কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর, ২০১৩

১০ নীতা বিশ্বাস

গ ল প কথা
নীতা বিশ্বাস



মা যেদিন ক্লান্ত থাকতো, আমাকে ঘুম পাড়াতে শুয়ে সেদিন এই গল্পটাই বলতো। মায়ের কাছে প্রত্যেক দিন নতুন গল্প, কী যে উত্তেজক, কী যে মরমী! কিন্তু ক্লান্ত থাকলে মা এই গল্পটাই বলতো। গ ল প ব্যাঞ্জণবর্ণের এই তিনটি অক্ষরকে নিয়ে। এরা তিন ভাই, ক্রমানুসারে বড় মেজ ছোট। একদিন তিনভাই বেড়াতে বেরিয়েছে, বাড়ির কাছেই সুবর্ণরেখা নদী। চল্‌ আজ আমরা নদী পেরিয়ে ওপারে যাই! তিনটি উজ্জ্বল মুখ, ছ’টি উজ্জ্বল চোখ, তিনজোড়া অগ্রগামী পা। ‘গ’ বড়দা বলল, আগে আমি জলে নামবো, আমার পেছনে তোরা। কেন?? বাঃ, আমি রাস্তা চেনাবো না? তবেই তো তোরা...। এখানে রাস্তা কোথায় রে দাদা! এতো শুধু জল। শুধু জল না রে ভাই, ডুবোপাথর চোরাবালি। তোরা পারবি না। আর তুই কী করে পারবি? পারতে যে হবেই রে, তাই পারবো। ‘গ’ জলে নামল। গোড়ালিজল, খানিক যাবার পর হাঁটুজল, আচমকা ডুবো পাহাড়ে জোর হোঁচট, সামলে নিয়ে, অমোঘ টান চোরাবালির, ‘গ’ নিয়ে যাচ্ছে ‘ল’ ‘প’-কে সবকিছু বাঁচিয়ে। দাদার হাঁটুজল মানে ছোট্টটার বুকজল। ‘প’ বলে, পারছি না রে দাদাভাই! ‘গ’ থমকে দাঁড়িয়ে ‘প’ কে পিঠে তুলতে যায়, পারে না। ‘ল’ ফাঁক পেয়ে এগিয়ে যায়, ‘গ’ এর সম্মানে লাগে। যেতে দেয় না ‘ল’-কে। বরং ‘প’-কে ‘ল’এর পিঠে তুলে দিয়ে মজা দেখতে চায় — পারে কিনা সে! সে, ‘ল’ দিব্যি ‘প’-কে পিঠে তুলে নেয়। ‘গ’ আর ‘ল’এর পিঠে ‘প’ নদী পার হয়ে ওপারে যাবার জন্য চলছে, চলছে... চলছে... বলতে বলতে মা ঘুমিয়ে পড়তো। আমার নিদ্রাহীন এবং নিদ্রামুখর সারারাত ধরে ‘গ’ ‘ল’এর পিঠে ‘প’ চলেছে... চলেছে... চলেছে... শুনতে পেতাম। চলতো তারা নদী পেরিয়ে ওপারের সবুজ সজীব জীবনের টানে। কতদিন চলবে ওরা মা? যতদিন না নদী পার হয়ে ওপারে পৌঁছোয়!

তখন বুঝতাম না, এ গল্পের স্পেস কতখানি দারুণ দুরন্ত। কতখানি সম্ভাবনাময় এর বিস্তৃতি। সন্দেহ করতাম মা’কে, মা নিশ্চয়ই ঘুরিয়ে যুক্তাক্ষর শেখানোর চালাকিপনায়...! কিন্তু গল্প তো চলতোই... চলতোই... কত বাধাবন্ধ কত না পা ভেঙে দেওয়া অন্ধকারময় পাহাড়পাথর, কত জলঢোঁড়া আর বিষবতীদের কুটুস, কত নিভৃত অতলে নিরুদ্দেশ করা চোরাবালি কাদা পাঁক আর স্রোতের বিপরীতে উজান বেয়ে যুদ্ধ নিয়ে ‘গ’ ‘ল’এর পিঠে ‘প’ নিয়ে কত যুগ যুগান্তর ধরে গল্প চলছে, চলছে...। নিজের মতো করে ভাঙা পা সারিয়ে নিয়ে, বিষছোবলের বিষ শুষে নিয়ে, চোরাবালির হাত ভেঙে গুঁড়িয়ে, কখনো তার ভেতরে তলিয়ে, আবার ওঠার মতো শক্তি অর্জন, চলবার মতো পায়ের জোর খুঁজে নিয়ে দিনের পর দিন বদলের ভাষা রং ছন্দ ছন্দবাণী... শিখতে শিখতে শিখতে আজও গল্প চলেছে, পাড়ের সন্ধানে।

আমার ছোট ভাইকে মা যখন ঘুম পাড়াতো, তখনও সেই চলনবার্তা। জলে পাথরে বালিতে কাঁটাগাছে ছিন্নভিন্ন পা নিয়ে বুকটান করে, কখনো সুবাতাসে, কখনো ঝোড়ো ঘূর্ণিহাওয়ায় শ্বাস নিতে নিতে পিঠে অবলীলাক্রমে ভার বহন করে চাপ ঠেসে নিয়ে সে, সেই গল্প আজও কত মায়ের ঘুমপাড়ানিয়া সুখজাগানীয়া জীয়াভরনীয়া প্রেম–রোমান্স-অনুরাগনীয়া হয়ে আমার মধ্যে চলেছে চলেছে...

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন