কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪

১০) নভেরা হোসেন


একজন মাহমুদ হোসেনের চালচিত্র


প্রয়াত মাহমুদ হোসেন যখন রিকশায় বুক ব্যথায় ছটফট করছিল, তার সারা শরীর   নীল হয়ে আসছিলবন্ধু হামিদের বাসা থেকে হৃদয় সংশ্লিষ্ট সব কথাবার্তা, তার উপর করাচির পূর্ণ-যৌবনের দিনগুলোআহা, এসব কথা সময়ের নিপুণ ঐশ্বর্য!  তখন জীবন ছিল স্রোতস্বিনী ধারার মতোআর মাহমুদ হোসেন সেই স্রোতশীল  খাড়িতে দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে ভাসছিলোকখনো ইরাবতি হতে বিয়াস, কখনো আঁড়িয়াল  খা হতে বুড়িগঙ্গামাহমুদ হোসেন শৈশবে এতই ধী শক্তি সম্পন্ন ছিল যে, চতুর্থ   শ্রেণীতে পড়ার সময়েই নিজের ভূত-ভবিষ্যত দেখতে পেয়েছিলগ্রাম্য ছেলের দল যখন মাঠে মাঠে মাটির ঢেলা নিয়ে কা-শালিক তাড়িয়ে বেড়াত, নকশাদার প্রজাপতির পেছনে ছুটত, তখন মাহমুদ স্কুল লাইব্রেরি থেকে আনা রবিনসন ক্রুশোতে  নিমগ্ননির্জনতা ভালো লাগতচতুর্থ শ্রেণীতে পড়ার সময়ে ধানের নৌকায়  আকস্মিকভাবে পিতার মৃত্যু হলে মা সুন্দরী বেগম তাকে পড়া থেকে ছাড়িয়ে পিতার  ধানের নৌকায় লাগিয়ে দিয়েছিলেনধানের নৌকায় কিছুদিন ফরিদপুর-খুলনা করার  পর মাহমুদ বুঝতে পারে, এরকম নৌকাবিহারে ধান-চালের কারবার করার জন্য  তার জন্ম হয়নিপিতা-মাতা সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, তারা কখনো  কখনো ছেলেমেয়েদের উপর এমন বোঝা চাপিয়ে দেয়, যা তাদের ভেতরকার  আগ্নেয়গিরিকে নিভিয়ে দেয়মাহমুদ চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র হলেও এ বিষয়টি খুব তাড়াতাড়ি বুঝতে পেরেছিএকদিন রাতে নৌকা থেকে পালিয়ে সে ফরিদপুরের  পথ ধরেপঞ্চাশের দশকে মফস্বলে যাওয়ার জন্য কিছু পাকা সড়ক তৈরি হলেও  মাহমুদ  সে পথ দিয়ে না গিয়ে গ্রামের দুজন ফল ব্যবসায়ীর সঙ্গ নেতারা প্রথমে   মাহমুদকে সঙ্গী করতে চায়নি, কিন্তু মাহমুদের পিড়াপিড়িতে এবং বারেক মাস্টারের  চিঠির কারণে শেষ পর্যন্ত ঢেকি গেলেসারাপথ মাহমুদ একটি কথাও না বলে তাদেরকে অনুসরণ করতে থাকেপথে খিদে পেলে ফল ব্যবসায়ীরা মাহমুদকে  পোটলায় বেঁধে আনা চিড়া-মুড়ি খেতে দেয়তেষ্টায় গলা ফেটে এলে মাহমুদ পথের ধারের পুকুর থেকে পানি খেয়ে নেপথে রাত হয়ে গেলে তারা গ্রামের ভেতর   প্রবেশ করে এবং একটি জীর্ণ কুটিরে রাত্রি যাপন করেগৃহস্থ অতি দরিদ্র বিধায় রাতে তিনজন লোকের খাবার যোগা করতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায়প্রায়  মাঝরাতে ফেনা ওঠা গরম ভাতের সাথে আলু ভর্তা আর কোলই শাক ভাজি দিয়ে ভাত খেতে দেয়সেই খাবারই মাহমুদ হোসেনের কাছে অমৃতের মতো লাগে, সে  থালার শেষ ভাতটি পর্যন্ত চেটেপুটে খা্য়গৃহস্থের বাড়িতে মাহমুদ সমবয়সী এক   মেয়েকে দেখতে পায়, যে পাশের বাড়ির বৈঠকখানায় তাদের থাকার বন্দোবস্ত করে  মেয়েটির কথাবার্তা শুনে মাহমুদ বুঝতে পারে, মেয়েটি লেখাপড়া জানেমাহমুদ  হোসেনের পুটলির দিকে তাকিয়ে মেয়েটি জানতে চায়, এর মধ্যে কী কিতাব আছে?  আমি কিন্তু ঈশপের গল্প জানি!” মাহমুদ হোসেন কূপির আলোয় দ্বাদশবর্ষীয়া  বালিকার  উজ্জ্বল মুখখানার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেএই পুটলির মধ্যে বই আছে, শ্লেট আছে, চক আছেআমি তো বাড়ি থেকে পালিয়ে ফরিদপুর  যাইতেছি ইস্কুলে পড়ার জন্যকী কন্! আপনার বাবা-মা মনে দুঃখ পাইব না? মাহমুদ মুচকি হেসে বলে, বাবাজান গেল বছর নৌকায় পড়ে ইন্তেকাল করেছেন  আর মা হয়তো আমার পড়াশোনার কথা শুনে মনে মনে খুশিই হবেন”কূপির  আলোয় মেয়েটির কৃষ্ণাভ চোখজোড়া রক্তবর্ণ ধার করে, গালেও লালাভ চি‎‎হ্ন ফুঁটে  ওঠেমেয়েটি দ্রুত হাতে মাহমুদ ও ফল ব্যবসায়ীদের বিছানা করে দিয়ে নিজেদের ঘরে চলে যায়! সারারাত মাহমুদ হোসেন টিনের চালে শিশির পড়ার টুপটাপ শব্দ শুনতে থাকে, মাঝে মাঝে বড়ই বা কোনো ফল গাছ থেকে চালের উপর পড়ার  শব্দ শোনা যায়একরকম না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দে মাহমুদ হোসেনতার পাশেই  হাঁটার ক্লান্তিতে ফল ব্যবসায়ীরা বেঘোরে নাক ডাকতে থাকেএকেবারে ফজরের  অন্ধকারে ফল ব্যবসায়ীরা জেগে উঠে কাঁচাঘুম থেকে তাকে ডেকে তোলেমাহমুদ  চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে কোনোমতে তাদের পিছন পিছন চলতে শুরু করে  রাতের গ্রামটিকে মাহমুদের কাছে আলেয়ার মতো মনে হয়কুয়াশায় মোড়া গ্রামের মধ্যে দিয়ে আল ধরে মাহমুদরা চলতে থাকেক্রমশ গ্রামটি ঝাপসা হয়ে আসে আর  মাহমুদ হোসেন রাতে দেখা মেয়েটির চোখের আলো নিয়ে ফরিদপুরের পথ ধরে গ্রামের পাশ দিয়ে হাঁটা পথ কতটুকু আগালো, মাহমুদ বুঝতে পারে নাএত পথ সে কোনোদিন হাঁটেনিহাঁটতে হাঁটতে পায়ের চামড়া থেতলে যায়নগ্ন পদে মাইলের  পর মাইল চলতে চলতে মাহমুদ হোসেনের মনে হয়, পৃথিবীটা গোল আর তারই এক প্রান্ত থেকে কোমল নগ্ন পায়ে সে হেঁটে চলেছে অজানার পথেএ পথ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে, সে জানে না, কিন্তু যে পথ চলতে অনেক ব্যথা পেতে হয় তার নিশ্চয়ই কোনো পরিণাম আছেউহ্! একটা ছোট শামুক মাহমুদের বা পায়ের পাতায় বিঁধে যায়ফল ব্যবসায়ীরা পথের মধ্যে কী করবে বুঝতে পারে নাব্যথা বেড়ে গেলে পথ থেকে মাহমুদকে কোলে নিয়ে পাশের গ্রামের এক বাড়িতে যায়, সেখানে গরম পানি করে শন দিয়ে টেনে পা থেকে শামুক বের করা হয়অনেক রক্ত ঝরতে থাকেঐ বাড়ির বউ একটা মাটির মালসায় করে কিছু কবিরাজি লতাপাতা ছেঁচে মাহমুদের পায়ে লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দেয়এক ঘন্টার মতো বিশ্রাম নিয়ে মাহমুদ খোঁড়াতে খোঁড়াতে ফল ব্যবসায়ীদের সাথে আবার চলতে থাকেফল ব্যবসায়ীরা মাহমুদ হোসেনকে অনুরোধ করে, একরাত ঐ বাড়িতে থেকে অন্য কোনো হাঁটুরের সাথে ফরিদপুর শহরে যেতেকিন্তু মাহমুদ তাদেরকে ছাড়তে রাজি হ না, কষ্ট করে তাদের সাথে চলতে থাকেশেষ পর্যন্ত দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে মাহমুদ  ফরিদপুর শহরে এসে পৌঁছাফরিদপুর শহরের একজন তরুণ উকিলের ঠিকানা   মাহমুদের হাতেআনোয়ার উকিলের কাছে তার লেখাপড়ার বন্দোবস্ত করে দেয়ার  অনুরোধ করে চিঠি দিয়ে দিয়েছেন বারেক মাস্টারএই চিঠিটাকে সম্বল করে মাহমুদ গ্রামের দুজন ফল ব্যবসায়ীর সাথে ফরিদপুর শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে, কিন্তু পথে দুর্ঘটনা ঘটাতে তার মনটা দমে যায়ফরিদপুর শহরের সারদা সুন্দরী গার্লস স্কুলের  পাশেই আনোয়ার উকিলের বাড়িসহজেই মাহমুদরা উকিল সাহেবের বৈঠকখানার সামনে উপস্থিত হসেখানে পৌঁছে মাহমুদ হোসেনের বুক দুরুদুরু করতে থাকে,   তেষ্টায় গলা শুকিয়ে আসতে চায়, ফল ব্যবসায়ীরাও পথের ধকলে ক্লান্ত হয়ে পড়ে উকিল সাহেবের মুহুরি সকলকে বৈঠকখানার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভেতরে আসতে বলেবৈঠকখানায় লম্বা একটা কারুকাজ করা কাঠের টেবিল, টেবিলের মাঝখানের কিছু অংশ সবুজ রঙের রেক্সিন দিয়ে মোড়াদুপাশে টানা বেঞ্চি আর উকিল সাহেব একটা সিংহের মুখের মতো হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে খুব সুন্দর একটা ফাউন্টেন পেন দিয়ে লম্বা কাগজে কী সব লিখে চলেছেমাহমুদ ঘরে ঢুকেই বলে  ওঠে, গুড মর্নিং স্যার!” উকিল সাহেব সোনালি ফ্রেমের চশমার ফাঁক দিয়ে মাহমুদ  হোসেনের চকচকে চোখের দিকে তাকিয়ে চমকে ওঠেমুহুরি সুযোগ পেয়ে বলে ওঠে,  উকিল সাহেব এরা আপনার কাছে আসছে, কিছু বলবে মনে হয়!” মাহমুদ সামনে  এগিয়ে যাউকিল সাহেব বলে, এই ছেলে, তোমার নাম কি? খুব চমৎকার ইংরেজী উচ্চারণ!” মাহমুদ হোসেনবাহ্! খুব সুন্দর নামতা তোমরা সব  কোথা থেকে? ফল ব্যবসায়ীরা হাত কচলাতে কচলাতে বলে, উকিল সাহেব আমরা  আপনার গাঁ আদিতপুর থেকে আসছিএই ছাওয়ালডারে আপনার হাতে সঁপে দিতেছি, এই যে চিঠি, বারেক মাস্টার সব বিস্তারিত লেখছেআনোয়ার উকিল চশমার  ভেতর থেকে খুব দ্রুত চিঠিটা পড়ে নেতা তোমরাই কি ছেলেটাকে এদ্দুর নিয়ে  এলে? ফল ব্যবসায়ীরা মাথা নিচু করে থাকেযাক, খুব ভালো করেছ! ছওয়াবের  কাজ করেছ! আনোয়ার উকিল বলে, বারেক মাস্টার যে চিঠি দিয়েছে তাতে  জানলাম ছেলেটি ভীষণ মেধাবীবৃত্তি পরীক্ষায় ফরিদপুরের মধ্যে প্রথম হয়েছে, ওর  দায়িত্ব আমি নিলামমাহমুদ এতক্ষণ সবার মধ্যে দাঁড়িয়ে চুপচাপ কথা শুনছি,  আনোয়ার উকিলের কথা শুনে ব্যথাসহ পা নিয়ে দৌড়ে এসে উকিল সাহেবের পা ধরে সালাম করেআনোয়ার উকিল মাহমুদকে বুকে টেনে নেউপস্থিত সকলের চোখ    অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠেকোনো এক অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে মাহমুদ ফরিদপুর শহরে পড়ালেখার বন্দোবস্ত হওয়ার আশায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেআনোয়ার উকিলের তত্ত্বাবধানে আসার পর থেকে মাহমুদের জীবন দ্রুত বদলে যেতে থাকেফরিদপুর এতিমখানায় থাকার ব্যবস্থা করে আনোয়ার উকিল মাহমুদকে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ভর্তি করে দেমাহমুদ হোসেনের স্মর শক্তি আর বিদ্যুৎ গতিতে অংক করার   প্রতিভা দেখে আনোয়ার উকিল মুগ্ধ হয়ে যা, তার উপরে মাহমুদের ব্যবহার, কথা   বলার স্টাইল দেখে আনোয়ার উকিলের বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে যায় যে, মাহমুদ এক  অজ পাড়াগাঁ থেকে সদ্য এসেছে, যেখানে শুধু চারিদিকে বিল আর বিল, এক হাটু কাদা পেরিয়ে স্কুলে যেতে হয়মাহমুদের চোখেমুখে অজানার প্রতি কৌতূহলছুটির  দিনগুলোতে মাহমুদকে বাড়িতে এনে ভালো-মন্দ খেতে দেসে সময় মাহমুদ খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে আসে, তার শরীর থেকে একটা অজানা ফুলের গন্ধ আসতে থাকেমাহমুদ সবসময় বৈঠকখানায় এসে চুপচাপ বসে থাকেমুহুরি মাহমুদকে ঘরের ভেতর নিয়ে গেলে আনোয়ার উকিলের স্ত্রী শিরিন আক্তার মাহমুদকে আদর করে বুকে টেনে নে, দস্তরখানা পেতে খেতে দেশিরিন আক্তারের  পিড়াপিড়ি সত্ত্বেও মাহমুদ  খুব কম খাবার খেতোআনোয়ার উকিল জানতে চায়, মাহমুদ তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? মাহমুদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, স্যার আমি এ বিষয়ে এখনও কিছু ভাবিনি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আমি আপনার মতো আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়তে  চাই, ব্যারিস্টার হতে চাইআনোয়ার উকিল শিরিন আক্তারের দিকে তাকিয়ে বলে, শিরিন দেখো, মাহমুদ ঠিক তাই হবে, আর না  হলেও মস্ত কিছু হবে
মাহমুদের বাড়ির লোক, মা-ভাইরা খবর পেয়ে ফরিদপুর শহরে এসে মাহমুদকে দেখে অবাক হয়ে যায়মাহমুদ স্কুলে রেকর্ড নম্বর পেয়ে হৈ চৈ ফেলে দেমেট্রিক  পরীক্ষার পর আনোয়ার উকিলের পরামর্শে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হয় তুখোড় ইংরেজী জানার কারণে সব ক্লাসে তার বেতন মওকুফ হয়ে যায়বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া শেষ করে মাহমুদ লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য প্রস্তুত হতে থাকেমাহমুদ হোসেনের মা সুন্দরি বেগম ছেলের লন্ডনে যাওয়ার জন্য ধার কর্জ করে অর্থ যোগা করে দেয়লন্ডনে যাওয়ার পর মাহমুদ হোসেনকে পকেট খরচ  চালানোর জন্য কিছুদিন কারখানায় কাজ করতে হয়ব্যারিস্টারি ভর্তির সব প্রক্রিয়া যখন প্রায় সম্পন্ন, সে সময় শীতে মাহমুদ হোসেন অত্যন্ত কাবু হয়ে পড়েঠাণ্ডায়  শরীর সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে, খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে যায়বন্ধুদের সহায়তায় মাহমুদ দিন চালাতে থাকেকয়েক মাস অসুস্থ অবস্থায় কাটানোর সময় তার মনে হয়, আর  বাঁচবে না, ধানের নৌকা ছেড়ে এতোটা চড়াই-উৎড়াই পার হয়ে আসলেও শেষ রক্ষা  বোধহয় হলো না! মাকে চিঠি লেখে অসুস্থতার খবর জানিয়েমাহমুদের মা ছেলেকে  দেখার জন্য অস্থির হয়ে যায়লন্ডনের দুঃসহ আবহাওয়া ছেড়ে শরীর বাঁচানোর আশায় মাহমুদ প্লেনে চড়ে ঢাকায় ফেরত আসেঢাকায় আসার পর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে  ওঠেঢাকার মাটিতে পা রাখার সাথে সাথে তার অসুখ ভালো হয়ে যায়, মুখে রুচি ফিরে আসেকিন্তু মনের মধ্যে ব্যারিস্টারি পড়তে না পারার জন্য তীব্র কষ্ট হতে থাকেদেশে মাহমুদ হোসেন নানা উচ্চ পদে চাকরি করলেও তার মনে শৈশবের স্বপ্ন পূরণ না হওয়ার কষ্ট রয়ে যায়করাচী, রাওয়ালপিন্ডিতে মাহমুদ হোসেনের উচ্চ পদ আর কোট-প্যান্টের সাজ-পোশাক দেখে অনেক পাঞ্জাবি পরিবার তার সাথে মেয়েদের বিয়ে দিতে চান কিন্তু মাহমুদ হোসেন দীর্ঘদিন বিয়ে না করে সুটেড-বুটেড হয়ে   সন্ধ্যার পার্টিগুলোতে যেতে থাকেএক সময় পাকিস্তান সরকার রাওয়ালপিন্ডি থেকে তাকে চট্রগ্রামে পোস্টিং দেয়সেখানে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের অনেকের সাথে তার  বন্ধুত্ব হয়সে সময় মাহমুদ হোসেন ঘরে-বাইরে সর্বত্র পাকিস্তান সরকারের কড়া সমালোচনা করতে থাকেঅফিসে অনেকে তাকে সাবধান করলেও মাহমুদ হোসেন কারো কথা শুনতো না এবং নিজের কথা স্পষ্ট ভাষায় বলে যেত, কারো তোয়াক্কা করত না, ভয় পেতো নাচট্রগ্রাম কাব এবং অন্যান্য বৈঠকেও তার তীব্র প্রতিবাদী  কণ্ঠস্বর সকলকে উজ্জীবিত করতধর্ম সম্পর্কেও তার বিশ্লেষণ অনেককে আকৃষ্ট করতহিস্ট্রি অব সারাসিনস ছিল তার নখদর্পণেবিশ্ব ইতিহাস, বিপ্লবের ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, ধর্ম মাহমুদের প্রিয় বিষয়যুদ্ধের আগেই মাদারীপুরের একজন  উকিলের মেয়ের সাথে বিয়ে হয় মাহমুদ হোসেনেরমাহমুদ হোসেনের স্ত্রী প্রথম দিকে তার চাল-চলন, কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারত নাএকেক দিন একেক মুডে থাকে সেকোনোদিন অফিস থেকে এসেই মোটা মোটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে দিতো, কারো সাথে কোনো কথাবার্তা নেই, কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর নেই; আবার পরের  দিন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডায় মশগুল, চায়ের পর চাইসলাম, ইহুদিজম, খ্রীস্টানিজম, হিন্দুইজম, জায়নিজম, সুফিইজম, হু এ্যাম আই... কথা চলতেই থাকতচায়ের পর ভাত, ভাতের পর চা, কফি চলতে থাকত রাত ১২টা-১টা পর্যন্তমাহমুদ হোসেনকে  যেন কথায় পেয়ে বসত, চোখে-মুখে আলোর ঝলকানি, হো হো হাসির শব্দ অনেকদূর পর্যন্ত শোনা যেতঅনেক রাত হয়ে গেলে মাহমুদ হোসেনের স্ত্রী ঘুমে ঢুলতে থাকে,  কিন্তু মাহমুদ হোসেনের যেন হুঁশ নাইদিন দিন পড়ায় আরও মগ্ন হয়ে পড়েযুদ্ধের মাঝামাঝি চাকরি ফেলে গ্রামে চলে যাতার বিপ্লবী সত্ত্বা দগ্ধ হতে থাকে আর  ফুঁসতে থাকেযুদ্ধের পর ঢাকায় এসে নতুন জীবন শুরু করে, কিন্তু ব্যারিস্টারি পড়তে না পারার দুঃখটা মনের মধ্যে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠলে মাহমুদ এলএল  বি পড়তে শুরু করে এবং পরীক্ষায় প্রথম শ্রে্ণী পায়কিন্তু আবার সংশয়চাকরি  ছেড়ে আইন পেশা আর শুরু করা হলো নাসরকারী চাকরিতে খুব দ্রুত প্রমোশন হতে লাগল, স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের নিয়ে জমকালো জীবন কিন্তু মাহমুদ হোসেনের মনে  সারাক্ষণ একটা অস্থিরতাসবাই, সব কিছুর সাথে থেকেও সে যেন কোথাও নেই  এমন অনুভূতি একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতা তাকে মাঝে মাঝে গ্রাস করে ফেলত, তখন মাহমুদ হোসেন ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ত, মাইলের পর মাইল হাঁটত, বন্ধুদের কাছে যেতসুফী-দরবেশদের আখড়ায়, দার্শনিক আসরে, নাস্তিকদের বৈঠকে... কিন্তু কোথাও গিয়ে মাহমুদ শান্তি পেতো নাতার মনের জিজ্ঞাসার কোনো উত্তর সে কোথাও পেতো নাহু এ্যাম আই, কোথা থেকে এলাম, কোথায় যাব, কেন  এলাম... সৃষ্টির রহস্য মাহমুদ হোসেনকে পাগল করে ছাড়তবইয়ের পর বই, লাইব্রেরির পর লাইব্রেরি চষে ফেলতো মাহমুদ হোসেনমাঝে মাঝে সন্তানদের মাঝে  নিজের ছায়া খুঁজতে গিয়ে আনমনা হয়ে পড়তো মাহমুদনিজেকে মরুভূমির উত্তপ্ত  বালুতে পরিভ্রমণকারী আরব মুসাফিরের মতো মনে হতো
২০০২ সালের ডিসেম্বরপ্রচণ্ড শীতঢাকা শহর কুয়াশায় মুড়ে আছেলোকজন প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে যাচ্ছে না, সূর্যের মুখ দেখাই যাচ্ছে নামাহমুদ হোসেন কয়েকদিন আগে নতুন কোট বানিয়েছিল, কালো রঙেরপড়বে পড়বে করে আর পড়া হয়নিঐ দিন কী মনে করে সাদা শার্ট দিয়ে কালো কোট, জুতো পায়ে ক্লিন্‌  শেভড হয়ে একেবারে সকাল নটার মধ্যে প্রস্তুতসকালে স্কুলে যাবার সময় মাহমুদ হোসেনকে চা দেবার সময় স্ত্রী দেখতে পা মাহমুদ হোসেন পড়ায় নিমগ্নএকবার  স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আবার পড়ায় মনোযোগ দেমেয়ে কলেজে যাবার জন্য নাস্তা  খাওয়ার সময় বাবার সাথে একটা-দুটো কথা হয়তারপর মাহমুদ হোসেন টেলিফোন বিল দেয়ার জন্য যখন ঘর থেকে বের হয়, তখনও ছোট ছেলে-মেয়ে দুটি ঘুমিয়ে বেরোবার পথে দোতলার আসমা পারভীন বলে, বাহ! আপনাকে তো খুব সুন্দর লাগছে! পুরো সাহেবদের মতো!” মাহমুদ হোসেন মৃদু হেসে বেরিয়ে পড়ে, তারপর সমস্ত দিন নানা জায়গায় ঘুরে বেড়াঝিকাতলা বাজারের এক দোকা থেকে ওষুধ   কিনে ব্যাঙ্কে গিয়ে ফোনের বিল দেয়, তারপর রায়ের বাজারের প্রিয় খালুর বাসায় যায়। সেখানে সারাদিন কথা বলতে বলতে ক্লান্ত বোধ করে, কিন্তু তাকে যেন কথায়  পেয়ে বসেছিলঘুমে চোখ জড়িয়ে এলেও করাচির জাকজমকপূর্ণ জীবনের গল্প করতে থাকেলন্ডনের সাদা বরফের গল্প, সাহেব-মেমদের গল্পসেখান থেকে বেরিয়ে  হামিদের কথা মনে পড়ে, হামিদের সাথে বহুদিন দেখা হয় নাতার বাসায় গিয়ে কিছু সময় কাটা মাহমুদ হোসেনআর সেখানেই হঠাৎ বুকের বাম পাশে চাপ চাপ ব্যথা অনুভব করেহামিদ বলে, সাথে ওষুধ নেই? খেয়ে নাও...!” এনজিস্ট সবসময় পকেটে থাকে লেবেল আটা ছোট কৌটোটা বের করে কয়েকটা সাদা ছোট ট্যাবলেট হাতে ঢালে, আবার কী মনে করে কৌটোয় ভরে রেখে দেয়হামিদ বলে, কি মাহমুদ, খাইলা না? নাহ্ এখন মনে হচ্ছে ব্যথাটা চলে গেছেরাত তিনটা  পর্যন্ত টেলিভিশন দেখলাম, এজন্য মনে হয় একটু ক্লান্ত লাগছেতারপর হামিদের  কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কিছুদূর হাঁটার পর আবার ক্লান্ত লাগলে রিকশা নেয় রিকশায় উঠেই অস্বস্তি লাগতে থাকে, বুকের ব্যথাটা বাড়তে থাকেবাসার একদম কাছের মোড়ে চলে এলে রিকশা থামাতে বলে বুকে হাত দিয়ে রিকশাওয়ালাকে ধরতে চেষ্টা করে... রিকশাওয়ালা ধরতে ধরতে মাহমুদ হোসেন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেরিকশাওয়ালা দ্রুত পাশের সব্জির চৌকিতে তাকে শুইয়ে দেয়চৌকির চারপাশে দু- চারজন লোক ভিড় করে দাঁড়ায়, চোখে-মুখে পানি ঢালতে থাকে, মাহমুদ হোসেন অনেকটা নিথর হয়ে পড়ে থাকেরিকশাওয়ালা পকেট হাতড়ে ঠিকানা খুঁজতে গেলে একটা ছোট পকেট ডায়রি পায় আর ফোনের বিলটা মাটিতে পড়ে যায়লোকজন তাড়াতাড়ি ফোনের দোকানে গিয়ে ফোন করতে থাকে, কিন্তু ঐ সময় মাহমুদ  হোসেনের পরিবার একটা অনুষ্ঠানে যাওয়াতে বাসায় গৃহকর্মী ছাড়া আর কেউ ছিল নাসে লোকজনের ফোনের কথা বুঝতে না পেরে ফোন রেখে দেয়রিকশাওয়ালা আর কোনো উপায় না দেখে আরেকজন পথচারীর সহায়তায় তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়যাওয়ার পথে মাহমুদ হোসেনের বাম হাঁতটা একটু কেঁপে নিথর হয়ে যায়বাড়ির লোকজন খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যায়হাসপাতালের করিডোরে মাহমুদ হোসেনের নিথর শরীরটি পড়ে থাকতে দেখা যায়গ্রামের পথে শীতের সকালে মাহমুদ যেমন করে একা কাঁপতে কাঁপতে হেঁটে স্কুলে যেত, তেমনি তার শেষ যাত্রায়ও শীতের  নিস্তব্ধতা ছেয়ে থাকে সকলের মাঝখানেও নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ে মাহমুদ হোসেনউপস্থিত সকলে ঘটনার আকস্মিকতায় এতটা বিমূঢ় হয়ে পড়ে যে, কাঁদতে পর্যন্ত ভুলে  যায়শুধু তার কফিনের উপর কোথা থেকে যেন দুটো চড়াই এসে বসে, আর  তাদের কফিন ঠোকরানের শব্দ শীতের রাতে একটানা শোনা যেতে থাকে



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন