কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ৩০ জুলাই, ২০১৪

০৪) অদ্বয় চৌধুরী


কবিতা পেরিয়ে

ক্যামেরাটা লাগানো ছিল অনেকটা উপরে। মৃত যীশু খ্রীষ্টের মতো দুহাত বাড়িয়ে  একা দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টটার মাথায়। ক্যামেরা লাগানো এরকম আরও অনেক ল্যাম্পপোস্ট গোটা আলিপুর জুড়ে শ’খানেক স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। যে সব স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট থেকে জীবনকে সঠিক অ্যাঙ্গেলে দেখা যায়, ধরা যায়। মাপ মতো, প্রয়োজন মতো। এই ল্যাম্পপোস্টটিও একটি স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্ট। আমরা জানি সে কথা। কিন্তু ছেলেটা জানত না।

অত উঁচু থেকে রাস্তাটার অনেকটা দেখতে পায় ক্যামেরাটা। সেই সামনে যেখানে এই মোটা কালো চকচকে সাপের মতো রাস্তাটা সামান্য একটু বাঁয়ে গোত্তা খেয়ে আরও অনেকটা মোটা একটা সাপের সঙ্গে শঙ্খ লড়িয়েছে, সেইখানটা পর্যন্ত। ওখানে একটা  ট্রাফিক সিগন্যাল আছে। লাল-হলুদ-সবুজ মণির মতো জ্বলে-নেভে। সাপের সেই মণিশোভিত ফণা গলে, তার তলা দিয়ে, একটা সাইকেল বেরিয়ে আসে। সেদিন ভোররাতে। কচুরি পানা কেটে এগোনোর মতো গাঢ় কুয়াশা ঠেলে, সরিয়ে, বুজে গিয়ে, আবার ঠেলে, সরিয়ে। কুয়াশার জন্যই ক্যামেরাটা তাকে প্রথমে ঠাহর করে উঠতে পারেনি। ক্যামেরার বদলে কোনো মানুষ হলে, যার দেখার সাথে শোনার ক্ষমতাও  আছে, সে পারত। কারণ সাইকেলের চাকার কাটা স্প্রিং-এর শব্দ অনেক দূর থেকেই শোনা যাচ্ছিল। থেমে থেমে, নির্দিষ্ট সময় অন্তর। কবিতার ছন্দের মতো। সেই কবিতা বুদবুদের মতো বছরের শুরুর হাড়-কাঁপানো রাত বেয়ে উঠে আসছিল আশপাশের উঁচু অ্যাপার্টমেন্টগুলোর থাকে থাকে সাজানো বারান্দা পর্যন্ত। তারপরে আর দুর্ভেদ্য কাচের শার্সি ঠেলে রক্তমাংসের পুতুলগুলোর মন ছুঁতে পারেনি নৈঃশব্দ্য কেটে তৈরি ঐ কবিতা। বরং নিঃশব্দ চলচ্চিত্রটি ক্যামেরায় ধরা পড়ে এক সময়। ক্যামেরা প্রথম ঠাহর করল যখন সেই সাইকেলটা তার পায়ের কাছাকাছি এসে থামে। তলা-ছেঁড়া বারমুডার উপরে মাথা পর্যন্ত নোংরা চাদর জড়ানো একটি অবয়ব নেমে আসে সাইকেল থেকে। কয়েক সেকেন্ডের ফ্রিজ শট। তারপর সাইকেলটাকে স্ট্যান্ডের উপরে বাঁ দিকে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে অবয়বটি রাস্তার মাঝখানে উবু হয়ে বসে কিছু একটা দেখতে থাকে মন দিয়ে। ম্যানহোল। ম্যানহোলের ঢাকনা। আবার উঠে দাঁড়ায় অবয়বটি। সাইকেলের ক্যারিয়ার থেকে খুলে নেয় একটা ছোট রড। গায়ের চাদরটা খুলে সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে রাখতে যায়। পড়ে যায় চাদরটা। তখন সেটাকে তুলে সাইকেলের সামনের রডে ঝুলিয়ে দেয়। তারপর চাদরের তলার হাফ-হাতা খোবলানো সোয়েটারটাও খুলে ক্যারিয়ারে রেখে দিলে একটি বছর কুড়ির সদ্য যুবকের দুবলা চেহারা মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে ক্যামেরায়। গায়ে একটি ছেঁড়া ফাটা গেঞ্জি। ছেলেটি তার আশপাশটা ভালো করে একবার দেখে নেয়। উপরের দিকেও তাকায়। যেখানে থরে থরে সাজানো রয়েছে জমাটবাঁধা নিঃসাড়তা। তারপরে এগিয়ে গিয়ে ম্যানহোলের উপরে ঝুঁকে বসে। হাতের রড দিয়ে কিছু একটা করে ম্যানহোলের ঢাকনায়। ছিটকে যায় ঢাকনাটা। ব্লেড দিয়ে কোনো স্থির, মেলে ধরা চোখ চিড়ে  দেওয়ার মতোই মেলে ধরা, স্থির নৈঃশব্দ্যকে চিড়ে দেয় এক ধাতব শব্দ। ভুড়ভুড় করে বাইরে বেড়িয়ে আসে থকথকে রংহীন দুর্গন্ধ। চমকে ছিটকে সরে আসে ছেলেটা। শব্দে, দুর্গন্ধে। ভয়ে। আবার চোখ ফেলে সারি সারি বোবা ব্যালকনি আর অন্ধ জানালাগুলোর দিকে। শব্দটা, হয়তো বা, ছুঁয়ে দিয়েছিল মোটা কাচের শার্সির আড়ালে  আশ্রয় নেওয়া সুখী রক্তমাংসের পুতুলগুলোকে। নড়ে উঠেছিল হয়তো নেতানো নরম শরীরগুলো। হয়তো একবারই মাত্র। আবার নেশাগ্রস্ত নিরাপত্তার আশ্বাসে ডুবে যায় প্রাণহীনতায়। ছেলেটা আবার এগিয়ে যায় খোলা ম্যানহোলের দিকে। নিশ্চিন্তে। তারপরে নেমে যায় ভিতরে, নিচে। নরকের গভীরে।

সাপের ফণার তলায় এসে পুলিশের গাড়িটা এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ায়। তারপর দম নিয়ে, কুয়াশাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে, লম্বা দৌড় লাগিয়ে খোলা ম্যানহোলটার সামনে এসে দাঁড়ায়। নিস্তব্ধতার কোমল শরীরে চাবুকের দাগ ফুটিয়ে তোলে তার  হুটারের শব্দ। এও একরকমের কবিতাই বটে, তবে দামাল, দাম্ভিক। উদ্ধত। এই কবিতা অবশ্যই ঘুমন্ত বারান্দা টপকে পুতুলগুলোকে ধাক্কা দিয়েছিলজেগে উঠছিল তারা। উপরে, ঘরে। নিচে, রাস্তায়, গাড়ি থেকে নেমে আসে একজন ইন্সপেক্টর, এক  সাব-ইন্সপেক্টর, এবং দু’জন কনস্টেবল। আশপাশটা দেখে নিয়ে, দূর থেকে ম্যানহোলে উঁকি মেরে, মাঝবয়সী ইন্সপেক্টর আর ছোকরা সাব-ইন্সপেক্টর কথা বলে ওঠে।
--মনে হচ্ছে মালটা নিচেই আছে!
--হ্যাঁ স্যার! কতক্ষণই বা হয়েছে! পাঁচ মিনিট স্যার।
--হুম। সাইকেলটা?
--তেওয়ারি দেখেছে স্যার! কিছুই নেই। শুধু একটা সোয়েটার আর একটা চাদর স্যার!
--বাজেয়াপ্ত কর।
--করেছি স্যার!
--হুম। ম্যানহোলে কী করতে পারে মালটা? ওখানে আছেটা কী? শুধুই তো নোংরা।  আর অসহ্য পচা দুর্গন্ধ!
--সেটাই তো স্যার ভাবছি! তবে স্যার ম্যানহোলে অনেক সময় শুনেছি মিথেন গ্যাস  থাকে। মিথেন গ্যাসে একটা দেশলাই মারলে গোটা এলাকা উড়ে যেতে পারে স্যার!  আমেরিকায় প্রায়ই ম্যানহোলে বিস্ফোরণ ঘটে। অটোমেটিক বিস্ফোরণ স্যার! আপনা  থেকেই।
--গাঁড় মেরেছে! আমেরিকায় এরকম ঘটে? এখানে তো তবে ঘটবেই। আগে বলনি কেন গান্ডু? গাড়োল কোথাকার!
--না স্যার! এখনই মাথায় এলো আমেরিকার কথাটা।
--তাহলে ফোর্সকে খবর দিতে হবে। পশ এরিয়া। মানীগুণী মানুষজনের বাস। এখানে কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। আশপাশের বিল্ডিংগুলো ইভাক্যুয়েট করে দাও।  ইমিডিয়েট।
--ওকে স্যার!
--হ্যালো কন্ট্রোল রুম? কন্ট্রোল রুম?... স্যার... আ সাসপেক্টেড পোটেনশিয়াল এনিমি হ্যাজ বিন ট্রেসড্... হি হ্যাজ ডিসেন্ডেড ইনটু আ ম্যানহোল... স্যার... মে বি উইথ আ মিশান টু ব্লো অফ দ্য এরিয়া উইথ দ্য হেল্প অফ মিথেন গ্যাস এগজিস্টস্ ইন ম্যানহোলস... স্যার... মে বি আ টেররিষ্ট... স্যার... আই কিপ গার্ডিং দ্য এন্ট্রি পয়েন্ট অফ দ্য ম্যানহোল... স্যার...
ইন্সপেক্টরের বিশাল দেহটা, ক্রমশ, এগিয়ে যায়। ম্যানহোলের খোলা মুখের উপর, ধীরে ধীরে, ঝুঁকে পড়ে। তাকে ঢেকে দেয়।

ছেলেটা এসব কোনো কিছুই জানত নাকোনো কিছুই সে জানতে পারে না। ছেলেটা,   শুধুমাত্র, এটাই জানত যে, ম্যানহোলের নিচে আছে পচা জল, নোংরা আবর্জনা, দুর্গন্ধ,  আর গোছা গোছা দামী ফাইবার কেবল্। ছেলেটা, ম্যানহোলের ভিতরে, হয়তো বা, ঠিক তখনই, ক্রমশ, কলকাতার অন্যতম পশ এরিয়ার, মানীগুণী মানুষজনের মল, মূত্র, বমি, রক্তস্রাব, বীর্য, জল, খাবার, স্কচ, ওয়াইন, শ্যাম্পেন, সোডা, কোল্ডড্রিংক্স, পচা দুর্গন্ধ এবং মিথেন গ্যাসের সঙ্গে মাখামাখি হতে হতে, হাতে তার-কাটা যন্ত্র ধরে, উপরের দিকে চেয়েছিল। তখন, হয়তো বা, সে দেখেছিল অনেকটা উপরে ঘন অন্ধকার আকাশে একথালা চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের গায়ে, হঠাৎ, ধীরে ধীরে, উঁকি মারে এক বিশাল আকারের মেঘ।

ম্যানহোলের ভিতরের এইসব কথা কিন্তু কিছুই জানা যায় না। ক্যামেরার ফ্রেমের বাইরে যা কিছু তা শুধুই অন্ধকার। আগে থেকেই। বরাবর। ম্যানহোলের বাইরে, ক্যামেরার ফ্রেমের মধ্যে তখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অসংখ্য বুটের ছন্দহীন আওয়াজ ছাপিয়ে বারবার পাক খেয়ে ওঠে কর্কশ গদ্যকথা— “আ সাসপেক্টেড পোটেনশিয়াল এনিমি হ্যাজ বিন ট্রেসড্... মে বি আ টেররিষ্ট...”

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন