কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

০৫) অপরাহ্ণ সুসমিতো


চিড়িয়াখানা বা ফেসবুক


ভাই বোনদের আলাদা কোনো রুম নেইযে রুমটায় আমরা গাদাগাদি করে থাকি সেটা একটা মোটামুটি বড় রুমুটো বড় বিছানা পাশাপাশি করে পাতা। যেন পদ্মা আর গঙ্গা। যেমন মা আর আম্মাজানপড়ার টেবিল আছে দুটো, আলনা আছে একটাসব কিছুই গায়ে লেগে লেগে
আমার বড় মামার একমাত্র ছেলে গৌতম দস্তিদার, গৌতমদা। খড়গপুরে পড়েছুটিছাটায় তার পিসিকে মানে আমার মাকে দেখতে এলে বলে –
: রূপবতী, তোদের খুব ভাগ্যতোরা সব ভাইবোন কী সুন্দর গায়ে গায়ে মিশে থাকিস। বাড়ি যত বড় হবে, পরিবারের মানুষ তত আলাদা হয়ে যায়এই দেখ না আমার সাথে দিদির সারাদিন দেখা হয় না। দুজনের আলাদা আলাদা রুম। খুব প্রাইভেসি
গৌতমদা আমাকে আদর করে রূপবতী ডাকেআমি ওর কান্তিমান মুখের দিকে হাঁ করে থাকিবলে কী গৌতমদা এসব!
ধনী হবার একটা সুবিধা আছে
ধনী মানুষের চেহারা দীর্ঘদিনের ধনদৌলতের ছায়ায় কান্তিময় হতে থাকে
তো একদিকের বিছানায় আমরা তিন বোন জড়াজড়ি করে থাকি। প্রায়ই আমাদের ঝগড়া হয় বটে, তবে পাশের বিছানায় শুয়ে থাকা বড়দা বা ছোড়দার ভয়ে মা শীতলা দেবী হয়ে যাই
পাশের রুমে মা বাবা। মেঝেতে ঘুমোয় আমাদের দূর সম্পর্কের খুড়তুতো বোন, ও এ বাড়ির হরফুন মৌলা, সকল কাজের কাজী
বড়দা খুব চুপচাপ থাকে। রাত করে বাড়ি ফেরেএক ধরনের লজ্জা তার চিবুকেএম. এ করেছে, এখনো চাকরি পাচ্ছে না। বাবা খুব বকাঝকা করেসারাদিন কোথায় যে হেঁটে বেড়ায় একাকী নি:সঙ্গ নাবিকের মতো! সবাই শুয়ে পড়লে সে  বিড়ালের মতো চুপিচুপি ছোড়দার পাশে আলগোছে শুয়ে পড়ে
আমি টের পাই
ড়দার জন্য আমার বুকটা পোড়েটের পাই ও দিনদিন শুকিয়ে যা্চ্ছেথুতনি ঝুলে পড়ছে ক্লান্তিতে, বেকারত্বেপাশে শুয়ে থাকা ছোড়দার গাঢ় ঘুমের শ্বাস বাতাসে ভেসে বেড়ায়
অনেক রাতের এক আলাদা নীরব শব্দমাধবী থাকেনিশি পাওয়া মানুষের কানে তা গোচর হয়আমি কান পেতে বড়দার বিড়াল হাঁটার শব্দ টের পাইগরমে ফ্যানের শব্দ, আলনায় বড়দি’র শাড়ির আঁচল উড়ে বেড়াবার ধ্বনিগলির মোড়ে কুকুরের ঝগড়া – সব আমার কানে তৃণমূল হয়ে ঢোকে
বড়দা বিছানায় গা এলাতেই আমি ফিসফিস করে ডাকি
:
বড়দা!  
: হুঁ
: খেয়েছিস?
: হুঁ
: এত দেরি করিস কেন?
: (কোনো কথা নেই)
: কি খেয়েছিস? টেবিলে তো খাবার পড়ে আছে!
: চুপ কর। ঘুমো
রাত হয়েছে  
বড়দার পাশ ফেরার শব্দ টের পাইরাত বাড়তে থাকেআমাদের খাবার জায়গাটুকুর যে স্পেস, ওখানে দেওয়াল ঘড়িটার টিকটিক শব্দ রাতের সাথে পাল্লা  দিতে থাকেবাথরুমে জ্বলে থাকা স্বল্প পাওয়ারের বাল্ব কুয়াশার মতো আলো ছড়ায়যেন রাতের অজগর গিলে খেতে থাকে আমার দারিদ্র, গাদাগাদি ঘরদোর। ভাই বোন

আমাদের দিন রাতের কোনো ঠকমকি নেই। নেই কোনো আলাদা খবর। প্রতিদিন একই সুর। মায়ের খুকখুক কাশি। রান্নাঘরে জল পড়ার শব্দগরম তেলে বেগুন ভাজার মৌ মৌ ঘ্রাণ বাড়ি জুড়েটেলিভিশনে স্টার জলসা, ভোর হলে বাবার সেই ঢিলেঢালা প্যান্ট, টিভিতে গোলগাল মুখের মিষ্টি মেয়েটার হাসি দিয়ে নমস্কার, আজ সকালের নিমন্ত্রণেসেই ঘামে ছিপছিপ দুপুর, মলিন বিকেল, সন্ধ্যায় মা’র পুজো
আবার টিকটিক রাত
সেই অপেক্ষা বড়দার বিড়াল প্রত্যাবর্তনের...

রাত বাড়তে থাকে সুকান্তের রানারের মতো হুমহুম করেদূরে কোথায় যেন শাহরুখ খানের লুঙ্গি ড্যান্সের অস্পষ্ট গানের সুরআমি শুয়ে শুয়ে বড়দার জন্য অপেক্ষা করিকখন আসবে, কখন আসবে! ঘড়ির টিকটিক আওয়াজে টের পাই অনেক রাত এখন। বড়দা তো এতো দেরি করে না। কেমন যেন লাগছে। একবার আধো অন্ধকারে বালিশের নিচে থেকে মোবাইল বের করে ফোন করিরিং হচ্ছে... হচ্ছে... ধরছে না...
ছোড়দা ঘুমে, দুই বোনও 
আমারই কেবল ঘুম নেইবিছানা থেকে উঠে খাবার টেবিলে আলগোছে গিয়ে বসিমোবাইলটা নিয়ে ফেসবুকে লগ ইন করি
আচানক চোখ পড়ে বন্ধুদের ওয়ালে ভিডিওএকটা বাঘের সামনে হাত জোড় করে জবুথবু বসে আছে একটা লোক। সেই ঝুলে পড়া থুতনি... নতমুখী মানুষ...

আমার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসে। ঘাম এসে আমাকে বানের মতো ভাসিয়ে নিতে থাকে এই রাত দুপুরে
রাত্রির সুনসান নীরব নীরা ভেঙ্গে চুরচুর হতে থাকে আমার চিৎকারে।

আমার কান্নার জুঁইফুলে সমস্ত বাড়ি ঢেকে যাবার প্রাক মুহূর্তে টের পাই, আমার বড়দা কী নরম সকাতর করুণ হাত জোড় করে প্রাণ ভিক্ষা চাইছে বীর রয়েল বেঙ্গল  টাইগারটার কাছে...

সমস্ত চিড়িয়াখানাটা তামাশা হয়ে আসে...
আমার আর কিছু মনে নেই

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন