কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ৩০ মে, ২০১৪

০১) যশোধরা রায়চৌধুরী

যন্ত্র-না



বড় দুশ্চিন্তা। বড় কষ্ট। এই রোবট জীবনে এত কষ্ট কিছুদিনের মধ্যে আর পাইনি। সেই প্রথম যৌবনে একবার। কাল জানতে পেরেছি পূষণের প্রেমিকা আসলে মানুষ। ছোট থেকে কত কতবার বলেছি, ওরে, মানুষ বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস, মানুষের সঙ্গে মিশিস না, মিশিস না, তবু সেই দ্যাখো, আবার গিয়ে পড়েছে মানুষেরই পাল্লায়। আমার ভাঙাচোরা জীবনটাকে দেখেও শিখলি না রে ছেলে! আমি রোবট। আমার শহরে আমার মতোন রোবট ৪৫৬৩৫৫৪৬ জন। প্রত্যেকে বিয়ে করেছে এক এক জন রোবটকে। সুখে আছে। কারখানা থেকে ছেলেমেয়ে নিয়েছে। তাদের সিস্টেমে ডেটা ইনপুট করেছে। ভালো থাকার ডেটা। কারোর জীবনে কোনো জটিলতা নেই, অশান্তি নেই। রবিবারে মাংসভাত খায়। সোম থেকে শুক্র হাস্যকৌতুক সিরিয়াল দেখে। কারোর দাঁতে পোকা নেই, বুকে হাঁপানি নেই। সমস্যা যা কিছু সে তো বয়সোচিত জং ছাড়া আর কিছু নয়। সে একটা বয়সে তো সার্কিটগুলো খারাপ হবেই, জং ধরবেই গাঁটে গাঁটে। অথচ আমি বয়সের ভুলে, তিরিশ হবার আগেই, বেখাপ্পা, বেভুল কাজ করে ফেললাম একটা। বিয়ে করে ফেললাম এক মানুষের মেয়েকে। এ শহরে মানুষরা রোবটরা পরস্পরের গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি করে থাকে, এটা ঠিক। মেয়ে রোবটের সঙ্গে মানুষের ছেলে বা ছেলে রোবটের সঙ্গে মানুষের মেয়ের প্রেম করারও কোনো বাধা নেই, এটাও ঠিক। কিন্তু একই সঙ্গে, ফট করে বিয়ে করার ঝুঁকি? সে আমার মতো আকাট মুখ্যুরাই নিতে পারে। ব্রেনের সবকটা সার্কিটে বিস্তর তেল ঢালার দরকার ছিল আমার সেদিন। স্ক্রুগুলো টাইট দেবার দরকার ছিল। কারখানার ওরাও সে কাঁচা বয়সে আমাকে বলে দেয়নি কী সর্বনাশ হতে চলেছে। অবশ্য, বললেও শুনতাম নাকি? আমার বউ আমার সঙ্গে থাকল না। মানুষ কখনো রোবটের সঙ্গে থাকতে পারে? ওর যে যখন তখন যা খুশি করতে ইচ্ছে করে। ওর রবিবার মাংস ভাত না খেয়ে আলুপোস্ত খেতে ইচ্ছে করে। ওর যে বিকেলে ভালো করে গা ধুয়ে চুল বাঁধতে ইচ্ছেও করে। কী মুশকিল! সবচেয়ে বড় অসুবিধে, আমাদের, রোবটদের যা কোনোদিন হবে না, ওর যখন তখন বিনা নোটিশে, মনখারাপ বলে একটা জিনিস হতো। তখন ও খোলা চুলে, এলোমেলো বিবর্ণ জামা পরে জানালার দিকে তাকিয়ে বসে থাকত ঘন্টার পর ঘন্টা। আমার রাগ হতো, হিংসেও। রোবটদের ঐদুটো হতে তো কোনো মানা নেই। তাহলে জানালার ওপারেই কিছু এমন আছে যা ওকে বেশি বেশি করে অধিকার করে নিচ্ছে। ওর চোখ, মন টেনে নিচ্ছে । তাই, খটখটিয়ে উঠে যেই জানালা বন্ধ করে দিয়েছি, বউটা রেগে কেঁদে, পটাপট কয়েকটা চুল ছিঁড়ে, একবস্ত্রে চলেই গেল। “হৃদয়হীন পুরুষ, শুধু বুঝেছ কয়েকটা সার্কিট... ছিঃ !” বলে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই যে গেল, আর ফিরল না। উফফ! রোবটের জীবনে এমন মানুষ মানুষ দুঃখ সহ্য করার ক্ষমতা তো ভগবান দেননি। সেই থেকে আমার হৃদয়ের একটা তার জ্বলে গেছে। কারখানার ওরাও ঠিক করতে পারেনি। আমার ছেলে পূষণকে কোনোদিন বলিনি, ও এক মানবীর পেট থেকে জন্ম নেওয়া মানুষ। ওকে ছোটবেলা থেকে রোবটের মতো করে বড় করেছি, সব সময় বন্ধু হিসেবে এগিয়ে দিয়েছি রোবটদের। ও পড়াশোনোয় ভা্লো, ওর ভবিষ্যত উজ্জ্বল। ওকে রোবট জগতে নাম রওশন করতে হবে। মানুষদের সঙ্গে মিশলে চলবে না। কোনো মানুষের সংস্পর্শে আসতেই দিইনি ওকে শিশুকাল থেকে তাই। এতদিন পেরেছিলাম। ও পড়াশোনা করেছে, টিভি দেখেছে, কম্পিউটারে বসেছে। মানুষ চেনেনি। সেই পূষণ, সেদিন দেখি, একজন মানবীকে হাত ধরে এনে ঘরে ঢুকে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। অনন্যা। বান্ধবী। মুখ চোখে টুপটাপ সৌন্দর্য। এ তুই কী করলি! বাপের নাম ডোবালি? আমার তো বাক্যি হরে গেছিল। কিছু না বলে আমার আরাম কেদারাটা ঘুরিয়ে নিয়ে টিভি দেখতে শুরু করলাম আবার। পূষণের ঘরে বন্ধ দরজার আড়ালে তখন অনন্যা আর পূষণের গল্প, হৈ হৈ। গানের কলি ভেসে আসছে। আর, ভবিষ্যতের কথা ভেবে আমার বুকটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আঃ আমার ছেলেটা আবার কোন্‌ ভয়ানক জীবনের পথে পা বাড়াচ্ছে, ও জানে না। অনন্যা বেশ রাত করেই বাড়ি গেল। ওকে এগিয়ে দিয়ে ফিরে এল পূষণ। মুখে খুশির ছোঁয়া, গুনগুন গান গাইছে। আমাকে বসবার ঘরে দেখে থমকে গেল। তোমার কিছু হয়েছে, বাপি? শোন্‌। তোর এই বান্ধবী কি মানুষের বাচ্চা? হ-হ্যাঁ, কেন বল তো? তুই আর ওর সঙ্গে মিশিস না। কী বলছ? আমার কথা শোন্‌ পুষু। নইলে কপালে দুঃখ আছে। ও যদি মানবী হয়, তাহলে ওকে বিয়ে করা মানে তোর সারাজীবন পস্তানো। সে পথ তুই বেছে নিস না। এত উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তোর। বাবা, কে বলেছে আমি অনন্যাকে বিয়ে করব? পাগল নাকি। ও আমার জাস্ট বান্ধবী। সে কি বিয়ে করবি না? তাহলে এমন ঘনিষ্ঠভাবে মিশছিস যে! বাবা, উফ, তুমি না, মাঝে মাঝে তোমার কান্ডকারখানা দেখলে বুঝে পাই না রাগ করব না হাসব। তার ওপর তোমার কিছু কিছু কাজ তো ক্ষমার অযোগ্য, বাবা! কোন্‌ কাজ? তুমি লুকিয়েছিলে আমার কাছে, আমি আসলে মানুষ। বলনি এতদিন, আমি নিজে জেনেছি। এরকম মিথ্যে কিন্তু শিশুদের মনস্তত্বে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তুই জেনে ফেলেছিস নাকি, কবে জানলি, তুই মানুষ? আমার তো কবে থেকেই বিকেল বিকেল চোরা মনখারাপ হতো, তখন কারখানায় দেখালাম। তারা বলল, ডাক্তারখানায় যাও, এটা মনের রোগ, মানুষের হয়। উফফ! আমি যা করেছি সব, সব তোর ভালোর জন্য, বাবা। বাবা, শোনো, তোমার কো্নো ধারণা নেই পৃথিবী কত পাল্টে গেছে এই ক’দিনে। তুমি সেই কোন্‌ প্রাগৈতিহাসিক যুগে যে পড়ে আছ! মানুষ যে কত পালটে গেছে! কি হয়েছে মানুষের? মানুষ এখন আর আগের মতো নেই, বাবা। জেগে ওঠো। জান, অনন্যাকে ভালোবেসে আমার দেওয়া ভ্রূণ সে নষ্ট করে ফেলেছে! কোনো রোবট তার সন্তানকে মারতে পারে? শুনেছ কখনো? তুমি কি পেরেছিলে, আমাকে মারতে, মা যখন স্পার্ম সেন্টার থেকে মানুষের ভ্রূণ এনে নিজের গর্ভে লালন করেছিল? উফফ, এসব কী বলছিস তুই? তারপর শোনো। অনন্যার তো আরও দু’তিনটে ছেলে বন্ধু আছে। রোজ তাদের নিয়ে রাত বিরেতে যুগপৎ তিনজনের সঙ্গেই চ্যাটিং করে। প্রেম করে সময় ভাগ ক’রে। কোনো রোবটকে করতে শুনেছ এরকম ? না পূষণ। আমাদের যে ওরকম করতে গেলে ‘টু মেনি ফাইলস ওপেন’ হয়ে, সিস্টেম বসে যায়, বাবা! সুতরাং, জেনে রেখো, বিয়ে আমি অনন্যাকে মোটেই করব না। বিয়ে যদি করি, তোমার মতোই বোকাসোকা, একরোখা, খুব একনিষ্ঠ একটা রোবটকে, যন্ত্র-না, একটা মেয়েকেই খুজেঁ নেব। অন্তত আমি ছেড়ে গেলেও সে আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না।

একজন মানবীকে হাত ধরে এনে ঘরে ঢুকে আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। অনন্যা। মুখ চোখে টুপটুপে মানু- তুই। বাপের নাম ডোবালি? আমার তো বাক্যি

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন