কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২৭ মার্চ, ২০১৫

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

কাঁকড়াকাহিনীর যতটুকু একজন মানুষ লিখতে পারে



আবিল জলের ভেতর কিছু পাথর। এদিক ওদিক ছড়ানো ছিটোনো। লাল সাদা ছিট ছিট। দুদিকে দুটো অক্সিজেন টিউব। এককালে ডুবুরীর মুখ থেকে ধোঁয়া বেরতে দেখেছি সেথায়, কিন্তু আধুনিক আকোয়ারিয়াম বোধহয় মাছেদের আর ঠকাতে চায় না। তাই ডুবুরী-টুবুরীর বালাই নেই। মাছেরা জেনে গেছে এই জলের দেওয়াল আছে।   সে দেওয়াল পেরোনো বারণ আর পেরোলে বাতাসিয়া ডাঙা চেপে ধরে। তখন  হাঁসফাস, তখন ধড়ফড়। জলের এই আবিলতা পাথর-দেওয়াল পেরিয়ে অনাবিল হতে শেখেনি এখনো। তাও তো বিত্তবানেরা কুকুর-বিড়ালের পরেই মাছ পোষে। মাছেরা প্রভুভক্ত হয় না। কুকুর তো নয়ই; এমনকি বিড়ালের মতো করেও কি সে চেনে তার  মালিক মালকিনদের? সে কি আদৌ কখনও দেখে চিনতে পারবে, যদি একদিন জলের বাইরে গড়িয়াহাটের মোড়ে তার সাথে হঠাৎ দেখা হয়ে যায় তার মনিবের? সে তো তখন হাঁসফাস আর ধড়ফড় করেই কুপোকাত। ডাঙার মানুষ কি তবে মাছের নামে কাচ-ভর্তি করে জল কেনে? নাকি মাছের চোখগুলোতেই লেগে থাকে তার পিছুটান?  সে চোখের কি পলক পড়তে দেখা যায়? কী দেখে মানুষ জলজ ঠোঁটের ওই আধ- খোলা শ্বাস-বায়ুর গভীরে? কী খোঁজে নিরলস চোখজোড়ার হৃৎকম্পহীন তীব্রতায়?  মাছ কি মানুষের ঘর পাহারা দেয় ঐ থর-থর-নিথর চোখ আগলে? নাকি মানুষ  শুধুই তার স্থলপ্রবণ গৃহে একটু জলের পিছুটান চায়? চায় একটা অন্য জগৎ -- ছোট কিন্তু আলাদা। জলের জগৎ, জগৎ পাথরের, ডুবুরীরা নিজেরাই একে একে ডুবে গিয়েছে ডুবজলে। তাও এখনো আলো জ্বলে। তাও এখনো অক্সিজেন কিনতে পাওয়া যায়।

আমি অবশ্য এখন যে আকোয়ারিয়ামটা দেখছি, তা কোনো বিত্তবান পরিবারের নয়।  নেহাতই ব্যবসার কাজে তার ব্যবহার। আমরা চায়নাটাউনে এক হোটেলে ডিনার করতে এসেছি। সেখানে শুরু থেকেই তারা শুধুমাত্র চাইনিজে লেখা একটি মেনু কার্ড দিয়ে আমাদের চমকে দিয়েছে। তারপর এই বিশাল বিশাল আকোয়ারিয়াম যেখান থেকে অর্ডার মতো একটু বাদে বাদেই একটা লোক এসে বড়সড় একটা জাল ফেলে  শিকার ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমি ঠায় তাকিয়ে আছি আমার উল্টোদিকের সেই জলজগতের দিকে, যেখানে দৈত্যাকার দুটি কাঁকড়া আকোয়ারিয়ামের দুই কোণে বসে  রয়েছে। আমরা বন্ধুরা আলোচনা করছি, ঐ পেল্লাই কাঁকড়া খাওয়া কি বিপুল চাপের  বিষয় হতে পারে তা নিয়ে ইতিমধ্যে বাঁদিকের কাঁকড়াটা আস্তে আস্তে তার সঙ্গিনীর  দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের দুজনের মধ্যে চোখে দেখে একটাই ফারাক করা যাচ্ছেঃ একজনের সুদৃশ্য এক শুঁড় রয়েছে যার ডগায় সবুজ আভা আর অন্যজনের শুঁড় চোখে পড়ছে না। যাক যে কাঁকড়া জলপথে ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল আরেকজনের দিকে, সে কাছাকাছি এসে আকোয়ারিয়ামের মেঝে ছেড়ে রাজকীয় কায়দায় খানিক জলের বাতাসে ভেসে গিয়ে আরেকটা কাঁকড়ার ওপর উঠে বসল, যেন বিক্রমের পিঠে বেতাল। কিন্তু তাদের গল্প এখানে নিবিড় এক শরীর শরীর টান।  সঙ্গিনীর ওপর চড়াও হয়ে সে তার সবুজাভ শুঁড়ের ডগা দিয়ে লতায় পাতায় পেঁচিয়ে ধরল তাকে। অক্সিজেন টিউবটা নড়ে গিয়ে বুদুবুদগুলো দিশেহারা হয়ে এদিক ওদিক দৌড়োদৌড়ি শুরু করল আর আমি জলের ভেতর ভালোবাসার সেই অমোঘ প্রদর্শনী দেখতে লাগলাম। নিরবধি ভালোবাসার জল আমার চোখ গেলে দিল যেন আর আকোয়ারিয়ামের মেঝের পাথর আমার চোখের ভেতর বুদবুদগুলোর আশেপাশে খেলা করতে লাগলআরামে যেন চোখ বুজে এলো আমার।


হয়তো মিনিটখানেক চোখ বুজে ছিলাম। হঠাৎ চোখ খুলে দেখি হাতে জাল নিয়ে সেই  লোকটা এসে দাঁড়িয়েছ আকোয়ারিয়ামের সামনে। একটা কাঁকড়ার ওপর থেকে আরেকটা কাঁকড়াকে তুলে নিচ্ছে জালে করে। আর তারপর আমার পাশ দিয়েই তাকে নিয়ে যাচ্ছে রান্নাঘরের দিকে। আমি জালের থেকে চোখ সরিয়ে দেখে নিচ্ছি আরেকটা কাঁকড়াকে। সে আবিল জলের ভেতর শ্বাসবায়ুর সাহচর্যে একা বসে আছে। চারপাশে তার ছড়ানো পাথর আর ডুবজল। একা নির্নিমেষ বসে সে মানুষের পরিযায়ী ভালোবাসার মাপ নিচ্ছে আর তার সঙ্গীর সবুজাভ ঐ শুঁড়টা লোকটার টানাটানিতে খসে গেছে শরীর থেকে। জলের বাতাস বেয়ে বয়ে বয়ে সেই শুঁড় আস্তে আস্তে  থিতিয়ে পড়ছে একাকী নিবদ্ধ কাঁকড়াটার মাথার ওপর। এমন সময় আমাদের টেবিলে চলে এলো প্লেট। ভাঙা ইংরেজিতে চৈনিক ওয়েটার জানালেন যে, আমাদের অর্ডার   রেডি হয়ে গেছে। আমি চোখটা একবার বন্ধ করে আবার খুলে দেখলাম, চোখের   কোণ বরাবর একটু জলের উঁকি দেখা দিয়েছে। এও আমার ডাঙার শরীরে এক ফেরারী জলচিহ্ন।      

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন