কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

০২ অনিমিখ পাত্র

নীলের বানান কিংবা রোদের অনুবাদ :
নীলাব্জ’র বই কিংবা বাক্‌-এর ই-বুক


বইয়ের নাম : ‘গুলমোহর... রিপিট হচ্ছে’
বাক্ প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়
বিনামূল্যে আন্তর্জালে বিতরিত



কখনও উপলভরা, কখনও মরুময়, কখনও বা সমুদ্রসোঁদা বিস্তীর্ণ ভূমির ওপর দিয়ে পথ করে নিয়েছে আমাদের বাংলা কবিতা। এই যাত্রায় হাইওয়ে ও গলি-উপগলি -- দুইই সামিল। আর এই মুহূর্তে হয়তো সমস্ত রকম রাস্তার সন্ধিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সে। কেউ কেউ বলছেন, আর্ট ফর্ম হিসেবে কবিতার আয়ু আর খুব বেশিদিন নয়। কেউ বলছেন, আস্ত বাংলা ভাষাটাই নাকি বিপদের মুখে। ফেসবুক এসে গিয়ে অনেক রকম পুরনো নক্‌শাও পালটে দিয়েছে। কবিতা হাত ধরে নিচ্ছে আরও অন্যান্য শিল্পমাধ্যমগুলির। এরকম একটা আবহের মধ্যেই, দীর্ঘদিনের সুপরিচিত বাংলা ব্লগজিন ‘বাক্‌’ ( সম্পাঃ অনুপম মুখোপাধ্যায় ) প্রকাশনার জগতে পা রাখলো। এবং তার ইঙ্গিতময়তা এখানেই যে, সে তার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে প্রকাশ করলো নীলাব্জ চক্রবর্তীর দ্বিতীয় কবিতা সঙ্কলন -- বাক্‌ প্রকাশনীর প্রথম ই-বুক ‘গুলমোহর... রিপিট হচ্ছে’।


আজ থেকে পঞ্চাশ কি একশো বছর পরে কবিতা থাকবে কিনা তথা বাংলা ভাষায় কবিতা লেখা হবে কিনা, সেটা অন্য বিতর্কের বিষয়। তবে রক্ষণশীল বইপাঠের অভ্যাসে প্রাথমিক আঘাতটুকু সইয়ে নেওয়ার পর এ বইটি (হাতে নয়) ডাউনলোড করে পড়া শুরু করলে অস্বস্তি কেটে যেতে থাকে। ছোট্ট এই বইটিতে মাত্র এগারটি কবিতা। ছাপা হলে বলা যেত রোগাপাতলা এক ফর্মার একটি বই। প্রবেশক কবিতাংশেই এই কবির স্থানাঙ্কটি টের পান পাঠকঃ ‘এই পেরিয়ে যাওয়াটার নাম তোমরা আলো রেখেছ আর ধরে নিয়েছি কীভাবে সমস্ত ছায়ার থেকে একলাইন স্মৃতি অনুবাদ করে নেওয়ার কথায় চোখের ভেতর দিয়ে দেখতে পাওয়া হাসপাতালের নিজস্ব জাহাজঘর...’ নীলাব্জ চক্রবর্তীর ভাষাদুনিয়ায় ঢুকে পড়া, এইভাবে। আলো আর ছায়ার যাতায়াত। স্মৃতির অনুবাদপ্রয়াস।

এক ক্রমে ছোট হয়ে আসতে থাকা হেমন্তের কথা নীলাব্জ’র লেখায়। এবং তার ভেতর ঢুকে পড়ে এক অসদৃশ মোটিফঃ ‘গুটি গুটি হেমন্ত ফ্যালা হয় এইখানে / ক্লিন শেভেন...’ এই ‘ক্লিন শেভেন’ শব্দবন্ধ যেমন মেধার ভেতর ক্ষুর চালিয়ে দেয়, তেমনি কোথাও কোথাও উপর্যূপরি ইংরেজি শব্দবন্ধের ব্যবহার কেবল এক প্রবণতা বলেও বোধ হয় বটে! কিন্তু কখনই কবি তাঁর লেখা থেকে ছায়াময়তা ছাড়িয়ে ফেলে তাকে হাজার ওয়াটে এনে ফেলেন না। এরকমই এক উদাহরণ, ‘নিওন’ কবিতার শেষ অংশটি পড়া যাকঃ

প্রিয় ব্যারিটোন থেকে দূরে
টাউনহাউস শব্দটার গায়ে
                 একেকটা জুবেইদা নামের আলো
নাজনীন ইত্যাদির মায়া লেগে আছে দেখি ...
নানান প্রপার নেম-এর উল্লেখ তাঁর লেখার শরীরে। নীলাব্জ’র প্রিয় নামগুলি, ধীরে, আমাদেরও ব্যক্তিগত মনে হতে থাকে। এইখানেই কবির মুন্সিয়ানা। ‘নাজনীন ইত্যাদির মায়া’ যেমন তিনি না দেখিয়ে পারেন না, তেমনি ‘ক্ষয়’ কবিতায় এক অপূর্ব অনুপস্থিতির মায়াঅঞ্জন লাগিয়ে দেন, নিজেকে ক্রমাগত মুছে মুছে ক্ষয় করতে থাকেন আর তার মায়াটিও অন্যভাবে ফোটে। বলেন, ‘এখানে নীলু নামের কেউ / কোনোদিন ছিলই না কখনো’। একটা সম্পূর্ণ আবহ গড়ে ওঠে, নিজের ওপর ক্রিয়া আরোপ হয়, অথচ তা হয় ক্রমাগত প্রত্যাহারের মাধ্যমে। তাঁর ভালোবাসা আমরা টের পাই।
‘জানলার ভেতর আর জানলার বাইরে
একইরকম স্বপ্নদৃশ্য
               এখানে
                        নীলু নামের কেউ
রোদের অনুবাদ করে না
               ফেনা আঁকে না
জেব্রাঘড়ির ছায়ায় বসে বসে ...’

আমাদের সময়ের অনেক কবিই এখন গল্প বা অন্য ধরণের ছোট গদ্যে কলমের ধার পরীক্ষা করে নিচ্ছেন। খুবই কৌতূহল উদ্দীপক এই প্রবণতা নিয়ে ভবিষ্যতে হয়তো বা গবেষণা হবে একসময়। তাহলে কি কবিতায় লেখকের সমস্তটা সম্ভব নয়? কবিতার ধারণক্ষমতা সন্তুষ্ট করতে পারছে না আর? নাকি আমরা চ্যালেঞ্জ এড়িয়ে যাচ্ছি?

হয়তো এই চ্যালেঞ্জটাকেই হালকা করে আঙুল বোলায় নীলাব্জ’র কবিতা। সে যেন হিমশৈলের শীর্ষবিন্দুর আভাটুকু ছড়িয়ে রাখে কবিতাশরীরে। কোনো গল্প বলে না। তার ঢংটুকু বলে। আরো অনেক চরিত্রনাম উল্লিখিত হয়ে সরে সরে যায়। ‘চেন্নাই’ শীর্ষক টানা গদ্যের দুই কবিতার সিরিজ এমনই এক আভাসকোলাজ। যার ২নংটি তে ফিল্ম শ্যুটিং-এর উত্তেজনা আছে। তবে ১নং-এ ‘রুক্মিনী’ নামটিকে ভেঙে ‘রুক তোর মিনি তোর স্কার্ট’ -- এমন উচ্চারণকে দম ফুরিয়ে ফেলা বলে মনে হয়। এরপরের ‘তারিখ’ নাম্নীটিও ওই একই ফর্মের দুই কবিতার সিরিজ। এবং এখানে নীলাব্জ’র প্রাণটিকে বড়ো কাছের বলে বোধ হতে থাকে। তার গায়ের ধুলোবালি পাঠকের হয়। যতিহীন এই দুটি অংশ কবিতা টানা একেক দৌড়কে পৌঁছে দেয় আমাদের খোলামাঠে। এর স্বেদবিন্দু প্রকৃত অর্থে পেতে গেলে পুরোটা পড়তে হবে। এবং পুরো বইটাই। তবু আপাতত অঙ্গহানির দায় নিলামঃ ‘জন্মদিনের হাতল থেকে গড়িয়ে আসছে এক একটা স্বাদু দস্তানা ও খসে যাওয়া আলোর সিরিঞ্জে এইভাবে উত্তাপ ও শীতলতা ধীরে বিনিময়যোগ্য হয়...’। নীলাব্জ’র এইসব কবিতায় ‘স্তনের জাফরি’ থেকে ‘স্তনের ডাকটিকিট’ পর্যন্ত এক পরিক্রমাকে দেখি। এও তো স্মৃতিরই অনুবাদ যা কবি প্রথমেই স্বীকার করে নেন। এমনকি বিদেশি শব্দগুলিও নীলাব্জ স্মার্টনেসের অছিলায় ব্যবহার করেন না। তাঁর মৃদু স্বভাবটিই পাঠকমনে রিপিট হতে থাকেঃ

যেভাবে একটি পোষা
নগ্নতার পায়ের কাছে
ফিরে গেছে দুপুরের বোতামবেলা

কবি ‘রাস্তার জন্য একলাইন রাস্তাও পড়ে নেই’ -- এরকম বলতে বলতেই পাঠকের জন্য তেমাথা-চৌমাথার ট্রাফিক খুলে দেন।

আর প্রচ্ছদ এবং সমগ্র ই-বুক তৈরির কারিগর অর্জুন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা না বললে এই ‘ওপেন-এন্ডেড গল্পরেখা’টি মুড়নো যাবে না।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন