কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

০৬) তুষ্টি ভট্টাচার্য



তুষ্টি ভট্টাচার্য


মন লিখিয়ে 


হাত-পা বেঁধে রাখি দড়ি দিয়ে তবু যেন কেমন করে লিখে ফেলি মনে মনে মনের অভ্রর টাইপো হয় না খুটখুট না করেই নিঃশব্দে লিখে ফেলে পেজের পর পেজ যখন হাত-পা খুলে ফেলি কাজ করার জন্য, তখনও দেখি লেখা চলছে ওর এক সময়ে খুব বিরক্ত হতাম, বাছা বাছা অনেক গালাগাল দিয়েছি ওকে, কোনো লাভ হয় নি এখন আর কিছু বলি না ওকে যা পারে করে করুক দেখি ওর কদ্দিন দম থাকে!

আর এভাবেই যা কিছু লেখা হতে থাকে আমার মনের ভেতর খুটখুটিয়ে, তারই কিছু ফুটপ্রিন্ট পড়ে যায় আমার ওয়ার্ড ফাইলে এক্ষেত্রে আমার কোনো ভূমিকা থাকে না  একদমই আমি বসে পড়ি কিবোর্ডের সামনে আর লেখা হতে থাকেএ সময়ের আমি ঠিক আমি নাআমার অচেনা অন্য কেউ যেন এসে ভর করে আমার ওপর। আমার আঙুল নড়েচড়ে, কীসব যেন লিখে যায় আমারই আঙুল ধরেঠিক যেমন প্ল্যানচেটের সময় হয় বলে শুনেছি। যে আত্মাকে ডাকা হয়, সে এসে উপস্থিত হয় এক মিডিয়ামের ওপরআর সেই মিডিয়াম তখন আর রাম, শ্যাম, যদু, মধু থাকে না। সে বিকৃত গলায় কথা বলে, স্লেটে আঁক কাটে ভর করা বিদেহীর ইচ্ছে অনুযায়ীগোদা বাংলায় এরকমই আমাকে ভূতে পায় এক এক সময়েসেই সময়ে অন্য কাজ এলে খুব বিরক্ত লাগে, একরাশ হতাশা উঠে আসে বুক থেকে মুখেআর প্রায়ই মুখ দিয়ে বেরোতে থাকে – ‘ধুর্‌, ভাল্লাগে না...!

আবার অনেক সময় দেখা যায়, যে ভূতের তাড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আর আমি কয়েকদিন পরে খেয়াল করি... আরে ভূতটা কোথায় গেল! ব্যাস্‌, এবার আমি উল্টে ভূত খুঁজে ফিরি। তখন আমার পাগল পাগল অবস্থা খেয়ে শান্তি নেই ঘুমোতে গেলে স্বপ্নে ভূত দেখি মনের লেখালিখি বন্ধ হয়ে যায় বলেই আমাকে আর ভূতে পায় নাখুব অস্থির লাগে কটা দিনোর করে বসে থাকি কিবোর্ডের সামনেঅভ্যাসে কিছু লেখা হয় বটে, কিন্তু নিজের কাছে নিজের ফাঁকি ধরা পড়ে যায়খুব বকি মনকে কেন রে তুই এমন খামখেয়ালী! িয়ম মতো লিখিস না কেন? এভাবে কী লেখালিখি হয়! লিখতে গেলে ধৈর্য লাগে, মনোযোগ লাগে। তা না... এভাবে দুমদাম কখন লিখিস আর কখন হাত গুটিয়ে বসে থাকিস, তো কোনো কাজের কথা না! তবু সে কথা শোনে নাএভাবে চলতে চলতে হঠাৎ করে যেন কোনো জানালা খুলে যায়  আচমকামন দেখি আবার গুছিয়ে গাছিয়ে বসে খুটখুট শুরু করেছেআর সেই ভূতটা এতদিন বাদে ফিরে এসে আমাকে বেদম খাটিয়ে মারছে কিবোর্ডে

যখন কিছু লিখতে শুরু করি, প্রথম প্রথম সে আমার বড় অচেনা থাকে। একটু দূর থেকে দেখি ওকেযত লেখা এগোতে থাকে আমাদের আলাপ বাড়ে, একে অন্যকে চিনতে পারি একটু একটু। তখন মন খুলে দিই, সব উগড়ে লিখে ফেলিআমার সাথে আমার লেখার আর দূরত্ব থাকে না। কখন যেন আমি আর ও, ও আর আমি এক হয়ে যাই মিলেমিশেতবে আমার একটু তাড়া থাকে, যেন সব কাজ সবার আগে শেষ করে ফেলতে পারলে আমাকে কেউ ক্যাডবেরি দেবে, তাই লেখাও শেষ হয়ে যায় বড্ড তাড়াতাড়িআমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচিযাক শেষ করে ফেললাম তবে! মনটা হালকা পালকের মতো হয়ে ওঠে তখন, মনে হয় পৃথিবীর টান ছেড়ে আমি  মাটি থেকে অনেক ওপরে ভেসে ভেসে ক্যাডবেরি খাচ্ছি! কিছুক্ষণ বাদে ফিরে দেখি যখন - ফিরে আসি যখন ওই শেষ হয়ে যাওয়া লেখার কাছে, বুঝি ইচ্ছে করে শেষ করে দিয়েছি আমি ওকেনিজের হাতে খুন করেছি ওকেঅথচ আবার প্রাণ  দিতে পারি না, ছুঁইয়ে দিতে পারি না জীয়ন কাঠি। মনে হয়, থাক ও এভাবেই ঘুমিয়ে। আর কেন জাগাই ওকে! মায়া নিয়ে চেয়ে থাকি ওর দিকেঘুমন্ত মুখের ওপর চুল পড়ে গেলে সরিয়ে দিই আলগোছে - যেভাবে টাইপো ঠিক করি আর কী!

এভাবেই লিখি, অগোছালো টাইপ করে চলি ছোট ছোট বাক্য। কবিতায় বেশি বেশি কথা বলি... অধরা থাকে না তার কিছুইসে তখন না কবিতা, না গদ্য হয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমায় মুখ ভ্যাংচায়। উপন্যাস লিখব ভাবি, আবার সভয়ে পিছিয়ে আসি। যদি শেষ না করতে পারি! শেষকরতেই হবে এক নিঃশ্বাসে, এই পাগল পাগল ইচ্ছা আমাকে ছুটিয়ে মারেআমার ভূত তখন বদ্ধ উন্মাদ হয়ে আমার টুটি টিপে ধরে বলে খেয়ে ফেল সব অক্ষরগুলো! যত কালো কালো অক্ষর লিখছিস,  সব গপ্‌ করে গিলে নে! কোথাও কোনো চিহ্ন থাকে না যেন ওই সব হাবিজাবির! একেক সময় গায়ের জোরে জিতে যাই, এক ঝটকায় ওকে মাটিতে পেরে ফেলি, পা দিয়ে পিষে ফেলি ওকেও অজ্ঞান হয়ে যায় তখন, আর আমি জিতে গিয়ে ফের অভিসারে যাই আমার কিবোর্ডের কাছে। অক্ষর সাজাই, সাবান দিয়ে স্নান করিয়ে দিয়ে অক্ষরের চুল বাঁধি, গায়ে ছিটিয়ে দিই সুগন্ধী আতর

তবে বেশিরভাগ সময়েই ওই লক্ষ্মীছাড়া ভূতটাই জিতে যায়আমি গোগ্রাসে গিলতে থাকি অক্ষরের দলা। চোখ ফেটে জল আসে, দম বন্ধ হয়ে যায়, বিষম খেয়ে কাশতে থাকিআর তখন দেখি ওই ব্যাটা ভূত নিজেই এসে আমার পিঠে হাত বুলিয়ে, মাথায় ফুঁ দিয়ে খাইয়ে দেয় এক ঢোঁক অক্ষরের জল। আমি শান্ত হয়ে বসিক্লান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে ওকে বুঝতে চেষ্টা করিদেখি, ওর ঠোঁটে মিটিমিটি হাসি, কী যে চায় ও কিছুই বুঝি নি এতদিনেওতাই ওকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করি আমাকে ছেড়ে যাবে না তো কোনোদিন? ও দেখি এবারেও সেই একইভাবে হেসে, কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যায়বুঝি এটা বিদায় নেওয়া নয়, ওর মর্জি মতো ও ফিরে আসবে আবার। কখনও জ্বালাতে, কখনও পোড়াতে, কখনও বা ক্যাডবেরি খাওয়াতে
  
     

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন