কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১৫

অন্তরা চৌধুরী

বাউলের সাতকাহন 





লাল মাটির পথ বেয়ে অজানার উদ্দেশ্যে চলে যাওয়া একান্ত বাউলের গান কিংবা ভেসে যাওয়া নৌকোয় মাঝির গান শোনবার সৌভাগ্য আমাদের দুএকবারই হয় নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় আমরা ইচ্ছে করলেই গ্রামীন হয়ে যেতে পারি না স্বতঃস্ফূর্ত গানের প্রতি আমাদের অন্তরীণ বাসনা আছে বলেই আমরা বারবার ফিরে গেছি বাউল গান বা লোকসঙ্গীতের কাছে বাউল তবে কি এক সমাধানহীন দ্বৈত? তার জীবনের কবোষ্ণ তাপ, তার পোশাকের মণ্ডন, তার গানের উদার মানবিকতা যেন এক মগ্ন স্রোত তার চোরা টানে আমাদের মননের অবগাহন হয়

বাউল বাংলাদেশের এক অসাম্প্রদায়িক সর্বধর্মসমন্বয়ী মিশ্র ধর্ম সাধনা অষ্টাদশ- ঊনবিংশ শতাব্দীতে একদল রহস্যবাদী সাধক বাউল নামে একটি উপসম্প্রদায় গড়ে তুলেছিলেন বাউল উত্তর ভারতের এক মরমিয়া সাধক সম্প্রদায়। তাঁরা কোনো  প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাসী নন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেরও তাঁরা পক্ষপাতী নন বৌদ্ধ-হিন্দু-বৈষ্ণব  তন্ত্রদর্শন এবং সুফি ধর্মের প্রভাবে বাউলের ক্রিয়াভিত্তিক সাধনা গড়ে ওঠে বৌদ্ধ শূন্যবাদ ও নাথপন্থের কিছু কিছু সংরাগও তাঁদের সাধনায় লক্ষ্যণীয়। তাঁরা নিজেদের  সহজিয়া বলেই পরিচয় দিয়ে থাকেন মানব দেহ যে সাধনায় ব্রহ্মাণ্ডের স্বরূপ,  তারই মধ্যে অধিষ্ঠান করে বাউলেরমনের মানুষ, যিনি উপনিষদেরপরমব্রহ্ম  পুরুষ প্রকৃতির মিলন সাধনায় মনের মানুষের সঙ্গে সাধক বাউলের যোগ সম্ভব হয় এজন্যই তাঁরা নিজেদেরমুক্ত পুরুষবলে বিবেচনা করে থাকেন। এঁরা দেহাত্মবাদী  তাঁদের মতে দেহই আত্মা তাই বাউলের যোগসাধনার সব কিছুই দেহকে আশ্রয় করে  দেহের ঊর্ধে অপর কোনো শক্তিতে তাঁদের আস্থা নেই  

সপ্তদশ শতকেই বাউলের উদ্ভব হয়েছে, এরূপ অনুমান অসংগত নয় সে যুগে ঈশ্বর প্রেমে মাতোয়ারা ও বাহ্যিক ব্যাপারে উদাসীন ব্যক্তিকে বাউল বলত এই ভাব বিচারে চৈতন্যদেবও নিজেকে বাউল বলতেন। তাঁরা ভোগমোক্ষমবাদী, সমাজছুট, কিন্তু সমাজ  বিচ্ছিন্ন ছিলেন না এই বাউল সম্প্রদায় নিজেদের অতি ক্ষীণ রূপে চিত্রিত করে স্বেচ্ছায় বিভিন্ন অপনাম গ্রহণ করে থাকেনবাউলশব্দটিও সম্ভবতবাতুল’ (পাগল) শব্দের অপভ্রংশ তবে বাউলরা দেহাত্মবাদী হলেও তাঁরা হিন্দু অধ্যাত্মবাদী  বাউলদের কোনো জাতি বা গোত্র থাকে না। অনেকে তাঁদের নিজেদের  গোত্রপরিচয় দিয়েছেনআলম্বায়নএবংঅচ্যুতানন্দবলে

বাউলরা শুধু গানের জন্য গান বাঁধেননি তাঁদের গান সাধনার অঙ্গীভূত বাউল  গানে আছে আচরণগত বিশ্বাসের সত্য, যা পারিপার্শ্বিকের প্রতিকূলতায় টলে না; বরং উচ্চবর্ণ ও সাম্প্রদায়িক ধর্মের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করতে পারে তার বিশ্বাসের ভিত্তিতে আছে প্রেমানুভূতির অস্মিতা, গুরুর বাক্যে নিষ্ঠা এবং পরম্পরাজাত পথ। তাঁরা মনে করেন, প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই আছে অধর চাঁদএবংমনের মানুষ’, অর্থাৎ যাকে বস্তুজগতের মধ্যে ধারণ করা যায় না, যিনি একাধারে বিশ্বদেবতা ও জীবনদেবতা ইনিঅচিনপাখি সাধকেরা তাঁকেই হৃদপিঞ্জরে ধরতে চাইছেন কিন্তু পারছেন না এইমনের মানুষকে আবিষ্কার এবং জীবদেহে তাঁকে উপলব্ধি করতে পারলে সাধকের মোক্ষ নির্বাণ হয় ওআলেখ নূরেরঅর্থাৎ পরম জ্যোতির আসঙ্গ লাভ হয় তখন তাঁদের পার্থিব সত্ত্বা ধ্বংস হয়ে গিয়ে সাধক ঈশ্বরের সাযুজ্য লাভ  করেন সীমাবদ্ধ জড় সত্ত্বাকে বিনাশ করে দেহে ও মনে মুমুক্ষু হয়ে ওঠা বাউল  সাধনার মূল কথা তাঁরা মন্ত্রহীন, কেননা মন্ত্রে তাঁদের বিশ্বাস নেই-
   ‘ওরা দেবতাকে খুঁজে বেড়ায় তাঁর আপন স্থানে
বাউল কোনো দেবতাকে খোঁজে না, খোঁজে মানুষ বাউল সাধকমনের মানুষঅন্বেষণে আকুতি প্রকাশ করেন-  
   আমার হলো কি ভ্রান্তি মন
   আমি বাইরে খুঁজি ঘরের ধন
   দরবেশে সিরাজ সাঁই কয়
  সুরবি লালন আত্মতত্ত্ব না বুঝে

বাউলের একটা গূঢ় গোপন সাধনপদ্ধতি আছে যার কথা অ-বাউলের জানা নিষেধ নর-নারীর দেহই সে সাধনার যজ্ঞবেদী, বিভিন্ন প্রতীকের দ্বারা তার ইঙ্গিত দেওয়া আছে বাইরের লোক তার অর্থ বুঝবে না



অনেকে বাউল ও ফকিরকে সমগোত্রীয় বলে মনে করে কিন্তু বাউল ও ফকির এক নয়।তাঁরা একক, অথচ নিঃসঙ্গ নয় ফকিরি সাধনা মূলতঃ ভাবের সাধনা এতে  আছে জপ ধ্যানের কাজ দমের ক্রিয়াকরণই প্রধান ফকিরি একটা সাধন পন্থা তবে ফকিররা ফিকিরি জানেনা। তাঁরা খুব গরিব বাংলার ফকিররা উপেক্ষিত ও ব্রাত্যতাঁদের সামাজিক সম্মান নেই শরিয়ত মানে না বলে মুসলিম সমাজের সঙ্গে তাঁদের ওঠাবসা নেই উলটে তাঁদের হাতে মার খেতে হয় ঘরদোর পুড়িয়ে দেয়, চুল  কামিয়ে দেয়, একতারা ভাঙ্গে ভারত বা পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিদেশে ফকির পাঠায় না, বাউল পাঠায় তাঁরা মোটা টাকা আয় করে দেশে ফেরে তাঁদের নিয়ে তথ্যচিত্র হয়, শিল্পীরা তাঁদের ছবি আঁকে ফকিরদের পোশাকের জেল্লা নেই প্রদর্শনপটু  বাউলদের পাশে তাঁদের অনাড়ম্বর মগ্ন সাধনা গবেষক ও দূরদর্শীদের টানে না তাঁদের  সাধনায় গানের প্রাধান্যও কম

তাঁদের জীবনযাত্রার ধরণও বাউলদের চেয়ে পৃথক মাটির ঘর, সম্পত্তি নেই, কিন্তু কারো কাছে হাত পাতেনা অথচ মানুষের অযাচিত দানেই তাঁদের সংসার চলে আর তাতেই চলে মানুষের সেবা যেখানেই তাঁরা পৌঁছান, পাঁচ-দশ জন লোক এমনি জুটে যায় যদি উপস্থিত সকলকে খাওয়ানোর পয়সা না থাকে তাঁরা নিজেরাও কিছু খান না নিজের থেকে কেউ যদি খাওয়ায় সে কথা ভিন্ন এদেঁর মধ্যে হা-অন্ন ভাবটা একেবারে নেই নেই লোভ-লালসা ধান্দাবাজি। এঁরা অতিথি আপ্যায়নে ভীষ সজাগ  

বাউল এবং ফকিরদের পোশাকেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায় আগেকার দরিদ্র বাউল সাধকেরা নানা রঙের টুকরো কাপড় সেলাই করে জুড়ে লম্বা আলখাল্লা পরতেন তাকে বলা হতো গুধরি কিন্তু এখন বাউলরা পরে গেরুয়া আলখাল্লা, গেরুয়া লুঙ্গি, একই রঙের কোমরবন্ধ ও পাগড়ি বাউলদের অচ্ছেদ্যসঙ্গী একতারা এবং ডুগি, খমক,  সারিন্দা বা দোতারা কেউ কেউ গলায় কণ্ঠী পরেন, কেউ করেন তিলকসেবা আর ফকিররা প্রধানত খিলকা, চুল, দাড়ি, টুপী ব্যবহার করেন; কারো কারো পায়ে নূপুরও  থাকে বাদ্যযন্ত্রের মধ্যে ডুগী, যমক, খুঞ্জুরি, একতারা প্রভৃতি বাউলদের পাশে নিজেদের তুলে ধরার জন্য ফকিররা সাদা পোশাক ছেড়ে বর্তমানে পরছে কালো  রঙের আলখাল্লা, গলায় পরছে কালো রঙের পাথরের মালা মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত   শ্রোতা ও ভক্তদের খুশি করার জন্যই বাউলরা তাঁদের সাজসজ্জাকে জাঁকালো করেছে  গানের পরিবেশনে এনেছে পারফর্মারের মঞ্চদাপানো যন্ত্রাণুষঙ্গ 

আগেকার বাউলরা আত্মবিজ্ঞাপনে অভ্যস্ত ছিলেন না তাঁরা থাকতেন নিজেদের ভজন কুটিরে ঘুরতেন পথে প্রান্তরে, মোচ্ছবের সম্মেলনে গানকে জানতেন তত্ত্ব বলে তার ছিল তিনটে পর্যায় - আত্মতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব আর দেহতত্ত্ব এছাড়া ছিল দৈন্য ও মনঃশিক্ষার গান

তবে বর্তমানে এই মরমিয়া সাধক সম্প্রদায়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে কিছু বিদেশিনী  এই শ্বেতাঙ্গিনী বিদেশিনীরা কেউই  মহীয়সী নারী নন, তাঁরা কেউ মার্গারেট নোবেল হয়ে ভারত উদ্ধারে আসেনি। তাঁরা পশ্চিমি বণিক সভ্যতায় দিগ্ভ্রষ্ট রমণী  অর্ধশিক্ষিত কিংবা নেশাগ্রস্ত, কামুক বা বখে যাওয়া সামান্য দুএকজন জিজ্ঞাসু ও  গবেষক



রবীন্দ্রনাথ সর্বপ্রথম বাউল গান সংগ্রহে আগ্রহী হন তিনি লালন ফকিরের বাউল গানের সংস্পর্শে এসে মুগ্ধ হন তাঁর জন্যই লালন ফকিরের গান সংকীর্ণতার সীমা ছাড়িয়ে আধুনিক শিক্ষিত সমাজে প্রচার লাভ করেছে এ প্রসঙ্গে গগন হরকরার নাম উল্লেখ করা যেতে পারে

তবে আধুনিক নগরকেন্দ্রিক সভ্যতায় বাউলের আদর্শগত পরিবর্তন ঘটেছে এখন পোশাকের চমক আর আধুনিক বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি তাঁদের মুখ্য বিষয় একতারা এখন  আর তাঁদের প্রতীক নয় একশ্রেণীর বাউলের যশ-পিপাসা আর প্রচারপ্রবণ মানসিকতা ধ্বংস করে দিয়েছে তাঁদের পরম্পরাগত ধ্যানতন্ময়তাকে বাউলের  প্রতীক একতারা আজ বুদ্ধিজীবীদের গৃহসজ্জার উপাদান একাকীত্বের একতারা হাতে  বাউলের সেই মরমিয়া সুর থেকে গেছে শুধু আমাদের মননে আর মহাকালের আলিঙ্গনে হারিয়ে যেতে বসেছে সেই লালমাটির বাউল  


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন