কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

০১) অমিতাভ প্রামাণিক


চারানা আটানা

১৪) বাইশে শ্রাবণ


অগস্ত্য মুনি কবে দেহ রেখেছিলেন, সে বিষয়ে আনন্দবাজার বিশেষ কিছু জানায় নি। তবে অগাস্ট মাস এলে বাইশে শ্রাবণও আসে। পড়াশোনা না করে ক্লান্তির ভারে পথে  যাতে না পিছিয়ে পড়ি, তার জন্যে জানতে হয় আর এক মুনি, থুড়ি ঠাকুরের দেহরক্ষার বিষয়ে। কোনো একদিন থেকে শতবর্ষ পর অবধিই ভাবতে পেরেছিলেন  তিনি জন্মানোর দেড়শোর বেশি বছর পরেও তাঁর উদ্দেশে ফুল-বেলপাতা দেওয়া  হবে, এমন ভাবতে পারলে তিনি নিশ্চয় আধুনিক কবিতা টবিতা লিখতেন।

রবি ঠাকুর জাপান গেছিলেন। রবি ঠাকুর চা-পান করতেন। চা নিয়েই বোধহয় লিখেছিলেন চা-র অধ্যায়। পান নিয়ে কিছু লিখেছিলেন কি?

নিশ্চয় লিখেছিলেন। পানও ভরিয়ে, তিসা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও  পান। খুব ভক্তি করে উচ্চৈঃস্বরে বাজে মাইকে, কলকাতার ট্রাফিক সিগন্যালে। পানাপুকুর থেকে ভেসে আসে এই সব মধুর সুরের সুবাস। পান্তা খেয়ে কাজে যাওয়া ট্রাফিক পুলিশদের এসব শুনতে হয় বলেই কাজের মধ্যে ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসে তাদের। তাই তো রাস্তায় এত যানজট!

বাইশে সাবোনে কলকাতায় অনেক হৈ হল্লা হয়। হবেই তো! ঠাকুর খোদ কলকাতার  লোক। ছোটবেলায় জোড়াসাঁকোয় বসে গান লিখেছিলেন, এই বাড়িতে জন্ম, যেন এই বাড়িতেই মরি। সেই গান শুনে বন্ধু দ্বিজু রায় হো হো করে হেসে উঠে বললে,  আজ শাবোনের পুন্নিমাতে কী লিকেচিস, ভাই!

কলকাতা তো এখন সংস্কৃতির জোয়ারে ভাসছে। কাল অবধি যারা চাঁড়াল ছিল, এখন তারা বিভিন্ন সরকারী কালচারাল কমিটির বড় বড় হনু। আর্টিস্ট হলেই এমেলে এম্পি। সারা পিথিবির কালচারাল ক্যাপিট্যাল কলকাতা। কুলের আচার দিয়ে আলোচালের ভাত খেতে খেতে নবান্নয় কালচার নিয়ে আলোচনা হয়। কথায় কথায় রবি ঠাকুরের প্রসঙ্গ উঠে আসে। একদিন শিক্ষামন্ত্রী এক সাহিত্যিককে জিজ্ঞেস করলেন,  আচ্ছা, রবিন্দোনাথ পচিসে বৈশাক নিয়ে গান লিখেছেন, আমি গড়িয়াহাটার মোড়ে আসতে আসতে শুনে হাতের তেলোয় টুকে নিলাম। এই যে, চিরো নুতোনেরে দিলো ডাক পচিসে বৈশাক। বাইশে সাবোন নিয়ে কিছু লেখেননি? সাহিত্যিক টাক চুলকে বললেন, কী জানি, মনে পড়ছে না। একটু গুগুল করে দেখে নিন না! 

দিনে দিনে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত এই সংস্কৃতিস্বরূপ তৃণটির মূলে আছে দাদাগিরি। সেটাও রবিন্দোনাথ থেকেই প্রাপ্ত। রবি তার জ্যোতিদাদাকে কিশোর বয়স অবধি যা দাদা দাদা করত, তার তুলনা নেই। তার গান ফান-এর শিক্ষা তো দাদার কাছ থেকেই  পাওয়া। এখনকার কালচারও gun-কেন্দ্রিক, ওটাই এখনও ফান।

রবি ও জ্যোতির এক প্রভাতী পথভ্রমণ নিয়েই আমাদের আজকের চারানা আটানার পান-ভোজন।

************************************************


দিবসের যে সময়খণ্ডকে ব্রাহ্মমুহূর্ত বলা হইয়া থাকে, ঘন অন্ধকারের কুজ্ঝটিকা অবসানের সেই প্রাক্‌-ঊষালগ্নে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের নিদ্রা টুটিয়া গেল। প্রত্যূষে কদাচিৎ তিনি শয্যাত্যাগ করেন, কিন্তু অদ্য কিঞ্চিৎ পৃথক বোধ হইলশয্যাপার্শ্বে কাদম্বরী নাই, তিনি নিঃসন্দেহে প্রভাতী সৌন্দর্য অবলোকন-হেতু শয্যাত্যাগ-পূর্বক উদ্যানে পুস্পচয়নাদি প্রাত্যহিক কার্যে নিমগ্ন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বাসনা জাগিল ময়দানে গিয়া  প্রভাতবায়ু সেবনের। কক্ষ হইতে নিস্ক্রান্ত হইয়া অবলোকন করিলেন, কাদম্বরী পিঞ্জরস্থ  পক্ষীকুলকে খাদ্য বিতরণে ব্যস্ত। ডাকিয়া কহিলেন, রবি উটেচে, কাদু? না উটে  থাকলে ওকে ডেকে তোলো তো, একটু ময়দানে হাওয়া খেয়ে আসি

অর্ধঘন্টা অতিবাহিত হইবার পূর্বেই কনিষ্ঠ ভ্রাতা সমভিব্যাহারে তিনি জুড়িগাড়িতে ময়দানের পথে যাত্রা শুরু করিলেন। প্রভাতরবির প্রথম কিরণে জগৎসংসার সুষুপ্তির বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিয়া ধীরে ধীরে প্রাণচাঞ্চল্যে পূর্ণ হইতেছে। পক্ষীর কলরব, পথে চলমান দুই একটি শকট, দুগ্ধবিক্রেতার আওয়াজ প্রভৃতি শব্দ কর্ণগোচর হইল।

দুই ঘন্টা ময়দানে অতিবাহিত হইলে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কহিলেন, রবি, সাউথ  ক্যালকাটায় কোতায় একটা ভালো মিষ্টির দোকান খুলেচে, সেকেনে নাকি দারুণ কচুরি-সিঙাড়া বানায় সকালে। চ’ আজ সকালের জলখাবারটা ওকেনেই সেরে আসি 

রবি অবগত যে তাহার এই বয়োঃজ্যেষ্ঠ ভ্রাতাটি তাহাকে সন্তানপ্রতীম স্নেহ করেন।  রবিরও তাহার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা।

জুড়িগাড়ি দক্ষিণ কলিকাতার পথে যাত্রা শুরু করিল। ত্রিকোণ পার্কের সন্নিকটে উপস্থিত হইলে তাহাদের উভয়ের পরম চা-তৃষ্ণা অনুভূত হইল। পথিপার্শ্বে এক দোকান  হইতে লেড়ো বিস্কুট সহযোগে চা পান করিতে করিতে জ্যোতিদাদা কহিলেন, রবি, চেয়ে দ্যাক, এই পার্কটা কেমন বাংলা ‘ব’-অক্ষরের মতোতিনকোণা শেপের যা- কিছুকে ব-দিয়ে প্রকাশ করলে খারাপ হয় না, তাই না? ব-দ্বীপ শব্দটা তো শুনতে বেশ ভালোই লাগে, কী বলিস? 

রবি কহিলেন, হুম। বেশ বললি তো, জ্যোতিদাদা! আমি এই নিয়ে ভেবে কিছু শব্দ   বানিয়ে আমার লেখায় দেব। বাংলা সাহিত্যে ব-কারের প্রচলন খুবই প্রয়োজন। ব-ছাড়া বাংলা যেন বুড়ো আংলা!

জ্যোতিদাদা বলিলেন, ঠিক। আর দ্যাক, সকালে আমরা গেলাম ময়দান-এ, আর  এখন এই ব-তে। দুটো পাশাপাশি করলে ময়দানব, বিখ্যাত সিবিল ইঞ্জিনীয়র, মহাভারতে যে পাণ্ডবদের ইন্দ্রপ্রস্থ বানিয়েছিল। অদ্ভুত, না রে?

রবি কহিলেন, হ্যাঁ। কিন্তু আজ যে তোকে হঠাৎ শব্দের খেলায় পেয়েচে!

মাঝে মাঝে পায়, বুজলি! তুই যে এত সুন্দর লিকিস, রবি, তোর কলম যে সোনায়  মোড়া। কী করে পারিস বলতো? আমার মাথায় তো হাবিজাবির বেশি কিচু আসে না। এই দ্যাক, এই জায়গাটা এরা বাংলায় ত্রিকোণ পার্ক বলে, ইংরিজিতে ট্র্যাঙ্গুলার পার্ক। আমি ভাবচিলাম জায়গাটার নাম ব-অঙ্গন বা ব-প্রাঙ্গন হলে কেমন শুনাতো?

ভালো শুনাতো না জ্যোতিদাদা। ব-অঙ্গন থেকে বাঙ্গন হয়ে হিন্দীর বেগুনের মতো   হয়ে যেত ওটা। ব-প্রাঙ্গণ-টাও খুব সুমধুর না। কালিদাসের লেকায় বপ্রক্রীড়া শব্দ  আছে বটে, কিন্তু তার সাথে এটা কি ঠিক মিলচে? আমি বরং ভেবে দেখলাম, শুধু শেষেই না, যে রাজ্যে মানুষের পাতে অন্ন নেই, মানে ‘ন অন্ন’ অর্থাৎ কিনা নান্ন, তার মদ্যিখানে এই ব ঢুকিয়ে দিলেই নবান্ন! বেশ মজা, না? মানুষকে উল্লু বানানোর এর চেয়ে সহজ রাস্তা আর কী হতে পারে, বল?

গড়িয়াহাট পথসঙ্গম হইতে গাড়ি দক্ষিণ অভিমুখে চালিত হইল। ঢাকুরিয়া সেতু অতিক্রম করিতেই জ্যোতিদাদা উল্লসিত হইয়া উঠিলেন, রবি, সাউথ ক্যালকাটা কত  অ্যাড্‌ভান্স্‌ড্‌ হয়ে গেচে দ্যাক। লোকে দক্ষিণা দ্যায় পুরুতকে, পুজোর প্রাপ্য, অনেকটা ফী-এর মতো ব্যাপার, পুজোর মন্ত্র পড়া আর অন্যান্য রিচুয়াল করার জন্যে। একটা  সার্ভিসের ভাড়া বলতে পারিস। যেমন এখনকার দাদারা তোলা তোলে পার্টিফান্ডের নাম করে, সন্ধ্যেবেলায় মালের আসর বসায়। ঐ আসর বসানোর তাদের জন্মগত অধিকার, তার বদলে কিঞ্চিৎ দক্ষিণা তো জনগণই দেবে। তাছাড়া কনেপক্ষ পণ দ্যায় বরপক্ষকে, সেটা একটা বাজে প্রথা, কিসের বিনিময়ে দ্যায় বুঝি না। দুটো পুরো দু’রকম জিনিস। ঐ ডানদিকে চেয়ে দ্যাক, একটা দোকান খুলেচে, বোধ হচ্ছে এখেনে এই দুটো কাজই একসাথে হয়। দোকানের নামে এই দুই শব্দের সমন্বয় – দক্ষিণাপণ!

জ্যোতিদাদা, বাংলা পান না খেয়েও তোর মাতায় আজ ইংরেজি পান কিলবিল  করচে। ওটা দক্ষিণা-পণ মোটেও না। দক্ষিণ-আপণ। আ-প-মূর্ধণ্য, আপণ মানে দোকান। দক্ষিণ কলকাতার দোকান, তাই দক্ষিণাপণবুঝলি?

ঠিক বলেচিস, রবি। আমি রহস্য করতেই কতাটা বললাম। তবে কী জানিস, এইসব  শব্দের কচকচি সাধারণ লোকে ঠিক বোঝে না। আমাদের মাধ্যমিক পরীক্ষায় বাংলা ব্যাকরণে এইসব পড়তে হতোআপন-আপণ, করি-করী – এদের আলাদা আলাদা  মানেসেগুলো দিয়ে বাক্য রচনা করতে হতোতুই তো ইস্কুলে গেলি না, তোকে  এসব অত্যাচার সহ্য করতে হয়নি। বাংলা কথ্য প্রবচন নিয়ে কী যে ঝকমারি হতো!  আমাদের কেলাসে ছিল একজন, তার মাতায় গজগজ করত অদ্ভুত উদ্ভাবনী উদাহরণ। ‘খয়ের খাঁ’ দিয়ে বাক্যরচনা এসেছিল পরীক্ষায়, সে লিকেচিল – পান খেয়ে তোর জিভটা লাল হয়নি, তুই আর একটু খয়ের খাঁ! বুজে দ্যাক! তার চেয়েও এক কাঠি  ওপরে ছিল একখানা, ‘সাবধানের মার নেই’ দিয়ে। লিকেচিল – সাবধানের বাবার  মুখে ইয়া বড় বড় দাড়ি-গোঁপ, কিন্তু সাবধানের মা’র নেই!’

উদ্দিষ্ট পান্থশালায় কচুরি-সিঙ্গাড়া সহযোগে জলযোগ চলিতেছিল, অকস্মাৎ জ্যোতিরিন্দ্রের চলমান দূরভাষযন্ত্র ধ্বনিত হইল। আচকানের বুকপকেট হইতে ব্ল্যাকবেরি নিস্ক্রমণ করিয়া বোতাম টিপিতেই কাদম্বরীর কণ্ঠস্বর শ্রুত হইল। জ্যোতিরিন্দ্র কহিলেন, কাদু, আমরা কচুরি-সিঙারা খাচ্চি দক্ষিণ কলকেতার এক রেস্টোরান্টেতোমাদের  জন্যে পার্সেল নিয়ে যাব? কী বলচ? ভেজিটেবিল নেই ঘরে? ঠিক আচে, গড়িয়াহাট মার্কেট থেকে নিয়ে নেব ফেরার পতে

জ্যোতিদাদার জাহাজ লইয়া ব্যবসায়বিদেশ যাতায়াত নিত্য লাগিয়াই থাকে। প্রত্যাগমনের সময় কনিষ্ঠ ভ্রাতার জন্য উপহারসামগ্রী ক্রয় তাহার স্বভাব। ইংলণ্ড  হইতে আনিয়া দিয়াছিলেন পার্কার কলম, সুইজারল্যাণ্ড হইতে ঘড়ি, ফ্রান্স হইতে সুগন্ধি পারফিউম, গত বৎসর আমেরিকা হইতে আইফোন। নিজস্ব ব্ল্যাকবেরি কিঞ্চিৎ পুরাতন হইয়া গিয়াছে, কিন্তু তদপেক্ষা ভ্রাতার মনোরঞ্জন অধিকতর উপযোগী। এই ব্ল্যাকবেরিতে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ ব্যক্তির জন্য ভিন্ন ভিন্ন রিংটোন। সকলই রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবির নিজস্ব কণ্ঠে গীত। শুধু রবির জন্য অধিকতর বিশেষ ব্যবস্থা। সঙ্গীত নহে, শ্লোক, ইহাও রবিরই কণ্ঠে, তবে একটি নহে, কুড়িটিরবি তাহাকে দূরভাষে আহ্বান করিলে  এক একবার সেই কুড়িটির এক একটি শ্লোক বাজিতে থাকে।

গড়িয়াহাট সব্জীবাজারে প্রবেশ করিতে করিতে জ্যোতিদাদা কহিলেন, বুজলি রবি,  একটা অস্ট্রেলিয়ান জাহাজের সন্ধান পেয়েচি, বেশ সস্তা। দরদাম করে আর একটু কমিয়ে ওটা কিনে ফেলব ভাবচি। কী বলিস?

রবি একটি মশলার দোকানের নিকট আসিয়া দোকানিকে কহিলেন, ভাই, তোমার  আদা কত করে?

হাস্যমস্করা সহযোগে শাকসব্জী ক্রয় চলিতে লাগিল। জ্যোতিদাদা কহিলেন, রবি, তোর  মনে আচে, সেই যে আমরা বাবামশাইয়ের সঙ্গে উত্তর ভারতের হিমালয় গেচিলুম?  সেকেনে এক মন্দিরের কাচে ছোট বড় গাদা গাদা বাঁদরের কী উৎপাত! বাচ্চাদের হাত থেকে খাবার কেড়ে খাচ্চিল সব। আমি একছড়া মর্তমান কলা কিনলুম, দোকানিটা একটা ক্যারিব্যাগে ভরে দিল সেই কলা। তোর হাতে খালি ক্যারিব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে আমি কলাগুলো নিজের সঙ্গে রাখলুম। কোত্থেকে এক বাঁদর এসে তোর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল সেই ক্যারিব্যাগ। পরে সেই ব্যাগটা খালি দেখে তোকে তার কী মুখ-খিঁচুনিমনে আচে তোর?

হ্যাঁ, থাকবে না! সে ছিল অবিকল আজকালকার দাদা-দিদিদের মতোযাদের কিছু   নেই, তাদের জিনিস কেড়েও আনন্দ। আমি তো সেই বাঁদরটার নাম দিয়েছিলেম fool-কপি। হ্যাঁ ভাই, তোমার এই ফুলকপির জোড়া কত? বলিতে বলিতে তাহাদের   ফুলকপি ক্রয়ও সমাধা হইয়া গেল

শাকসব্জীর বাজারের পার্শ্বেই মুদি ও মনোহারি দোকানের সমাবেশ। ‘আরশিনগর’ নামক একটি দোকানে ক্ষুদ্র-বৃহৎ দর্পণের সমাহার। জ্যোতিদাদার দৃষ্টি সে দোকানের একটি বিশেষ কোণে নিবদ্ধ হইল। সেইস্থলে দর্পণ নহে, কাচের খণ্ডের উপর বিভিন্ন তৈলচিত্র অঙ্কিত। জ্যোতিদাদা রবিকে ডাকিয়া কহিলেন, রবি, এই গ্লাস-পেন্টিংগুলো দ্যাক,  আমি গতবার ইওরোপ থেকে কাদুকে যেগুলো এনে দিয়েচিলাম, তার চেয়েও ভালো প্যাটার্ণগুলোর মধ্যে আমাদের অবনীর আঁকার একটা প্রভাব পড়েচে, লক্ষ্য করেচিস? যেন ওরা হাঁক পেড়ে বলচে, ‘অবনী, বাড়ি আচো?’ আমাদের দেশেও যে এ রকম ভালো ভালো গ্লাস-পেন্টিং পাওয়া যায়, আমার ধারণাই ছিল না। এদের একটা ভালো নাম দে তো!”

রবীন্দ্রনাথ কহিলেন, হুম। এই রকম আয়নায় যদি মুখ দেখতো এখনকার নেতাগুলো,   তবে ন্যাতা থেকে কিঞ্চিৎ উঁচুদরের হতো হয়্তোশিল্প বলতে এরা ইন্ডাস্ট্রী বোঝে না,  পকেট সাফ করা বোঝে। কাচ নিয়ে এই শিল্প, এর উপযুক্ত নাম হল কাচ-কলা। এর চেয়ে ভালো নাম এর হতেই পারে না। কাচকলা কিনেছিস তো জ্যোতিদাদা? 

জ্যোতিরিন্দ্র সেইক্ষণে এক তরুণ মূলা-বিক্রেতার সহিত আলাপন করিতেছিলেন। কী হে ছোকরা, তোমার এই মূলো কত করে? এ হে, যা খেলেই পেটে গ্যাস হয়, তিনও মূলোর এত দাম! তুমি বাপু মূলো বেচা ছেড়ে মন্ত্রী হয়ে যাও না! এত কষ্ট করে গ্যাস সাপ্লাই দিতে হয় না তাহলে। সারাদিন গ্যাস ছাড়বে, লোকে তোমার পায়ে এসে আলুটা মূলোটা ফেলে যাবে!”

বাজার সমাধা হইলে পুনরায় জুড়িগাড়িতে আসন গ্রহণ করিয়া জ্যোতিরিন্দ্র কহিলেন, কাদু বলচিল তেল-সাবান-টুথপেস্ট এসবও কিনতে হবে। এগুলো বিগ বাজার থেকে  নেওয়াই ভালো, কী বলিস, রবি? দাম সস্তা পড়বে

বিগ বাজারের সম্মুখে পরিদর্শন করিলেন এক বিশাল জনস্রোত। যেন সমস্ত কলিকাতা নগরী এই একটি দোকানে আপন সামগ্রী ক্রয়ের নিমিত্ত উপস্থিত হইয়াছে। বিশাল ব্যানারে বিজ্ঞাপিত হইতেছে, কোন বস্তু ক্রয় করিলে তৎসহ অন্য কোন বস্তুর কত অংশ বিনামূল্যে প্রাপ্ত হইবে। মহিলাদিগের অধররঞ্জনীর সহিত পুরুষদের শ্মশ্রুকর্তক  বিনামূল্যে। চারিটি সাবানের সেট ক্রয় করিলে পঞ্চমটির মূল্য লাগিবে না। তদ্রূপ পঞ্চ কিলোগ্রাম চাউল ক্রয় করিলে অর্ধকিলোগ্রাম শর্করা।

জ্যোতি ও রবি কোনোপ্রকারে সেই দোকানের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া প্রয়োজনীয়  বস্তুসমূহ নিজস্ব চলমান ঠেলাগাড়িতে সংগ্রহ করিতে লাগিলেন। জনস্রোতের চাপে প্রতি পদক্ষেপে দুইজন বিচ্ছিন্ন হইয়া যান। সমস্ত বস্তু সংগৃহীত হইলে রবি মূল্যপ্রদানের লাইনে দণ্ডায়মান হইলেন। সেই স্থলে দোকানের অন্তঃপুর হইতেও অতিরিক্ত জনসমাগমএক মুহূর্ত জ্যেষ্ঠভ্রাতার দর্শনপ্রাপ্তি ঘটে, তো পরমুহূর্তেই তাহাকে পুনরায় অন্বেষণের  প্রয়োজন হয়। জ্যোতিদাদাও বিপর্যস্তনিরুপায় রবীন্দ্রনাথ কহিলেন, জ্যোতিদাদা, তুই  এক কাজ কর। বেরিয়ে গেটের কাছে গিয়ে আমার জন্যে অপেক্ষা কর। আমি দাম দিয়েই আসচি, তোকে মিস্‌ড্‌ কল করে দেব’খন!”

চতুষ্পার্শে এত কলরব, জ্যোতিদাদা রবির বার্তা সঠিকভাবে অনুধাবন করিতে পারিলেন না বলিলেন, কী বলচিস, জোরে বল!”  

রবীন্দ্রনাথ অনুভব করিলেন স্বাভাবিক সংলাপ এইস্থলে উত্তমরূপে শ্রুতিগোচর হইবে না। পরিপার্শ্বের সকলকে হতচকিত করিয়া উদাত্ত বাউলের ন্যায় উচ্চৈস্বরে গাহিয়া উঠিলেন – আপণ হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ-শোলোকের পাবি  সাড়া...


2 কমেন্টস্:

  1. এ সময় ও পরিসরে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা লেখা। যথার্থ বিনির্মাণ। ''রবীন্দ্রনাথ অনুভব করিলেন স্বাভাবিক সংলাপ এইস্থলে উত্তমরূপে শ্রুতিগোচর হইবে না। পরিপার্শ্বের সকলকে হতচকিত করিয়া উদাত্ত বাউলের ন্যায় উচ্চৈস্বরে গাহিয়া উঠিলেন – “আপণ হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া...” এটা দাগিয়ে দাগিয়ে পড়লাম।

    উত্তরমুছুন