কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০৬) আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ


কবিতার শত্রু



কবিতার শত্রু কারা? মাঝে মাঝে ভাবি। দুই রকমের শত্রুর কথা ভাবা যায়। ১) সলিড টাচেবল বা বস্তু-শত্রু ২) ফর্মলেস আইডিয়াজ বা চিন্তা-শত্রু। অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, ভাষা-পণ্ডিত, কোর্পরেট ব্যবসায়ী, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, ছাত্রনেতা, জমির দালাল, পুলিশ, জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিক, ছন্দ যাদুকর, ছড়াকার, আবৃত্তিকার, পত্রিকার সম্পাদক, লাক্স সাবানের প্রযোজক (সুন্দরীরা নন অবশ্যই), ইত্যাদি ছাড়াও আরো ভীষণ লোকজন যারা ছায়ার মতো ঘোরে, যারা রঙ বদল করে সকাল বিকাল বিভিন্ন সমাজ সংগঠনে ঢুকে পড়ে, এমন কি যারা গান করে, গান দেখে, কালারফুল পাঞ্জাবি পায়জামা পরে, ঘন ঘন বিড়ি ফোঁকে, লম্বা চুল রাখে, কবি হওয়ার ভান করে -- এরা হলো সলিড টাচেবল বা বস্তু-শত্রু।

ফর্মলেস আইডিয়াজ বা চিন্তা-শত্রু আবার কারা? এই যে আমাদের চারদিকের সমাজ, সংসার তার ভেতরে বেড়ে ওঠা আমাদের চিন্তা ভাবনা, আমাদের ভাষা, আমাদের সংস্কার, বিশ্বাস এইসব হলো ফর্মলেস আইডিয়াজ বা চিন্তা-শত্রু। চিন্তা-শত্রু কেন? কারণ এগুলো শুধুমাত্র এমন একটি সামাজিক মূল্যবোধকে গড়ে তোলে যার প্রথম ও প্রধান কাজ হলো - যে কোনো কিছুর ব্যবহার-মূল্য আবিষ্কার করা। বস্তু বা চিন্তার মূল্য তাদের সামাজিক চাওয়া পাওয়ার সাথে এক না হলে সেই বস্তু বা চিন্তাকে তারা গ্রহণ করে না।

সৃষ্টির প্রাথমিক পর্যায় থেকে আজ পর্যন্ত মানব সভ্যতার ইতিহাস হলো বস্তুবাদী আর ভোগবাদী মানুষের ইতিহাস। অধিকাংশ মানুষই ডিপ ইন্ট্যুইশন থেকে আগত ব্যবহারিক মূল্যহীন শুধুমাত্র ‘সৌন্দর্যমূল্য’-এর চেয়ে বস্তু বা চিন্তার শ্যালো ইন্টারপ্রিটেশনকে বেশি মূল্য দেয়। কবিতা কবির বোধ আর চিন্তাকে ভাষার মাধ্যমে এমন একটি শিল্পকাজে পরিণত করে যে, এখানে মানুষের দৈন্দিন ব্যবহারিক মূল্য নির্ধারণতা - একটি অসাড় কাজ বলে পরিণত হয়। তাই তারা কবিতা নামক ভাব বা বাষ্পকে পারলে পুড়িয়ে মারে। এই যে দীর্ঘ দিন ধরে আমাদের কাছে থাকা চারদিকের প্রতিষ্ঠিত প্রায় স্বাভাবিক সামাজিক মূল্য ‘বিচারক্ষেত্র’ সেখানে কবিতার মতো একটি ‘সৌন্দর্যমূল্য’ জড়িত ভাষাকাজ, যা আবার সামাজিক ব্যবহারিকভাবে অকেজো -- তার কি যে অসহায় অবস্থা, তা আন্দাজ করতে কারো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

একজন বাস্তববুদ্ধির মানুষ কবিতার শত্রু হয় বা কবিতাকে সমাজের অন্যান্য মূল্যবান কাজ থেকে দূরে রাখে, কারণ কবিতা দিয়ে তার কিছুই হয় না। মানে তার কাছে এটির কোনো অর্থনৈতিক মূল্য নেই। তাই কবিতার পাঠক সর্বকালেই বিরল। কারণ কবিতার কাজ এমন একটি ভাষাকে নিয়ে যেখানে বস্তু বা বস্তুরহিত এক অমোঘ রসচেতনা - সুন্দর বা অসুন্দর যাই হোক - তা প্রকাশ পায়। সেখানে অর্থনীতির প্রবেশ নিষিদ্ধ। কবিতা ভাব আর ভাষার কাজ। অনেক সাবজেক্টই তো ভাষার কাজ। কিন্তু সেগুলো সমাজ সংসারকে, রাষ্ট্রকে একটি মূল্য দেয় ও মূল্য নেয়। কবিতার ভাষা কাউকে মূল্য দেয় না, নিজেও মূল্য নেয় না। যা করে সেটি হলো একটি বিশেষ ভাষার হাত ধরে সে আপনা আপনি কোথাও জেগে ওঠে। এই যে কোথাও জাগে, তার ধ্বনি একজনই শুধু শুনতে পায় - সে হলো কবি।


আমার বিবেচনা:

১) কবিতার পাঠক কোনোদিনই বেশি ছিল না। টুথ পেস্টের অ্যাড বা ফাংকি গাড়ির উপরে বসে থাকা নগ্ন নারীর ছবি/ওয়েব-পাতা নিয়ে আম-পাঠকদের মনে যে রকম হালকা আনন্দ-প্রতিক্রিয়া হয়, তার সাথে কবিতার আয়োজন/ওয়েব পাতার পাঠকের বিশুদ্ধ আনন্দ প্রতিক্রিয়ার বিষয়টিকে এক করে দেখার উপায় নেই।

২) কবিতা লেখা যেমন আপনা-আপনি ব্যাপার, তেমনি কবিতা পাঠ করাও আপনা আপনি। এখানে জোরাজুরির কোনো অবকাশ নেই। কবির আচ্ছন্নতা তার নির্ভেজাল সমর্পণ-শক্তির উপর ভর করে কবিতার জন্ম। কবি-ব্যক্তি বিশেষে তার তারতম্য ঘটে। তাই কারো কবিতা লেখা না লেখার উপর বিবেচনা করে বলা যায় না কবিতার কোনো ভবিষ্যৎ নেই।

৩) ধনী/গরীব, নজরুল/রবীন্দ্র, হিন্দু/মুসলমান, আমেরিকা/রাশিয়া, দেশি/বিদেশি ইত্যাদি বাইনারি চিন্তাধারাকে ঠাঁই দিয়ে বা বাদ দিয়ে কবিতার সৃষ্টি ঘটে না। কবিতা কোনো ধরনের শতের্র অধীন নয়, কবিতা স্বয়ংপ্রকাশ। তাই ভালো কবিতার দেখা না পাওয়া মানে ভাবতে হবে - ভালো কবিতা হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে।

৪) কবিতা দিয়ে মানুষের শুভবোধ সৃষ্টি করা যায় না, যুদ্ধও হয় না। শুভবোধ, ভালোমন্দ বিচারবোধ মানুষ পায় পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে। কবিতা শুধুমাত্র পাঠকের বিস্ময়বোধকে আবারো বিস্ময়ে ভরে দিতে পারে। তাকে দিতে পারে নতুন একটি জন্মলাভের অভিজ্ঞতা।

৫) খুন, রাহাজানি, ছিনতাই বদ-রাজনীতি ইত্যাদি সময় আর সমাজের গহ্বর থেকে আসে। অপরদিকে কবিতা সরাসরি সমাজের বাই-প্রডাক্ট নয়, এটি একটি প্রতিভা আর ভাষার উত্তরাধিকারের যৌথ কারবার।

৬) ভালো কবিতা আর মন্দ কবিতার মধ্যে ফারাক করার যে স্বাভাবিক জ্ঞানবোধ, তা অনেক কবি-বোদ্ধা ও সমালোচকের মধ্যে নেই। থাকলেও তারা কূটচাল আর সুবিধাবাদিতার কাছে নিজেদেরকে বিক্রি করে দিয়েছে। সম্প্রতি বাংলা একাডেমী কর্তৃক বাছ বিচারহীন কবিতা সংকলন প্রকাশ করার কাজটি এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। সাথে আরো পত্র পত্রিকা(অনলাইন সহ) আছে। মাঝে মাঝে এমন সব কবিতা সম্পাদকেরা ছাপায়, তা পড়ে নিজের কাছেই লজ্জা লাগে। তাই ভালো কবিতার পাঠক সৃষ্টি হবে কীভাবে? নতুন কবিরাও নতুন পথটিকে চিনবে কীভাবে?

৮) মানুষের চিন্তাবোধ, জ্ঞান কাঠামোতে অনেক পরিবর্তন আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের কবিতা, কিছু হাতেগোনা ব্যতিক্রম বাদে, এখনো প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির আবহ, আর রবীন্দ্র, জীবনানন্দীয় লিরিক্যাল, মধুর ভাষায় সয়লাব। দরকার নতুন চিন্তা আর নতুন ভাষা।

৯) যে কবিতা লিখবে সে যে কোনো মূল্যেই লিখবে। তার কাছে কবিতা লেখা প্রায় একটি রেলিজিয়াস কাজ। লেখাটি তার কাজ নয়, তার আনন্দ। এটি না করলে সে বাঁচবে না। তেমনিভাবে যে কবিতা পড়বে, সে যে কোনো মূল্যেই তা পড়বে।

১০) গ্রুপ করে বা আয়োজন করে কবিতার উপর আলাপ আলোচনা রেখে কবিতার সৃষ্টি হয় না। কবিতার প্রথম ও প্রধান শর্ত একা হয়ে যাওয়া, আপনাতে বিলীন হয়ে যাওয়া। বোধ আর ভাষার উত্তরাধিকারের হাত ধরে আর একটি নতুন উপলদ্ধির দিকে যাওয়া।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন