কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২৩ জানুয়ারী, ২০১৪

০৬) অপরাহ্ন সুসমিতো

মাধবীলতা জুয়েলার্স



ফেসবুকে আমার এক বন্ধু আছেন, প্রায় সময় টাঙ্গাইলের সুতি শাড়ি পরা ছবি পোস্ট করতেন। বেশ ভালো লাগত দেখতে। এক ধরনের বিকল্প সৌন্দর্য তাঁর মুখখানি ঘিরে। মাধবীলতা। শখ করে পান খেতেন কখনো। পান খেয়ে ঠোঁট লাল করে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ পোস্ট করতেন। শিরোনাম খানিকটা এরকম : ‘পৃথিবী আজ জবাময়’।

প্রবন্ধ মোটামুটি দুই বিঘা লম্বা। আশ্চর্য লাগত যে, প্রবন্ধটি পোস্টের সাথে সাথে অনেক লাইক। আরে প্রবন্ধটি তো পড়তে কমপক্ষে দশ মিনিট লাগার কথা! যাইহোক বন্ধুটিকে অনেকদিন দেখছিলাম না। গতকাল আচানক দেখা।

মাধবীলতা বিয়ে করেছে খগেন্দ্র সাহাকে। খগেন্দ্র সাহার স্বর্ণের দোকান আছে টরকী বন্দরে। মোটামুটি ধনী। খগেন্দ্রবাবু’র প্রথম স্ত্রী কোনো এক হরতালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। সে পক্ষে তিন সন্তান মাধবীলতা খগেন্দ্রবাবুর প্রেমে পড়েন।



দু’জন একসাথে গৌরনদী এসে নাহার সিনেমা হলে সিনেমা দেখেন, গৌরাঙ্গ মিষ্টান্ন ভান্ডারে এসে ছানা সন্দেশ খান। মিষ্টি টিষ্টি খেয়ে সামনের মালেকের দোকান থেকে উজিরপুর স্পেশাল পান খেয়ে পিচিক করে পিক ফেলেন আর খিলখিল হাসেন।

খগেন্দ্র’র ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির নাম ছিল ‘জয়দুর্গা জুয়েলার্স’। সরকার পরিবর্তনের পরদিন হাঁটুর বয়সী কিছু তরুণ ছেলে এসে হাজির হলো খগেন্দ্র’র জুয়েলার্সে। খগেন্দ্র তখন আটার রুটি আর মাঠা খাচ্ছিলেন। ছেলেগুলো দোকানে ঢুকেই বলে--


: দাদা এহন তো দোকানের নাম পাল্ডাইতে হইবে!

খগেন্দ্র এইসব ছেলেদের জন্ম হতে দেখেছেন চোখের সামনে। এখনো নাক টিপলে দুধ পড়ে। অবাক হয়ে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

: হে ব্যাডা তোগো সমেস্যা কি? মুই নাম পাল্টামু কেন?

চিত্রনায়ক আদিত্য পাঞ্চোলী’র মতো দেখতে ফর্সা মতো ছেলেটা ধুম করে একটা কিল মারে খগেন্দ্র’র ক্যাশবাক্সে।

: একটা কথাও কবেন না আর। মোগো সরকার ক্ষমতায় আইছে। মোগো হুকুম, এই জয়দুর্গা নাম পাল্টাইতে হবে। নাইলে ইন্ডিয়া পাডাই দিমু।

খগেন্দ্র’র মোটা শরীরটা চিনচিন করে ঘামতে থাকে। উপরে মিল্লাত ফ্যান ফুল স্পিডে ঘুরছে, তবুও গরমের আস্তর সরছে না। নদীঘাট থেকে জামাল মিয়ার টরকী-ঢাকা লঞ্চ ছেড়ে যাবার লম্বা ভেঁপু শোনা যায়। লুক এলাইক আদিত্য পাঞ্চোলী’র পেছনের ছেলেটার হাতে নাক বোঁচা কিউট মতো দেখতে একটা পিস্তল দেখা যায়।

পরদিনই দোকানের নাম পাল্টে যায় ‘এলাহি ভরসা জুয়েলার্স’। ছেলেপিলে সাহিত্য পত্রিকার নামে, বার্ষিক বনভোজনের নামে দোকান থেকে হরহামেশা চাঁদা নিয়ে যায়।

জুয়েলার্সের সামনের দধি হাউজে দুপুরবেলা উপমন্ত্রীর মতো পুরু মাছি উড়ে বেড়ায়। লোকজন বাড়তে থাকে। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন আসে পাটের চালান নিয়ে। খগেন্দ্র দার্শনিক বার্ণাড শ’এর মতো গালে হাত দিয়ে ঝিম মেরে বসে থাকেন। ব্যবসায় মন নেই। ভিনদাস লাগে সব। কর্মচারী মোহাম্মদ আদিলুজ্জামান খগেন্দ্রবাবু’র মন ভালো করার জন্য গান ছেড়ে দেয়--



বিছু রে ইয়ে নায়না
বড়ি জেহেরেলি আঁখ মারে

কমসি কমরিইয়া সালি

ইক তুমকে সে লাখ মারে (সিটি বাজানোর শব্দ)

আয়ি চিকনি চামেলী চুপকে একেলী...



খগেন্দ্র তবুও ভিনদাস। কোথাও মন নেই। মোহাম্মদ আদিলুজ্জামান মন খারাপ করে বলে--

: দাদা গরম রসগোল্লা আনামু?

তার সতেরো দিন পর আমার বন্ধু মাধবীলতার সাথে খগেন্দ্রর পরিচয় হয়। দোকানে মিল্লাত পাখা পাল্টে এয়ারকুলার লাগানো হয়। আগে দোকানে ঢুকলে আগরবাতির একটা দমবন্ধ আবহ ছিল। মোহাম্মদ আদিলুজ্জামান ঢাকা থেকে বিদেশী এয়ার ফ্রেশনার কিনে আনে। দোকানে আগে যে সব বিবর্ণ ক্যালেন্ডার ছিল, সে সব পাল্টে কিংফিশার এয়ারওয়েজের বিকিনি পরা ক্যালেন্ডার উঠে আসে।

আলেকান্দা, পিঙ্গলাকাঠি, বার্থি থেকে আসা কাস্টমররা দোকানে ঢুকে হাঁ করে ক্যালেন্ডারের পেপসি ফিগারের মেয়েদের দিকে তাকিয়ে থাকে, আর পাশে জবুথবু দাঁড়ানো বউয়ের দিকে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলে--

: ওরে সর্বনাশ! সোনার দাম এতো বাড়ছে? আধা ভরি’র কিছু দেহো।

খগেন্দ্র পান খাওয়া লাল মুখে তেলতেল করে নরম করে বলে--

: ভাইজান এহনি কেনেন। সোনার ভরি আরো বাড়বে, কইলাম।

সামনের দধি হাউজে আমি মাছি তাড়াচ্ছিলাম আর ছক্কার দানা দিয়ে দধি খাচ্ছিলাম। আচমকা চোখ পড়ে মাধবীলতাকে। কী মিষ্টি মুখখানি... টাঙ্গাইল সুতি পরা... খিলখিল হাসছে...

কী আশ্চর্য! দোকানের সাইনবোর্ড নামানো হচ্ছে। তাকিয়ে দেখি, নতুন সাইনবোর্ড... ঝকঝকে...

‘মাধবীলতা জুয়েলার্স’!


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন