কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

রবিন্দর পূজা  



                           
বিহারি ড্রাইভার বলল — সাব আপলোগ সব কোই রবিন্দরনাথকো শুরুসেই অ্যায়সেহি পুজতে থে ক্যা? প্রশ্নটা শুনে চমক লাগলবলে কী ব্যাটা! বাঙালির রবীন্দ্রভক্তিতে  সংশয়? আর ভাবলাম, আচ্ছা আমার চমকিত ভাবনাটা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করা  যাক। এই বছরের ৯ই মে রবিন্দরনাথ তাঁর খ্যাতিপ্রচারের নয়া মাধ্যম পেয়ে গেলেন, ফেসবুক! আমি আনাড়ি বলে এখনো জানি না, টুইটারে আর হোয়াইট অ্যাপ্‌‌সে  রবিন্দরনাথ ঠিক কত বাইট পেলেন। এখানে আবার বাইট বলে তো? কে জানে!

কিন্তু যেটা জানি তা হলো স্বদেশে বা বিদেশে রবিন্দরনাথ শুরুসেই এত পাত্তা পান নি। হয়তো ‘বিদ্বান সর্বত্র পূজ্যতে’ আপ্তবাক্যটি তাঁর ক্ষেত্রে অতটা খাটেওনি। একে তো ‘কালেজি’ পড়ায় রসগোল্লা। তারপর শেক্সপীয়রের পড়াশোনার পরিধি নিয়ে মোটামোটা বই আছে। আর আমাদের রবীন্দ্রনাথ কী পড়েছিলেন, তা নিয়ে তো ওই  সবেধন  নীলমণি উজ্জ্বলকুমার মজুমদার। সুতরাং অত পাত্তা পাবার কথাই নয়। তাই নিয়ে লিখছি, কাজলবাবু, সরি! আমার গুরুগম্ভীর এ সংখ্যায় হলো না। এ সংখ্যায় নিতান্তই কবিকথন। গুরুগম্ভীর হবে কী করে? ৯ই মে ফেসবুকে জানালাম যে—
কেউ কি জানেন যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পাওয়ার আগে পর্যন্ত কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর বাংলা রচনার একটি উপযোগিতাই খুঁজে পেয়েছিলেন, তা হলো,  বাংলা পরীক্ষায় শুদ্ধ বঙ্গানুবাদ করতে দেওয়ার জন্য প্যাসেজ হিসেবে? বিশ্বাস না হলে পড়ুন বিখ্যাত ঐতিহাসিক ই.পি. টমসনের, তাঁর রবীন্দ্রভক্ত কবিপিতা ই.জে.  টমসনের ডায়েরি ও কাগজপত্রের ভিত্তিতে লেখা Alien Homage: Edward Thompson and Rabindranath Tagoreএরকম আরো কিছু জ্ঞাতব্যবিষয় নিয়ে  হয়তো লিখব একটি ব্লগজিনের পরের সংখ্যায় (যদি ছাপা হয়)ড়বেন, অ্যাঁ।  বড্ড মাতামাতি করি আমরা বাঙালিরা, তখন উৎসবী ভক্তদের কেউ কেউ যখন জানালেন যে এইরকমের গবেষণালব্ধ আরো তথ্যের জন্য তাঁরা আশায় রইলেন, তখন ভালো আত্মগ্লানি হলো। নিজের একটি পচা, মোটা, (ন্যায়তঃই) প্রায় অপঠিত বইয়ের ভূমিকায় এ কথা লিখেছিলাম সার্ধশতবার্ষিকীর আগের বছরে তাঁর লেখার প্রতি আরো সন্নিষ্ঠ মনোনিবেশের আবেদন জানাতে গিয়ে। সেখানে আরো কথার ফাঁকে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মতেই জানিয়েছিলাম যে, এই সোচ্চার বাৎসরিকের গণ্ডগোলের মধ্যেই  তাঁকে — মানে তাঁর লেখাকে ভুলে যাওয়ার প্রক্রিয়া আরও বীরগতিতে চলবে। তার ফলে রাজশেখর বসুর ভাষায় ‘কাকদন্তগবেষণ’ তথা ‘কাগের দাঁত কটা আছে’ তা গোণার বরাত! বরাত আমার!২ 

অথচ এই ভদ্রলোকটির সামনে পড়লে বিশ্বনিন্দুক, ইংরেজপাগল, ইউরোপমনস্ক নীরদ চৌধুরীর কলম পর্যন্ত কেঁপে গেছে। ‘Tagore: The Lost Great man of India’ প্রবন্ধে চৌধুরী বলছেন, যদি এক কঠোর মেধামাপকের কষ্টিতে পৃথিবীর সর্বকালের, সর্বদেশের লেখকের সংখ্যা এককুড়িতে নামিয়ে আনা হয়, তবুও রবীন্দ্রনাথ সেখানে থাকবেন। চৌধুরী নিজেই এক European standard of reference’ অনুযায়ী তাঁকে ১৯১৩ সালের আগের তেরো বছর ধরে নোবেল পাওয়া সবার অনেক উপরে, একদিকে গ্যেটে আর এক দিকে বিত্তর উগো-র মাঝখানে একস্তরে রেখেছেন। কিন্তু সংশয় প্রকাশ করেছেন যে, রবীন্দ্রনাথ কখনো তাঁর প্রাপ্যটা পাবেন না (অবশ্যই এই প্রাপ্য পুজোর  নয়, রসানুধাবনের, রসোপলব্ধির) সমস্যাটা কেবল অংশতঃ তাঁকে যে কোনো  ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করার কষ্টসাধ্যতা। কিন্তু আরো বড় সমস্যা হলো, তিনি বঙ্গদেশেও ‘নিরাপদ’ নন। তাঁর কাছে বঙ্গদেশে রবীন্দ্রনাথের ‘গ্রহণের’ বহমান ট্রাজেডি হলো এই যে, তাঁর আসল ব্যক্তিত্বটি দৃষ্টান্ত হিসেবে স্মৃত হবে না। আর তাঁর সাহিত্যকর্ম এক মাটির নিচে পোঁতা নগরীর মতো রয়ে যাবে। বেঁচে থাকবে কেবল এই  জড়মোহটা, কিন্তু সেই উদ্দেশ্যে নয় যার জন্য এটাকে তাঁর স্বদেশীয়রা সৃষ্টি করেছে। এটা কেবল তাদের গলার চারদিকে ঝুলে থাকবে, কোলরিজের প্রাচীন নাবিকের গলায় ঝোলা অ্যালব্যাট্রস-টার মতো, শাস্তি হিসেবে। গলা থেকে পড়বে না। কারণ সেই অ্যানসেন্ট ম্যারিনারের মতোই বাঙালিরা কিছুতেই তাঁর বিরুদ্ধে করা নিজেদের পাপের  জন্য ক্ষমাপ্রার্থনা করতে পারবে না
কী বললেন? চৌধুরী ভুল বকেছেন? আমরা কী পাপ করেছি? পাপ করিনি? আধুনিক  বাংলাভাষার স্রষ্টা (লোকে বলে মিল্টন ইংরিজি ভাষায় ছ'শো নতুন শব্দ সৃষ্টি  করেছিলেন; শেক্সপিয়র করেছিলেন কুড়ি হাজার; আর রবীন্দ্রনাথ? কখনো-কিছু-করার-না-থাকা শীতের দীর্ঘ সন্ধ্যাতেও ভেবে দেখেছেন?)! তাঁর লেখা বাংলা পরীক্ষায় শুদ্ধ  বঙ্গানুবাদ করতে দেওয়ার জন্য প্যাসেজ হিসেবে দেওয়া পাপ নয়? আর কিসে পাপ হতো! ইনকুইজিশনে দিলে? আর এই অসাধারণ বঙ্গ-বঙ্গানুবাদের উদাহরণ বেয়াক্কেলে চৌধুরী দেন নি। কে দিয়েছেন, ওপরে বলেছি না? সেকালীন শ্রেষ্ঠ বা বলা ভালো একমাত্র উচ্চবিদ্যায়তনিক প্রতিষ্ঠান! আর কীভাবে অপমান করা যেত ওঁকে। এর পরেও আমরা বলতে পারি না যে তাঁকে এই কাল্ট করে দেওয়া আসলে অবচেতনায় (রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘মগ্নচৈতন্যে’) এই অ্যালব্যাট্রস নামানোর উদ্দণ্ড অবসাদ? কী ভুল করেন চৌধুরী, যখন তিনি বলেন যে নিজের জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ সহ-বাঙালিদের অধিকাংশের দ্বারা প্রায় পরিত্যক্ত হয়েছিলেন, কারণ তিনি যা লিখতেন সেটা তাঁদের মাথার উপর বেরিয়ে যেত এমন কি যে অল্পসংখ্যক অনুরাগী তাঁর বিগ্রহায়ন করতেন তাঁরাও সেটা বুঝতেন না। এখন অবস্থাটা আরো খারাপ,  কারণ বাঙালি জীবন আর সাহিত্যিক ঐতিহ্য এত আলাদা হয়ে গেছে ... যে তাঁর লেখ্যবিষয়  আর তার শৈলী  সমসাময়িক বাঙালিদের কাছে অল্পবিস্তর অনধিগম্য হয়ে গেছে’ তাঁর প্রবন্ধে একটু পরেই নীরদচন্দ্র বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে এমন সময় আসবে যখন  রবীন্দ্রনাথের কাব্যে-সাহিত্যে অর্থ ও সম্পদ খুঁজতে পেশাদার প্রত্নতাত্ত্বিক খনক লাগাতে  হবে৪ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কোথায় যেন বলেছিলেন (মোটেও ঠিক বলেননি যদিও, কাহ্নপাদের লেখায় কবিতা নেই?), চর্যাপদে কবিতা খুঁজতে গেলে গোয়েন্দা লাগাতে হবে। রবীন্দ্রনাথের সেই দশা হবে না তো আরো একশো বছর পর!  

ভুল বকছি? যাঁরা রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে ফেসবুকে, অ্যাপসে গলা ফাটাচ্ছেন (যেন যায়?), বুকে হাত দিয়ে বলুন তো শেষ সপ্তক, পরিশেষ, পুনশ্চ-র কটা কবিতা পড়েছেন? উইলিয়াম রাদিচের গীতাঞ্জলি সহ বিভিন্ন কাব্যগ্রন্থের অনুবাদ, কেতকী কুশারী ডাইসনের নির্বাচিত কবিতার অনুবাদ, ওয়েন্ডি বার্কার ও শরনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (Wendy  Barker Saranindranath Tagore) যুগ্ম সম্পাদনায় Rabindranath Tagore: Final Poems নামে 'শেষ সপ্তক'এর কবিতাগুলির অনুবাদ ইত্যাদির উপর  করে’ ভর করে’ রবীন্দ্রনাথ অবশেষে তাঁর নিজের এবং তাঁর বেছে নেওয়া কোটারির (coterie)-র জঘন্য অনুবাদের রাহুদশা কাটিয়ে আবার বিদেশে নিখাদ কবি হিসেবে কিছু কল্কে আর আমরা সিরিয়ালে, পাড়ার ক্লাবে, ব্লকের অনুষ্ঠানে ফেসবুকে কবির সেই সব বালখিল্য কবিতা নিয়ে আদিখ্যেতা করছি, যেগুলোকে নিয়ে তিনিই হয়তো পরে লজ্জিত ছিলেন।

কেন করছি এই আধিক্য? নোবেল পেরাইজ ব্যাধি! বা অন্য খেতাবের? যেমন করি অনাবাসী খোরানা, বা চন্দ্রশেখর, এমনকি সুনীতা উইলিয়ামসকে নিয়ে? আনন্দমোহন চক্রবর্তীকে নিয়ে নয়, পেতেও পেতেও নোবেল পাননি যে! প্রাইজকাঙাল বাঙালি এই একটা মওকা পেয়ে গেছে গলা থেকে অ্যালব্যাট্রসটাকে নামাবার! কারুর খেয়াল নেই  যে সেই সময়কার এক বরেণ্য সাহিত্য-সমালোচক আর বিদ্বান দীনেশচন্দ্র সেন অনামা থাকার শর্তে ই. জে. টমসনকে লিখলেন, বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে ইউরোপের হাতে  তুলে দেয়নি। বরং ইউরোপই তাঁকে দিয়েছে বাঙালিদের হাতে। ফলে তাঁকে প্রশংসা করে’ ইউরোপীয় পণ্ডিতরা নিজেদের ‘দান’-এরই প্রশংসা করছে।৫ আরো দুঃখের কথা, তিনি  চাইলেন না, তাঁর নাম উদ্ধৃত হোক। কারণ হিসেবে তিনি ই.জে.টি.কে লিখলেন, যে তিনি রবীন্দ্রনাথের আক্রমক ভক্তদের যত ভয় করতেন, ততটা বোধ হয় টোরিরা হুইগদের বা ক্রমওয়েলের আয়রনসাই্ডসদেরও করতো না।৬ ভদ্রলোক হিসেবে ই.জে.টি. তাঁর ১৯২৬ সালে লেখা Tagore বইয়ের প্রথম পরিশিষ্টে চিঠিটির কিয়দংশ নাম না করেই উদ্ধৃত করেছেন। সেটি আবার ই.পি. উদ্ধৃত করেছেন তাঁর বইতে।৭ সব্বাই হয়তো এত লুকোছাপাও করেন না। যাঁরা ইচ্ছুক জানতে, তাঁরা দেখুন সুজিতকুমার সেনগুপ্তর লেখা জ্যোতির্ময় রবি ও কালো মেঘের দলদেখুন কালীপ্রসন্ন কাব্যবিশারদ তাঁর মিঠেকড়া-তে লিখছেন যে, কেবল বাপের টাকার জোরে তাঁর  ওইসব লেখা বিকোলোআর পাঁচকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায় তো বলেই দিলেন যে,  রবীন্দ্রনাথের সব লেখাই বিদেশি সাহিত্যের অঋণস্বীকারী নকলি! ই.জে.টি. বোধহয় জানতেন না এঁদের নাম। জানলে বেচারা দীনেশবাবুকে নিয়ে পড়তেন না।
                   
তো! দীনেশবাবুর মতে, ‘ইউরোপই তাঁকে দিয়েছে বাঙালিদের হাতে’ইউরোপ মানে কী? ইয়েটস, স্টারজ মুর, রথেনস্টাইন? রবীন্দ্রনাথের নোবেলপ্রাপ্তির পর ইয়েটসের  কিছু কথাবার্তা এই বিশাল কবিকে বাঙালির কাছে অচ্ছুত করে দিয়েছে। কিন্তু ইয়েটসের মাধ্যমিকতা ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কী হতো তা বোঝা যায় নোবেলপ্রাপ্তির আট বছর পরও তাঁর সম্পর্কে ইউরোপ কী বলছে তার টুকরো-টাকরা থেকে। এক প্রতিষ্ঠিত জার্মান কাগজে লিখছে, প্রাচ্যের এই স্বপ্নদর্শী ও কবির একটি সঙ্কীর্ণ   ইউরোপীয় দৃষ্টিভঙ্গি আছে। নিজের দেশের প্রতিভা থেকে তিনি পেয়েছেন কেবল কিছু ঐতিহাসিক এবং দার্শনিক ভাবনা, কিন্তু প্রখর কবিপ্রতিভা নয়আরেক ফরাসি সাহিত্য-সমালোচনা পত্রে এলো এই বাণী যে, নিজভূমেই রবীন্দ্রনাথ অনিকেত। কারণ  এক ‘শিক্ষিত বাঙালি’ নাকি সমালোচককে বলেছেন যে, রবীন্দ্রনাথের দেশবাসীরাই তাঁর ইংরেজি 'গীতাঞ্জলি' বইটি আদি বাংলাটির থেকে বেশি পছন্দ করে। কেবল  বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কচ্যুত কিছু বাঙালি সাহিত্যব্যবসায়ী, যারা অবিরত  ইংরেজি বই পড়ে, তারাই তাঁর লেখার পরম ভক্ত। তাছাড়াও তাঁর তথাকথিত মরমিয়াবাদে আচে কেবল উপনিষদের, দুর্বল, মৃদু প্রতিধ্বনি।৯ এই মত যে একেবারে অমূলক নয়, তার কিছু প্রমাণ আগেই দিয়েছি। এখানে উল্লেখ করা অসমীচীন হবে না যে, ই.জে.টি দেখাচ্ছেন কীভাবে তাঁর নিকটস্থ স্কুলের সংস্কৃতজ্ঞ হেডপণ্ডিত বাংলা  'গীতাঞ্জলি' দেখে ইস্কুলে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিলেন পাশে তীর বেঁধা চিতার মতো (‘like a  leopard with an arrow in his side, আর এক পণ্ডিত বইয়ের সারমর্মটিই উপলব্ধি করতে পারেননি। আর ছাত্রদের বিষয়বস্তু ‘পসন্দ’ হলেও কাব্যশৈলীটা মনে হয়েছিল কাঁচা (‘the diction was mean and bad)১০ আরেক বোদ্ধা তাঁর কবিতার  উপর প্রাচ্যের প্রভাবের গভীরতা আর অগভীর পাশ্চাত্যবাদকে একই বাণে বিঁধে বললেন, এই যদি টিপিক্যাল ওরিয়েন্টাল কবি হয়, তাহলে প্রাচ্যের এমন কিছু দেওয়ার নেই আমাদের যা কিনা আমরা জানি না, একটু স্থানিক রঙ ছাড়া (beyond a little local colour’)এটাই পথ করে দিল পরের ব্যঙ্গোক্তিটির যে,  যাঁরা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা একটা জীবনের ঝলক দেখে প্রভাবিত হতে চান, যে পূর্বের মন এমন ভাবে কাজ করে যে আমাদের পক্ষে বোঝা সম্ভবই নয় তার প্রকাশ দেখে  ভাবিত হতে চান, তাঁরা ভালো করবেন তাঁদের প্রার্থিত বস্তুর জন্য মিঃ কিপলিং-এর কাছে গেলে, ... ইনি বরং খুব সঙ্কীর্ণ ভিক্টোরীয় অর্থে ইউরোপীয় (‘Those who wish to be impressed by glimpses of a life that is totally different from  our own, by revelations of the Eastern mind which works in a way we can never understand, would do far better to go to Mr. Kipling for what they want … And he is European in what can be called a narrow Victorian style.)’ যাঁরা এতটা মাকড়া নন, তাঁরা আবার বললেন, তাঁরা প্রাচ্য  থেকে চান না, ‘poetic edifices built  upon a foundation of Yeats and Shelley and Walt Whitman”, বরং শুনতে চান কৃষ্ণের সেই বংশীধ্বনি যা শুনে রাধা স্বপ্নপদ্ম-হৃদে এই নীল-দেবতার মায়ামোহে পড়েছিলেন (the flute of Krishna as Radha heard it, to fall under the spell of the blue god in the lotus-heart of dream’).  ১১  

১৯২০ থেকে ১৯৩০-এর বছরগুলিতে রবীন্দ্রনাথ যখন ইউরোপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তখন দুই বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী রাজনীতির আবর্তে এই দেশগুলির কায়েমী স্বার্থসমূহ তাঁর সম্পর্কে যেসব আজব আকথা-কুকথা বলেছে, (ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন,  সব্বাই!) সে কথা বলার ঠাঁই এটা নয়। রবিন্দর-ভক্তরা ব্যথা পাবেন। কেবল তিনটি কথা  বলি। ক) জানেন যে, পৃথিবীতে একটিমাত্র দেশে রবীন্দ্রনাথের লেখা  নিষিদ্ধ হয়েছিল, লিথুয়ানিয়ায়? কারণ রাজধানী ভিলনায় (যাকে ইতিমধ্যে ইউরোপীয় মাতব্বররা পোল্যাণ্ডকে দিয়ে দিয়েছিলেন) অগ্রসরমাণ ব্রিটিশ ও ফরাসি  যুদ্ধজাহাজগুলিকে  প্রতিহত করতে অপারগ এই দেশটি রাগে, ক্ষোভে রবীন্দ্রনাথের সব লেখাকে শেক্সপীয়র এবং অস্কার ওয়াইল্ডের সঙ্গে বাজেয়াপ্ত করেছিল, অষ্টাদশ শতাব্দীর কুপ্রভাব বলে? ২) ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এক সময়ে নাচানাচি করা জার্মানিতে ইতিমধ্যেই ফ্যাসিবাদী কাগজগুলি ভাবতে আরম্ভ করেছিল, রবীন্দ্রনাথ জার্মান না সেমিটিক! বলছিল, জার্মানই মনে হয়, ফলে স্বস্তিকা-ধারণের উপযুক্ত, কিন্তু  বেটার শান্তিবাদ দেখেই ধন্দ হয়। আর  সেমিটিক না হলে ওই লম্বা দাড়ি কেন? আর এত ইহুদি প্রকাশক, শিল্পপতি, বিজ্ঞানীদের (আইনস্টাইন) সঙ্গে ওঠাবসাই বা কেন? ১২

ভাবতে, সংশয় কাটতে লেগে গেল পাক্কা বারো বছর, মানে জার্মানি পুরো ফ্যাসিস্ট হয়ে যাওয়া অবধি। তারপর  এক ইংরেজ মহিলা স্টেটসম্যান, কলকাতায় চিঠি লিখে জানালেন যে, ‘ওখানে’ একটি বক্তৃতার পর একজন উঠে দাঁড়িয়ে জানালেন, এইসব  লোকদের সম্বন্ধে (মানে রবীন্দ্রনাথ) কথা বলাও পাপ। কারণ সব্বাই জানে ব্যাটা  ইহুদি, আদত নাম ‘Rabbi Nathan’ — ইহুদি যাজক কিনা  বিয়ে করেছে বম্বের এক ইহুদিনীকে, যার বাপ আবার বাঁশ-ব্যবসায়ী, আর প্রচুর টাকা কামিয়েছে এই বিয়ে থেকে। ১৩

তো! জার্মান জাত কিনা! পাঁচ বছরের মধ্যেই ভুল শুধরে নিল। বলল যে, নাম  শুনেই বোঝা যায় যে লোকটা ইন্দো-জার্মান। এই ইন্দো-জার্মান বংশেরই একটা ধারা ভারতে গেল, আর একেবারে অশোক থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ, মায় নেহরু অবধি  ওটাতেই জন্মাচ্ছেন কিনা! ১৪ ওদের কথা ছাড়ুন। আপনি একটু পড়ুন না ভাই!  লোকটাকে! নইলে সব্বাই যে বেবাক ভুলে যাবে! আর চলবে এই মোচ্ছব!   
**************         ******************         
আরে দূর! এও পড়তে বলছে, বে! শেষ দিকের কবিতা, কীসব মাথামুণ্ডু বকছে। চল তো ‘কবিগুরির’ জম্মদিনটা সেরে আসি! ১৬ শালা বেজম্মা, আমাদের রবীন্দ্রনাথ শেকাতে চায়! বোঝে না, গুরু আমাদের জম্মসূত্রে পাওয়া।  চল, ‘ওই রাতদুপুরে দুষ্টু  বাঁশি বাজে’ দিয়েই শুরু কর। বেড়ে লিখেছে মাইরি বুড়ো! একেবারে লে ছক্কা!

তথ্যসূত্র (ইংরেজিতে, তবে না পড়লেও হয়)
1.  E.P. Thompson, Alien Homage: Edward Thompson and Rabindranath Tagore (Delhi: Oxford University Press, 1993), pp. 53-54, 66.
2.  রাজশেখর বসু, ‘বৈজ্ঞানিক বুদ্ধি’, রাজশেখর বসু প্রবন্ধাবলী, সঃ দীপঙ্কর বসু (কলকাতা মিত্র ও ঘোষ, ২০১৪), পৃঃ ১৩৯-৪৮, বিঃ ১৪৭।   
3.  Nirad C. Chaudhuri, Thy Hand, Great Anarch! : India 1921-1952 (London: Chatto & Windus, 1987), p. 63-6 সেখানে চৌধুরী বলছেন ‘his real personality will not be recalled as an example, and his work will be like a buried city in the past. Only the fetish Rabindranath will remain, but nor for the purpose for which it has been created by his people. It will hang round their neck as punishment… and it will not drop from there because the Bengalis will never be able to pray for forgiveness for their sins against him.’ 
4.  ‘He was virtually rejected by a majority of fellow Bengalis in his life time, because what he wrote was far above their head, not fully understood even by the small number of admirers who made an idol of him. Now the position is even worse, because both Bengali life and Bengali literary traditions have become so different … because both his matter and manner have become more or less inaccessible to contemporary Bengalees’, তদেব। 
5.  ‘Bengal has not given Rabindranath to Europe. Rather, Europe has given him to the Bengalis. By praising him, the European scholars praise their own gift’, তদেব।
6.  ... far more than the Tories did the Whigs or Cromwell’s Ironsides’.
7.   Dineshchandra [Sen] to E.J. Thompson (EJT), n.d. (1922) and 6 November 1922. EJT, Tagore (1926), parts of Sen’s Letter in Appendix A , pp. 307-08; cited in E. P. Thompson, Alien Homage: Edward Thompson and Rabindranath Tagore (Delhi: Oxford University Press, 1993), pp.53-54.
8.  ‘This man from the East, a dreamer and a poet, has a narrow European outlook. He has gained from the genius of his country only historical and philosophical impressions, but not a formidable poetical impetus’. Vorwarts, Berlin, June 1921, cited in Alex Aronson, Rabindranath through Western Eyes (1943) (Calcutta: Ŗddhi-India, 1978), p.17.
9.  Revue Anglo-Americaine, Paris, February 1930, cited in ibid, p.17.
10.          … only uprooted litterateurs who no longer are in touch with Bengali culture, and only read English books are his most enthusiastic admirers.” Thompson, Alien Homage, pp. 46-7, 53.
11. Edward Shanks, ‘Sir Rabindranath Tagore’, in The Queen, London 21 May 1921, cited in Aronson, Rabindranath, p.16. 
12.          Der Gegner, Berlin, 20 June 1921, Aronson, Rabindranath, pp. 62-3.  
13.          Cornelia Blake to The Statesman, Calcutta, 21 July 1933, cited in Aronson, Rabindranath, p.63. 
এক নাৎসিভূত সিংহলীর বয়ানে, Daily News, Colombo, 6 October 1936.
হ্যাঁ, ভাই এবছরের সরকারি বিজ্ঞাপনে এরকমটাই! দ্রঃ, আর কী? ফেসবুক! সৌজন্যে মহালয়া চ্যাটার্জি।    
                                               
              
 
  

                         

                                  

6 কমেন্টস্:

  1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  2. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ...অমর্ত্য দা---সুরঞ্জন রায়

    উত্তরমুছুন
  4. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

    উত্তরমুছুন
  5. 1. Eta to sobai jane Puroskar na pele tar dike "sobai" fire takai na. School jibon theke suru hoi prothom ke holen ta niyei hoi choi. Omulok map-kathi gulo sohoj-gomyo. Ebong egulir upor vorsa korlei matha kom ghamate hoi.
    2. Kolkata te kanta chamoch-e na khete janle sobai duyo dei, gopone sikhi, chesta kori, karon seta saheb ra khae. Hate khelei Guha-Manob. Shrodhyar phulo ki kanta chamoche dite hoi? Na bodh hoi, karon Saheb ra ekhon seta suru koreni ......
    3. Vincent ba Ludwig (Boltzmann) (aaro onekei) keno aantyohotya koren ?
    4. "Tagore" likhi, boli karon seta saheb ra bole. Othocho "champagne"-r uchharon niye koto jotno.

    Ekhono aantyobiswas-er prokhor ovab ......

    উত্তরমুছুন