কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০২) অর্ক চট্টোপাধ্যায়

দৃশ্যপাঠ



একটা ছেলের গল্প। অথবা একটা লোকের। ছেলেটা সময়জোরে লোক হয়ে উঠেছিলো, কিন্তু লোক থেকে কী করে আবার ছেলে হওয়া যায়, বুঝে উঠতে পারছিলো না। তাই এই গল্প: একটা ছেলেলোকের গল্প, যে লোকছেলে হতে চাইছিলো।

আমাদের ছেলেলোক টেবিল চেয়ারে। দেখা যাচ্ছে। ওর চোখের সামনে টেবিলের ওপর একটা বই। ওর প্রিয় লেখকের। এবার আমরা ওই বইয়ের পাতায় ঢুকে পড়ব আর দেখবার চেষ্টা করব, শব্দের দিকে চেয়ে ও ঠিক কী ভাবছে! শব্দের ভেতর থেকে নজর থাকবে ওর মগজে। দেখে নেব, কী ছবি তৈরি হচ্ছে ওর মগজিয়া মজলিশে!



গ্রেস্কেইল:

ইউরোপীয় দৃশ্যপটে দীর্ঘ সরলরেখার মতো একটা বুলেভার্ড, বক্রতা পেয়েছে ক্রমশ। তার ভেতর দিয়ে হন্টনরত এক বৃদ্ধ। হাতে একটা লাঠি। পরনে ধূসর কোট-প্যান্ট। মাথাভর্তি খাড়াখাড়া ধপধপে চুল। মুখ দেখা যাবে না কোনোদিন। কারণ, ক্যামেরা একটাই, তাঁর পেছনে, স্ট্যাটিক। বুলেভার্ড ধরে এগিয়ে চলেছেন তিনি। ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে তাঁর হেঁটে যাওয়া, কিন্তু তাঁর মিলিয়ে যাওয়ার মধ্যে কোনো দ্রুতি নেই। ক্যামেরা জুম করছে বলে নয়, হাঁটার মৃদুমন্দ গতি দৃশ্যের মিলিয়ে যাওয়াকে আদিম এক মন্থরতা দিয়ে গেছে। বয়েসের ভারে গুটিয়ে আসা এই হাঁটার মধ্যে অঙ্গের শেষ সঞ্চালনসুখ ধরা দিচ্ছে।



ইস্টম্যানকালার:

ঘরে ফেরা। পরিচিত দেশজ দৃশ্য। ব্যস্ত হাসপাতালের মাঠ। রাজবাড়ির মতো। মাঠের কোণে জংধরা অকেজো একটা রোলার। রোলারের ওপর একটা বাচ্চা বসে রয়েছে। তাকে ধরে রয়েছেন যিনি, শুধু তাঁর হাতটা দেখা যাচ্ছে। তিনি বাচ্চাটির কে হন, তা কোনোদিনই জানা যাবে না, কারণ ক্যামেরার এই জুমটা স্ট্যাটিক। দৃশ্যের সম্প্রসারণ অসম্ভব হলেও হাতের যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে লোমের ইশারা বলছে পুরুষ, মহিলা নন। বাচ্চাটার মুখ অভিব্যক্তিহীন। কয়েক সেকেন্ড স্থির। তারপর হাতদুটো ওকে রোলার থেকে নিচে নামিয়ে দ্যায় সবুজ ঘাসের ওপর। ক্যামেরা ওকে ফলো করে, কিন্তু জুমের অদল বদল না হওয়ায় সহায়ককে দেখতে পাবার আশা মাঠেই মারা যায়। বাচ্চাটা সদ্য হাঁটতে শিখেছে মনে হয়। একপা দু’পা করে হাঁটে। দৃশ্যের বৃত্তের মধ্যে তার কোমর বরাবর পেছন পেছন হাতদুটোকে এখনো দেখা যায়। রক্ষণে উদ্যত হাতদুটো শরীরের পতনমুখরতা রুখতে চায়।

আমাদের ছেলেলোকটার প্রিয় লেখকের আজ মৃত্যুদিন। এই দিনটায় ও ওই চারটে বছরের কথা ভাবে, যখন পৃথিবীর দুই প্রান্তে ও এবং ওর প্রিয় লেখক হাঁটাহাঁটি করেছেন। দেশ আর ভাষা আলাদা হতে পারে, কিন্তু মাটি আর পা তো এক! সেই বয়েসে আমাদের এই ছেলেলোকটা ঐ লেখকের কোনো লেখা পড়েনি, এমনকি তার নামও শোনেনি। কিন্তু তাও প্রায়ই সে ওই চারটে বছরের কথা ভাবে। ভাবে ওর জীবনের প্রথম আর প্রিয় লেখকের জীবনের শেষ চারটে বছরের কথা। আকাশ পাতাল ভেবেও নিজের জীবনের প্রথম চারটে বছর নিয়ে ওর বিশেষ কিছুই মনে পড়ে না। যেটুকু মনে আসে, তা শুধুই অন্যের কথার মধ্য দিয়ে। বাবার বলা নানা কথা, মায়ের কথা, দাদু দিদার কথা। তার ছোটবেলা নিয়ে গুরুজনদের আসর জমানো নানা বাক্য মাথার ভেতর কিলবিলোতে থাকে। কথার লোক। কথার ছেলে। কথার শৈশব। কথা ঠিকরেই যেটুকু ছবি বেরিয়ে আসে। কথা পেরিয়ে যেতে পারে না ছবি আর তখনই বিরক্তি তৈরি হয়। ও কি সত্যিই ও ছিল, না অন্য কেউ? কথার আগে ছবি ছিলো, নাকি ছবির আগে কথা?

আজ প্রিয় লেখকের মৃত্যুদিনে তার একটা বই পড়তে পড়তে ও দেখতে পায়, কীভাবে ওর প্রথম চার বছরের ক্রমশ সহজ হয়ে যাওয়া হাঁটা মিলে যাচ্ছে ওর প্রিয় লেখকের শেষ চার বছরের ক্রমশ কঠিন হয়ে আসা হাঁটার সাথে। ওই সহজ আর কঠিন হাঁটাদুটো হাত ধরাধরি করে হেঁটে যাচ্ছে বুলেভার্ডের নাব্যতা ধরে। রাস্তার পাশে বেঞ্চের পেছনে রাখা রয়েছে জং ধরা অকেজো একটা রোলার। আর রোলারের ওপর রাখা রয়েছে চলচ্ছক্তিহীন ক্যামেরা।

শব্দের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে প্রশ্ন: এই ছবিগুলো ছেলেলোকটার মগজেই ছিলো তো, নাকি বইটার ভেতর? কে জানে!

বইছেলে। ছেলেবই। বইসময়। সময়বই। লোকছেলে। ছেলেলোক।






0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন