কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০১৪

০৪) তুষ্টি ভট্টাচার্য


তুষ্টি ভট্টাচার্য

চুলচেরা

চুলের চুলচেরা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা আমার নেই। তবুও দেখি তার কত রূপ, রঙ, বৈচিত্র্য আর কত ঢঙের বাহা! যদিও চুল বললেই স্বাভাবিক ভাবে মনে পড়ে, কোনো  সুন্দরীর দীঘল লম্বা চুলের কথাযে চুল বেয়ে কোনো এক রাজকুমার উঠে এসেছিল সেই স্বপ্নের বারান্দায়! আমার কিন্তু লম্বা চুল দেখলেই নদীর কথা মনে পড়েযেন কোনো এক অমাবস্যার রাতে নদী তার তণ্বী শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে আছেআর কোঁচকানো এক মাথা চুল দেখলে মনে হয়, যেন এক অবাধ্য শিশু, যে তার মায়ের  কোলে থাকবে না কিছুতেই, একবার এদিকে বেঁকে যায় তো আর একবার ওদিকে নুয়ে পড়ে আর শান্ত, নিপাট, ভাঁজ করা কালো চুলের কথা এলেই মনে পড়ে লেডি ডায়নার কথা। যেন কী এক প্রশান্তি লুকিয়ে আছে ওই চুলে! যদিও বাস্তবে তার উল্টো ছবি দেখিসে প্রসঙ্গে অবশ্য যাচ্ছি না এখানে

চুল কি শুধু তোমার একার রমণী? তাহলে তুমি কার চুলে হাত বুলিয়ে মাতৃত্বের স্বাদ পাবে, কাকে ভাই বা বন্ধু বলবে, আর কার চুলের মুঠি ধরবে আশ্লেষে কোনো এক  গোপন সময়ে – ভালোবাসায়, আদরে, সোহাগে? সেই পুরনো দিনের বাংলা সিনেমার আইকন ছিলেন উত্তমকুমার আর ততোধিক প্রসিদ্ধ তাঁর উত্তম ছাঁটঅল্পবয়সীদের  ফ্যাশন ছিল উত্তম ছাঁটএদের কথা বাদ দিলে তেল দেওয়া চুলে টেরি কেটে পাট পাট করে চুল আঁচড়ানোর চল ছিল একচেটিয়া। এযুগ, ওযুগ, সব যুগেই চুলের  রকমফের তো থেকেই যায়! এখন যেমন বিজ্ঞাপনে নিয়মিত দেখি জেল শোভিত  ব্যাকব্রাশ করা ঘাড় পর্যন্ত চুলদেখলে সেই টেরি কাটার দিন মনে পড়েজেলের বদলে তেল ছিল, এই যা তফাৎআবার কারুর খাড়া খাড়া চুল দেখলেই আমার পাগলা দাশুর কথা মনে আসেপুরুষের চুলহীনতার সমস্যা অর্থাৎ কিনা টাকের সমস্যা চিরকালই ছিল। চাঁদিজোড়া টাক না থাকলে বোধহয় পুরুষের ব্যক্তিত্ব বাড়ে  না! আবার জটায়ুর টাক দেখলেই কেমন যেন মায়া লাগেমনে হয়, আহা রে – ভোলেভালা লোকটাকে নিয়ে সবাই মজা করে! আবার অল্প বয়সের টাক বিড়ম্বনা বই কী! পকেটে রেস্তো থাকলে অবশ্য হেয়ার ট্র্যান্সপ্লান্ট করানো যেতেই পারে। উইগ লাগানোর দিন শেষ। টাক আর সমস্যা নয় পুরুষের

আমাদের সময় পর্যন্ত বা কিছুদিন আগেও বাচ্চাদের চুলের স্টাইল ছিল মায়ের দখলেএকদম শিশু অবস্থায় সিঁথি না করে দুপাশ থেকে টেনে এনে মাথার মাঝখানের  চুলগুলো চূড়ো করে আঁচড়ে দেওয়া হতোতারপর সেই সিঁথিকাটা একঘেয়ে চুল চলত,  যতদিন না সে বাচ্চা তার নিজের ব্যক্তিত্বের মালিক হয়ে ওঠেএখন তো ছোট ছেলেদের দেখি স্পাইক করা চুল, মাশরুম কাটের চুল, আর মেয়েদের বিভিন্ন রকমের হেয়ার ব্যান্ড বা ক্লিপ আঁটা চুলবিনুনির দিন শেষ, এটা ফাইন্যাবাচ্চাদের আর  বাচ্চা বলে এলেবেলে ভাবার দিনও শেষআমার বাছা যেন থাকে দুধেভাতে – বলতে আজকাল কেমন লজ্জা লজ্জা লাগে, যেমন লাগে ওদের জবজবে করে মাথায় নারকোল তেল মাখাতেফুরফুরে বেবি শ্যাম্পু মাখানো হয় সদ্য শিশুর মাথায়, নো প্রব,  চোখে গেলেও চোখ জ্বলবে না টিন এজারদের জন্য আবার স্ট্রবেরি-শ্যাম্পুর  আয়োজন আছে। সো গাইস, গো গো গো... চুলবুল করতে করতে এগিয়ে চল!


সেলুনে যেতেই হতোএখনও অনেকেই যায়কিছু সংখ্যক মানুষ যাচ্ছে সালোঁ-য়, আর বিউটি পার্লারেসেই ইটালিয়ান সেলুন থেকে আজকের সালোঁ–যাত্রা বেশি দিনের না যদিও, তবু একটা বিপ্লব ঘটে গেছে অলক্ষ্যেই, অজান্তেই। কাঁচির বাহার আর রকম বেড়েছে, চিরুনি আর ব্রাশ যে কত ধরনের হতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না! যে কাঠের চেয়ারে বা টুলে বসতাম ছেলেবেলায়, এখন তাতে নরম গদি, মাথায় নরম কুশান দেওয়া হেডরেস্টযেদিকে ইচ্ছে ঘোরে আবার সেই চেয়ার কাঁচিধারীর ইচ্ছে অনুযায়ী! গায়ে একটা যা তা চুলমাখা কাপড় জড়িয়ে দেওয়া হতো চুল কাটার সময়, এখন সেখানে দড়ি বাঁধা বা বোতাম টেপা সিনথেটিক ক্লোক, ওতে অন্যের চুল আটকে থাকার সুদূরতম সম্ভাবনাও নেইখাঁ খাঁ রোদে পুড়ে ঠান্ডা বিউটি পার্লারে ঢুকে খানিক জিরিয়ে নিয়ে আরাম করে চুল কেটে ফেলছে মানুষজনআর চুল কাটার পর গা-ময় বিজবিজে কাটা-চুলের চুলকুনি? নাহ, তাহারও দিন গিয়াছেপাউডারে ভর্তি ব্রাশ আছে না সেবা করার জন্য! একে তো ক্লোকের ভেতরে কাটা চুলের প্রবেশ নিষেধ, তারপর আছে সেবক বা সেবিকাদের হাতে ব্রাশ দিয়ে চুল ঝাড়ার পালাআপনি খুশি হবেনই চুল কাটানোর পরে

পাকা চুল, উকুন, খুশকি, চুল পড়া বা চুলের ডগা ফেটে যাচ্ছে? টেনশন করবেন না, আপনার জন্য হেয়ার এক্সপার্টরা রেডি আছে সব সমাধান নিয়ে। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। আরে ঘাবড়াবেন না, তেল-টেল মাখতে হবে না, হয়তো হট অয়েল মাসাজ নিয়ে শ্যাম্পু করতে হতে পারে। কিম্বা হেয়ার স্পাআপনার সমস্যা অনুযায়ী প্রেশক্রাইব করবেন এক্সপার্টরাকিছুদিনের মধ্যে আপনার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবেআপনিও ফুরফুরে মেজাজে বাড়ি যাবেন, কাজে যাবেন, পার্টিতে যাবেন, আপনার বয়স বাড়বে না কিছুতেই আরর যদি পকেটে রেস্তো না থাকে তেমন, আপনি ঘরোয়া উপায়ে হার্বাল টোটকার দ্বারস্থ হতে পারেন। সময় একটু বেশি লাগতে পারে, এই যা... ঘাবড়াবেন না, আস্থা রাখুন হার্বাল প্রোডাক্টের ওপর। মনে রাখবেন, দেশ-বিদেশ মাতানো এই হার্বাল সামগ্রীর রুট লুকিয়ে আছে কিন্তু ভারতীয় আয়ুর্বেদে। সাধে কী আর আমাদের মুনি-ঋষিরা কালো চুল নিয়ে যুগ যুগ ধরে তপস্যা করে এসেছিলেন!

চিরুনি বা ব্রাশের ডগায় যদি চুল উঠে আসে আচঁড়াবার পর, ফেলে না দিয়ে যদি ওই চুল জমিয়ে রেখে দেন, ব্যাংক-ব্যাল্যান্স বাড়তে পারে আপনার পড়ে যাওয়া চুলও যে কত মূল্যবান, আপনি হয়তো জানতেনই না! প্রতি কেজি পাঁচশো থেকে এক  হাজার টাকায় দর ওঠানামা করে শেয়ার বাজারের সাথে জানতেন না তো! নিন এবার জমাতে শুরু করুন, ভোল্টে অনেক সোনাদানা জমে যেতে পারে এই তালেতবে যদি আপনি চুল পড়ার সমস্যা মুক্ত হয়ে যান, তাহলে এ সুযোগ হারাবেনএখন চয়েস আপনার! চুল যেমন পড়ছে পড়ুক, নাকি সব গাছা চুলই মাথায় থাকুক – কোনটা বাছবেন? ভাবুন, ভাবুন, ভাবতে থাকুন এখন আমায় ভাবাচ্ছে কাটা চুলগুলো, যেগুলো জমা হচ্ছে সেলুন, পার্লার আর সালোঁর ডাস্টবিনে

কাঁচির ডগায় লেগে থাকা চুলগুলো কি সহজে ঝরে যায়! একটুখানি ধৈর্য নেই যেন ওদের, কত তাড়াতাড়ি মাটির কাছে যাবে, এরই অপেক্ষা শুধুথচ মাটিতে মিশে যেতে পারে না ওরা, ওদের জন্মই তো পড়ে থাকার জন্যেএক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছড়িয়ে যাওয়াযতই কেটে টুকরো টুকরো করা যাক না কেন, ওদের মৃত্যু নেইঅমরত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়ানো আর এদিক থেকে ওদিক, ওদিক থেকে এদিক – এক বৃত্তের চৌহদ্দির মধ্যে নির্জীব, অন্তঃসাশূন্য হয়ে পড়ে থাকা। ক্ষয়ে যাওয়া, ঘষটে যাওয়া একের সাথে অন্যেরমিহি কোনো কিচির মিচির লেগে নেই ওতে, শুধু খসখস শব্দ তুলে শরীর আলগা করে অযথা ঘুড়ে বেড়ানোজন্মের সময় কি জানত ওরা তাদের এই পরিণতি? কেরাটিন সমৃদ্ধ জীবনে মেলানিন পিগমেন্টের বাড়বৃদ্ধি কি একটা জীবন হতে পারে? কোথায় গেল কোষে কোষে রক্তের ছোটাছুটি আর হৃদস্পন্দন! এতসব প্রশ্ন হয়তো জাগে না ওদের মনে। একটা জীবনের মতো বৃদ্ধি লেগে থাকে, পতন লেগে থাকে শুধু ওদের গায়ে। মৃত্যু থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন