কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

০৮) দেবপ্রিয়া চট্টোপাধ্যায়


জীবন যখন শুকায়ে যায়


চশমাটা খুলে রাখলেন সুপ্রভা| এই পৌষেও তার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম| বুকের ভেতরটা অস্বাভাবিক দ্রুততায় কেঁপে চলেছে| বাঁ চোখ দিয়ে বেরিয়ে আসা জল মুছলেন শাড়ির খুঁট দিয়ে; কী যেন ভেবে নিলেন একটু, নাহ ফোনগুলো তাড়াতাড়িই সারতে হবে, এখন কেঁদে এক মিনিট সময় নষ্ট করা চলবে না|
সিদ্ধান্তটা তাদের দুজনেরই ছিল| ছেলেদের কারো মত নেবার প্রয়োজন অনুভব করেননি তারা| কেনই বা করবেন? এই বাহাত্তর বছরের বিগত পঞ্চাশটা বছর কেটেছে ওদের মানুষ করতে| ওদের প্রতিষ্ঠিত দেখার জন্য কী অসম্ভব পরিশ্রমটাই না করেছেন ওরা দুজনে! আর আজ?
কেউ নেই এবাড়িতে আর| অথচ এই আঠারো মিনিট আগেও সংখ্যায় দুজন ওরা থাকতেন এই বাড়িটাতে| আর এই মুহূর্তে এই বাড়িতে একজনের স্তব্ধ হৃদস্পন্দন  বুঝিয়ে দিচ্ছে, এখন থেকে শুধুমাত্র একজন জীবিত মানুষকে এই চার দেওয়ালের  দুর্গম দুর্গে কাটাতে হবে আরও বেশ কিছু অনির্দিষ্ট দিন, মাস বা বছর|
পাটা অস্বাভাবিক শীতল| মুখটা একটু খোলা| বাঁধানো দাঁতটা বেরিয়ে এসেছে অতনুর মুখ থেকে| সাধারণত শোবার আগে দাঁতটা খুলেই রাখতেন অতনু| কিন্তু গত রাতে হয়তো কোনো অজ্ঞাত কারণেই... অথবা শরীরটা বেশ খারাপই হয়েছিল অতনুর|
খাটের ধারের নিথর দেহটাকে পেরিয়ে এখন সুপ্রভাকে যেতে হবে ল্যান্ডলাইন টেলিফোনটার দিকে| এই আঠারো মিনিটের প্রথম সাত আট মিনিটেই তিনি বুঝে গেছেন যে, পাশে শুয়ে থাকা দেহটাতে আর প্রাণ নেই| তাও নাকের কাছে হাত এনে দেখেছেন অনেক বার, বুক মাথা দিয়ে হৃদস্পন্দনের শব্দ শোনার ব্যর্থ চেষ্টাও করেছেন বেশ কয়েক বার| অতঃপর বুঝতে আর বাকি থাকেনি সুপ্রভার| নিজের মানুষটা চলে গেছেন, আর কোনোদিন সকালে উঠে বলবেন না – কী গো!  তোমার বাতের ব্যথাটা বাড়েনি তো? অথবা কাগজে কোনো ভালো আর্টিকেল পড়তে পড়তে প্রভা প্রভা করে ক্ষীণ গলায় আর ডাকবেন না|
ঘরে দুটো মোবাইল একটা অতনুর মাথার ওপর, গায়ে শান্তিনিকেতনী বাটিকের  জামা, কাচ পুঁতি বসানো কেসে টা অতনুর মোবাইল, আর অন্যটা সুপ্রভার| মূলতঃ ফোন ধরতেই টা ব্যবহার করেন সুপ্রভা, এই বয়েসে আর অন্য কোনো  প্রকরণ আয়ত্ত্ব করে উঠতে পারেননি যে!
অতনুর নিথর শরীর ডিঙিয়ে বিছানার এপাশে চলে এলেন সুপ্রভা| হাতে ফোনের ডারি| প্রথমে লেখা পাতাটা খুললেন তিনি – ইলেকট্রিক মিস্ত্রী অশোকের  পরেই লেখা আই হসপিটালের নম্বর| কাঁপা হাতে ডায়াল করা নম্বরটা কিছুক্ষণ বেজে নারীকন্ঠে বলে ওঠে –ব্যারাকপুর আই হসপিটাল|  
“আচ্ছা আমার হাসব্যান্ড এই মিনিট পনেরো আগে মারা গেছেন, ওঁর চোখ, চোখদুটো... দান করা আছে আপনাদের হাসপাতালকে – একটু যদি তাড়াতাড়ি  আসেন...!” কাঁপা গলাটা থেমে যায় সুপ্রভার| 
আমাদের লোক রেডিই থাকে মাসিমা, ও প্রান্তের গলাটা নিতান্তই কেজো শোনায়  সুপ্রভার পুরো ঠিকানা আর কাছাকাছি কোনো ল্যান্ডমার্ক কিছু থাকলে বলুন|
“১০, পদ্মপুকুর রোড, কলকাতা–৭৯, টিপটপ ড্রাইক্লিনারের ঠিকপাশের বাড়ি... সুপ্রভার গলাও যান্ত্রিক ভাবে আউরে যায়|
আচ্ছা লোকাল ডাক্তারের থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়েছেন তো?” অপর প্রান্তের নারীকন্ঠের প্রশ্ন|
নাঃ, সেটা, মানে এখনও হয়ে ওঠেনি... এই তো সবে কিছুক্ষণ...কেমন একটু অসহায়, কাতর শোনায় সুপ্রভাকে| এত রাতে কেই বা...
ওটা না হলে কিন্তু মাসিমা আমরা কিছু করতে পারবো না...নারীকন্ঠের চাঁছাছোলা বক্তব্য সুপ্রভাকে আরও একটু বিচলিত করে কি?
নারীকন্ঠ বলে যায় – ওটা ছাড়াও খেয়াল রাখবেন, যাতে মাথাটা বেশি ঝুলে না  যায় – দরকার হলে দুটো বালিশ দিয়ে রাখুন আর চোখ দুটো অবশ্যই ভিজে তুলো দিয়ে ঢেকে রাখবেন, সম্ভব হলে ওডিকোলন দিয়ে| আমরা আসছি মিনিট চল্লিশের মধ্যে|
আই হসপিটালের পরের গন্তব্য ডিএর পাতা – ডাঃ মুখার্জির নম্বর| পারিবারিক চিকিৎসক বলতে উনিই ছিলেন বরাবর শেষ দিকে অতনুর অশক্ত শরীর আর  চেম্বার অবধি যেতে পারতো না, ডাঃ মুখার্জিই আসতেন বাড়িতে| বয়েস তাঁরও নিতান্ত কম হয়নি, তাও আসতেন, এই পরিবারটাকে কোথাও পেশাগত সম্পর্কের   বাইরের কিছু ভাবতেন বলে|
নাঃ, ওঁর পক্ষে এই রাত সাড়ে তিনটেয় আসা কোনোমতেই সম্ভব নয়, সুপ্রভার মাথা এই শোকের সময়েও পুরোপুরি বাস্তবজ্ঞান হারায়নি|
অগত্যা ডাঃ বাসুদেব রায়| ডাঃ মুখার্জির দু তিনটে নম্বরের পরেই তাঁর নম্বর সুপ্রভার হাতটা একটা যন্ত্রের মতোনই ডায়াল করে চলে... ২৫৭০... একটু পরেই ওপার থেকে একটা চেনা  ভরাট কন্ঠ বলে ওঠে, হ্যালো... 
সুপ্রভার হাত এবার অমোঘভাবে চলে যায় খাটের অন্য দিকটায় রাখা আলমারির হাতলে| বাদামি চামড়ার ফাইলটা ওখানেই রাখা আছে সযত্নে – ওর মধ্যেই যে আছে অতনুর মরনোত্তর দেহ দানের অঙ্গীকারপত্র!
নির্দিষ্ট সময়েই হয়েছে সব কিছুডাঃ রায়ের ডেথ সার্টিফিকেট, এসেছে আই হসপিটালের দল, খুলেও নিয়েছে অতনুর কর্নিয়া তাদের অভ্যস্ত তৎপর হাতে... আবার ওদের গাড়ির শব্দ মেলাতে না মেলাতেই এসেছে পিজি হাসপাতালের সেই বিশেষ মুহূর্তদ্যোতক শকট...ঘরে তারা ঢুকতে সুপ্রভাকে বেরিয়ে যেতে হলো ঘর থেকে – শেষ যাত্রার প্রস্তুতিপর্বের সূচনার সময়ের সাক্ষী থাকতে পারেননি সুপ্রভা|
এই কটা ঘন্টায় ছেলেদের কথা বারবারই মনে হয়েছে সুপ্রভার কিন্তু পরক্ষণেই  আবার মনে হয়েছে, থাক – কী দরকার ওদের বিব্রত করে! বাবার চূড়ান্ত শরীর  খারাপ জেনেও “একটা ভালো ডাক্তার দেখানো দরকার বা দেখিয়ে নাও” – এই জাতীয় কথার ওপরে যারা উঠতে চায়নি, এ সময়ে তাদের জানানোর কোনো নৈতিক তাগিদ আজ অনুভব করেন না সুপ্রভা|
এখন আস্তে আস্তে সকাল হচ্ছে| ঘন কুয়াশা ভেদ করে ল্যাম্পপোস্টের রাতবাতিগুলোর আলোর উজ্জ্বলতা আশপাশের জায়গাগুলোয় গলির মোড়ের কুকুরগুলোর জটলাও চোখে পড়ে| এইসব অঞ্চলের জমিজমা এখনকার মতো দুষ্প্রাপ্য বা দুর্মূল্য হয়ে ওঠেনি সে সময়, যখন থেকে অতনু-সুপ্রভার সংসার শুরু হয়েছিল এখানে| তারপর ছেলেদের জন্ম, পড়াশোনা কলকাতার নামী স্কুলে – কত দিনই চলে গেল মাঝখান থেকে নিরুচ্চারে, নিঃশব্দে!
তারপরে সময়েরই নিয়মে জন্মভিটে ও আশপাশকে ওল্ড ফ্যাশনড জ্ঞানে ছেলেরা এক এক করে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে, সংসারে এসেছে বিত্তবান পরিবারের উপার্জনকারী বৌমারা| না, সুপ্রভাকে তারা আপন করতে চায়নি কখনই, আর  অবশ্যম্ভাবী নিয়মে বেড়েছে ছেলেদের সঙ্গে দূরত্বও| অতনু সুপ্রভা একদিন অনুভব করেছেন, তাদের জীবন থেকে ছেলেরা পুরোপুরি সরে গেছে আর তারা ডুবে  গেছেন অতলান্ত একাকিত্বে|
পারস্পরিক নির্ভরতা অবলম্বন করেই তো এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলেন দুজনে – পঞ্চাশটা বছর কোথা দিয়ে কেটে গেল! যখন প্রায় যৌবনেই ছেলেদের পড়াশোনার জন্য আনন্দ বিনোদন জীবন থেকে বাদ চলে গেল, বাইশের তন্বীর শরীর নিঃশব্দে পৃথুলা হয়ে মধ্যবয়েসে পা দিল; তখনও ছেলেদের সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার যুদ্ধে শরিক   হয়ে আক্ষেপ না করে, নিজেদের ত্যাগ স্বীকারের মহিমার গর্বে ভেসে না গিয়ে, হাসিমুখে নিজেদের কর্তব্য করে গেছেন শুধু একে অপরের উপস্থিতিকে সিঞ্চন করে  বাঁচার রসদ সঞ্চয় করেছেন|
আজ এভাবে একা হয়ে জীবনে এই প্রথম প্রতিটি মুহূর্তকে যেন বোঝা মনে হয় মনে হয় এই অস্ত্বিত্ব অর্থহীন মন আর শরীরকে টানার কোনো কারণ আর খুঁজে  পান না সুপ্রভা| বেদনার চোরাস্রোতটা আজ যেন শতধারায় ধাবিত| ভারাক্রান্ত মনকে মন্থন করে বুকের ভেতর থেকে উঠে আসে এত বছরের জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস| মনেও জাগে হাজার প্রশ্ন – ছেলেরা কি সত্যি বাবা-মাকে ভুলে সুখী থাকতে পেরেছে? নাকি ওরাও ওদের পেশা, প্রতিষ্ঠা, সংসারের আশা-প্রত্যাশার আবর্তে ঘূর্ণায়মান যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে? আদৌ কি বুঝতে পারছে অতনু-সুপ্রভার একাকিত্বের ক্লান্তি, অসহায়তা? কে জানে! হঠাৎ যেন কঠিন পাহাড়শিখরে জমে থাকা অভিমানের বরফের শীতলতা সুপ্রভাকে সম্পূর্ণ গ্রাস করলসুপ্রভার খুব শীত করছিল।  

1 কমেন্টস্: