কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

১) সমীর রায়চৌধুরী ও নাসের হোসেন


কালিমাটি পত্রিকার ১০০


ঝাড়খন্ডের ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ১০০তম সংখ্যাটির আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হলো গত ২২শে ডিসেম্বর। কলকাতায় কলেজ স্কোয়ারের অদূরে মহাবোধি সোসাইটি হলে। কাজল সেন সম্পাদিত এই সাহিত্যের পত্রিকাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। জামশেদপুরের পূর্বনাম কালিমাটি। এখানকার মাটিতে কয়লা, লোহা ইত্যাদি পাওয়া যায়। সে কারণেই হয়তো স্থানীয় নাম এর কালিমাটি। জামশেদজী টাটার আগমনে জায়গাটির নাম বদল ঘটে, একথাও সকলেই জানেন।

কাজল সেন এই ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে ও যত্নের সঙ্গে একটানা ৩৫ বছর ধরে বের করে চলেছেন, এই কাজকে অসাধ্যসাধন ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে জানি না। কাজল নিজে পড়ুয়া মানুষ, কবিতা গল্প ও নিবন্ধ লেখেন, এই পত্রিকায় লিখতে উদ্বুদ্ধ করেন পৃথিবীর যেখানে যত বাঙালি আছেন তাদের সবাইকে। বিভিন্ন পত্রিকাকে কেন্দ্র করে নানান সাহিত্যিক গোষ্ঠী তৈরি হয় ও হয়েছে, এ তো আমাদের জানা এবং চোখে দেখা। কিন্তু মজার ব্যাপার এবং আশার কথা এই যে, কাজল সম্পাদিত এই পত্রিকাটি কোনো গোষ্ঠী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেনি, বা কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকেই গোষ্ঠী হিসেবে তোল্লাই দেয়নি। ‘কালিমাটি’ পত্রিকার যে-কোনো সংখ্যা হাতে নিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন ধারার লেখকদের কবিতা গল্প নিবন্ধ এতে স্থান পেয়েছে, পাশাপাশি যাঁরা কোনো ধারারই নন, কিংবা একক অভিলাষে লিখে চলেছেন, তাঁদের লেখাও গুরুত্ব দিয়ে ছাপা হয়েছে, পরিবেশিত হয়েছে।



‘কালিমাটি’ ১০০ সংখ্যার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘটে সমীর রায়চৌধুরীর হাতে, মলাট উন্মোচন ঘটিয়ে উপস্থিত সকলকে সেটি প্রদর্শন করেন তিনি। মঞ্চে আরও যাঁরা বিশেষ অতিথি রূপে ছিলেন, তাঁরাও ‘কালিমাটি’ ১০০ সংখ্যার পৃথক-পৃথক কপি হাতে নিয়ে প্রদর্শন করেন -- মঞ্চে ছিলেন সাধন চট্টোপাধ্যায়, প্রভাতরঞ্জন রায় এবং নাসের হোসেন। অনুষ্ঠানে ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটি সকলের হাতে হাতে পৌঁছে দিলেন সম্পাদক কাজল। প্রভাতবাবু রচিত ‘বঙ্গভাষা সাহিত্যের বিশ্বপরিচয়’ পুস্তিকাখানি সকলের হাতে পৌঁছে দিলেন নাসের। প্রভাতরঞ্জন তাঁর পুস্তিকায় বলতে চেয়েছেন – মানবজাতির উৎস ও ক্রমবিকাশের ধারার সঙ্গে সমান্তরাল ভাবে এগিয়ে চলেছে উৎস থেকে ভাষার বর্ণময় ধ্বনিময় ক্রম বিভিন্নতার ধারা। বিভিন্নতার নিহিত ঐক্যে প্রত্যয়ী হলে ক্রমবিকাশের অনিবার্য বিভিন্নতা নিয়ে ভুল বোঝার এবং আত্মীয়তাবোধের অবকাশ তৈরি হতো না। তাঁর মূল অবস্থান জামশেদপুরেই, এখন আছেন বেহালায়।

সম্পাদক কাজল সেনের বক্তব্যে উঠে এলো তাঁর ৩৫ বছরের সংগ্রাম এবং এই পত্রিকাটির দিকে যাঁরা সাহায্যের ও ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বিভিন্নভাবে, তাঁদেরও কথা। ‘কালিমাটি’ এখন আর শুধু প্রিন্টেড ম্যাগাজিনই নয়, ইন্টারনেট জগতে তার পরিচিতি বিশাল এক ব্যাপ্তি পেয়েছে, ইতিমধ্যে নেটে ‘কালিমাটি অনলাইন’এর ১০টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। ‘কালিমাটি অনলাইন’ পত্রিকার এখনও পর্যন্ত সাতটি বিভাগ আছে, সেগুলি হলো – কবিতার কালিমাটি, কালিমাটির ঝুরোগল্প, কালিমাটির কথনবিশ্ব, চারানা আটানা, দীর্ঘ কবিতা, অণুরঙ্গ ও ছবিঘর। যিনি অনলাইনের কাজে কাজলকে সহায়তা করেন, তাঁর নাম সুমিতরঞ্জন দাশ। মঞ্চে উঠে সুমিতরঞ্জন তাঁর মৃদু ভাষ্যে জানিয়েছেন, অনলাইন নিয়ে তাঁর তৎপরতা কতটা এবং কতদূর ক্রিয়াশীল।



সমীর রায়চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে জানিয়েছেন, ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটি কেন বাংলা ভাষার একটি অদ্বিতীয় পত্রিকা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, কোথায় কোথায় তার বিশেষত্ব। সাধন চট্টোপাধ্যায় বলেন, কীভাবে পশ্চিমবঙ্গ থেকে দূরে অবস্থান করেও বাংলা ভাষাভাষী সাহিত্য পাঠকের নয়নের মণি হয়ে উঠেছে আজ ‘কালিমাটি’, কেন বাংলা পত্রিকার জগতে ‘কালিমাটি’র ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রভাতরঞ্জন রায় জানিয়েছেন, বাংলাভাষা যেমন বিশ্বভাষা পরিবারের একটি প্রাণবন্ত অস্তিত্ব, ‘কালিমাটি’ পত্রিকাটিও তাই। দীর্ঘ বক্তব্য ছিল তাঁর। নাসের তাঁর বক্তব্যে বলেছেন, ‘কালিমাটি’ পত্রিকার বিভিন্ন সংখ্যাতেই নানা উল্লেখযোগ্য লেখার সন্ধান পেয়ে যাই আমরা। যেমন, ভূদেব ভকতের ছবি, কবিতা এবং গদ্যের অসাধারণ সম্ভার সব।

সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন তরুণ কবি সুবীর মন্ডল, তিনি ‘কবীর’ নামে একটি চমৎকার পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সুবীরের ভাই প্রবীরও পরিচিত কবি। প্রবীর এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন।


এসেছিলেন অনেকে – বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সচিব ড. সুবিমল মিশ্র, সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায়ের কন্যা ও জামাতা ম্যাডোনা চট্টোপাধ্যায় ও দ্বৈপায়ন সেন। এসেছিলেন অনেক কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সঙ্গীতশিল্পী, চিত্রশিল্পী, অভিনয়শিল্পী, লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক এবং ‘কালিমাটি’-প্রেমী – অতীন্দ্রিয় পাঠক, সুবিমল বসাক, অজিত বাইরী, উদয় চট্টোপাধ্যায়, অচিন্ত্য দাশ, অনিশ্চয় চক্রবর্তী, ধীমান চক্রবর্তী, প্রণব পাল, অলোক বিশ্বাস, রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়, মৌলিনাথ বিশ্বাস, দেবযানী বসু, রঞ্জন মৈত্র, প্রভাত মিত্র, অশোক চক্রবর্তী, দিলীপ ভট্টাচার্য, সব্যসাচী হাজরা, উল্কা, ঊষসী ভট্টাচার্য, অরূপ মাইতি, বিশ্বজিৎ, তানিয়া চক্রবর্তী, সন্তোষ মুখোপাধ্যায়, অঞ্জন সেন, সুমন্ত ঘোষ, লেনা ঘোষ, প্রবীর চক্রবর্তী, অভিজিৎ সেন, রুচিস্মিতা ঘোষ, জয়দীপ সেন, কুঞ্জলাল মুখোপাধ্যায়, রবীন বন্দ্যোপাধ্যায়, তপনকর ভট্টাচার্য, চিত্রা সেন। এছাড়া দিল্লী থেকে এসেছিলেন ‘দিল্লী হাটার্স’ পত্রিকার সম্পাদক দিলীপ ফৌজদার এবং মুম্বাই থেকে ‘মায়ামেঘ’ পত্রিকার সম্পাদক সঞ্জিতা সেন। আরও এসেছিলেন আমেরিকা থেকে আগত চিকিৎসক ড. শৌভিক সেনগুপ্ত ও তাঁর স্ত্রী মৌসুমি সেনগুপ্ত। চমৎকার দুটি গান গেয়ে শোনালেন ম্যাডোনা চট্টোপাধ্যায়। আর চলচ্চিত্র পরিচালক এবং নাটক ও গানের দলের অধিনায়ক অরিন্দম গুপ্ত তাঁর ছোট্ট গানের দল নিয়ে মাতিয়ে দিলেন অনুষ্ঠানের শুরুতেই। তাঁর সঙ্গে ছিলেন সুরঙ্গমা লালা দাশগুপ্ত এবং সুরম্য দাশগুপ্ত। সুরম্য গিটার বাজিয়ে খুব সুন্দর গান গেয়েছেন। আবৃত্তি করেছেন কয়েকজন – কৌস্তুভ নাগ, অভিষেক রায়, গৌতম মন্ডল। কবিতা পাঠ করেছেন ঊষসী ভট্টাচার্য, উল্কা, প্রবীর মন্ডল, সায়ন দাশ। মৌসুমি সেনগুপ্ত আবৃত্তি করে শুনিয়েছেন প্রণব পালের কবিতা। দর্শকের আসনে উপস্থিত ছিলেন চলচ্চিত্র ও বাংলা সিরিয়ালের বিশিষ্ট অভিনেতা প্রদীপ চক্রবর্তী। শিল্পী ভূদেব ভকতের শিল্পীত ‘ব্যানার’ এবং ‘পোস্টার’ দিয়ে সাজানো হয়েছিল সভাঘর।



এই সামগ্রীক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ছিলেন উল্কা। আর নেপথ্য থেকে এই পত্রিকাটিকে আরও একজন শ্রম ও সমর্থন দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তিনি কাজল সেনের স্ত্রী চিত্রা সেন। ‘কালিমাটি’ ১০০ সংখ্যা প্রকাশ অনুষ্ঠানে কাজল ও চিত্রা দুটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো অনুপম-ব্যস্ততায় সবাইকে আপ্যায়ণ করে চলেছিলেন।

সব মিলিয়ে মনে হলো, ‘কালিমাটি ১০০’ অনুষ্ঠান একটি এলাহি ঘটনা। এই অনুষ্ঠানে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন এবং যাঁরা শুধুমাত্র দর্শকাসনে বসে সমস্তটা অবলোকন ও শ্রবণ করেছেন – দু’পক্ষই অসম্ভব সমৃদ্ধ ও নন্দিত হয়েছেন। ‘কালিমাটি’ পত্রিকার উত্তরোত্তর আরও শ্রীবৃদ্ধি ঘটুক, আমাদের সকলের এটাই একান্ত কামনা। যাঁরা আসতে পারেননি, তাঁরা জানেন না, কী বিশাল অভিজ্ঞতা-নজরানা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন!

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন