কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০১৪

০১) সুকোমল ঘোষ



মহেশ

কাহিনী - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

নাট্যরূপ - সুকোমল ঘোষ



(১)

(গফুরের বাড়ির সামনের রাস্তা)

তর্করত্নঃ গফুর, ওরে ও গফরা, বলি ঘরে আছিস?
         (মেয়ে আমিনা দুয়ারে দাঁড়িয়ে সাড়া দেয়, বয়স বছর দশেক)
আমিনাঃ ডাকছ কেন বাবাকে? বাবার যে জ্বর।
তর্করত্নঃ জ্বর! ডেকে দে হারামজাদাকে। পাষন্ড। ম্লেচ্ছ।  
         (হাঁকডাকে গফুর কাঁপতে কাঁপতে বাইরে আসে)
গফুরঃ পেন্নাম হই বাবাঠাকুর! বোশেখের আগুন ঝরা দুপুরে কোত্থেকে আসছো  বাবাঠাকুর?
তর্করত্নঃ জমিদার বাড়ি থেকে, তার ছোটছেলের জন্মতিথির পুজো সেরে। কিন্তু তোর বাড়ি কী অবস্থা? দেওয়াল ভেঙ্গে উঠোন-রাস্তা এক হয়ে গেছে! আর লোকজন  আসা যাবার পথে ষাঁড়টাকে বেঁধে রেখেছিস?
গফুরঃ  কী করবো বল বাবাঠাকুর! সবই তো জান, বোঝ।
তর্করত্নঃ তোর আক্কেলটা কী বল তো গফরা? এ হিঁদুর গা। ব্রাহ্মণ জমিদার। সে খেয়াল আছে?
গফুরঃ  কেন, কী করেছি বাবাঠাকুর?
তর্করত্নঃ কী করেছিস? সকালে যাবার সময় দেখে গেছি বাঁধা, দুপুরে ফেরবার পথে দেখছি তেমনি ঠায় বাঁধা। গো হত্যা হলে যে কর্তা তোকে জ্যান্ত কবর দেবে! সে, যে-সে বামুন নয়।  
গফুরঃ  কী করব বাবাঠাকুর, বড় লাচারে পড়ে গেছি। কদিন থেকে গায়ে জ্বর, দড়ি  ধরে যে দু' খুঁটো খাইয়ে আনবো- তা মাথা ঘুরে পড়ে যাই।
তর্করত্নঃ তবে ছেড়ে দে না, আপনি চরাই করে আসুক।
গফুরঃ  কোথায় ছাড়ব বাবাঠাকুর? লোকের ধান এখনো সব ঝাড়া হয়নি- খামারে পড়ে- খড় এখনো গাদি দেওয়া হয়নি, মাঠের আলগুলো সব জ্বলে গেল, কোথাও এক মুঠো  ঘাস নেই। কার ধানে মুখ দেবে, কার গাদা ফেড়ে খাবে- ক্যামনে ছাড়ি বাবাঠাকুর।
তর্করত্নঃ (নরম হয়ে) না ছাড়িস তো ঠান্ডায় কোথাও বেঁধে দিয়ে দু'টি বিচুলি ফেলে দে না, ততক্ষণ চিবোক। তোর মেয়ে ভাত রাঁধেনি? ফ্যানেজলে দে না এক গামলা, খাক।
গফুরঃ   (নীরব, অসহায়- তার প্রকাশ শব্দ)
তর্করত্নঃ রে চুপ করে আছিস যে বড়? অ, তাও নেই বুঝি? কি করলি খড়? ভাগে এবার যা পেলি সমস্ত বেচে পেটায় নমঃ? গরুটার জন্য এক আটি ফেলে রাখতে নেই! ব্যাটা কসাই।
গফুরঃ  (নীরবে হজম করে) কাহন খানেক খড় এবার ভাগে পেয়েছিলাম, কিন্তু গত সনের বকেয়া বলে কর্তামশাসব ধরে রাখলেন। কেদে কেটে হাতে পায়ে পড়ে  বললাম, বাবুমশায়- হাকিম তুমি, তোমার রাজত্বি ছেড়ে আর পালাবো কোথায়? আমাকে পণ দশেক বিচুলিও না হয় দাও। চালে খড় নেই- একখানি ঘর, বাপ-বেটিতে থাকি, তাও না হয় তালপাতার গোঁজা গাঁজা দিয়ে এ বর্ষাটা কাটিয়ে দেবো, কিন্তু না খেতে  পেয়ে আমার মহেশ যে মরে যাবে!
তর্করত্নঃ ঈস, সাধ করে আবার নাম রাখা হয়েছে মহেশ! হেসে বাঁচিনে।
গফুরঃ  কিন্তু হাকিমের দয়া হলো না। মাস দুয়েকের খোরাকের মতো ধান দুটি আমাদের দিলেন, কিন্তু বেবাক খড় সরকারে গাদা হয়ে গেল, মহেশ আমার কুটোটিও পেলে না।
তর্করত্নঃ আচ্ছা মানুষ তো তুই? খেয়ে রেখেছিস, শোধ দিবি নে? জমিদার কি তোকে ঘর থেকে খাওয়াবে? না কি! তোরা তো রাম-রাজত্বে বাস করিস-  ছোটলোক কিনা, তাই তার নিন্দে করে মরিস।
গফুরঃ  নিন্দে করবো কেন বাবাঠাকুর, নিন্দে তার আমরা করিনে। কিন্তু কোথা থেকে দিই বলো তো? বিঘে চারেক জমি ভাগে করি, কিন্তু উপরি উপরি দুই সন অজন্মা- মাঠের ধান মাঠেই শুকিয়ে গেল- বাপ বেটিতে দু'বেলা পেট ভরে দুটো খেতে পর্যন্ত পাই নে। ঘরের পানে চেয়ে দেখ, বিষ্টি বাদলে মেয়েটিকে নিয়ে কোণে বসে রাত কাটাই, পা ছড়িয়ে শোবার ঠাই মেলে না। মহেশকে একটিবার তাকিয়ে দেখ, পাঁজরা গোণা যাচ্ছে- দাও না ঠাকুরমশায়, কাহন দুই ধার- গরুটাকে দুদিন পেট পুরে খেতে দিই- তোমার পায়ে পড়ি ঠাকুরমশায়।
তর্করত্নঃ করিস কি, করিস কি; আ মর ছুঁয়ে ফেলবি নাকি?
গফুরঃ  না বাবাঠাকুর, ছোঁব কেন, ছোঁব না। কিন্তু দাও না আমাকে কাহন দুই খড়, তোমার চার চারটে গাদা সেদিন দেখে এসেছি- দুটি দিলে তুমি টেরও পাবে না। আমরা না খেয়ে মরি ক্ষতি নেই, কিন্তু আমার বলা জীব-  কথা বলতে পারে না, শুধু চেয়ে থাকে, আর চোখ দিয়ে জল পড়ে।
তর্করত্নঃ  ধার নিবি, শুধবি কি করে শুনি?
গফুরঃ   যেমন করে পারি শুধবো বাবাঠাকুর। তোমাকে ফাঁকি দেবো না।
তর্করত্নঃ  ফাঁকি দেবো না, যেমন করে পারি শুধবো! রসিক নাগর! যা যা সর, পথ ছাড়!
             (যাবার উদ্যোগে মহেশের কাছাকাছি উপস্থিতির আভাষ)
       আ মর, শিং নেড়ে আসে যে, গুঁতোবে না কি?
গফুরঃ   বাবাঠাকুর, তোমার পুঁটুলিতে ভিজে চাল আছে, গন্ধ পেয়েছে। খেতে চায়।
তর্করত্নঃ  খেতে চায়! তা বটে, যেমন চাষা তার তেমনি বলদ। খড় জোটে না, চাল-কলা খেতে চায়! নে নে, পথ থেকে সরিয়ে বাঁধ। যা শিং, কোনোদিন দেখছি কাউকে খুন করবে-
             (গরু তাড়ানোর শব্দ করতে করতে চলে যায়)  
গফুরঃ  তোকে দিলে না এক মুঠো! ওদের অনেক আছে তবু দেয় না- না দিক গে- জমিদার তোর মুখের খাবার কেড়ে নিলে, শ্মশান ধারের গোচরটুকুও পয়সার লোভে বিলি করে দিলে। ছেড়ে দিলে তুই পরের গাদা ফেড়ে খাবি, মানুষের কলাগাছে মুখ দিবি- তোকে নিয়ে আমি কী করি! লোকে বলে তোকে গো-হাটায় বেচে দিতে। নে, তোকে চালের থেকে খড় টেনে দিই- শীগগির করে  খেয়ে নে বাবা, দেরি হলে আবার--
আমিনাঃ  বাবা!
গফুরঃ  কেন মা!
আমিনাঃ ভাত খাবে এসো।(হঠাৎ) মহেশকে আবার চাল ফেড়ে খড় দিয়েছ বাবা?
গফুরঃ  পুরনো পচা খড় মা, ঝরে যাচ্ছিল।
আমিনাঃ কিন্তু দেওয়ালটা যে পড়ে যাবে বাবা। হাত ধুয়ে ভাত খেতে এসো।
গফুরঃ  ফ্যান টুকু দে তো মা, একেবারে মহেশকে খাইয়ে দিয়ে যাই।
আমিনাঃ ফ্যান যে আজ নেই বাবা, হাড়িতেই মরে গেছে।
গফুরঃ  নেই? আমিনা, আমার যে আবার শীত করে মা, জ্বর গায়ে ভাত খাওয়া কি ভালো? এক কাজ কর না মা, মহেশকে না হয় ধরে দিয়ে আয়। রাতের বেলা আমাকে এক মুঠো ফুটিয়ে দিতে পারবি নে আমিনা?
আমিনাঃ পারবো বাবা।

 
(২)

(গফুরের বাড়ি)

প্রতিবেশীঃ আমিনা, আমিনা, ঘরে আছিস?
আমিনাঃ  কী বলছো?
প্রতিবেশীঃ তোর বাপ কোথায় রে?
আমিনাঃ  বাবা তো ও পাড়ায় চাল ছাইতে গেছে।
প্রতিবেশীঃ আরে আমিও তো সেই জন্যই এসেছিলাম। ছিল ভালো, চাষ করে খাচ্ছিল,  আর এখন মজুর। তা কী আর করবে বল? এই বোশেখে কালবৈশাখী তো দূরের কথা, আকা থেকে খালি আগুন ঝরছে। শোন গফরাকেকে বলবি  আমার গোয়ালের খড়গুলো নতুন করে ছাইতে হবে। আসতে বলিস, তখন কথা বলা যাবে। চলি রে
আমিনাঃ আচ্ছা। (স্বগতোক্তি) বাবার জ্বর আজ চার পাচ দিন হলো ছেড়েছে- গায়ে নাই জোর, তবু এত পরিশ্রম। সহ্য হয় কী করে? তার পর মহেশ। নিজে না খেয়ে থাকবে, কিন্তু মহেশ না খেলে তার শান্তি হবে না। নিজের পাতের ভাত তুলে দিতেও বাবার কোনো দ্বিধা নেই।  
গফুরঃ  (বাইরে থেকে ডাকে, পরিশ্রান্ত, ক্ষুধার্ত )আমিনা, ভাত হয়েছে র? বেড়ে রাখ, আমি হাত পা ধুয়ে আসছি।
আমিনাঃ (নিরুত্তর)।
গফুরঃ   কী হলো, খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে রইলি যে!
আমিনাঃ (নিরুত্তর)।
গফুরঃ   হয়েছে ভাত? ও হয়নি, কেন শুনি?
আমিনাঃ  চাল নেই বাবা।
গফুরঃ   চাল নেই? সকালে আমাক বলিস নি কেন?
আমিনাঃ  তোমাকে রাত্তিরে যে বলেছিলুম।
গফুরঃ (ভেংচিয়ে) রাত্তিরে যে বলেছিলুম রাতে বললে কারো মনে থাকে? আর চাল থাকবে কী করে! রোগা বাপ খাক আর না খাক, বুড়ো মেয়ে চার বার পাঁচবার করে ভাত গিলবি! এবার থেকে চাল আমি কুলুপ বন্ধ করে বাইরে যাব। দে একঘটি জল দে, তেষ্টায় বুক ফেটে গেল। বল তাও নেই!
আমিনাঃ (নিরুত্তর)।
গফুরঃ  (চড় মারে) মুখপোড়া হারামজাদী মেয়ে, সারাক্ষণ তুই করিস কী? এত লোকে মরে, তুই মরিস নে!
আমিনাঃ (কাঁদার অভিব্যক্তি)আমি জল আনতে গিয়েছিলাম বাবা, গর্ত খোঁড়া জল। বে-জাত বলে নিজে তো নিতে পারি না; আর, আজ কেউ আমার ঘড়াতে জল ঢেলে দেয়নি। আমি আর একবার যাচ্ছি বাবা।(আমিনা বেরিয়ে যায়)।
গফুরঃ  (স্বগতোক্তি) আল্লা, আমাকে মাফ কোরো! ঐটুকু মেয়ের গায়ে আমি হাত তুলেছি। ও মেয়ে যে পাঁচবার খায় না, তাও আমি জানি। সামান্য জল,  তাও সে ভিক্ষেতে পায়। কেন, কেন তুমি ক্ষিধে দিলে, পিপাসা দিলে আর যদি দিলে, তার সঙ্গতি আমাদের কেন দাওনি?  
                                        (বাইরে থেকে ডাক আসে)
লোকঃ  গফরা, ঘরে আছিস?
গফুরঃ  (তিক্ত) আছি, কেন?
লোকঃ  বাবুমশায় ডাকছেন, আয়।
গফুরঃ  আমার খাওয়া দাওয়া হয়নি, পরে যাব।
লোকঃ  হারামজাদা, বাবুর হুকুম জুতো মারতে মারতে টেনে নিয়ে যেতে।
গফুরঃ  শোন সুমুদ্দির পো, মহারাণীর রাজত্বে কেউ কারো গোলাম নয়। খাজনা দিয়ে বাস করি, আমি যাব না।
লোকঃ  যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! হারামজাদা, তবে দেখ কী করে তোকে  নিয়ে যাই--
                              ( মার, চড়, কিল, ঘুষি, হ্যাচড়া টান...)


(৩)

(শিবচরণ জমিদারের বৈঠকখানা)

তর্করত্নঃ এ হিঁদুর গা। আমাদের কাছে গো হলো মাতা। তাদের মাতৃজ্ঞানেই যত্ন করা উচিত। গফরা তার ষাঁড়টাকে যে ভাবে রেখেছে, তাতে যে কোনো দিন গো-হত্যা হবে। তার পাপ তো আমাদের বর্তাবে, না কি? না হুজুর, আপনিই হাকিম, এর একটা বিহিত করুন।
জমিদারঃ আজকের ঘটনা কি তোমরা জান?  
প্রতিবেশীঃ না হুজুর, কী হয়েছে?
জমিদারঃ এই ষাঁড় দড়ি ছিঁড়ে বেরিয়ে আমার বাগানের ফুলগাছের দফারফা করেছে। ধান শুকাতে দেওয়া ছিল, সেগুলো মাড়িয়ে ছড়িয়ে নষ্ট করেছে। উপরন্তু যখন গরুটাকে ধরার চেষ্টা করা হচ্ছিল, ছোট খুকীকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে  পালিয়েছে। আমি ওকে ডাকতে পাঠিয়েছি।
তর্করত্নঃ   খেতে তো পায় না ,কিন্তু নজর উঁচু– ওই ষাঁড় পুজোর চাল-কলা খেতে চায়, খড়–বিচুলি-ফ্যান নয়।
প্রতিবেশীঃ এ রকম ঘটনা হুজুর আগেও ঘটেছে। মাণিক ঘোষ তো জন্তুটাকে দরিয়াপুরের খোঁয়াড়ে পুরেছিল।
তর্করত্নঃ   হ্যাঁ, শুনেছিলাম। বংশীর কাছে শুনেছিলাম। তার দোকানে পেতলের থালা বাঁধা দিয়ে ষাঁড়টাকে ছাড়িয়ে এনেছিল।
জমিদারঃ  আমি আরো খবর শুনেছি- জবাই করার জন্য গফরা তার ষাঁড়টাকে বেচে দেবার চেষ্টা করেছিল। দাম পায়নি, নাকি ভগবান সুমতি দিয়েছিল, জানি না- শেষ পর্যন্ত সে অবশ্য বেচেনি। তবে কথাটা আমার কানে এসেছে।
তর্করত্নঃ   পাষন্ড হুজুর, একে তো ম্লেচ্ছ, তায় ধর্মজ্ঞানহীন।
প্রতিবেশীঃ না হুজুর এ চলতে দিতে পারা যায় না। অধর্ম হবে।
তর্করত্নঃ  জীব যখন রেখেছ, তখন তার খাবার ব্যবস্থা করা তো তোমারি কর্তব্য। নয় কি?
(পেয়াদা ঢোকে গফুরকে নিয়ে)
পেয়াদাঃ  হুজুর, গফরাকে নিয়ে এসেছি। আসতে চাইছিল না হুজুর, মেরে ধরে আনতে হয়েছে। বলেছে খাজনা দিয়ে বাস করি, কারো গোলাম নই।
জমিদারঃ  এত বড় আস্পর্ধা! লাগা, লাগা চাবুক হারামজাদাকে। মেরে চিৎ করে  ফেল ব্যাটাকে-
             (লাথি, চড়, ঘুসি- গফুরের আর্তনাদ)


(৪)

 (গফুরের বাড়ি। গফুর দাওয়ায় বসে, আমিনা উঠোনে)

আমিনাঃ বাবা, মহেশ আবার দড়ি ছিঁড়ে পালিয়েছে- এখনো ফেরেনি।  
গফুরঃ   (নিরুত্তর)।
আমিনাঃ ঈস, জমিদারের চাবুকে তোমার গায়ে যে দাগ পড়েছে বাবা! একটু গরম জলের সেঁক  দিয়ে দেবো বাবা?
গফুরঃ   (নিরুত্তর)।
আমিনাঃ মহেশকে খুঁজবে  না বাবা? যদি আবার কেউ খোঁয়াড়ে দেয়?
গফুরঃ   না, ওর নাম উচ্চারণ করবি না আমার কাছে।

(সহসা মহেশ সবেগে আসে, আমিনাকে গুঁতিয়ে ফেলে দেয়, জলের ঘড়া ফুটো করে দিয়ে মাটিতে গড়ানো জল খেতে চায়।)
আমিনাঃ বাবা, ওই তো মহেশ, বাবা, বাঁচাও, মহেশ আমায় গুতিয়ে ফেললো। বাবা, মহেশ ঘড়া ভেঙ্গে দিল। সব জল যে গড়িয়ে গেল বাবা!
গফুরঃ  (ক্ষিপ্ত) হারামজাদা! জল খাওয়া বার করছি তোমার। চরে খেতে পার না, লোকের ঘরে উপদ্রব করো! আজ তোমার একদিন কী আমার একদিন! এই লাঙ্গলের মাথা দিয়েই আজ তোমায় শেষ করবো—
                          (আঘাত করে)
আমিনাঃ বাবা, বাবা, কী করলে বাবা! মহেশের কান দিয়ে যে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে- ও যে থরথর করে কাঁপছে- ও বাবা, মহেশ যে পড়ে গেল- কী করলে  বাবা, আমাদের মহেশ যে মরে গেল--
                    (কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে)
গফুরঃ   (নিরুত্তর)।
আমিনাঃ  কী করলে বাবা! এরপর কী হবে?
গফুরঃ   (ঘোরের মধ্যে) মুদ্দোফরাস আসবে- তারা বাঁশে বেঁধে মহেশকে ভাগাড়ে নিয়ে যাবে- তাদের হাতে ধারালো চকচকে ছুরি... আর আমাদের! জমিদারের লোক বেঁধে নিয়ে যাবে। বিচার হবে গো-হত্যার। তর্করত্নর প্রায়শ্চিত্তের বিধানের ব্যবস্থা করতে আমাদের ভিটে বেচতে হবে...
আমিনাঃ  বাবা!
গফুরঃ   আমিনা, চল আমরা যাই।
আমিনাঃ  কোথায় যাব বাবা?  
গফুরঃ    ফুলবেড়ের চটকলে কাজ করতে।
আমিনাঃ  কিন্তু তুমি যে বলেছিলে, সেখানে মেয়েদের ধর্ম থাকে না, মেয়েদের ইজ্জত, আব্রু থাকে না!
গফুরঃ  দেরি করিস নে মা, অনেক পথ হাঁটতে হবে।
আমিনাঃ থালা ঘটিগুলো সঙ্গে নিয়ে নিই বাবা?
গফুরঃ   ও সব থাক মা, ওতে আমার মহেশের প্রাচিত্তির হবে।
আমিনাঃ চল বাবা।
গফুরঃ   (ডুকরে ওঠে) আল্লা, আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো, কিন্তু মহেশ আমার  তেষ্টা নিয়ে মরেছে। তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি। যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তোমার দেওয়া তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি, তার কসুর তুমি যেন কখনো মাপ কোরো না।

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন