কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ১৪ মার্চ, ২০১৩

কালিমাটি অনলাইন / ০১

২০১১ সালের ১লা জানুয়ারী প্রকাশিত হয়েছিল কবিতার ব্লগজিন ‘কবিতার কালিমাটি’র প্রথম সংখ্যা। আর গল্পের ব্লগজিন ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’র প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের ৩রা মার্চ। এখনও পর্যন্ত ‘কবিতার কালিমাটি’র ২৩টি সংখ্যা এবং ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’র ৮টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত, এই দুটি ব্লগজিনই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাংলাভাষী পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সমাদৃত হয়েছে। তাঁদের সহযোগিতা এবং ভালোবাসায় সমৃদ্ধ হয়েছে।

‘কালিমাটি অনলাইন’ একটি নতুন ব্লগজিন, যেখানে ‘কবিতার কালিমাটি’ এবং ‘কালিমাটির ঝুরোগল্প’ এই দুই ব্লগজিনকে সমান্তরাল ভাবে রাখা হলো। সেইসঙ্গে অদূর ভবিষ্যতে আরও কিছু সংযোজনের পরিকল্পনাও থাকলো। আমরা নিশ্চিত, প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের কাছে আমাদের এই নতুন প্রয়াস সাদরে গৃহীত হবে।


প্রসঙ্গত আবার আমরা আপনাদের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাই, প্রকাশিত কবিতা ও ঝুরোগল্পগুলি সম্পর্কে আপনাদের অভিমত অবশ্যই জানাবেন। সেইসঙ্গে আগের মতোই কবিতা ও ঝুরোগল্প পাঠিয়ে সহযোগিতা করবেন।


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : kalimationline100@gmail.com


প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :

0657-2757506 / 09835544675
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.
গত ১২ই মার্চ প্রয়াত হয়েছেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী গণেশ পাইন । তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রণাম জানিয়ে ‘কালিমাটি অনলাইন’এর প্রথম সংখ্যায় তাঁর পাঁচটি ছবির স্লাইড-শো পরিবেশন করা হলো ।

সমীর রায়চৌধুরী

দোপাটি ফুলের সুরলিপি


তেজময় বিন্দু থেকে শিথিল বিন্দুতে আমাদের গমনাগমন

বিগব্যাঙ তেজপুঞ্জের বিস্ফোরণ
নৈঃশব্দের ক্রন্দন
ব্রক্ষ্মান্ডের জন্মমুহূর্তের সম্প্রসারণ
মানুষও জন্মমুহূর্তের পর ডুকরে ওঠে
তরঙ্গকণা তখন আসঙ্গকাতর
দিনে দিনে আমৃত্যু সম্প্রসারিত হবে বলে

শুধু বিড়ালের শুদ্ধিভাব জানে
সে তখন অ-বিড়াল
আমি তখন অ-সমীর
তুমি তখন অ-শেফালি
বিগ্‌ক্রাঞ্চ মৃজ ধাতুর মৃত্যুদিবস
ঐ দেখ ফুরিয়ে যাচ্ছে অ – উ – ম
মানুষের স্বপ্নের মৃত্যু...

বারীন ঘোষাল

ওল্ড ডেজ হোম


এটাই বিষয় এখন
দৃশ্যটা বড় ছোঁয়াচে
জানালার একটা পাখি এই দৃশ্য থেকে
রটে যায় ফুরিয়ারে
সিরিজ সিরিজ
তোমাদের সপ সব এত প্রসবের চিহ্ন ধোয়ার কাহিনী

পালাও পড়েছে
মৃদু বারিশের হিম
ঈশ্বরকণা
এই করুণার মানে জানি না

বিশ্বাস হয় না
এসব বেহায়ার কথা মনে হয়
আমারই কূ-কথা
এত সবুজ স্তন
কেবলই সবুজ এত বোরিং
আমার কি মুচড়ে গেল জিৎ

ফুল ফুলেরা
মহক
মহকানিয়া
ফ্রিং ফ্রাং শুকতারা কোন্‌টা রে
কোন্‌টা রেব্যান

লাস্টসিন। ট্রেক। জুতো। পায়ের ডিম। গলার চোক। বৃদ্ধাশ্রম। ধুপকাঠি। মিসিং পাখি।

স্বপ্নদোষ থামছেই না

আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ

ট্রেনে জানালার পাশে



অ্যারোবিক এই শরীরগুচ্ছ
                    লাল লাল তরমুজ
ভেসে উঠছে বাদামী বীজের চিকন নদীপথ।
মো মো ঝিক্‌ ঝিক্‌
গান আর গন্ধম দেবে আধখোলা পাহাড়।

কাচে আর নাচে কোন তাঁবুর সিপাহশালার
তার জিপার খুলো তার পুলিন্দে
                   বসে আছে সবুজ বাঘের সার্কাস।

পাশে গলফ খেলার মাঠ
বালির পাতাল ঘেঁষে সূর্য আর সিংহের কংকাল
সাদা মানুষেরা রেশম হয়ে ঢুকে গেছে অ্যাশিয়ার
                   ঘুলঘুলিতে।

যারা নামছে তাদের মহীপাল বিবশ
নড়ে চড়ে বসে পড়ি ভিজে যাওয়া গালিচায়।
ঘুম খুলো না খুলো না তরমুজের শহর
দরজা ছাড়িয়ে ঢুকে যাবে
                  বাদামী বীজের দুশমন।








প্রণব বসুরায়

চলে যায়


মনে মনে জ্যোৎস্নার মধ্যে ছুটিয়ে দিই সাদা ঘোড়া
তার গা বেয়ে ঘামের বদলে গড়িয়ে নামছে খুশির ফুল

রেকাবে পা দিতে সঙ্গীতের মতো কিছু বেজে ওঠে,
আর ঐ ঘোড়া দ্রুত ছুটে যায়...
অবহেলায় পেছনে ফেলে রাখে জীর্ণ বাড়ি, বোবা গাছ;
শুধু এক সাদা প্যাঁচা পাল্লা দিয়ে ওড়ে

অগাধ জ্যোৎস্না কাঁপিয়ে ঘোড়া চলে যায়, যায়...

কিরীটি সেনগুপ্ত

রিক্টারের কাটায়…



(এক)

সেই কাকভোরে বৃষ্টি শুরু। ঝিরঝিরে। থামবে না। স্বভাব। চরিত্রের স্বভাব। ভরা পৌষের পাথর জমা শীত। খাঁচার রিক্টারে চার-এর কম তো নয়ই। পথ চলতি হাতে গোনা কয়েকটি প্রাণী, বিক্ষিপ্ত এদিক-ওদিক। পথের ধারে ঝাপসা এক্রিলিকে স্বপ্নের আদুরে প্রেম। ভেজা বট্ চারপেয়ে ঝাঁকুনির অপেক্ষায়। ফুটপাথের পশ্চিমে কানাগলির বস্তি। খড়কুটো জ্বালিয়ে সেঁকে নিচ্ছে হাত। কখনো পা’ও। অবশ স্নায়ু কোমায়, জেগে উঠতে চায়। খুব ইচ্ছা। উপায়?


(দুই)

জানালা খোলা রেখে ঘর পালানো। মনের বিকার বুঝি! চাদর মোড়া শীতে একা হাঁটতে পাওয়া। খানিক স্বস্তি। মজাও খানিক। হাঁ করলেও ধোঁয়া নেই। খাঁজে খাঁজে বরফ কুচি। গরম বাড়লে গলবে। জল হবে। ধোঁয়া বেরোবে না। কত খুঁত! মস্ত খুঁত বটে। ঘুলঘুলি লাগাতে বেমালুম ভুলেছে। পাকিয়ে ধোঁয়া জমছে। রিক্টার চার ছাড়ালো। এখুনি। কিন্তু ধোঁয়ার ঘাম?


(তিন)

বছর সাতেকের পুরনো। পড়ে পড়ে ধুলো মেখেছে। ঝাড়পোছে এখন সাদা। কোথাও একটু ধূসর। চেয়ে আছে। নতুন কেনা জল রঙে তুলি টানছে প্রলয়। ক্যানভাস শুষে নিচ্ছে নরম আদর। অভিমানী মুখ লজ্জায়, ঘোমটায়। সবুজে-হলুদে। তুলি শেষে ব্রাশ। কনুই-এর জোর ধাক্কায় কোমর নীল। সরেছে আড়াল। বরফ জলে চকচকে আয়না। নীল সমুদ্রের হাতছানি। প্রলয় শান্ত আজ। রিক্টার সাড়া দেয় না।

অলোক বিশ্বাস

অতনুর নামগন্ধ


মুকুট : জানালা খোলা থাক বা না থাক প্রোটন কণা মুখে পিয়ানোদের উড়ে যেতে দেখা যায়। সর্দি কাশি আজবতা বাহিত পিয়ানোর পরম্পরা তোমাতেই বাজবে যেভাবে মনকে নাড়াবে। যতদূরেই উড়ে যাক চঞ্চল আঙুলের খেলা ওয়াড্রোবে যাপিত হবে পংক্তির পর পংক্তি। সংহত কনটরাসেপটিভ থেকে শুরু করে মিছরির কার্যকারিতা ধাপে ধাপে বদলায় মাঠ ঘাট মোকদ্দমায় বাহিত হয়ে গেলে।

পুজো : আল্পনা নিজে থেকে অ্যাবসটরাকট হয়েছে। কেউ তাকে শাসিয়ে বলেনি ওইখান দিয়ে লক্ষ্মীর আগমন হয়। কেউ তাকে বলে না কৌণিক বিন্দু থেকে কেন্দ্র বিন্দুতে পৌঁছে পাঁচালির ধ্বনি তুলতে হয়। আমি তো বলিনি তাকে অ্যাবসটরাকট হয়ে কথা বল। নিজেরই কর্মফলে আল্পনা মোতি হয়ে গেল।

সাঁঝবাতি

আদরের নৌকা


এই ভাবেই গানে গানে ছুঁয়ে যাচ্ছি ঠোঁট
আর ঠোঁটের কথারা গান হয়ে যাচ্ছে

লিরিকে লিরিকে রাগ জমে যাচ্ছে
আমি পালটে নিচ্ছি রিংটোন
আসলে প্রতিটা রিংটোনই একটা অপেক্ষার মতো
যাতে একটা লম্বা রাস্তা থাকে
আমরা হেঁটে হেঁটে কেবল এগিয়ে চলি
আমাদের রাগগুলো পিছোতে থাকে, আমাদের থেকে
আমরা পিছু ফিরে তার ফিকে হওয়া দেখতে দেখতে
নতুন রিংটোনে এগিয়ে চলি...

তুষার প্রসূন

খেলা


পরাগমিলনের সময় ফুল কি ভেবেছিল তাদের পরবর্তী কাজ হবে পৃথিবীর ফুলদানী সাজানো! কিংবা বৈঠাপ্রধান তরণীগুলো কি ভেবেছিল মানুষ নিয়ে ভেসে যাওয়াই হবে তার চিরকালের কাজ! না জানার ধারাবাহিকতায় এইভাবে এক এক করে বিদ্যালয়ের ইতিহাস ভূগোল থেকে পাঠ্যক্রমে উঠে এসেছে গণিত। জ্যামিতি প্রধান রাস্তাগুলোও চলতে শুরু করেছে অনিয়ন্ত্রিত আহ্নিক ও বার্ষিক গতির সীমানায়।

বেলুনের উচ্চাভিলাষী আশা আমার সবটুকু অক্সিজেন নিয়ে উড়ে যায় আমারই নাগালের বাইরে। কেউ তো ভাবে না ঘাসের শেকড়ে ছড়িয়ে থাকে প্রাণের ইতিহাস অথচ প্রাণ নিয়ে ঘাসই ভাবে যেটুকু প্রকৃত ভাবার। ভাবনা প্রধান সড়কে বসে থাকি নিয়তিনির্ভর। আমরা ভাবতে পারি না চোখের ভেতরের নিদ্রিত চোখ কীভাবে তাকিয়ে থাকে মাঠের প্রান্তের মাটি খোঁড়াখুড়ি আর কাদা ছোঁড়াছুড়ি খেলার সঙ্গীদের দিকে...

রত্নদীপা দে ঘোষ

দুপুর



দুপুর নথ স্বভাব


হার মানা হার। লাফিং বুদ্ধ হাঁফাচ্ছে গরমে। হস্তমৈথুন করতে করতে হীরের নখদাঁত গেছে ক্ষয়ে। আদমের আপেল। কামড়ের দাগে চোদ্দদফা ঈভ।


দুপুর বৃহন্নলা স্বভাব

বেআব্রু মেয়ে। নাচভাঙা ব্রেসিয়ার, মুঠোতে আঁটে না ঘুঙুর এমন। হন্যে হয়ে ঘোরা সিলিং। চলো পালিয়ে যাই কনডোম থেকে কোকেনের বিজ্ঞাপনে।


দুপুর ট্রেকিং স্বভাব

ডেনিমের ব্রিজ। হাল্কা পায়ে চরকির মতো ঘুরছে ঝরোখা। টিকিট কাটার পরও চোখ রাঙালো দুটি খরগোশ। হেথা নয়...অন্য কোথাও... মাতাল দু’কোয়া বাতাস


দুপুর লকগেট স্বভাব

বোন চায়নার স্থাবর অস্থাবর। ক্যামেরার শাটার ঝলসে দীঘাশুক্র। কান পাতলে ঝিকঝিক ক্রিমসন লোকাল। হে ইস্পাতের শিরদাঁড়া, পাল্লা দাও সাথে... তাহার সাথে...


কফিব্রেকে গজানো দুপুরগুলো আমি স্বভাবের...
সাদা প্যাডে একঘেয়ে মাকড়সা, অসমাপ্ত ঘুমের ব্লেড
হাল্কা চিরুনি... দরখাস্তের জট... টানা সাতদিন...

আলোক দেবদাস

তেমন সুদিন এলে


চেষ্টার অসাধ্য কিছু নেই,
আমি স্নায়ুতে স্নায়ুতে
তা জানি।
সে আমার বোকামোর ওপর হাসে,
সব শব্দের তো প্রতিশব্দ হয় না!
প্রার্থনা আমার –-
শুধু আমার অসাধ্যের দাম
যদি পাই!

আরণ্যক টিটো

লাঠি


নবী-ন বাঁশের কেল্লা ভালোবেসে
তোমাকে আজকে
ভাষা দিতে ইচ্ছে করছে
প্রিয় লাঠি
কথা কও!...
লাঠিটা মাটিতে ফেলতেই
হলো,
দাঁড়ি।...
লাঠিটা মাটিতে ফেলতেই
হলো,
রেখা —
যেন,
পথ! নদীর ওপারে,...
লাঠিটা মাটিতে ফেলতেই
হলো,
দাঁড়!
দেখে,
পারাপারের তরণী!...


দেবরাজ চক্রবর্তী

চক্ষুদান

শরীরের অন্য দিকে
আরও একটা শরীর।
লাল নীল পর্দা ওড়ে
প্রতিবেশীর ঘুমের দিকে...
পরদিন সকালে তারা
খবরের কাগজে রাশিফল খুঁজে নেয়
তবে ততক্ষণে পৃথিবী চুলোয় যাক
তবুও কেউ একজন তোমার শাড়িকে
লুঙ্গি রূপে পরার অধিকার পায়।
সুসময়ে যদি ভালোবাসা না হয়
তবে চক্ষুদান করব তোমার স্বামীকে।

ছন্দম মুখোপাধ্যায়

দুটি কবিতা



ভেষজ মুখোশ

নীল এক কামার্ত শজারু।
প্রত্যেকটা রাতে সে প্রেমিকার মুখে
উপগত। তারপর টুলের ওপর নগ্ন
হয়ে বসে। গিটার বাজায়। সমুদ্র
সরে গেল। দেখছি, জ্যোৎস্নায়
পুরনো মদের গভীরতা। বালিতে
আমি ও আমার মৎস্যকন্যা।

তুমি কার নিশিডাক দেবারতি যে এত বিষণ্ন হয়ে আছ!



মোহ

খটখটে চোখে দেখা নদীপাড়ের
শ্মশান। মদ ফুরিয়েছে। সর্বস্ব চ্যুতির
চিহ্নও পড়ে থাকলো। মাঝে মাঝে এর
কাছে এসো। ধুলো মুছে রেখো কচি
নিমের ডাল, ঘড়াভর্তি জল, কলাপাতায়
গরম ফ্যানাভাত, নুন, গামছা। এই
সমাধিতে এসো।

শিমন রায়হান

মাহুতের গান


পেয়ারা বাগানের দুপুর পেরোলেই
সন্ধ্যেমাঠের দৃশ্যে উড়ে যায় ছাপোষা ফু
লোকরান্নার ধোঁয়াশা ধোঁয়ার আশা বিদগ্ধ কাঠ

পর্ণোস্টারের ক্রূর হলো আবাবিল
আর বরফের নতুন নাম বীভৎস জ্বলন
অজাচারী মেঘে শেখা গেল তানপুরার অন্য উপমায়ন
বৃষ্টির জিগির মশগুল হলো নিতম্বের তালে আর তানসেনে

পরিত্যক্ত সার্কাস হস্তীনির বৃক্ষশরীর –- আধপেটা চোখ
ওর ভারী এগোনোর মানেও দাঁড়ালো জীবন
কিছু হ্যাংওভার দুলুনির বেঘোরে ক্ষুধার দশা

লিপিকা ঘোষ

টার্নিং পয়েন্ট থেকে


একটা জ্যোৎস্নায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পাশের ছাদে নামা মুগার কারুকাজে জরি মিশেল মেখলা-জ্যোৎস্নাও যদি হাত বাড়িয়ে দিতে চায় নিরাশ করবে কি করবে না এটা নিয়ে অদ্ভুত কনফিউশন... কিছুই না, এ আলোর রঙ তোমার গায়ে মাখামাখি ও আলোয় হাত... শিউরে উঠে গেলে চলবে না। তারপর থেকে নীলাঞ্জনের আর ঘুম নেই। রাত দশটা’য় টিফিন খায় ওরা, রাত সওয়া বারোটা’য় ডিনার... নীলাঞ্জন জ্যোৎস্নায় যায়, রোজ-ই যায়; এ জ্যোৎস্না ও জ্যোৎস্না ঘুরে ভোর ধুয়ে ঘরে ফেরে। ঘোরে পাওয়া শব্দরা এভাবে তাড়া করে বেড়ালে নীলাঞ্জন আর কী-ই বা করতে পারে...




মানিক সাহা

জোকার


(১)
মুছে যাবার মতো করে নাম লিখেছো

হীরের চমকে ভিজে যাওয়া আলো
উটের পিঠে ভেসে আসা
পিতা-পুত্র, ভাঙা সাইকেলওয়ালা

তোমাকে মুখস্ত করার দিনে
পানের বরজ থেকে ভাঙা মূর্তির শাড়ি

আহা দরবেশ, বিশাল ঊরুতে রাখো
ফেলে দেওয়া চুমু ও চোখের জল


(২)
ছিটছিটে দাগ লাগছে ঘুমের ঊরুতে
তার একটা স্তন কাঁটা হয়ে
ফুল ঢেকে রাখে...

আসলে কনসেপ্টটাই প্রকৃত জোকার
নাচ দেখাবার জলসা ভিজে গিয়ে
প্রাচীর উলটে দেয় ঘুমের চাদর

গুরু, সকাল হলেই সব জাল ছিঁড়ে যাবে
জাল ছিঁড়ে একা সূর্য ফাটবে বাহুমূলে


নভেরা হোসেন

সবাই আলাদা


আমি একটা চ্যানেল দেখব
চ্যানেল নাইনে মঙ্গোলিয়ান বাঁশি বাজবে সন্ধ্যে সাতে,
তোমার খবরটাও ঐ সময়ে,
আর তোমরা কেউ এই ছবিও, কেউ দেশ টিভি, ডিডি বাংলা,
রিমোটটা কারো হাতে থাকছে না,
এক হাত হতে অন্য হাতে
এক বাটন হতে অন্য বাটনে--
এই সুনামীর পুরনো রেকর্ড
পর মুহূর্তে চাইনিজ নববর্ষ
বান কি মুনের মেক্সিকো সফর--
এবারও বাম্পার ধান হয়েছে বরিশালে
চ্যানেল ঘুরছে লাটিমের মতো
এখন আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না
ঝির ঝির ঝির ঝির
শোঁ শোঁ গর্জন
সমুদ্রটা কত কাছে?
কিন্তু মানুষগুলো দূরে দূরে
কেউ কাউকে ছুঁতে পারছে না
যদিও পরস্পর আলিঙ্গনবদ্ধ সারারাত!

দীপঙ্কর বরাট

চোরাস্রোত


নিছকই দুর্ভাগ্যবশত ছুঁয়ে গিয়েছিল তোমার হাত
তারপর মোবাইল হতে কাগজে,
ময়দান হতে ভিক্টোরিয়ায়,
ছড়িয়ে পড়তে থাকলো সেই জ্বর

দেখা আর কথার ওঠা নামায়
কখন যে তা শিরা উপশিরায় বইতে লাগলো
জানা গেল না
শুধু উষ্ণতা পাওয়ার জন্য কিনা জানি না
উদ্ধত চাঁদের আলোয় উন্মুক্ত ছিল
শুধু আকাশ
আর বাকিটা ঢাকা পড়ে গিয়েছিলো
জ্বরের আবেশে...


বিশ্বজিৎ

উত্তরণ

ক্রমশ একটা অন্ধকার ভেঙে
আর একটা অন্ধকারের দিকে
এগিয়ে চলেছো। চারিদিকে
অসংখ্য ঝোপঝাড়, কাঁটাগাছ
শেয়াল-কুকুর-হায়নার দল।
তবুও বিরতি নয়...
ছুঁড়ে দেওয়া ঘ্রাণ, চাবুক চিন্তায়
আরও বাহান্ন হাত বাড়িয়ে রেখেছো।
নিমডালের ফাঁকে ফাঁকে
দূষণের কারবার
ছড়িয়ে পড়ছে
তোমার
খান্‌-খান্‌
ছন্দে...

সোনালি বেগম

প্রতিযোগিতা


বৃদ্ধ হয়ে গুরুতর অসুস্থ, তারপর মৃত্যু।
দুঃখ না পেলে চরম অসুখী হতে হয়। মকরন্দ
পেতে সহস্র মাইল ভ্রমণ। সুখ-অসুখ হাতে
হাত গ্রন্থিত মালা।
গোধুলিসন্ধ্যায় মেঘের কাছাকাছি
বছর-পুরনো প্রতিযোগিতা প্রতিফলিত হতে থাকে।

দীপঙ্কর গোস্বামী

আগামী রোদ্দুর


অনাগত ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে বুঁদ হয় সে
নিঃশব্দে ছবি এঁকে চলে শ্বাসে-প্রশ্বাসে
বুকের ওঠা-নামায় গড়ে ওঠে পাহাড়
ভেঙে পড়ে ঢেউ কালের পাড়ে পাড়ে।

তার চিন্তার আকাশে তখন হাজারো জোনাকি
মনের দোলায় ধুলো ওড়া পথ,
একটা শৈশব ছুটতে ছুটতে হারিয়ে যায়
বার্ধক্যের উপত্যকায় জন্ম নেয় কঠোর বাস্তব।

নকশিকাঁথার মাঠের পড়শিরা একথা জানে,
জানে শালুক ফুলেরাও সব;
পদ্মদিঘির তীরে ঝুঁকে পড়া খেজুর গাছটিকে ঘিরে
চলছে ওদের বিজয় উল্লাস
ছুঁয়ে যাচ্ছে তার স্বপ্ন
ছুঁয়ে যাচ্ছে সে
অনাগত আগামী রোদ্দুর...


রোশনি ইসলাম

সমুদ্র ডাকছে



বিশাল নীল সমুদ্র
পাথরের উপর আছড়ে পড়ছে জল আতঙ্কিত সমুদ্র-গুহা
সংঘর্ষে সমুদ্র-খিলান
যেন উন্মুক্ত কপাট!
অবিচ্ছিন্ন আঘাত পরিবর্তিত ‘ক্লিফ’ সমুদ্র-বুকে
সেই মেয়েটি নাবিক হতে চায়
যেমন ভাস্কো দা গামা, ক্রিস্টোফার কলম্বাস।
সমুদ্র-বাতাসে অবাধ্য পোশাক
প্রসারিত হাত আকাশ ছুঁতে চায় –-
নীলাভ শব্দের সীমাহীন উত্থান-পতন ছড়িয়ে যায় --




পাঞ্চালী সীনহা

দুটি কবিতা



বিনিদ্র রাতের চাঁদ

বিনিদ্র রাত বেয়ে
তুমুল জ্বর
ঘোর
ঘোরের ভেতর হাঁটাচলা
চুপকথায় হাজারো নিষেধ
প্রহরায় ভরে তোলে
আনাচকানাচ
বাড়ি পাড়া আর সমাজ নামক

চাঁদের গায়ে তবু ক্রমাগত বেড়ে যায় দাগ।



বাসন্তিক

বাতাস ছুঁয়েছে গাছ
ছুঁয়েছে জল
গভীর তল

রাত ছোঁয় নিষিদ্ধ ঠোঁট

পাতারা আগুন ছড়ায়
শিমূলের লাল ওড়ে উড়ুক
এলোমেলো উড়তে পুড়তে
কিছু সুখ তো ছোঁয়া যায়!

সুমিতরঞ্জন দাস

দুটি কবিতা



পেলব নীরবতা

পাশে শুয়ে আছে মৃত ছায়া
গাঙপাখি সন্ধ্যায় আমি আর নীরবতা

কেঁপে কেঁপে ওঠে চাঁদের সোহাগ
পাতাখসা উষ্ণতা নিয়ে যায় গহীন অন্ধকারে
হেঁটে চলি একা নৈঃশব্দের মতো
প্রগাঢ় তৃষ্ণার দিকে

কোথায় আমার জল
কে আমার মেঘবালিকা
কার কাছে যাব হারিয়ে
কার কাছে মেটাব ঘুঙুর পিপাসা
কেবল শূন্যতার শব্দধ্বনি দিগভ্রান্ত একাকার



এবং রাত

অবশেষে পানপাত্রে লাবণ্য ঘুম আর
লালশালুমোড়া আপেলের পতনকাহিনী

আয়,
তোকে দেখাই জল আর দীর্ঘশ্বাসের পাথর
সিঁড়িভাঙা অঙ্ক কষে নেমে যাব এবার
সাদা বাড়ির একা অন্ধকারে;
আমি কাঞ্চা তুই কাঞ্চি
পাথুরে শরীরে এঁকে দেব যুগল-দহন-চপলপ্রীতি

আসিস্‌ রে তুই কালসোমরাতে
ছুঁয়ে দিয়ে যাস মুগ্ধ নিষেক

তোর জন্যই আমার জমিয়ে রাখা যত নৈঃশব্দ


অনুপম মুখোপাধ্যায়

বিকিয়াখোলা



বিকিয়াখোলা

যে কোনো দিক থেকেই হাওয়া আসতে পারে
এই কবিতাকে ঘিরে থাকা পৃষ্ঠায়
যে কোনো নাম থেকে হাওয়া বইতে পারে

কবিতাকে ঘিরে থাকা সাদা আমাকে

খ্যাপাচ্ছে

ভালোবাসার শেষের মতো নয়
পারফিউমের খালি বোতলের মতো নয়

খালি বোতল নয় খালি বোতল নয়
জাতীয় সড়কের পাশের সেই গ্রাম
অথবা নাম বিকিয়াখোলা

বিকিয়াখোলাআআআআআআআআআআআআআআআআআআআআ

আর কিছু গাড়ির ব্যাকলাইট
লাল

লাল

লাল বৃষ্টির মধ্যে
গাড়ির রঙ কিছুতেই গাড়ি হচ্ছে না

কাজল সেন

তার নাম


নীল রঙ ছিলই অনেকটা
তার সাথে কালচে সবুজের এখন আপাত সহাবস্থান
একটা রাতপাখি উড়তে উড়তে
এভাবেই কখন কোনো এক অদিতির জানালায়
খুব বেশি কি হলো আতিথেয়তা
আন্তরিকতায় কোথাও লাগলো না তো টান সকাল সন্ধ্যায়
ঘুমপুর থেকে যে আসছে সে আছে কতই না দোটানায়
কিছুটা পরিশ্রুত জল একটা দরকারি বিছানা
বহুতলের ছায়ায় এক্কা দোক্কার ত্রৈমাসিক প্রতিযোগিতা

সম্মান সে পেয়েছে অনেক সম্মানিত আরও কেউ কেউ
গুছিয়ে থাকা বলতে গোছাতে চেয়েছে প্রয়োজনীয় সমাস
আর অযান্ত্রিক যাত্রায় কতই না উজিয়ে আসা মাঠ
সেই যে একদিন একটা খেলা হলো দূরদর্শনের পর্দায়
পর্দার ভেতর আলতো হাত ঢুকিয়ে
অদিতি লাল বলটায় লাগিয়েছিল মলম
টাঙানো আয়নায় তখন একটানা সাদা টুপির ঝড়

আর আরও একদিন এভাবেই একটা কালো পাথরের বুকে
অদিতি খুব যত্ন করে লিখেছিল তার নাম


বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

সমীর রায়চৌধুরী

চন্দ্রমুখী হোমিও


বন্ধুমহলে সোমেনের পরিচয় ডাক্তারবাবু। সারাক্ষণ হোমিওপ্যাথির বই নিয়ে পড়াশোনা করে। আর হোমিওপ্যাথি ওষুধের নামের মধ্যে আশ্চর্য সব ঝুরোগল্প লুকিয়ে আছে। আজ সকালেই সোমেন আমার কাছে যখন এসেছিল, কথায় কথায় সোমেনকে এই ব্যাপারটা নিয়ে উস্‌কে দিলাম। যে যে-লাইনে আছে, তার প্রাণের কথায় সেখানেই যাদুবাস্তবতা।

--আচ্ছা সোমেন, মানুষের যত অসুখ হয়, তার পরিত্যক্ত বা বর্জন থেকে নিয়ে কোনো ওষুধ আছে কি? এই ধরো যেমন মল পুঁজ থুতু এসব নিয়ে ওষুধ?
সোমেনের মুখ মুহূর্তে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো।

--হ্যাঁ, আছে তো! যেমন যক্ষা রোগীর পুঁজ থেকে একটা ওষুধ আছে, নাম টিউবারকুলিয়াম। --তা দিয়ে কী হয়? কোন্‌ রোগ সারে?
--এই ধরুন মানুষের পছন্দ, পছন্দও তো একটা রোগ! ধরুন কোনো একজন মানুষের স্ত্রী বেড়াল পুষতে পছন্দ করে, কিন্তু তার স্বামী পছন্দ করে না। কিংবা ধরুন তার উল্টোটাও হতে পারে, স্বামী পছন্দ করে, কিন্তু তার স্ত্রী পছন্দ করে না।
--অর্থাৎ তুমি বলতে চাও, আখ্যানের অভিমুখ ঘুরিয়ে দিতে পারে যক্ষা রোগীর পুঁজ!
--হ্যাঁ, তা তো হতেই পারে। যেমন ঘরে তোলা পুঁজি আর ফেলে দেওয়া পুঁজ।
--হোমিওপ্যাথি তো জানে ইকোনমি। অতএব প্রয়োজন শুধু মিলিয়ন ডোজ।
--যেমন যে বেড়াল পছন্দ করে, মিলিয়ন ডোজ পড়লে তার পছন্দ বদলে যাবে। সে তখন হয়তো বেড়ালের জায়গায় কুকুর পুষতে চাইবে।
--ধরো যদি শরৎচন্দ্রকে খাইয়ে দেওয়া যেত মিলিয়ন ডোজ, কিংবা যদি মিলিয়ন ডোজ খাইয়ে দেওয়া হতো দেবদাসকে, তাহলে কী হতো? কিছুটা ভাবতে সময় নিল সোমেন। তারপর বলল -–আমার মনে হয়, তাহলে দেবদাস আর পারুর বাড়িতে যেত না। কষ্ট করে তাকে রক্তবমিও করতে হতো না। আসলে রক্তবমি করার নাটকীয়তার প্রয়োজনই হতো না।
--তাই! আর দেবদাস তাহলে কার নায়ক হতো? সোমেন আবার কিছুটা ভাবতে সময় নিল। তারপর ডাক্তারবাবুর মতো গম্ভীর গলায় বলল –

-তখন দেবদাস হতো শুধুই চন্দ্রমুখীর...

রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়

কর্ণার্জুন



প্রিয় কর্ণ,

আমি ব্রাহ্মণকে বরণ করলাম। আমার বাবা নেই। তাই সমাগত পাণিপ্রার্থীরা তাকে আক্রমণ থেকে বিরত থাকলো। আমার মা আছেন, তবে একাধিকে যে আমাকে মিলিত ভাবে ভোগ করবে, তা কখনো তিনি বোধহয় ভেবে উঠতে পারেন নি।

আমি ভেবেছিলাম। আমার বুকের মধ্যে উলের গোলা। আমার হাতে পায়ে ঘৃণ্য রোম। ফলতঃ দীর্ঘ পাজামা, রঙিন ও উজ্জ্বল, আমার ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসা নিকৃষ্ট শিশ্ন আর আমার শীৎকার নিয়ে ভেবেছিলাম। আমি তো তোমার পুরুষকারের কাছে বালিকা উত্তীর্ণ কিশোরী মাত্র। তোমার ওই রূপলাবণ্যের রূপক স্বর্ণকবচ ও কুন্ডল দ্বারা আমাকে আশ্রিত রাখো। রাখো তোমার অর্জুনবিদ্বেষ। অঙ্গরাজ্য থেকে মালিনী নগর পর্যন্ত তোমার শৌর্য অক্ষুণ্ণ রাখো।

এটাই তো রাজন্যনীতি! গুরুর গোত্র অনুসারে নিজেকে ভার্গব পরিচিতি দেবে তুমি, বহ্মাস্ত্রের জ্ঞান লাভ হবে তোমার, পরশুরামের ক্ষমা পাবে না, সেই জ্ঞান তিরোহণ হবে। তাই তো তুমি প্রিয় কর্ণ। আমাকে বহুভোগ্যা আখ্যা দানের পরেও। দাসীর কর্তব্য অবহিত করেছিলে আমাকে। প্রকাশ্য সভায়। আমি আহত নয়, আহৃত হয়েছিলাম। দাসীত্বে বরণ করেছিলাম নিজেকে। আর অর্জন করেছিলাম তোমায়, কর্ণ। অর্জিত হয়েছিলাম তোমাতে।

বৃহন্নলার সঙ্গে যুদ্ধে যখন তুমি পরাজিত হলে তখন আশ্চর্য হয়েছিলাম কি? পূর্বেই তোমার কর্ণচ্ছেদ হয়েছিল। ছদ্মবেশী দেবরাজকে কুন্ডল দানের সাথে সাথেই তুমি অমোঘ বৈজয়ন্তী শক্তি লাভ করেছিলে। বেদাদি শাস্ত্রেও তোমার ব্যুৎপত্তি ছিল। দান উপাসনা ছিল। আর আমার শরীর থেকে পুরুষ ঝরে পড়ছিল। কানীন সুতপুত্র তুমি, আমি কখনো তোমার মাকে ক্ষমা করতে পারি নি, যেমন আমার মাকেও, যিনি শুধু কন্যাসন্তান চেয়ে পুত্রের শরীরে কন্যা স্তুতি ও শংসাকে আরোপ করেছিলেন। কিন্তু আমি তো কন্যা, দেখো, আমার আয়ত নেত্র যুগল, মনোহর শ্রোণিদেশ, কৃষ্ণ ও কুঞ্চিত কেশরাশি।

তোমার মৃত্যু সংবাদ আমি পাবো নিশ্চিত। অগ্নিহোত্রী ব্রাহ্মণের হোমধেনু বধ করেছিলে তুমি। রথচক্রগ্রাস নিয়তি তোমার।

তখনও থাকবো, তোমারই।

আমি কৃষ্ণা।



প্রিয় অর্জুন,

আমার এই জীবন কোনো অধুনা ব্যাসদেব দ্বারা লিখিত নয়। আমার কোনো বিধিলিপি নেই। আমিই আমার বিধিলিপি। আমি কল্যাণী নই। সর্বনাশিনী। একদিন নিজের অস্তিত্বকেও বিনাশ করবো বলে আমি কর্ণকে ত্যাগ করিনি। তোমাকেও।

তুমি কীর্তিমান। যুদ্ধ জনিত যশ সকলি তোমার। নৃত্য, গীতাদি, গান্ধর্ব বিদ্যায় প্রভূত জ্ঞান তোমার। কিন্তু তুমি ততদূর কীর্তিমান নও যতদূর বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি আমার শরীরে প্রবেশ করাও। বহু নারীতে তুমি প্রবৃত্ত হয়েছো। তাই আমি তোমার নিবৃত্তি স্বরূপ।

তাই বৃহন্নলা নাম ধারণ করে তুমি যখন অজ্ঞাতবাস করেছিলে, তোমার সেই পুরুষ অভ্যন্তরস্থ নারীটিকে আমি আমার পুরুষ অভ্যন্তরস্থ নারীটিকে দিয়ে সর্বসুখ আস্বাদন করেছিলাম। তুমি যখন পুরস্ত্রীগণকে নৃত্য গীতাদি শিক্ষাদানের মধ্যে প্রীত করতে, আমি তখন স্বয়ং প্রীত হতাম। পার্থসারথ্য তোমাকে মহিমান্বিত করেছিল কি না আমি জানি না। কিন্তু তোমার প্রতি পার্থের বহু অন্যায় পক্ষপাতিত্ব একদিন অন্য কোনো মহাভারতে লেখা হবে।

যেমনটা উলঙ্গ আমি রূপ দ্বারা শাসিত, আমার পদ্মপলাশাক্ষি, তোমার পার্থ তখনই লজ্জাবাস টেনে দিল আমার শরীরে! কী লজ্জার! কিন্তু দ্রৌপদী যে ভারতবর্ষ, লিঙ্গ বিভক্ত ভারতবর্ষ, নারী অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিরূদ্ধ ভারতবর্ষ -- সেই মহাভারতবর্ষর কথা কেউ লিখবে না। এই জেনেও আমি লৌহিত্যসাগর পর্যন্ত তোমার সঙ্গে যাব। অহংকার তোমার পতনের কারণ হওয়ার ঢের আগেই তোমার প্রতি পক্ষপাতিত্বের কারণে আমার পতন নিশ্চিত হবে।

হে সঞ্জয়, আমি তো প্রত্যঙ্গ স্থাপনের পরেও পুত্র উৎপাদনে অক্ষম হবো, কী ভাবে প্রশ্ন করবো আপনাকে আমার সেই কল্পিত সন্তানদের পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে আপনার কৃতকর্ম কী হতে পারে!

তখনও তুমি থেকো অর্জুন, আমার এই গোপনকে সঙ্গোপনে লালন করার জন্য।

আমি দ্রৌপদী।




শ্রাবণী দাশগুপ্ত

বড়কাকিমার পুঁটুলি


নৈহাটি থেকে গুরগাঁও -– দূরত্ব নেহাত ‘কম নয়’ বলে শান্ত্বনুর যাওয়া হলো না। অঝোর বর্ষা, স্যান্ডাকের জুতো, রোজকার কলেজ-বাড়ি, শুঁড়িখানার মাতালের টানে সাহিত্যসংসদ, লেখালেখি। তার মা বলল, তমসাও বলল “যাও, না যাওয়াটা খারাপ দেখায়। বড্ড টান ছিল তোমার ওপরে।” বাইরে লম্বা বুনোঘাসের মাথায় টুসটুসে বৃষ্টিফোঁটা। বৃষ্টি এখন থেমেছে। দিন পনের আগে শমীক ফোন করেছিল, “আসতে পারলে ভালো হতো বড়দা, তোমাদের তো ছুটির অভাব থাকে না!” তা অবশ্য, শমীক বহুজাতিক সংস্থার উচ্চ-আধিকারিক। হয় না, হলো না কত কিছুই! ছায়ারঙের মেঘপর্দা। স্যাঁতানো গন্ধে বুনোভাপ। বড়কা’র বিয়ের সময় সে ক্লাস-টু। বাগানের পাঁচিলে একটা মা-বাঁদর এসে বসত। তিনবছর পরে বাঁদরছানা বড়কাকিমার শাড়ির বুকের কাছে গোলাপী...। একটুখানিই দেখেছিল সে। “ও শানু, ভাই দুধ খাচ্ছে...পরে আসিস?” সে লম্বা এক দৌড়। পেছনের বাগানে বড়বড় ডাঁসা কাশীর পেয়ারা। সেই গাছের নিচে তেড়ে হিসি করেছিল শান্ত্বনু। এই ক’দিন সবাই হবিষ্যি না খেলেও নিরামিষ। রিম্পি রোজ ঘ্যানঘ্যান করছে, “ও ঠাম্মা, আরো কদ্দিন?” তমসাকে বলছিলেন শান্ত্বনুর মা,“...তোমার শ্বশুরের সঙ্গেই আগে গৌরীর সম্বন্ধ এনেছিল ওর মেজমামা। দেখাশোনা... তা পনের বছরের তফাৎ বলে আমার শাশুড়ি অরাজী। ওনার আগের ফোটো দেখেছ তো; কী রূপবান ছিলেন! বাড়ির মধ্যে বটঠাকুরপোই কুচ্ছিত।” গুমোরে মেঘ ডাকল। “বড়কাকিমাও তো ওয়াহিদার মতো –- ফোটো দেখেছি মা। কী সুন্দর!” “ওই! রঙ তেমন নাঃ।” শান্ত্বনুর মা ধবলা, বেঁটে, ল্যাপচা-মুখ। বড়কাকিমার পা সে দেখেছিল, একদিন। কচুপাতা গোছ, গোড়ালি। উঁচু হয়ে কাপড় মেলছিল। সে দোতলার বারান্দায়। তখন তার মাধ্যমিকের ছুটি। আজ সন্ধ্যেবেলায় কমলদা’র বাড়িতে মিটিং –- পুজোসংখ্যা সংক্রান্ত। ইচ্ছে করছে না। সাদাকালোয় সেজপিসি, মা, বড়কাকিমা, ছোটকা, বড়পিসি, ১৯৬৯। পাছবাগানে বড় বড় সাবানের গোল্লা উড়ছে, ভাসছে, বড় হচ্ছে, ফাটছে। বৃষ্টির ধোঁয়ায় ঝাপসা বড়কাকিমার সবুজ-শাড়ি, হলদে-পাড়। গোল্লাগুলো ঘরে ঢুকছে। এক, দুই, তিন, চার পাঁচ...। আসছেই। “তোকে দিলুম যে শানু, খুলে দ্যাখ্‌না!” একখানা কালো খোঁপা, একজোড়া বকফুল, তাসের জোড়ায় রুইতনের সাহেব-বিবি, লালসুতোর গোলাপে তার বাবার নাম সেলানো রুমাল। পাঁচ নম্বর পুঁটুলিতে...? শান্ত্বনু ছোঁওয়ার আগেই উড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে বৃষ্টির মধ্যে। জলছাপ ঘরের মেঝেয়।

বারীন ঘোষাল

স্বপন দেখিনু


মুখে কষ্ট মেখে হাত কাটা স্বপনের দোকানে চা টোস্ট-এর অর্ডার দিয়ে বসে দেখছি কী করে সে এক হাতে চা বানিয়ে ঢাললো, পাউরুটি সেঁকলো, তারপর একে একে টেবিলে রাখলো। আর আমার দুটো হাত, তবু যেন আমিই নুলো। স্বপন বললো –

-- কী ব্রাদার, মুখটা যেন পেছনে কাটি করেছে কেউ?
-- আর বোল না, আমার স্বপ্না বাড়িউলি...
-- হ্যাঁ হ্যাঁ বলো, রগড়টা বলো, বাড়িউলি স্বপ্নার সঙ্গে ফস্টিনস্টি বুঝি?
-- না গো। স্বপ্না আমাকে প্যাঁদাতে বাকি রেখেছে। আমাকে তুলবেই। হপ্তার মধ্যে যদি না উঠি তাহলে শ্মশান স্বপনকে লেলিয়ে দেবে। আচ্ছা তুমিই বোঝ স্বপনদা, শ্মশান স্বপন এলে আমি কোথায় যাই?
-- ভাবতে হচ্ছে। তুমিইইই –- কাঁধে চেপে শ্মশানে চলে যাবে। আরে হ্যাঁ, তুমি ছড়া স্বপনের কাছে চলে যাও। ও এমন ছড়ানো ঝাড়বে না, ভূতেও পালাবে। সেই সেবার...

অগত্যা ছড়া স্বপনকে –- একটা কিছু উপায় করো ভাই, আমাকে রক্ষে করো। কেসটা শুনে স্বপন বললো –- সিরিয়াস। এইজন্যই তো কবি ছীবানন্দ সুসাইড করেচিল। তবে ভয় নেই। আমার কাচে এয়েচো, কিছু একটা হয়ে যাবে। এমন লিখে দুবো না, যে কানে গেলেই লজ্জা দেবে। কিছু মাল ছাড়ো দিকি। হাজার পাঁচেক। ভেবোনি, শ্মশান স্বপন এলে এর ডবল নেবে খন।

-- এখন তো নেই ভাই।
-- তবে আর কী। কাল এসো বাড়িতে। মাল্লু দেবে, কবতে নেবে। ঠিক আচে?

আমার কাঁপুনি আর কমে না। ঝুলে রইলো এখনো। বাড়ি ফিরতে পা সরছে না। কী করে সেই খান্ডারনীকে চুপ করানো যায়, তা ভাবতে ভাবতে মনে পড়লো পাশের বস্তির শান্তির কথা। ভাড়াটে চোপদার, মানে, চোপার লড়াইয়ে ক্ষেপ নেয়, ভাড়া খাটে। দেখি যদি কমে কোনো উপায় হয়! শান্তির ঘরের দরজায় পৌঁছে দেখি কাঁপুনি কিছুতেই থামছে না। মানুষের কত বন্ধু থাকে এসময়ে মনোবল বাড়াবার জন্য। আমার ভাগ্যে না বউ না বন্ধু। এমন কী পাড়ার ক্লাবও স্বপ্নার দলে। দরজার কড়ায় হাত রাখা মাত্র সেটা নিজে থেকেই বাজতে থাকলো।

-- কে রে? মেয়েমানুষের গলা এত বাঁজখাই হতে পারে ভাবা যায় না। আমার পিলে চমকে গেল। দরজা খুলে এসে দাঁড়ালেন মূর্তিমতী।
-- কেএএএ? ওমা! পাড়ায় থাকি, ভাজা মাছটি উলটে খেতে দেখিনি তো! তোমাকে তো কখনো রা কাড়তে দেখিনি গা!। তা আজ কী মনে করে বাছা?
-- আমাকে বাঁচান দিদি। বাড়িউলি বাওয়াল করছে উঠে যাবার জন্য। শ্মশান স্বপন দেখাচ্ছে। মোটে এক হপ্তা টাইম। আমাকে বাঁচান!
-- তো উঠে যাও না কেন বাপু? আমি কী করব? আর করলেও খরচা আছে। বাওয়ালির জবাব বলে কথা। পারবে? ঘন্টায় তিন হাজার টাকা। আগাম চাই। মাল দেবে, আমি নেমে পড়ব। ঘন্টা বাড়লে রেট বাড়বে, বলে দিলাম। এমনিতে আমি মিছিলে গেলে দু’হাজার নিই। আর রুদালিতে এক হাজার। কোন্‌টা চাই?
-- ওই রুদালিটাই করে দেবেন দিদি। এই হাজার দিয়ে যাচ্ছি। নিন্‌। কালই লাগিয়ে দিন।

অশান্তি করার জন্য শান্তিকে স্বপ্নার পেছনে লাগিয়েও শান্তিতে ঘুমোতে পারলাম না। হাতকাটা স্বপন, ছড়া স্বপন, শ্মশান স্বপন আর স্বপ্না মিলে আমাকে মেরে ফেললো!


নবেন্দুবিকাশ রায়

:P



বিমল হাত তুলে জানালার বাইরে কিছু একটা দেখানোর চেষ্টা করছিলো। এই হাসপাতালের কেবিনগুলো বেশ বড়ো আর জানালাগুলোও সমানুপাতে। এমনকি কেবিনের ভেতর থেকেই দ্বিতীয় হুগলী ব্রীজ দেখা যায়।
--তোর কখনো মনে হয় না, পৃথিবীটা ঠিকঠাক ক’রে বানানোই হয়নি? মানে বলতে চাইছি, গড, ইফ হি একজিস্টস্‌, হি ইজ এসেনশিয়ালি আ পুওর আর্কিটেক্ট। তাই না কি?
-- বিমল। ফিলোজফি মাড়াস না। নন্দিনী বলছিলো, তুই নাকি ইদানীং টোটাল ভেজ হয়ে গেছিস। ফলের রস ছাড়া কিছুই মুখে তুলছিস না!
-- হুঁহ্‌। ভেজ।

বিমল আবার চুপ করে গেল। সাদা বিছানায় আধশোয়া। পাশাপাশি আরও তিনখানা বেড। ফাঁকা। তিনজনই নাকি আজ সকালে ছাড়া পেয়েছে। বিমল ছুটি পায়নি। আসলে বাবার জন্য ডাঃ পাকড়াশীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট করাতে এসেছিলাম এই হাসপাতালে।

রিসেপশনে নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। অনেক দিন পর। জানতে পারলাম, বিমলের একটা ফুসফুসে ম্যালিগন্যান্ট গ্রোথ। কেমো চলছে। এটা তিন নম্বর। গতকালই জেনারেল বেডে দিয়েছে। নন্দিনী আমার হাত ধরে বলেছিলো, “ভিসিটিং আওয়ার চলছে। একবার দেখা ক’রে যাস, প্লীজ। ওর ভালো লাগবে... ঘনঘন ঘড়ির দিকে দেখছি লক্ষ্য ক’রে বিমল হাসলো।

--কী? চলে যাবি তো? জানি। তাও আর একটু বোস। আর পাঁচ মিনিট।
-- কীভাবে টের পেলি? কাশি হতো? জ্বর?
-- না। কাশিটা নিয়ে মোটেও চাপ ছিলো না। স্মোকার্স কফ বলেই ভাবতাম। সেরকম কষ্টও হয়নি। শুধু কাঁধে যন্ত্রণা হতো। টাটিয়ে থাকতো সারারাত। ডাক্তার এক্সরে করাতে বললো, তারপর বায়োপ্সি এটসেট্রা এটসেট্রা...

বিমলের সঙ্গে যদি এই শেষ দেখা হয়, তাহলে শেষের আগেরবার দেখা হয়েছিলো প্রায় বছর সাতেক আগে। হাওড়া বাসস্ট্যান্ডের পাবলিক ইউরিন্যালে। দু’জনেই হিসি করতে করতে, আমি বাঁ দিকে আর বিমল ডান দিকে, ঘাড় না ঘোরালে হয়তো দেখতেই পেতাম না!

-- তাহলেই দ্যাখ্‌, ইস্ট মিটস ওয়েস্ট ইন আ পাবলিক মুতখানা। ভাবা যায়! কঠিন... হাহাহা।
-- বিমল, কলেজের কারোর সঙ্গে আর দেখা হয় তোর? আই মীন, কেউ জানে?
-- ওঃ! না। আর কীই বা জানানোর আছে? আমি মাথা নাড়ি। এইবার আমাকে উঠতেই হবে। আজ বিকেলটা একপ্রকার নষ্টই হলো। আমি ইন্সেন্সিটিভ হচ্ছি না, কিন্তু আমাকে বলতেই হবে, বিমলের সঙ্গে আমার আর কোনো স্মৃতি অবশিষ্ট নেই। সে যে একসময় আমার বন্ধু ছিলো, এখন আর মনে হচ্ছে না। বিকেলে আমি একটা টিউশন মিস ক’রেছি। ছাত্রদের ফোন ধরিনি। আজকালকার বাজারে মাস্টারদের এইরকম খামখেয়ালিপনা কেউই সহ্য করে না। পরদিন থেকে একজন ছাত্রও যদি কমে যায়, তাহলে সেটা আমারই ক্ষতি।
--ভালো থাকিস... আমি নন্দিনীকে ফোন নাম্বার দিয়ে দিচ্ছি... বাড়ি ফিরলে একদিন যাবো... মাসিমা কেমন আছে... ইত্যাদি ব’লে বেরোতে যাচ্ছি, বিমল আবার বললো কথাটা। এইবার একটু জোর গলায়।
-- অমিয়, তুই যাই বল না কেন, আমি শিওর যে আমি ঈশ্বর হলে পৃথিবীটা আরও বেটার বানাতে পারতাম। বাল্‌। মুখ দিয়ে খিস্তিটা বেরিয়ে যাচ্ছিলো। কোনোরকমে আটকালাম। মুচকি হাসলাম। এই কথাটা নেপোলিয়ান ভেবেছিলো, বাহাদুর শাহ্‌ জাফর ভেবেছিলো, আমার ধারণা লেনিনও এই ধরনের কিছু নিশ্চয়ই কোনো না কোনো সময় ভেবেছিলেন। সব্বাই ভাবে। এটাকে ফিলজফিক্যাল স্টেটাস দেয়ার কোনো মানেই হয় না। মৃত্যু এড়ানো যাবে না জেনেও মানুষ যে কেন ফালতু ফালতু নাটক করে!

বাড়ি ফিরে বিমলের ওপর খানিকটা রাগই হলো। না, টাইম খাওয়ার জন্য ততটা নয় যতটা ভাবনাটা মাথায় ঢোকানোর জন্য। বিমলের ঘরবাড়ির কথা আমি যতদূর মনে করতে পারছি, ওরা ছিলো যাকে বলে ওয়েল অফফ। ক্যান্সার হওয়াটা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক ব্যাপার, কিন্তু ওরা অন্তত তার খরচ বহন করতে পারবে। বিনা চিকিৎসায় মরে যেতে হবে না। নন্দিনী বলছিলো, কয়েকমাস বাদেই সে নাকি সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাবে বিমলকে। সুতরাং সহানুভূতির কোনো জায়গা নেই। বিমল বা নন্দিনী যে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিলো, তাও নয়। শুধু এক ক্লাস। এক স্টাডি সার্কেল। এক হাফ-হার্টেড রাজনীতি। তারপর সময়। না। আমার বিমলের জন্য শোক করার প্রয়োজন নেই। শুধু ওল্টানো গুবরে পোকার মতো গোঁ গোঁ করছে বুলশিট ভাবনাটা।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে নিজের দু’কাঁধ টিপেটুপে দেখলাম। নাহ্‌! কোথাও ব্যথা বেদনা নেই। দিব্যি ঝরঝরে লাগছে। আমার বোকামিতে আমি নিজেই হেসে ফেললাম।


অলোকপর্ণা

অর্পণ


কনট্যাক্ট লিস্টে চোখ বুলিয়ে ঊষসী আনমনে বলে, “অর্পণ কে বলো তো?” ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে কাঁধ ঝাঁকায় উন্মন। এরপর ঊষসীর অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যাওয়া, উন্মনের আড়চোখ তার হাতে ফোন দেখতে পায় না। সিঁড়ির ধাপে দাঁড়িয়ে ঊষসী হাত নাড়লে উন্মনও তাকে বিদায় জানিয়ে হাঁটতে লাগে,-- খানিক খেইহীন, “সত্যি, অর্পণটা কে?”

পাশ কাটিয়ে বের হওয়া সাইকেল আরোহীর মুখ উন্মনের চোখে লেগে যায়,-- “অর্পণ!...” দেখতে দেখতে অজানা গলিতে গুম হয়ে গেল সাইকেল সমেত আরোহী। নিশ্চিত নিঃশ্বাসে সে অন্ধকারে হেঁটে যায়। ঊষসীকে কেমন আলগা লাগছিল যেন... উন্মন মন টেনে নেয় রাস্তার পাশের বিরাট হোর্ডিং-এ। একা রাস্তায় উন্মন দেখে, হোর্ডিং-এ তার প্রিয় মডেল,-- হুবহু ঊষসী। বিজ্ঞাপনের ছবিতে নজর কাড়ছে সে একাই। উন্মনের ভালো লাগে। কিছুদূর হেঁটে এসে আবার ফিরে তাকায় হোর্ডিং-এ, সে ভুল দেখেনি,-- মডেলের পাশে ফোকাসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে--অর্পণ! তার সাইকেল চালিয়ে যাওয়া মুখ নিয়ে। উন্মন ঘেমে যায়, ঊষসী খালাস করল তাকে! উন্মন অবসন্ন হয়ে পড়ে।

নির্জন একটা হাওয়া রাস্তায় ঢুকে আসে। উন্মনের মনে পড়ে, অর্পণ কে,-- সেও জানে না। ঊষসীর প্রতি অর্পিত সমস্ত সন্দেহের সঙ্গে নিজের প্রতিও ঘৃণা হয় হঠাৎ, কারণ-- অর্পণ কোনো কেব্‌ল চ্যানেলওয়ালা হতে পারে, গত মাসে ঊষসীকে খুব ভুগিয়েছে সেট টপ। আবার মায়ের ফিজিও থেরাপিস্টও হতে পারে, যাকে এই ব্যথাহীন দুই সপ্তাহে আর প্রয়োজন পড়ছে না। অথবা অর্পণ আপৎকালীন ড্রাইভার - হোম ডেলিভারি বয় - পাড়ার ক্লাব সেক্রেটারি – বীমাদালাল - হেয়ার ড্রেসার - ন্যূনতম ই-রিচার্জিং দোকানকর্মীও হতে পারে। অবশ্যই হতে পারে। উন্মন গুটিয়ে আসে নিজের সন্দেহের সামনে। লেভেল ক্রসিং-এর ঘন্টায় সে সোজা হয়ে দাঁড়ায়,-- একটু ঝুঁকলে দূরে ট্রেনের হেডলাইট দেখতে পাবে। ক্রসিং-এর ওপারে কেউ যেন আনমনে এসে দাঁড়িয়েছে।

ঠিক ট্রেন ঢোকার মুহূর্তে উন্মন সচকিত হয়। ট্রেনের কামরার ঝলকে ঝলকে সে দেখে, ক্রসিং-এর ওপারে ক্রূর হেসে তারই দিকে তাকিয়ে আছে -- অর্পণ! ট্রেনসহ ট্রেনের দমক চলে যাওয়ার পর উন্মন আর তাকে খুঁজে পায় না।

উন্মন দৌঁড়োয়। সিঁড়িতে উঠে বেল বাজাতে উষসীই দরজা খোলে। উন্মন দেখে উষসীর পাশে এসে দাঁড়াচ্ছে সাইকেল আরোহী।

নিজেকে সংযত করার প্রচেষ্টায় উন্মন বলে, “অর্পণ কে?”

ভূদেব ভকৎ

একটি মৃত্যুর ছবি


সূর্যটা ভাবছে আজ উঠব কী উঠব না! কারখানার দু’টি চিমনির ওপারে সোনালি আভা। আঁধার আর নেই। দুই চিমনির মুখ থেকে লালচে ধোঁয়া এঁকেবেঁকে আকাশে ছবি আঁকছে। ব্যাগ থেকে ক্যামেরাটা বের করে কাঁধে নিলাম। একটা জায়গা বেছে নিয়ে দাঁড়ালাম। সকাল তো রোজই হয়। কিন্তু একটি সকালের সঙ্গে আর একটি সকাল কোনোদিনও মেলে না। দূরে হালকা কুয়াশা মায়া ছড়িয়ে রয়েছে। ঠিক এই মুহূর্তে সূর্যটা যদি দুই চিমনির পাশে দেখা যায়, তাহলে একটা দুর্দান্ত ছবি অবধারিত!

ক্বচিৎ দু’একটা গাড়ি আলো জ্বালিয়ে চলে যাচ্ছে। এক শ্রমিক মহিলা মাথায় কিসের যেন বোঝা নিয়ে চলে গেল। সূর্যটা জানি না কেন এত অলস আজ! এখনও দেখা নেই তার। ক্যামেরা হাতে আমি অধৈর্য। একটা ঘোড়ার গাড়ি দূর থেকে এগিয়ে আসছে। খুরের কঠিন শব্দ ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। সূর্যটা কেন যে এখনও উঠছে না! চিমনি, ধোঁয়া, কুয়াশা, ঘোড়ার গাড়ি –- আহা! এই সময় যদি সূর্য উঁকি দেয়, তাহলে মনের মতো একখানা ছবি হয়ে যায়!

কিন্তু আজ সকালের ঈশ্বর বোধহয় অন্য কিছু ভাবছিলেন। হঠাৎ অঘটন! ঘোড়াটা আচমকা মুখ থুবড়ে পড়ল আমারই সামনে। ভোরের স্বপ্ন বদলে গেল এক অপ্রত্যাশিত দৃশ্যে। সামনে অবাক মৃত্যু। আমি চমকে উঠে ক্যামেরা ক্লিক করলাম। মাত্র একটি ক্লিক। একটি মৃত্যুর ছবি। আর ঠিক তখনই দূর দিগন্তে সকালের সূর্য উঁকি দিয়েছে আনমনে।


দেবতোষ দাশ

গন্ধ


টিভির পর্দা হঠাৎ ঝিরঝির। ছবি হাওয়া। মেয়েটি বিরক্ত। ছেলেটি বুঝতে পারে না কী হলো। বাইরে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। সঙ্গে কিছুটা বৃষ্টিও। ছাদে গিয়ে অ্যান্টেনাটা একবার নেড়েচেড়ে দিয়ে আসবে কী না ভাবে। মেয়েটির বিরক্তি কমে না। ছেলেটি বাইরে বেরোয়। হাতে ছাতা। আলো- আঁধারি সিঁড়িপথে পা ফেলে ফেলে ওঠে। দরজা খোলে। শূন্য ছাদটা হাঁ করে গিলতে চায় ছেলেটিকে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো শজারুর কাঁটার মতো আছড়ায়। ছাতাটা খোলে ছেলেটি। এক-পা দু-পা করে এগোয়। অ্যান্টেনাটা একটু নাড়াচাড়া করে। হঠাৎ দমক। তীব্র পাখসাটে ছিটকে যায় ছাতা। ঝড়-জলেই ছেলেটি অ্যান্টেনাতে মন দেয়। কিন্তু একটা কেমন যেন গন্ধ! ঝড়ের গন্ধ! বৃষ্টির! না, এ গন্ধ অচেনা। কোথা থেকে আসছে এ গন্ধ! চকিতে পেছন ফেরে। এ কী –- আঃ –- ছেড়ে দাও, আঃ –- আঃ –-

নাঃ, কেউ তো কোথাও নেই! তাহলে কেন মনে হলো কে যেন গলাটা চেপে ধরেছে! ছেলেটি ধূ ধূ ছাদে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। আবার সেই গন্ধ আসে নাকে। গোটা শরীর যেন অবশ করে দেবে। দ্রুত হাতে দরজা বন্ধ করে নিচে নামে। টিভিতে ছবি এসে গেছে। মেয়েটি খুশি।

মেয়েটি টেনে নেয় তাকে সোফার নরমে। জিভ ঢুকিয়ে দেয় কানে। আগুন লেগে যায়। মেয়েটি এবার ছেলেটির বুকের কালো নিপল্‌-এ হাত দেয়। তারপর জিভ। এ কী, সেই গন্ধটা আবার, আবার! কিন্তু কোথা থেকে আসছে এই ঘাতক ঘ্রাণ! ছেলেটি মেয়েটির বুকে ঠোঁট রাখে। টোলহীন। নরম। কিন্তু সেই গন্ধ! এ গন্ধ তো এখানেই! মেয়েটির শরীরে! ছেলেটি মুখ তোলে। আতঙ্ক। মেয়েটি তার গলা জড়ায়। সে ছিটকে সরায় তাকে। ছেলেটির চোখ ধোঁয়াটে। মেয়েটি অবাক। তার সবল আঙুলগুলো চেপে ধরে মেয়েটির গলা। মেয়েটি আস্তে আস্তে ঢলে পড়ে।

বাইরে ঝড় ক্রমবর্ধমান। টিভিতে আবার ছবি হাওয়া। ঝিরঝির। ঝিরঝির। এদিক-ওদিক তাকায়। হাতের কাছে ক্রিকেট ব্যাটটা নিয়ে ঠুকে দেয় টিভির পর্দায়। একটা ছোট্ট বিস্ফোরণ। কাচ ভেঙে যায়। গলগল ধোঁয়া। ছেলেটি সোফায় মেয়েটিকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। মেয়েটির শরীর তখন ঠান্ডা হতে শুরু করেছে।

চৈতী আহমেদ


বৃষ্টির আঁচল


দুদিন ধরে এমন নাকি কান্না কাঁদছে আকাশ! ওমা কাঁদবো না? এতো আমার কান্নারই দিন, শ্রাবণ মাস! তাতে কী, এমন প্যান্‌প্যানে কান্না আমার একেবারেই না পছন্দ, পথ ঘাট তোমার এমন সিকনী কান্নায় ঘিনঘিনে হয়ে উঠে! চলাফেরা দায়, কাঁদবেই যদি বুক ভাসিয়ে কাঁদ না কেন? তোমার বুকের গুমোটও কেটে যাবে, সমাজসেবাও হবে, মানে এই নগরের মানুষ কাজের ফাঁকে ফাঁকে রাজপথেই নৌকা ভ্রমণের সুযোগ পাবে। শুনে ওর সেই যে হেঁচকি উঠলো, থামার নামটি নেই। ত্যাক্ত হয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। কাঁহাতক আর ঘরে বসে থাকা যায়!

জরুরি কেনাকাটা বাকি, নাটক সরণীতে যেই পৌঁছলাম, ওমা ওর যেন রোখ চাপলো, দীর্ঘদিনের জমানো শোক বুঝি আমার অপেক্ষাতেই ছিলো, বাগে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো মাথার উপর, কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমাকে ভিজিয়ে দিলো। আমি কোনো দোকানের বারান্দায় আশ্রয় নেবার জন্য ইতিউতি তাকালাম। উঁহু কোথাও দাঁড়াবার জায়গা নেই, আর ভিজেই তো গেছি! কী হবে আর বারান্দায় উঠে! অনেকদিন মানে অনেক বছর, তাও না, কয়েক যুগই হবে এমন ঝুম বৃষ্টিতে ভিজি না আমি। একেবারে গহীনের, যাকে তুমি বলতে ছেলেমানুষ, জেগে উঠলো ছলবল করে। বারান্দায় দাঁড়ানোদের তাকানো দেখে মনে হচ্ছে, তারা যেন বাংলা সিনেমার শুটিং দেখছে। কী করবো, ভিজে ভিজেই এগোতে লাগলাম। আগে ভিজতাম তোমার সাথে লুকিয়ে বাড়ির ছাদে, বাগানে, মাঠে। এখন একা, রাজপথে। অবশ্য এটাকে এখন পথ না বলে আমাদের ছোট নদী বলাই যায়। হাঁটু পানি ভেঙে ভেঙে এগোচ্ছি। হঠাৎ দেখি লোডশেডিংয়ের মধ্যে ফুলের দোকান আলো করে বসে আছে দোলন! আহা, কতদিন দেখিনি তাকে, দোলন আমার প্রিয় দোলন! জীবনের প্রথম লেখা গল্পের প্রথম লাইনটি লিখেছিলাম ওকে নিয়ে। তুমিও ছিলে সেই গল্পে। ‘দৈনিক পূর্বকোণে’ ছাপা হয়েছিলো। বৃষ্টিতে ভিজে কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল সে। আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভিজছি, আর আমার এতো কাছে দোলন, আমার আর তর সইলো না। জলকন্যার মতো ভেজা শরীরেই ছুটে গেলাম দোকানের ভেতর। দোকানীর হাতে টাকা গুঁজে দিয়েই সবগুলো দোলনকে বুকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে আবার নেমে গেলাম ছোট নদীতে। হাঁটু জল ভেঙে ভেঙে বুকের মধ্যে অনেক স্মৃতির বুদবুদ নিয়ে চোখের জলে বুক ভাসিয়ে ভাসিয়ে ঘরে ফিরলাম। কেউ টের পেলো না। এই দোলনচাঁপার ভেজা পাপিড়তেই আঁচড় কেটে তুমি জলরঙে লিখেছিলে 'ভালোবাসি'।

কতদিন পর আমি মনের সুখে কাঁদলাম! শ্রাবণের বৃষ্টি, তুমুল বৃষ্টি দিব্যি গিলে ফেললো আমার চোখের নোনা পানি। কেউ কিচ্ছুটি টের পেলো না। শ্রাবণের বৃষ্টি কেবল জেনে গেল আমারও গহীনে তার মতো এমন কান্না থাকতে পারে। অন্যরা দেখে ভাবলো, আমি বুঝি এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বেরিয়েছিলাম সাদা ধবধবে ন্যাতানো ফুলগুলো কিনতে। ওরা কি আমায় পাগল ভাবলো! ভাবুক যা খুশি। তুমি তো জান, দোলনচাঁপা আমাদের প্রিয় প্রিয়তম স্মৃতিময় ফুল! বর্ষা আমাদের বুকের ভেতর প্রিয় প্রিয়তম ঋতু! বর্ষণ! প্রিয় ফুল,ঋতু ফেলে রেখে কেন চলে গেলে! মৃত্যু মায়াপুরীতে আছে কি বর্ষা? সেই বর্ষার ঝুম বৃষ্টিতে দোলনচাঁপা কি মেলে রাখে তার প্রেমময় শুভ্র হৃদয়ের আঁচল কারও অনন্ত অপেক্ষায়? আমার মতো কেউ কি ওখানে বৃষ্টির আঁচলে কান্না লুকোয়!


কাজল সেন

হ্রস্বদীর্ঘ


বাবাই তো তখন অনেক ছোট! খুবই ছোট। বাবাইকে নিয়ে তখন কোনো ভবিষ্যৎবাণী করা কি আর চলে? করাটা কি ঠিক? কিন্তু তিনি করেছিলেন। তিনি, মানে নিবারণবাবু। সম্পর্কে বাবাইয়ের কেমন যেন দাদু হন। বলেছিলেন –- ‘বুঝলে সুনির্মল! তোমার ছেলে কিন্তু একদিন খুব বড় হবে। খুব বড়। দেখে নিও। এই আমি বললাম’। কথাবার্তা রাতের খাবার খেতে খেতে হচ্ছিল। সুনির্মলের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল। কথাটা তিনি শুনলেন। একটু হাসলেন। এক ঢোঁক জল খেলেন। তারপর ‘আমি উঠছি’ বলে উঠে গেলেন।

রুটিটা দুধের মধ্যে চটকাতে চটকাতে বাবাইও কথাটা শুনেছিল। সে হাঁ করে দেখছিল নিবারণদাদুর দুটো চওড়া ঠোঁট। এইমাত্র ওর ফাঁক দিয়েই তো বেরিয়ে এসেছিল, একদিন তার খুব বড় হবার কথা। সে আন্দাজ করার চেষ্টা করছিল, কতটা বড় সে হতে পারবে! ঠিক কতটা বড় হলে, খুব বড় হয়েছে বলা যাবে!

তারপর থেকেই বাবাই লাগাতার ভেবেছে তার বড় হবার কথা। কীভাবে ঠিকঠাক বড় হওয়া যায়! এবং একদিন বলতে ঠিক কোন্‌দিন বোঝায়! পাশের ফ্ল্যাটের পল্টু তার সঙ্গেই পড়ত। একদিন বাবাই সুযোগ মতো পল্টুর পাশে দাঁড়িয়ে মেপেও নিয়েছিল, পল্টু তার থেকে কয়েক সেন্টিমিটার ছোট। আবার এভাবেই একদিন ক্লাসের মনিটর উৎপলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা গেল, উৎপল কয়েক সেন্টিমিটার বড়। বাবাই ঠিক বুঝে উঠতে পারত না, এখনও পারে না, এই বড় হবার মাপকাঠিটা আসলে কী! তার স্ত্রী সুমিতা তাকে প্রায়ই ঠেস দিয়ে বলে –- ‘তুমি কী বলো তো! এখনও পর্যন্ত তুমি কোম্পানির ডেপুটি ম্যানেজারই থেকে গেলে! এ জি এম আর কবে হবে? আর দেখ মিঃ সায়গলকে, তোমার সাথেই জয়েন করেছিল, এখন কোম্পানির সিনিয়র এ জি এম’। বিয়ের আগে করবীর সাথে খুব মাখামাখি ছিল বাবাইয়ের। সেই করবীও তাকে প্রায়ই বলতো –- ‘বি. টেকের পর এম. বি. এ করেই তোমার পাঠশালা শেষ? তুমি বোঝ না কেন, আজকাল ফরেন ডিগ্রি না থাকলে জীবনে উন্নতি করা যায় না, জীবনে বড় হওয়া যায় না!

নিবারণদাদু সেই কবেই বেমালুম উবে গেছেন এই দুনিয়া থেকে। বাবা সুনির্মলও ইতিমধ্যে নিজের বয়স যথেষ্ট বাড়িয়ে নিয়েছেন। বাবাইয়ের ইদানীং খুব আক্ষেপ হয়, দাদু বেঁচে থাকলে অন্তত যাচাই করে নেওয়া যেত, সে এখনও পর্যন্ত ঠিক কতটা বড় হয়েছে এবং আর কতটাই বা বাকি আছে! বাবা এসব ব্যাপারে একেবারেই উৎসাহী নন। তিনি নিজের দুই হাঁটু নিয়েই ব্যস্ত। আসলে বাত। বড় বজ্জাত!

তবু বাবাই প্রায়ই স্বপ্ন দেখে, সে একদিন সত্যি সত্যিই বড় হবে। খুব বড়। কিন্তু ঠিক কতটা বড়? কিছুতেই যেন আন্দাজ করা যায় না। বাবাইয়ের মনে হয়, দাদু যদি বাবার থেকে বয়সে ছোট হতেন, তাহলে হয়তো এখনও বেঁচে থাকতেন। আর যদি বেঁচে থাকতেন, তাহলে বড় হবার সঠিক সুলুকসন্ধানও দিতে পারতেন। কিন্তু কী আর করা যায়! বাবার থেকে বয়সে বড় হয়েই সব গন্ডগোল হয়ে গেল যে!

অনুপম মুখোপাধ্যায়

ভুল পৃথিবী


এমনভাবে বারান্দায় বসে থাকা যেন ঈশ্বরের বসে থাকা। ঝলমলে বসন্তের দিনে। অনেকখানি সুস্থ শরীরে। শুকনো পাতাগুলো খসে পড়ছে ফড়িংগুলোর ওড়াউড়ির ফাঁকে।

সামনের সবুজ মাঠটার দিকে তাকিয়ে এই বসে থাকা... আমার নিজেকে একইসঙ্গে সুখী এবং অসুখী মনে হচ্ছিল। একদম নির্ভার... বুঝি মানবসমাজ চেয়েছে এই ২০১৩-র দুপুর আড়াইটায় ২০শে ফেব্রুয়ারির বারান্দায় আমি বসে থাকি। বুঝি সকলে অনুমোদন করেছে। আমার এই বসে থাকা কারো কাছে একটুও আপত্তিকর নয়।

একটা বাচ্চা ছেলে একা একা খেলছে মাঠে। হাতে একটা ব্যাটের মতো কিছু মনে হচ্ছিল। একটা বলকে নিজে নিজেই পিটছে... হাওয়ায় পাঠিয়ে দিচ্ছে... নিজেই ছুটে গিয়ে ফিল্ডিং করছে। ও জানে না, আমি ওকে দেখছি ।

হঠাৎ দেখলাম একজন সাইকেল চালিয়ে আসছে। চালানোর ভঙ্গিটা যেন কেমন! হয় মাতাল, নয় পাগল! ছেলেটার কাছে এসে থামল। জড়ানো পায়ে সাইকেলটা স্ট্যান্ড করল। বুঝলাম একজন মধ্যবয়স্ক মাতাল। বেশ দরিদ্র। যত না মদ খেয়েছে, মাতলামি তার চেয়ে বেশি করে সুদ তুলে নিতে চাওয়া একজন লোক।

ছেলেটার সঙ্গে কী সব কথাবার্তা হলো।

লোকটা এবার বোলারের ভূমিকায়।

জীবনে কখনো কি কিকেট খেলেছে?

অদ্ভুতভাবে দৌড়ে এসে বল ছুঁড়ল... ব্যাট বাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার হাত দশেক দূর দিয়ে বেরিয়ে গেল বলটা...

তারপর ছেলেটাই আবার ছুটল বল কুড়োতে। দুজনেই খুব হাসছে। খেলা যে চট করে থামবে না... বোঝা যাচ্ছিল।

ওরা জানে না, আমি ওদের দেখছি।

লিপিকা ঘোষ


দরবার

কাকে যেন খুঁজছে এই সন্ধ্যে ভাসানো পাখিরা। সবুজ বর্ণ ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে প্রার্থনার দিকে। আজান ছোঁয়া গীর্জার ঘন্টা বেয়ে বেয়ে ওঠা না কি শাঁখে ফুঁ ডাকা আকুল ধ্বনি? লীন হয়ে যাবে দুরারোগ্য ব্যাধিদের মন ঘেঁষে থাকার অপচেষ্টা। একটু পরেই কি নেমে আসবে সেই শতাব্দী সেরা একটা লাইন!

লিরিক পিছল খাওয়া আশ্চর্য গলানো সোনা নেমে আসা চারদিক... চ্ছ্বটা দিচ্ছে।

‘এ ভাবে ছবি চাইলেই কি দেওয়া যায়?’ চিত্রকরের স্বর-বিদ্রূপ।

তৈলচিত্র আঁকা শেষ হয়ে গেলে তুলির শেষ টান ধুয়ে রাখবে ছবিওলা। বিকেল নেভানো মজলিসি ঝাড়বাতির রৌশন জাগল।

‘দেওয়া যায় না, না?’ নর্তকীর ঠোঁট-ছোঁওয়া হাসির আভাসে আভা লাগে।

বাদশাহের দরবারে দরবারী ছবির কত না দর...

একটু বিরহ ছোঁয়া সান্ত্বনা ঘুরপাক নিচ্ছে নর্তকীর ঘুঙুর ঘুরে ঘুরে। উঠে আসছে উত্তেজক পানীয় থেকে... দুরন্ত নদীর স্রোত থেকে কোমল বাষ্প উঠলে যেমন হয়, সেই ঘুরপাক খাওয়া এক তৃপ্ত জাগরণ। কিনার থেকে আলোটা আরেক কিনারের দিকে... এ আলোর পান্ডুলিপি পুরনো কোনো এক ধূসর যুগের উদাস লাগা। ঘুঙুরের গতি আর ছবিওলার তুলির টানে এ দরবারী মজলিসে আজ বাদশাহের মেজাজ-জৌলুস।

এর পরের ছবিটা নর্তকীর পায়ের দ্রুত। নর্তকী ‘দরিয়া’। দরিয়ার পানিও বুঝি বা হার মানল এইবার... স্রোত থমকে ঢেউ থমকে নাচ উঠছে। ছবিওলার আর তুলি সরে না।

বাদশাহ অবাক দেখলেন, ঘুঙরু ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছিটকে যাচ্ছে সেই কিনার বেয়ে নামা আলোর দিকে। সে আলোয় ভাসছে ধূসর যুগের এক আবছা পান্ডুলিপি, শতাব্দী সেরা কোনো শব্দের স্রোত যেন!

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

ঠুলি-মাংস


রাতের ঘড়ির কাঁটা তখন ঠিক বারোটায়, নাভির ভেতর থেকে ও ডাকাডাকি শুরু করলো। আমি ওকে বললাম, “অ্যাই, এখন আমি বই পড়ছি, এখন না, পরে আয়।” যেই না বলা, নাভির দেওয়ালে হাতুড়ি পিটতে লাগলো; বলে বসলো, “আমিও বই পড়বো!” আমি বললাম, “আরে দূর, তোর কি চোখ আছে যে বই পড়বি?, তুই তো খালি একটা হাওয়া। আমার জন্মানোর সময় মায়ের সাথে আমার যে সুতোটা ছিল না, ওটা কাটার পর তুই হাওয়া হয়ে সেঁধিয়ে গেছিলিস গর্তে! আমার নাই গর্ত তাই সত্যি সত্যিই নাই গর্ত; গর্ত নাই, ভরাট হয়ে গেছে! তুই হাওয়ার মাংস। আমার মাকে ডাক্তার বুঝিয়েছিলো, মা আমাকে আর আমি তোকে। দেখ কেমন বুঝিয়ে দিলুম!” ও বলল, “আমার ভাই-বোনেরা সবাই চোখে দেখতে পায়, খালি আমার চোখের ওপর থলথলে মাংসের ঠুলি। বহুত না-ইনসাফি হ্যায়!” শুনে আমার মনটাও গেল খারাপ হয়ে। ঠিকই তো বলছে বেচারা! নাই গর্ত মানে কোথায় একটা শিবনেত্র গোছের হবে! পৃথিবীর ওপরের আধা বাদ দিয়ে নিচের আধা দেখবে। অ্যাঙ্গলটা কিন্তু জমাটি। জন্মের এমন হাওয়া যে সব মাঠে মারা গেল। আমি আঙুল বুলিয়ে আদর করে দিলাম ওকে, বললাম, “এই নে, আমি জোরে জোরে পড়ছি, মন দিয়ে শোন্‌ এবার!”

এই আমি লোকটার নাম ছিল পাঁচকড়ি দে। ওর পাড়ায় থাকতো এমন একটা লোকের থেকে জানতে পেরেছিলাম যে, শেষের দিকে ওকে নাকি কালো একটা চশমা পরে দেখা যেত, যাকে বলে অন্ধের চশমা। যারা ওকে কাছ থেকে দেখতে পেতো, তারা বলেছে, চশমার কাচের নিচে ও দুই চোখেই ঠুলি পরতো। ঐসব কাছের লোকেরা বলতো, পাঁচকড়ি লোকটা আস্ত পাগল! ও নাকি অপারেশন করিয়ে নিজের শরীরের মাংস কেটে ঐ দুটো ঠুলি বানিয়েছে!


অচিন্ত্য দাস

লুডো


বিকেল আর সন্ধ্যের ফাঁকটাতে পাঁচ বছরের খোকন তার সাত বছরের দিদির হাত ধরে পার্ক থেকে খেলাধুলো সেরে বাড়ি আসে। এসেই দুজন চলে যায় দোতলায়, বড়দাদুর ঘরে। মেঝেতে বসে লুডো খেলা শুরু হয়।

- আমি লাল নেবো, দিদি রোজ লাল নেয়!

- ল্যাল নে নে নে... বো –- ভাইকে ভেঙিয়ে দিদি বলল -- নে লাল নে, তুই ঠিক হারবি।

খোকন চাল দিল। পুট। এবার দিদি। ছক্কা ছক্কা পাঁচ –- দুটো ঘুঁটি বেরিয়ে গেল, এগিয়েও গেল খানিকটা। খোকনের পড়ল তিন। দিদির পড়ল ছক্কা চার। খোকন অস্থির হয়ে উঠছে, তার চারটে ঘুঁটিই ঘরে। দিদির আর একটা ছক্কা পড়তেই, খোকন রেগেমেগে সব তছনছ করে দিল। বড়দাদু খোকনকে কোলে নিয়ে বললেন, এটা কী হলো, ছক্কা পড়েনি তো কী হয়েছে...

- হেরে যাচ্ছি যে।... খোকনের কান্না এসে গেল।

- হারলে তো হারলে, তাতে কী, কালকে তো আবার খেলা হবে। বড়দাদুর কথায় চোখ মুছে খোকন বলল, সাপলুডো খেলব। সাপলুডোতে কিন্তু দেখা গেল, খোকন দিদিকে প্রায় হারিয়ে দিচ্ছে। খোকন আশি-নব্বই এর লাইনে, আর দিদি বারবার সাপের মুখে পড়ে একেবারে নিচে। দিদির মেজাজ গরম, খোকন গুনতে একটা ভুল করেছে, ব্যাস, দিদি এক চাঁটা মারল তাকে। খোকন জোর করে ঘুঁটিটা একশ পার করে দিয়ে বলল, আমি জিতেছি।

বড়দাদু খেলা বন্ধ করে দিয়ে বললেন –- লুডো খেলা শেখোনি তোমরা। ছক্কা না পড়লে বা ঘুঁটি কেটে গেলে কাঁদবে না। সব সময় মজা করে খেলবে। আজকে হারলে কী, কাল তো জিত হতে পারে... চলো এবার আমিও খেলব...

খেলা অবশ্য আর হলো না। নিচে থেকে ‘ঝঙ্কার’ উঠল। ছোটবৌ, মানে খোকনের মা’র গলা। -- রোজ রোজ ভর সন্ধ্যেবেলা লুডো খেলা! একটু শিক্ষেটিক্ষে তো দিতে পারে, ঘরভর্তি বই...

বড়দাদু খোকনের বাবার জ্যাঠামশায়। আশ্রিত মানুষ। জমানো টাকা নেই, তাই নির্ভরও করতে হয়। শুনে তো যেতেই হবে! খোকনরা হাওয়া বুঝে ততক্ষণ নিচে চলে গেছে।

বড়দাদু বিড়বিড় করে বলছিলেন –- শিক্ষের তুমি কী বোঝ, ছোটবৌমা! লুডোর বোর্ডটা বইয়ের তাকে রেখে নিশ্বাস ফেলে বললেন –- এটার মধ্যে জীবনের যা শিক্ষে আছে, তা ঘর‌ভর্তি বই-এ পাওয়া যায় না, সেটা বোঝ কি...




সোনালি বেগম

মায়াজাল


লাল লাল গোলাপ হাতে শ্যামল সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ে, কলেজে নয়, উল্টোপথে। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি, প্রেমনিবেদন দিবস ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’। রোমানদের ভালোবাসার দেবতা কিউপিড তীর-ধনুক হাতে কানে ফিসফিস করে, ‘চন্দ্রিমা তোমার ভ্যালেনটাইন নয়, শ্যামল’।
শ্যামল চমকে ওঠে, ‘হতেই পারে না’ -- নিজেকে সামাল দিতে থাকে সে। অসংখ্য যুবক যুবতী নাচছে, জেগে উঠছে ইন্দিরাপুরমের স্বর্ণ জয়ন্তী পার্ক -- লাল গোলাপের পাপড়ি, আবীর আর গান... ‘তোমার ভ্যালেনটাইন’ লিখে সন্ত ভ্যালেনটাইন প্রেমনিবেদন করেছিলেন তাঁর প্রেমিকাকে, সেই ২৬৯ সালে এবং তৎকালীন ইতালির রোমান সম্রাট সন্ত ভ্যালেনটাইনকে ১৪ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করেছিলেন। ৪৯৬ সালে তাঁর স্মরণে প্রথম ‘ভ্যালেনটাইন্স ডে’ শুরু হয়।
প্রাচীনকালে ভারতে ঝলমল শারদ পূর্ণিমার রাতে কৌমুদী মহোৎসব পালিত হতো। এই অনুরাগ উৎসবে সুসজ্জিত যুবক, যুবতী, দম্পতি, বন্ধু পরস্পরকে ‘ভাবয়ামি’ ‘পরিভাবয়ামি’ -- ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ জ্ঞাপন করতো।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে শ্যামল মোবাইলে কল্ করলো চন্দ্রিমাকে, কিন্তু এনগেজড্ টোন... কোনোদিনই চন্দ্রিমাকে ফোনে ধরা গেল না! ও ভাবলো, অন্তত আজ চন্দ্রিমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে। শুধু ফেসবুকেই আলাপ ও অন্তরঙ্গতা। চন্দ্রিমার প্রোফাইল পিকচারে চাঁদ আর কভার ফটো অন্তহীন আকাশ।

শ্যামল : আসছো তাহলে?
চন্দ্রিমা : ও. কে.
শ্যামল : শোনো, আমি নীল জিনস্ লাল শার্ট পরবো
চন্দ্রিমা : আমিও
শ্যামল : হাতে থাকবে একগুছ তরতাজা লাল গোলাপ
চন্দ্রিমা : আমারও
শ্যামল : সুইস্ চকোলেট হার্ট শেপেড্
চন্দ্রিমা : আমারও
শ্যামল : স্বর্ণ জয়ন্তী পার্কের মেন গেটের ডানদিকে যে পাথরের বেদি রয়েছে, সেখানেই দাঁড়িয়ো, কেমন...
চন্দ্রিমা : তথাস্তু

পার্কের পূর্ব নির্দিষ্ট পাথরের বেদির কাছে দাঁড়িয়ে আছে একজন বছর তিরিশের সুঠাম পুরুষ। হাসতে হাসতে হাত বাড়িয়ে, ‘হাই শ্যামল, আই অ্যাম্ ইয়োর ভ্যালেনটাইন, চন্দ্রিমা, বাট্ মাই রিয়াল নেম্ ইজ্ চন্দ্রনাথ!’


পিনাকী সেন

হাওয়া-ভুক


লোকটা পাগলাটে, ক্ষয়াটে। উসকোখুসকো চুল-দাড়ি আর হলদেটে হাসি নিয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখছিল আমাদের। একটু দূরে বৌ’টা বরং গোছানো। শুকনো কাঠ-পাতা জ্বেলে হ্যান্ডিলিয়ামের তোবড়ানো হাঁড়িতে কিছু একটা ফোটাচ্ছিল। স্থির চোখে ফ্যানা গুনছিল।

রবিবারের মজলিশে আমরা ক’জন ধূমপায়ী তখন রাস্তার মোড়ে। খাদ্যসামগ্রীর সাম্প্রতিকতম আগুন-দাম নিয়েই আলোচনার সূচনা। ‘শালা জিনিস-পত্রের কী দাম বেড়েছে রে, হু হু করে মাল বেড়িয়ে যাচ্ছে। এবার কত ডি.এ বাড়ছে, কিছু শুনলি?’ ‘তোরা তো সব পোষ্যপুত্র, সাধারণ মানুষগুলো কী করে দিন কাটাচ্ছে একটু অন্তত ভাব।’, ‘সরকার তো চেষ্টা করছে, কন্ট্রোলে আলু চাল...’। ‘ঢপের চপ’। সমীরণের হাত থেকে পোটেটো চিপ্‌সের প্যাকেটটা ছিনিয়ে নিল অনুপম। ‘বিশ্ব জুড়ে মন্দা... ইকোনমিক সাইকেল’। ‘যত সব চোর চোট্টা’। আমাদের মন্তব্যগুলোর মতো চিপ্‌সের প্যাকেটটাও অনেকক্ষণ ধরে হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিল এ হাত থেকে ও হাত। কেউই কব্জা করতে পারছিলাম না। এবার আবার আমার হাতে। লুফে নিলাম গাঢ় নীল রঙ। রঙচঙে ভাবনা। হলুদে বড় বড় লেটারিং। ফ্লেক্সিবেল। যেদিক দিয়েই ধরতে যাই, অন্যদিক ফেঁপে উঠে।

লোকটা এগিয়ে এলো, হাতের তালুতে বিড়ি ঠুকতে ঠুকতে বললে, ‘একটু আগুন হবে?’ সদ্য দু’এক টান দেওয়া ফিল্টার উইলস্‌টা বাড়িয়ে দিলাম। হাতের বিড়িটা দিব্যি কানের গোঁড়ায় গুঁজে রেখে সিগারেটটাই মুখে দিয়ে দিল লোকটা। হাঁটু মুড়ে বসে এমন মৌজ-টান দেওয়া শুরু করল যেন অমৃত গিলছে। রাগে বিরক্তিতে ঠোঁটের ডগায় চলে আসা খিস্তিগুলো তুলে ঝাড়তে যাব, ঠিক তখনই, ‘এই নিন ব্লেড’। যত্ন করে কাগজে মোড়া আধখানা ব্লেড আমাদের দিকে এগিয়ে দিল লোকটা। আলতো করে ব্লেডটা চালিয়ে দিতেই চিপ্‌সের মোড়কটা ফাঁসল। এক দঙ্গল হাওয়া ভক্‌ করে বেড়িয়ে গেলে ,নিচের কোণে একটুখানি পোটেটো। এত বড় প্যাকেটটা শুধু হাওয়া গুঁজে চালিয়ে দিয়েছে!

‘ঠোঙা যেমন হাওয়ায় ভরো, খিদে পেলে খাও বিড়ি। জুটলে খাওয়া মুখশুদ্ধি, মুখ দিয়েছেন হরি’।

হাসতে হাসতে ফুঁকতে ফুঁকতে সে বলে চলল, ‘বৌটার জন্য শুধু কষ্ট হয়, বড় প্যান প্যান করে, বিড়ি খাওয়া শিখতে পারল না এখনও। কী করে বুঝাই, বিড়ির এখনও তেমন দাম বাড়ে নি’।

পরে একা একা অনেক ভেবেছি, লেখক হলে, ‘চিপ্‌সের প্যাকেট আর আধপেটা পেট’ -- এই শিরোনামে কী দারুণই না একটা কবিতা বা গল্প হতে পারত...


অরুণাভ ঘোষ

অলিখিত


যা খুশি তাই লিখবে বলে আদিত্য বসেছিল তার টেবিলে। কাগজ কলম নিয়ে। সন্ধ্যাবেলা ঘরের সব আলো নিভিয়ে শুধু টেবিল ল্যাম্পটা জ্বেলে দিয়েছিল। সাদা কাগজের উপরে রাখা কলম। এদিক থেকে গড়িয়ে দিলে ওদিকে যায়। ওদিক থেকে গড়িয়ে দিলে এদিকে আসে। কাগজটাকে খুব উজ্জ্বল লাগে টেবিল ল্যাম্পের জোরালো আলোয়।

আঙুল দিয়ে কলমটাকে কাগজের উপরে ধরলে দারুণ ছায়া পড়ে। কিছুক্ষণ ছায়া দিয়ে ছবি বানায় আদিত্য। তারপরে আবার চুপ করে সাদা কাগজের দিকে তাকিয়ে থাকে। বাংলা আর ইংরাজী বর্ণমালার প্রচুর অক্ষর তাদের আগের আর পরের যতিচিহ্ন সমেত খেলা করে যায় কাগজের উপরে। আদিত্যর মনে হয়, এগুলো সব ঐ কলমের নিব থেকে বেরোবার জন্য অপেক্ষায় বসে। সীমিত অক্ষর, যতিচিহ্ন দিয়ে আরো সীমায়িত। তবু সীমাহীন শব্দ। কথা শেষ হয়ে গেলেও আরো কত শব্দ পড়ে থাকে? আদিত্য ভাবতে থাকে। Words with their heavy body of meanings...

আদিত্যর গল্প লিখতে ইচ্ছে করে। সুদর্শনার জীবনের একটি সকাল নিয়ে। একটি সকাল, যখন সে আদিত্যর সঙ্গে দেখা করার জন্য খুব ভোর থেকে প্রস্তুতি নিয়েছিল। একটি সকাল, যখন সে সব প্রতিবন্ধকতা অস্বীকার করে এসে দাঁড়িয়েছিল ইউনিভার্সিটির গেটে। একটি সকাল, যেদিন আদিত্য পৌঁছতে পারেনি।

হঠাৎ কাগজটাকে খুব ছোট মনে হয় আদিত্যর। কলমটাকে খুব কৃপণ। সব কথাতেই যতিচিহ্ন লাগে কি? কাগজটার প্রতি কেমন যেন একটা করুণা হয় তার। টেবিল ল্যাম্প নিভিয়ে ঘরের অন্য আলোগুলো জ্বালিয়ে দেয় সে। কাগজটাকে খুব যত্নে ভাঁজ করে। তারপর সেটাকে জানালা গলিয়ে ফেলে দেয়। অক্ষম অকিঞ্চিৎকর কাগজ আর কোনোদিন দরকার হবে না বলে মনে হয় তার!


রিমি দে

ফুল কিংবা অফুল


এই যে প্রবল শীতকালটা গেল, তাতে একটা ফুল ক্রমশ আমার কাছে চলে এসেছিল। ফুলটি ফুলের মতো অথচ প্রকৃত ফুলও বলা চলে না। বৃতি সবুজের বদলে নীল। আর পাপড়িগুলো এমন গুটিসুটি মেরে বসে থাকে যে, ওর ঠোঁট থেকে কেমন যেন একটা আহ্লাদের হাসি বেরিয়ে আসে। এমন একটা ভাব, যেন কাজল কাজল চোখ নিয়ে আমার দিকে দু’হাত বাড়ায়। অদ্ভুত রঙ ওর বুক জুড়ে। চোখের নিচে কালো তিল। ধূসর দু’গালে রঙের গভীরতা। গোধূলির চোরা টান চাহনিতে। শরীরের রঙ এমন, ঠিক বর্ণহীন যেন! তার নাম ফুল কিংবা অফুল।

আমি মহম্মদ ইকতারা। সব সময়ে কিসের অন্বেষণে! কী যেন তাড়া করে। ভেতরে এক অস্থিরতা। এ তাড়না পশ্চিমের ঝঞ্ঝার মতো। প্রভাব সুদূর প্রসারিত। পৃথিবীর কোন্‌ প্রান্তে কী ঘটছে, তার ভোগান্তি ভারতবর্ষে, উত্তর পূর্বাঞ্চলে।

এসব কথা ভাবতে ভাবতে আমার আজকাল আর পরীক্ষা দিতে ভালো লাগে না। গোসল করতে ইচ্ছে করে না। মনটা নড়চড় করে খুব। রোজ নামাজ পড়ি না। তবে রাতের দিকে, কোরাণ যখন পড়ি, পাশাপাশি বাইবেল আর গীতাও রাখি। সন্ধের পর দু’এক কুচি আপেলের টুকরো মুখে পড়লেই ফুল বা অফুলটি আমার মাথার চারদিকে ভনভন করে। মশার মতো নয়, ভ্রমরের মতো! ফুলের সঙ্গে ভ্রমরের সম্পর্ক ওতপ্রোত। কিন্তু অফুল! সেটা আবার কী? ফুল অথচ ফুল নয়!

কাগজের ফুল? যাঃ, তা আবার হয় নাকি? কেন হবে না? বুকের ভেতরে কাঠঠোকরার কামড়! হয় না বুঝি? রক্তজবাও তো মাঝে মাঝে ঘাড়ের ভেতর চুপ করে বসে মজা দ্যাখে। তখন আজান পড়ে। ফুল কিংবা অফুলটি নেচে ওঠে। গোটা শরীর জুড়ে!

ঊর্মি খান

গন্তব্য


ঠিক এইরকম ভোরেই সে আত্মহত্যা করেছিল। আমার বাস তখন হাইওয়ে ধরে ছুটছে...আমিও ছুটছি...

চোখে তখন ঘুম কুমারের আসা-যাওয়া। সেলফোন বেজে বেজে কখন বন্ধ হয়েছিল জানি না। ঘুম কুমার আমাকে যখন ছেড়ে গেল, তখন সূর্যটা অনেকটাই মাথার ওপর। বাসস্ট্যান্ডে কোলাহল, লোকে লোকারণ্য। আমি তখনো জানি না তার আত্মমৃত্যুর খবর। বাসটা কোন্ এক অজানা স্ট্যান্ডে থেমে আছে, বুঝতে পারছি না। বাইরে তাকালে যে কোনো সাইনবোর্ড দেখে কিংবা কাউকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই জানা যাবে। কিন্তু ইচ্ছে করছে না। মাথাটা ঝিমঝিম করছে খুব। সেলফোনে চার্জ নেই। সময় কত হলো কে জানে! চোখটা একটু খুলে দেখলাম, পাশে বসা লোকটি আয়েশ করে পান খাচ্ছে। জর্দার তীব্র গন্ধটা নাকের সামনে ধাক্কা দিচ্ছে অনবরত। নাহ... আর চুপচাপ থাকা যাচ্ছে না। একটু নড়ে চড়ে বসতেই লোকটি বলল, ''পান খাবেন আফা?'' ''না। থ্যাঙ্ক ইউ।'' এই প্রথম এক বিরক্তিকর যাত্রী আমার পাশে বসে যাচ্ছে। যতই সরে যাচ্ছি, সে রীতিমতো আমার দিকে চেপে বসার চেষ্টা করছে। বার দুই বলা স্বত্ত্বেও আবার একই কাজ করছে। এভাবে হবে না... কথা বলা শুরু করলাম। ''ভাই সাহেব কী কাজ করেন?'' ''আমি এঞ্জিনিয়ার''। বেশ অবাক হলাম।'' কী ইঞ্জিনিয়ার?'' বিস্তৃত হাসি দিয়ে সে বলল ''এই ধরেন গিয়া তালা-চাবি ঠিকঠাক করি আর কী!'' '' বাহ, বেশ ভালো কাজ।'' কথা আর বাড়ালাম না। একটু বমি বমি ভাব হচ্ছে। জানালায় মুখ বাড়িয়ে দু'বার গল গল করে বমি করলাম। শেষবার যেই না বমিটুকু ফেলতে যাব, দেখি কয়েকটা হকার এটা-ওটা সেধেই চলেছে। কোনো রকমে হাত দিয়ে মুখটা চেপে ধরে রাখলাম। ওরা সরে যেতেই ফেলে দিয়ে স্বস্তি মিলল। ছোটবেলায় বাসে বমি হতো। আজ হঠাৎ কেন যে হলো...!

''আফা পান খান। ভালা লাগব।'' আমি জর্দা ফেলে দিয়ে পান চিবুতে লাগলাম। ঝালে জিভ পুরে যাওয়ার অবস্থা। তারপরও ভালো লাগল খেতে। বাস আবারও চলছে। ঘুম পাচ্ছে খুব। আমি জানতেই পারলাম না, সে নেই!

শরীরের তীব্র আকর্ষণ আমাদের দুজনার আদিম খেলাকে পূর্ণতা দিয়েছে বহুবার। তাকে হারিয়ে ফেললাম একদিন নিজের ভুলেই। হঠাৎ একদিন অনুভব করলাম, শরীরের ভেতর নতুন এক মানব স্বত্ত্বার আগমন তীব্রভাবে জানান দিচ্ছে। এখন যে তাকে খুঁজে পেতেই হবে! অনাগত ভ্রুণ আমাকে যখন আনন্দময় আঘাত করে চলেছে, যখন তাকে খুঁজতে খুঁজতে সেদিন যখন অচেনা বাসস্ট্যান্ডে নেমে তার গন্তব্যের ঠিকানায় নিজের গন্তব্য রচনা করতে গেলাম...; অচেনা উঠোন পেরিয়ে অচেনা দরজায় কড়া নাড়ার আগের মুহূর্তেও আমি জানতে পারি নি, সে নেই! কেন, কি কারণে মৃত্যুর স্বাদ নিল সে, জানা হলো না আমার! মাঝে মাঝে উদাস হয়ে শুধু বলত --''ঈশ্বর বলেছেন, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন, মৃত্যু খুব সহজ।''

আজ আবার সেইরকম একটি ভোর। দ্রুত বেড়ে উঠছে ভ্রুণ। আমি আবারও ছুটছি... হাইওয়ে ধরে বাস ছুটছে তীব্র গতিতে। পাশের সিট ফাঁকা। ঘুমকুমার পালিয়েছে সেদিনই।

আজ কারো মৃত্যু আমাকে তাড়িত করছে না। আজ আমার মৃত্যু স্বয়ং আমাকে গন্তব্যে নিয়ে চলেছে...

পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে কঠিন, মৃত্যু খুব সহজ!

দেবযানী বসু

খোয়াবি


‘অল্প ভালোবাসার কোনো বিকল্প নেই। আমি কী করে জানাবো বল, জানালেই তুমি আরেকজনের হয়ে যাচ্ছ। এসব দেখতে দেখতে আমাকে চাঁদের খই খেয়ে মুখ তেতো করে হট্টমালার মালা পরে যাদুকরী মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। ওটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়’। গোলাপি নাইটি পরে নিতে নিতে জেব্রানী ঝগড়া করছিলো জেব্রা দাগের উপর দাঁড়িয়ে।

ওখানেই ঘর সংসার। মেট্রো ডেয়ারীর প্যাকেটে প্যাকেটে গোলপাতার ঘর। ফুসফুস থেকে ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ছে জ্বরের কথা। জ্বরের স্বপ্ন। ট্রেন চলতে চলতে মনে হয়েছিল ফলের গাছগুলো মা, আর ফুলের গাছগুলো মাসি । পাঙাশ মাছের স্বেচ্ছাচারিতা ড্রেনের জলে গুলে যাচ্ছিল। মা কালীর ফটো ঋতুতে ঋতুতে দেওয়াল বদল করে। তবু দেওয়ালের খেয়ালিতে একছড়া সিটি গোল্ডের হার জীবনে সে পেয়েছিল। ট্রেনের কামরায় মদ ও মৈথুন ফ্ল্যাশব্যাক করছে বারবার। একটা সময় মনে হয়েছিল, পরের স্টপেজে নেমে ফিরে যাওয়া ভালো। একরাশ তেতো স্মৃতি অক্টোপাসটা ছুঁড়ে দিল মিলিয়ে যাবার আগে। স্বস্তি কথাটার মানে কেঁচোর একদলা গুয়ের মতো মাটির উপরে যেন ঘর গড়ে তোলা। দি বস্তী একটু একটু করে চাঁদের মাটি ব্যাংকে জমিয়েছে। মায় যৌতুকটুকু পর্যন্ত। আর সেভাবেই আভা ও আভাস মিলে দ্বিতল বাড়ি।

আমি কী অন্য রকম হয়ে যাচ্ছি! দীঘার সাগর জলে আমার কাঁপা কাঁপা ছায়া আর পড়ে না। জলের ভিতর আমি শুয়ে নেই। মদ খেয়েও বা না খেয়েও তুমি আর আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। এই একবছরে আমি হারিয়ে গেছি।

আসলে খুব হাসার সুযোগ করে দিয়ে এক পশলা বৃষ্টি ঝগড়া শেষ দেখার কৌতূহলে ঝরে পড়ল। ওখানে অনেক মদ অপ্রয়োজনীয় সমুদ্রের নুনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল। জল বগলে চেপে জেব্রানী জামাকাপড় বদলায়। রাজ্যের মাওবাদী গল্প ঘুরে জেব্রার অনেক সময় লেগেছিল সমুদ্রকে ড্রেন ভাবার ভুলটি ভাঙাতে।




স্বপন রায়

বাবা


পা ঝুলিয়ে বসে আছে। বাবা আর বাবার বন্ধু।

ফ্লাইওভার, নতুন। বাবা এই ফ্লাইওভারের প্রথম ক্যাসুয়ালটি। পেছন থেকে সুমোর ধাক্কা। বাবা এবং বাবার স্কুটার চূর্ণ বিচূর্ণ । বাবা বন্ধুকে বললো, তোর কেসটা ঠিক আছে! হার্ট ফেল, আমারটা ভাব!

বন্ধু বললো, খুব যন্ত্রণা হলো, খুব... তারপর কেমন হাল্কা হয়ে গেলাম...

নিচে পুরী এক্সপ্রেস যাচ্ছে।

বন্ধু -- তোর হনিমুন তো পুরীতে?

বাবা -- হ্যাঁ, সে কী বৃষ্টিরে! কোথাও বেরোতে পারি না

বন্ধু -- বেরোবার কী আছে? একটা গান ছিলো না, হম তুম এক কম্‌রে মে বন্ধ হো... গেয়েছিলিস?

বাবা হাসে। মাথার ওপর পার্থিব চাঁদ। আর একটা গান, ও চাঁদ, সামলে রেখো জোছনাকে... এটা হিট হয়েছিলো। ছেলে অভি যখন সম্ভাবিত... বাবা প্রায় সব সময় গাইতো, ও চাঁদ... আর এভাবেই অভির ডাক নাম হয়ে গেলো চাঁদু!

চাঁদু এখন অধ্যাপক। কলেজে পড়ায়। চাঁদু বিয়েও করেছে। ওর বৌ স্কুলে। চাঁদুর মা যূঁইকে হ্যাটা করে না। মা বলে ডাকে। একসাথে মলে যায়। মাল্টিপ্লেক্সেও। চাঁদু বরাবরের আলাভোলা! বাবা ভাবে, দুঃখ পায়। চাঁদুর বিয়ের আগেই সুমোর ধাক্কায় ওর... সেই থেকে সুমো দেখলেই এই অপার্থিব শরীরেও অস্বস্তি হয়...

বাবা আর বাবার বন্ধু নিচে তাকিয়ে রেললাইন দেখে। আলো লাইনের ওপর পিছলে যাচ্ছে! বন্ধু বলে, চল ও দিকটায় যাই... ও দিকে মানে বাজার... আলুর দাম এখন ১৬ টাকা... কী হবে এই দেশের? এ সব বলতে বলতে ওরা ঘুরে দাঁড়ায়...

বন্ধু বলে, আরে ওই তো চাঁদু... বাইকে... বাবা ছেলেকে দেখে... কী সুন্দর লাগছে চাঁদুকে... আর তখনই বাবা দেখে, তুমুল গতিতে ছুটে আসছে একটা সুমো... চাঁদু দেখছে না... অন্যমনস্ক... নিশ্চয়ই গান গাইছে... সুমোটার স্পীড কমছে না... বাবা বন্ধুকে বলে, চাঁদুকে মেরে দেবে রে...

সুমোর ড্রাইভার ব্রেক ফেল করে চিৎকার করছিলো... ভয়ে... সামনে একটা বাইক। লোকটা সরছে না... পাগলের মতো হর্ন বাজাতে থাকে ড্রাইভার...

প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে সুমো হঠাৎ থেমে যায়... ড্রাইভার হতবাক... ঘামছে... এ কী হলো? কী ভাবে হলো?

বাবা দেখে, চাঁদু স্পীড তুলে চলে যাচ্ছে... ও জানে না কী হতে যাচ্ছিলো... চলে যাচ্ছে নিশ্চিন্তে চাঁদু... বাবা মনে মনে বলে, বেঁচে থাক...

আর বন্ধুকে বলে, আজ বদলা নিলাম... শালা শুয়োরের বাচ্চা সুমো...


সচীন


মধুমিতা মিত্র


ভূদেব ভকৎ


অভিষেক নন্দী


রোশনি ইসলাম


বীরেন্দ্র সিং




রঞ্জন চক্রবর্তী


দীপঙ্কর বসু