কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ মে, ২০১৫

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

ট্রেনের স্বদেশট্রেনের বিদেশ ওরা আর বোতলের রম্যকাহিনী

সে বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। আমরা তিনবন্ধু বড়দিনের ছুটিতে শান্তিনিকেতনের ট্রেন ধরেছিলাম হাওড়া থেকে। কয়েক ঘন্টার ধাক্কা। আরামের চেয়ার কারে যাচ্ছিলাম আমরা; স্বাদ বদলের ঝালমুড়িশীতের রুক্ষ খোয়াই আর বিশ্বভারতীর পাতা ঝরা গাছেদের প্রত্যাশা নিয়ে। জানালার ধারে কে না বসতে  চায়আমি আর আরেক বন্ধু চুক্তি করেছিলাম একটু বাদে বাদে উইন্ডো সিট বদলাবদলি করে নেব কিন্তু তৃতীয় বন্ধু জানালা ছাড়তে নারাজ, তাই আমাদের থ্রি- সিটারটা ছেড়ে সে সামনের সিটে গিয়ে বসেছিল ওর সাথে বিশেষ কথাবার্তা হচ্ছিল না। তবে ট্রেনের এমনিতেই যা ঘটাং ঘটাং শব্দ তাতে কথা বলা-শোনা দায়। বরং বাইরের হাওয়ায় ভেসে জানালার বাইরে কান বাড়িয়ে সামনের সিটের বন্ধুর সাথে  কথা বলা যাচ্ছিল টুকটাক। ঘন্টাখানেক কাটার পর ওদের দেখা গেলওরা। যাদের আমরা ট্যাক্সির জানালায় দেখি কিম্বা বাড়ির নিচে, বাড়িতে নতুন বাচ্চা জন্মালে।  ওদের আমরা যে নামে সচরাচর ডেকে থাকি সেটা অপমানজনক তো বটেইকিন্তু সেরকম কোনো নাম থাকুক আর না থাকুক, ওরা আমাদের কাছে সব সময়ই ওরা। ওরা ভীতিপ্রদওরা অস্বস্তিদায়ক এবং ওরা অসভ্যঅশালীন। কখন কী করে বসে  ঠিক নেইকেউ ওদের পাবলিক স্পেস ম্যানার্স শেখায়নি। আমরা ওদের দেখলেই তাড়াতাড়ি গাড়ির জানালার কাচ তুলে দি কিম্বা এক চিলতে ফাঁক রেখে চট করে  একটা ১০-২০ টাকার নোট গলিয়ে দিই। সেদিন ট্রেনে প্রথমে ওরা দুজন ছিলআমি তখন সবে আমার বন্ধুকে ধারের সিট ছেড়ে পাশে এসে বসেছি। ওদের দুজনের একজন এসে প্রথমে আমায় চিকনা বলে সম্বোধন করে মাথায় গায়ে হাত বুলোতে  থাকে। আমার যাবতীয় সভ্যতা ও লিবারাল সাহিত্য-সংস্কৃতিময় পড়াশোনা সত্ত্বেও গায়ে হাত দেবার সাথে সাথেই আমি বেশ হতচকিত হয়ে পড়ি।  অস্বস্তি ও ভয়ের মাঝে কিছু একটা অনুভূতি, ব্যক্তিক আর সামাজিকের মাঝে বলেই কি নামহীনযাক, ঘৃণা জাগেনি এ যেমন সত্যিতেমন বিচলিত যে হয়েছিলাম, কোনো  সন্দেহ নেই। কোনোরকমে পকেট থেকে ওয়ালেট বার করে দুজনের হয়ে ২০ টাকা  ধরিয়ে দিই ওর হাতে। ও টাকাটা নিয়ে একফালি হেসে এগিয়ে যায়। আমার জানালায়  বসা বন্ধু তখন আমার অপ্রস্তুত হয়ে পড়া নিয়ে বেশ হাসাহাসি করছে আর আমিও লজ্জ্বা পাচ্ছি নিজের অস্বস্তিবোধে। সামনের সিটে যে বন্ধু ছিল তার কাছে দ্বিতীয়জন অনেকক্ষণ ছিল। চলে যাবার পর আমার জানালায় বসা বন্ধু শুধালো

-- কিরে, এতক্ষণ ধরে কি করছিলিপয়সা দিসনি?
-- দিলাম তো
-- তাহলে
-- আরে ভাবলাম, বেশ গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেআরামই তো লাগছে তাই ঠিক করলুম, একটু বাদেই নয় দিই টাকাটা। 
-- মানে টাকা দিচ্ছি যখনএকটু আরামও খেয়ে নিই, নাকিযা তা
-- হে হে 

আমি আমার দুই বন্ধুর এহেন কথোপকথন শুনছিলাম, ঠিক তখন ওরা দুজন যেদিক থেকে এসেছিল তার উল্টোদিক থেকে অর্থাৎ আমার চোখের সামনে আরেকজন দেখা দিল। ওরা তাহলে দুজন ছিল না! তিনজন ছিলআমরা যাদের তৃতীয় বলে থাকি তাদের তৃতীয়জন কিন্তু আমার মনে হলো সর্ব অর্থেই বেশ সুন্দরী। কালো নেটের ব্লাউজ আর নীল রঙের কিছুটা ট্রান্সপারেন্ট শাড়ি পরেছিল হাতে নানা রঙের চুড়িমাথায় ছোট টিকলি, কপালে পুচকে টিপ আর ঠোঁটে হাল্কা লাল লিপস্টিক। সাজসজ্জা কিছুটা উচ্চকিত হতে পারে কিন্তু লাউড নয়। সব মিলিয়ে ওকে বেশ আকর্ষণীয় মনে হলো এবং সব থেকে ইন্টারেষ্টিং যেটা লাগল, তা হলো ওর  আত্ম-সচেতনতা। বেশ দুলকি চালে শাড়ির খুট বাঁ হাতে ধরে ডান হাত দিয়ে কপালের ওপর ঝুঁকে পড়া চুলটা ঠিক করতে করতে হেঁটে যাচ্ছিল অন্য দুজনের মতো ও কারুর গায়ে হাত দিচ্ছিল না। এলিগান্স এবং দূরত্ব বজায় রেখে আলতো লজ্জ্বা নিয়ে মিহি গলায় টাকা চাইছিল মাঝে মধ্যে। আমি বেশ একমনে ওর দিকে তাকিয়ে ছিলাম দেখে আমার জানালায় বসা বন্ধু আমায় আওয়াজ দিয়ে বলল--

-- কীবেশ তো মনে ধরেছে মনে হচ্ছেএটা ঠিক যে এ কিন্তু অনেক বেশি মেয়ে মেয়েতাই না

-- মেয়ে মেয়েহয়তো! কিন্তু তার জন্যই কি মনে ধরলোচমকে উঠলাম  নাজানি না। কাকে কেন মনে ধরে তা বলা কি এত সহজ নাকি


সেসব অনেক বছর আগের কথা। এখন কর্মসূত্রে বিদেশে। যেদিন হঠাৎ সেই শান্তিনিকেতনের ট্রেনটার কথা মনে পড়ল, সেদিনও ট্রেনেই ছিলাম। সাথে অবশ্য কেউ  ছিল না। বেশ রাতের ট্রেন। এদেশে লোকসংখ্যা এমনিতেই কমআর অত লোক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারও করে না। এখানে ট্রেনে কেন, রাস্তাতেও সচরাচর কাউকে টাকা চাইতে বা ভিক্ষা করতে দেখা যায় না। বড়জো হোমলেসরা গলায় বোর্ড  ঝুলিয়ে রাখে: 'In bad shape, please help' প্রাচ্যের মানুষ বলেই হয়তো এই  লিখিত চীৎকার কেমন উদ্ভট লাগে আমার। কে জানে, হয়তো উচ্চারণহীনতা আরো  বেশি অসহায়তা ব্যক্ত করে। এদেশে আসার পর দুবছর হলো আমি ওদের দেখিনি।  ট্রেনেও নাট্রেনের বাইরেও না। এদেশে ওদের ঐ নামে ডাকাও হয় না। আমার এখনকার এখানকার কম্পার্টমেন্টে আমি ছাড়া দুজন ছিলেন, কিন্তু কে বা কারা  বিয়ার আধা খেয়ে বোতলখানা ট্রেনের মেঝেতে ফেলে দিয়ে গেছে আর সে হতচ্ছাড়া  এদিক ওদিক গড়িয়ে গোটা কম্পার্টমেন্ট জুড়ে স্রোতপ্রবাহ তৈরি করেছেযেন  দেওয়ালের গায়ে দু বাচ্চার হিসি-কাটাকুটি। কম্পার্টমেন্টের ফ্লোর জুড়ে বিয়ারের ক্ষণস্থায়ী নানা ডিজাইনশব্দছক আমার বেশ শিল্প শিল্প মনে হলেও যে দুজন এই কম্পার্টমেন্টে উঠেও এগিয়ে চলে গেলেন ডাবল ডেকার ট্রেনের ওপরের দিকেতাদের মুখ দেখে মনে হলো না তারা এই বোতলবাজিতে নেহাৎ খুশি হয়েছেন। আমি তখন ভাবছি ট্রেনের ওপর-নিচে বোতলটা কতদিকে গড়াবে কেউ জানে না।  কতক্ষণে শুকোবে এই বিয়ারের ছাপ আর কি কি নতুন ডিজাইন বানাবেকেউ জানে না। যতক্ষণে আমি আমার স্টেশনে এসে পৌছলামবিয়ারের খালি বোতলটা আমার সিটের কাছে এসে থেমে রয়েছে। একবার ভাবলাম নিয়েই নামিস্টেশনের বিনে ফেলে দেবতারপর ভাবলাম একে তো নোংরা বোতল তারপরে আমি ওপেন লিকারের বোতল নিয়ে ট্রেন থেকে নামছি দেখলে আমাকেই হয়তো ধরবে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে  ইল্লিগালি মদ খাবার জন্য। এইসব ভেবে কিছুটা ভয় আর কিছুটা অস্বস্তি হলো। ঠিক নাম দিতে পারলাম না অনুভূতিটার। অস্বস্তি ও ভয়ের মাঝে কিছু একটা অনুভূতিব্যক্তিক আর সামাজিকের মাঝে বলেই কি নামহীনবোতলটা আমার এইসব চিন্তার কথা ভেবে একটু নড়ে সশব্দে হেসে উঠল   



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন