কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

০৬) মেঘ অদিতি

ভুলভুলাইয়া
মেঘ অদিতি



হাড়িতে টগবগ করে চাল ফুটছে। সেদিকে আগুন চোখে তাকিয়ে আছে জফুরা, যেন নিজেকেই সে সেদ্ধ করছে।

এত লোক মরে আর তুই মরতারছ না!

নিজের প্রতি উঠে আসা বিষের দলাকে আবার পেটের ভেতর চালান করে ভাত সেদ্ধ হয়েছে কি না দেখে, ভাতের ফ্যান ঝরায়। খাবার ঘর থেকে ডাক আসে, কী রে জফুরা, ভাত রান্দস না পোলাউ পাকাস? খাবার দিতে এত দেরি হয় কেন?

চুলার আগুন কমিয়ে ভাতের হাড়ি আবার চুলার আঁচে দেয় সে, তারপর বাটিতে তরকারি বাড়ে। ডালের বাটি, তরকারি আর থালা গ্লাস এনে টেবিলে রাখে। খাবারের জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকা বাড়ির মালকিনের ভারী শরীরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মনে মনে গজগজ করে, হুলা বিলাই একখান! খাইতে খাইতে তো দুইন্যাডাই খায়া ফালাইছ, তাও খাওনের সাধ মিটে না?

জফুরার মনের ভেতর দিনরাত অশান্তির ঝোরো হাওয়া। দুনিয়ার সবার প্রতিই তার অসন্তোষ। গুমরে চলা নানা অভিযোগের ভেতর পেটের দায় শব্দ দুটো তাকে বড় বিরক্ত করে। এই পেট, এর জন্যই তো তাকে দশ বছর ধরে পরের বাড়ির ঘানি টানতে হচ্ছে। পেটটাকে তাই জীবনের পরম শত্রু বলে মনে হয়। এমনকি তাকে জন্ম দিয়ে যারা তার ভরণ পোষণ না করে উল্টে তারই রোজগারের টাকায় সংসার চালায়, তাদেরকে আরও বেশি শত্রু বলে মনে হয় জফুরার।

খাওন দিতে পারে না, জনম দেয় কেন এরা? কুত্তা বিলাইও তো এর থিকা ভালা জীবনে পায়। দুইটা ট্যাকা আর এই মরার প্যাট-এর জন্যি জীবনই শ্যাষ! লাত্থি মারি এই মরার জীবনের মুখে!

গজগজ করতে করতে সে রান্নার কাজ শেষে রান্নাঘর পরিষ্কার করে, সে বাথরুম ধোয়, নিজের গোসল সেরে ছাদ থেকে শুকনো কাপড় তুলে আনে। আচারের বয়াম আর বড়ি তুলে আনে। তারপর নিজের ভাতের থালা টেনে নেবার আগে এ বাড়ির বিকেলের চা নাস্তার জোগাড় করে। কাজের ফাঁক গলে হঠাৎ এক একদিন তাকে অন্যমনস্ক করে দেয় বহু দূরের কোনো এক গ্রামের ভাসা ভাসা স্মৃতি। বিকেল বেলার সোনারঙা পুকুর ঘাট কিংবা মাঠের আ’ল তাকে শৈশবের দিকে নিয়ে যায়। সেই কোন্‌ ছোটবেলা তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে, আয় আয় আয়... সে ডাকে জফুরাও যেন কোথায় হারিয়ে যায়। পরমুহূর্তেই শোবার ঘরের এসির বিনবিন মৃদু আওয়াজ ছাপিয়ে মালকিনের নাসিকা গর্জন আবার জফুরাকে কাজে ফিরিয়ে আনে। তার হাত দ্রুত চলতে শুরু করে। বিকেলের খাবার তৈরি শেষে সে তার ভাতের থালা টেনে নিয়ে ভাতের দলা ভাঙে। ঠান্ডা হয়ে আসা ভাতের সাথে গা জড়াজড়ি করে থাকে পরের সকালের জন্য রুটি বেলা, ডাঁই করা শুকনো কাপড় ভাঁজ করে জায়গায় তোলা, রাতের খাবারের জোগাড় করা, বাড়ির সাহেব ফিরলে তার চা-নাস্তা দেওয়া। পরপর এই ছবিগুলো সাজাতে জফুরাকে তাই মেশিনের মতো সচল হয়ে উঠতে হয়।

রাতের খাবারের পালা শেষ হতে না হতে বাড়ির টিভিতে ভেসে ওঠে স্টার জলসা। সারাদিনের কাজের চাপে পিষতে থাকা জফুরার মন কেবল মাত্র এই একটা সময়ই আনচান। জফুরা তখন রুমঝুম নূপুর। চুলের ফিতে কষে বাঁধতে বাঁধতে গোগ্রাসে সে সিরিয়াল গেলে আর স্বপ্ন দেখে টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে ওঠা ওই পুরুষের মতো কেউ একজন তার বাকি জীবনের হাত ধরবে। সেই রেশে ভেসে ভেসে সে রাতের বাকি কাজগুলো শেষ করে রাতের খাবার খায়। তারপর রান্নাঘরের মেঝেতে নিজের বিছানা পেতে শুয়ে পড়ে। ঘুমের ভেতর আচানক জফুরা পরীর ডানা পায়। সে ডানায় তিন আসমান পাড়ি দিয়ে আরও বহুদূর উড়ে যাবার পর সে নামে নাম না জানা কোনো এক গ্রামে। স্বপ্নের উনুনের পাশে বসে সেখানেও সে রাঁধে বাড়ে। দ্রুত হাতে ভাত বেড়ে দেয় অস্পষ্ট অবয়বের এক পুরুষকে। যত্ন করে তাকে খাওয়ায়। সে পুরুষটি তাকে সবলে জড়িয়ে ধরে যখন, তখন তার ডানা দু’টো শরীর থেকে খ’সে পড়ে। বুনো গন্ধ মাখা স্বপ্ন তাড়িত জফুরা তখন ঘুমের মধ্যে এপাশ-ওপাশ করে। অন্ধকারের গায়ে সেঁটে তার ঠোঁটে ফোটে এক বিন্দু অপূর্ণতার স্বেদ।

ভোরের আলো ফোটার আগে জফুরা জাগে। রাতের স্বপ্ন তাকে আরও কিছুক্ষণ আচ্ছন্ন করে রাখে। উসখুশ করে করে, শেষে জফুরা উঠে পড়ে। বিছানা গুছিয়ে, মুখ হাত ধুয়ে চুলার আগুন জ্বালায় সে। আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে মনে হয়, তার আবার আরেকটা দিনের শুরু। আবার একটা হাঁ-মুখ গর্তের ভেতর নিজেকে পুরে দেবার শুরু। এক দলা থুতু জমে ওঠা মুখে সে দিন শুরু করে ‘বেজইন্মা’ শব্দটি দিয়ে। এবার তার যন্ত্রবৎ হাত কুসুম গরম পানিতে লেবুর রস মেশাবে। রুটির সাথে খাবার জন্য আলু ভাজবে অথবা অফিসের লাঞ্চবক্স আর স্কুলের টিফিন বাক্সে খাবার ভরবে। ঘড়ির কাঁটা তড়িঘড়ি এগোতে থাকবে, ফলে জফুরাও খাবার টেবিল থেকে রান্নাঘর, রান্নাঘর থেকে শোবার ঘরের ইতিউতি চরকিপাক খেতে থাকবে।

এর মাঝেই হয়তো এ বাড়ির মালকিনের নরম ঘুম ভাঙবার পর লেবুপানি খাবার সময় হয়ে যাবে। তার লেবুপানির গ্লাস হাতে তুলে নেবার ফাঁকে জফুরা সে সময়টায় লুকিয়ে ফেলবে তার স্বপ্নে পাওয়া পরীর ডানা দু’টো।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন