কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৫

অপরাহ্ণ সুসমিতো

ভেসে যাই জলের গ্রহে


মা উচ্চকন্ঠে ডাক দিতেই চমকে উঠিজানালার কাছে পর্দা সরিয়ে মুখ বাড়িয়ে বৃষ্টির সাথে আমার গান হচ্ছিল, গান আমি গাইতে পারি নাবৃষ্টি দেখলে, শব্দের সাথে আমার সুর কেঁচে ওঠেবৃষ্টির আগমনী সংকেত থেকেই আমি অধীর হয়ে উঠিটের পাই, আমার যাতনা জুড়ে রুমরুম কলাপাতার চামরপায়ের শব্দে অচেনা ধ্বনি
কোনো কো্নো পাখি গলা বাড়িয়ে তারস্বরে চেঁচায়, পাশের বাসার আন্টি মোটা শরীর আর এক মন্ত্রণালয় সমান বিরক্তি নিয়ে ছাদে শুকাতে দেওয়া কাপড়, আচারের বয়াম সরাতে সরাতে খিটখিটে হয়ে ওঠেন, ছোট মেয়েটাকে জোরে জোরে ডাকেন
: অমৃতা এই অমৃতা!  
অমৃতা ব্রাজিল দলের মতো মুখে টেনশন বানিয়ে ছাদে হাজির হয়
:
আদেশ করো মা গুরুজন!  
: কী করো পাজি মেয়ে? ডাকি, কথা কানে যায় না?
: মা শোবার ঘরে ন্যাংটুপুটু ছিলাম, ডাকলে তো আসা যায় না, রেডি হয়ে এলাম

আন্টি অবাক হয়ে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে
বজ্রপাতের তীব্র বিদারী শব্দেও ভাবান্তর হয় না। এই এক রত্তি মেয়েসেদিন পর্যন্ত ভাত না মেখে দিলে খেতে পারত নাকী বলে এসব মেয়ে!
‌আন্টি হার্টফেল করার ক্ষণ।
: মাইক এনে দিই? দুনিয়া জানান দাও। এতো ডিটেইল শুনতে চেয়েছি আমি?
: মা তোমাকে সত্যি কারণটা বললাম। তুমি কি চাও আমি মিথ্যা বলব?

আন্টির মুখ লাল হতে থাকে
বুকের ধুকপুক থামে না, আগে থেকেই এই শরীরে ছাদে আসার হাঁপরে হাঁপাচ্ছিলেন, মনে হয় আরো বাড়ছে...
আমি রাজ্যের আনন্দে অমৃতার দিকে তাকিয়ে থাকি
ুকনো মতো বিস্কুট কিউট একটা মেয়ে। কী পড়ো তুমি অমৃতা? ফার্স্ট ইয়ার? সেকেন্ড ইয়ার?
আমি বৃষ্টির ডাকাত ছেনি কুঠারে অমৃতার কাছে জানালা দিয়ে অদৃশ্য বার্তা পাঠাতে থাকি
অমৃতা, তুমহারি অমৃতা, আমার যাযাবর বন্ধু হবে তুমি?
সে যদি নেচে যায়, সে যদি টলটল, সে যদি পাখির পালকের ভেজা কলাপাতা বৃষ্টি মুনমুন করে নামে। আমি মুখ বাড়াতে থাকি
এতো ঝুপ এতো ঝম এতো ভাটিয়ালী এতো টুম্পা এতো রুম্পা এতো ঝুম্পা এতো মগ্ন বৃষ্টির দাপুটে হানা, আমি দেখতে পাই ভিজতেই আছি... ভিজে ভিজে একশা...

মা বললেন-- 
: পুটলী, জানালা থেকে সরে এসো। জ্বর আসবে আবারএসো কাবাব ভেজে দিই, খাবে এসো
আমার এক কান কাবাবের ভাজার শব্দে সচকিত হয়, অবয়ব দেখতে থাকি গোল গোল কাবাবগুলো নেচে নেচে প্লেটে তুলকালাম করছে, লাল সস পাশে হিহি করে হাসছেকাবাব আমার সাথে সাইন ল্যাঙ্গুয়েজে কথা বলছে
: আমাকে খাবে তুমি পুটলী?
: খবরদার, আমাকে পুটলী বলবে না! আমি বড় হয়েছি

কাবাবগুলো ফুটবলারদের গোল করার ভঙ্গিতে আনন্দ করতে থাকে, যেন আমাকে পুটলী বলায় জিতে গেছে ওরা
মা আমার গায়ে একটা বুনো রঙ চাদর দিয়ে দেয়, আমি টের পাই, ন্যাপথালিন ঘ্রাণ চাদর থেকেএতো দামাল বৃষ্টির ঘ্রাণ জানালা জুড়ে ভেসে থাকে, চোখের পাতায় মিহি ছাটের রেণু কণা যে টের পাই শরীরে প্রতি কোষ বেয়ে ব্যথা, তীব্র ব্যথাটা ছড়াচ্ছেশক্ত করে জানালার কাচ ঠেস দিয়ে থাকি
বৃষ্টির মতো আমার মুখ জলরঙ হতে থাকে, ফ্যাকাসে হতে থাকেটের পাই লিউকোমিয়া জিতে যাচ্ছে, বৃষ্টি পরাজিত হতে যাচ্ছে।
ব্যথায় নীল হতে হতেও টের পাই, বাবার ফোন বাজছে কোথাও


:
মা রে, আর কটা দিনটেরি ফক্স হাসপাতালে তোর ভর্তি হয়ে যাবেআমি আসছি। আর ক’টা দিন। মনে আছে সেই কানাডার ছেলেটা? টেরি ফক্সক্যানসার নিয়ে মাইলের পর মাইল দৌড়াচ্ছেএক পা নিয়ে... ফান্ড তুলছে... তুষার পড়ছে, পেছনে টিভি ক্যামেরা... কমেন্টেটর বলেই যাচ্ছে
হেয়ার ইজ আওয়ার ব্রেইভ টেরি ফক্স...
মা ওয়েট ওয়েট ওয়েট...
বাবা কী কথা বললেন এতক্ষণ? এখন কি কানাডায় গভীর রাত? আমি কি স্বপ্ন দৃশ্য দেখছি?
আচানক মনে হলো, শহর ডুবে যাচ্ছে অপূর্ব সুন্দর বৃষ্টির নন্দন কাননে
পাশের বাসা, দূরে দেখা যায় ধোঁয়া বৃষ্টি যমুনা, আহা আমার মতো রাই কিশোরী
অমৃতার অস্পস্ট ছায়া দেখা যাচ্ছে কি ছাদের চাতালে? ও কি ভিজছে ঝুপঝুপ? ও কি মুনমুন? ও কি টুনটুন?

আমার হাত ধরো অমৃতাআমাকে ধরো তো, বন্ধুটা! প্লিজ! আমি মরব না তো! ড: বলেছে, কানাডায় ভালো হবো আমি...
এতো গহীন শব্দের তরাস গর্জন, ভাসতে থাকল আমার চারপাশে সাঁওতাল মেয়েদের মতো খোঁপায় তারার ফুল পরে

এতো আশ্চর্য সুন্দর করে মা বাবা আমার দু’ হাত ধরে আছে। কী মায়া! কী মায়া!

এই অমৃতা তুমি কি ফার্স্ট ইয়ার? আমার সমান? কাঁদছো কেন?
ডোন্ট ক্রাই ডোন্ট ক্রাই...
বৃষ্টিতে আঁধারে শোঁ শোঁ শব্দ কান জুড়েই ভাসতে থাকল


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন