তাহার কাছে।

ওর মাথায় সে হাত রাখিল। কতদিন সে বিদেশ যায় নাই। ওই জীবন তাহার বড় পরিচিত। একবার সে রিও-ডি-জেনেরিও যাইবে। আপাতত ইহার নাম রিও সাব্যস্ত হোক। রিও দি ইয়েলো। আরো দুইখানি বিস্কিট আর এক চামচ মাল্টিভিটামিনসহ এক গ্লাস দুধ অতএব রিও-র প্রাপ্য হইল। ও আনন্দ পাইয়াছে। সে-ও।

আনন্দর সহিত তাহার কদাচিৎ দেখা হয়। শেষ শরত অথবা শীতে। সেকালে সে জুতাজামা পরে। নিয়মিত কথা বলে। পরিবার এবং পুত্রের কুশল, এমন কি নিজের হাতদুইটি বিষয়ে প্রচুর যত্নবান হয়। লেটুসপাতা, কমলালেবু, মাংস গ্রহণ করে। এই জঙ্গলে কদাপি হরিণ সন্ধান করে না। তাহার নিজস্বটি শিয়ালে খাইয়াছিল। হরিণটির চোখ দুইটি ছিল বড় মায়াময়, মনে আছে। তখন আনন্দর সহিত সে রাত্রি যাপন করিত। প্রকাশ্যেই।

নতুবা অপ্রকাশ্য থাকিতে পছন্দ করে। প্রচুর মায়া, তাই। সে ভয় পায়।

এখনো সে। অথচ রিও এক বছর হইল নাই। কতদিন আর অপছন্দের ঘরে কালাতিপাত সম্ভব! রিও শেষ কয় মাস আহার ত্যাগ করিয়াছিল। শেষ প্রভাতে তাহার সহিত সামান্য আলাপ করিল। কোলে বসিল খানিক। তখন বোঝে নাই, উহা ছিল যেন বা তাহাকে সান্ত্বনা। ভালোবাসার ছলে মানুষেরা তাহাকে কতবার এইরূপ। তথাপি সে বোঝে নাই। সে ভয় পায় ইদানীং। বল কমিয়া আসিতেছে। জঙ্গলে আর কতদিন!

মোমবাতি ছোট ক্রমশ। স্বাভাবিক। বহু জ্বলিয়াছে। বাহিরে সম্ভবত বৃষ্টি। তাহার আর কী! আলোর বৃত্ত ক্রমশ ছোট। একদা রিও আর সে। এখন ওই ছোট আলোয়। একা। কতক্ষণ!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন