কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩

০৪) অলোকপর্ণা

হাওয়া হাওয়াই
অলোকপর্ণা



(১)

কাচের দরজার ওপারে ‘বিজলি গিরিয়ে’ আট বছরের রানির চোখ টেনে আটকে রেখেছেন চল্লিশজন শ্রীদেবী, কাচের দরজার এপারে দু’হাতে ভর করে পায়ের আঙুলে চাপ দিয়ে অল্প অল্প দুলে চলেছে সে। তার বিহ্বল চোখে শোরুমের চল্লিশটা এল ই ডি টিভির প্রতিবিম্ব তৈরি হয়ে, যেন এক ক্যালাইডোস্কোপে ঘুরে চলেছে শ্রীদেবীর স্কার্ট। প্রতিবার যেমন হয়, -- পাশে দাঁড়িয়ে রাজুও বার বার মগ্ন হয়ে পড়ছে শ্রীদেবীতে, আর ঘোর কাটতেই রানির হাত ধরে টানাটানি শুরু করছে। বেশ কিছু ব্যর্থ চেষ্টার পরে মন্ত্রমুগ্ধ রানিকে উদ্ধার করতে না পেরে তাকেও কাচের দরজার ওপর দু’হাতে ভর রেখে অল্প অল্প দুলে উঠতে দেখা যায়, আর সেইসব সময় রানির ঠোঁট অস্ফুটে বলে চলে, “আক চিকি লাকি চিকি চিকি লাকি চু, আক চিকি লাকি চিকি চিকি লাকি চিকি চু...”।



(২)

“ইস মহেনে কি হর রাত আপকে সাথ, শ্রীদেভি!!!” -- হুবহু চ্যানেলের বিজ্ঞাপনের কায়দায় কথাটা বলে প্ল্যাটফর্মের ভিড়ের মাঝেই একপাক ঘুরে নেয় রানি।

রাজু বলে ওঠে, “তোর তাতে কী বে?”

উত্তরে গালের গর্তে টোল ফেলে হেসে রানি কোমরে বাঁধা ওড়নার আশ্রয় থেকে করতালটা বের করে নেয়। তারপর তারা দুজনেই উঠে আসে কোনো এক ট্রেনে। শেয়ালদা স্টেশন ছাড়ালে একচল্লিশতম শ্রীদেবী হয়ে জেনারেল কামরায় ‘বিজলি গিরাতে’ শুরু করে রানি, মুগ্ধ চোখে তাকে দেখতে দেখতে, করতাল বাজিয়ে রাজু ভাঙা গলায় রানির ‘হাওয়া হাওয়াই’র সাথে পাল্লা দিয়ে কোনো রকমে গেয়ে ওঠে, “উইউই উইউই উইউই উইউই, -- হাওয়া হাওয়াই!!...”



(৩)

ঠিক রাত ন’টায় ‘সদমা’র শ্রীদেবী টিভি থেকে বেরিয়ে এসে ঢুকে গেলেন রানির মধ্যে। ফুটপাথে বসা রাজুর কাছে তারপর থেকে শোরুমের শ্রীদেবীদের কোনোই অস্তিত্ব থাকল না বলে, সে রানির দিকে ফিরে বসল। রানির মধ্যে ঢুকে হাসপাতালের বেডে শোওয়া সদ্য স্মৃতিহারা ‘সদমা’র শ্রীদেবী তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কওন হো তুম?”

থতমত রাজুর ঠোঁট ফাঁক হয়ে লালা গড়িয়ে পড়ল শার্টের কলারে।

রানি অবাক চোখে বলল, “মা?!”

হাতের চেটো দিয়ে লালা মুছতে মুছতে চোখ গোল গোল হয়ে গেল রাজুর।

“তুম মেরি মা নহি হো!” বলেই কুঁকড়ে গেল রানি। রাজু ভয়ে পিছিয়ে এসে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল। এরপর শ্রীদেবীর ছেলেমানুষীতে কখনও খিলখিলিয়ে হেসে উঠল রাজু, কখনও ছলছলে চোখে তাকিয়ে থাকল।

রাত বাড়তে মানুষের ভিড় ফিকে হয়ে এলো স্টেশন চত্বরে। ততক্ষণে ‘সদমা’র শ্রীদেবী ঢুকেই পড়েছেন ভিলেন বলুয়ার ডেরায়। রাজু চট করে শ্রীদেবীর কোলের ছোট্ট কুকুর হরিপ্রসাদ হয়ে গিয়ে খলবল করতে থাকলে, সুযোগ বুঝে বলুয়া ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীদেবীর ওপর। -- রানি আর রাজু দুজনেই একসাথে তিন চারটে আঙুল মুখে পুরে দিল। কাচের ওপারে শ্রীদেবীরা ছটফট করতে করতে কমল হাসানকে চিৎকার করে ডেকে উঠলেন, আর তখনই- কারেন্ট চলে গেল!

হতাশ, ছোট্ট হরিপ্রসাদ সেজে রাজু, রানির পাশ দিয়ে চুপচাপ হেঁটে প্ল্যাটফর্মে ফিরে আসে। ফাঁকা অন্ধকার প্ল্যাটফর্মের এক কোণায় থাকা দুটো চোখ তখন তাদের দেখতে পায়। রানির মধ্যে ঢুকে থাকা শ্রীদেবীকে দেখে সেই চোখ জ্বলে ওঠে। ধীর পায়ে সে এগিয়ে এসে, এক লাথি মেরে রাজুকে দূরে ছিটকে ফেলে দিয়ে রানির কাঁধ ধরে মাটিতে শুইয়ে দেয়। রানি চেঁচিয়ে ওঠে “ছোড় দো মুঝে! সোমু!!!!!!!!!!!!”

কারেন্ট এসে যাওয়ায় শোরুমের ‘রেশমি’ হওয়া শ্রীদেবীরা ‘সোমু’ হওয়া কমল হাসানদের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে ওঠেন, আর ফাঁকা স্টেশনে ছোট্ট ‘হরিপ্রসাদ’ হওয়া রাজুর ডাকাডাকি রানির চিৎকারে ঢাকা পড়ে যেতে থাকে।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন