কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

**** কালিমাটি অনলাইন / ২৬ ****

সম্পাদকীয়  
  

প্রকাশিত হলো 'কালিমাটি অনলাইন' ব্লগজিনের তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা। ক্রমিক সংখ্যা ২৬। সম্পাদকীয়র শুরুতেই প্রয়োজনীয় দু' একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি। 'অণুরঙ্গ' বিভাগটি যখন শুরু করা হয়েছিল, তখন আমরা জানিয়েছিলাম, এই বিভাগে নিয়মিত ভাবে ছোট নাটক প্রকাশ করা হবে। কেননা  আমরা মনে করি যে, নাট্যসাহিত্য বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম মুখ্য ধারা। এক সময় বাংলা গদ্য সাহিত্যের পাশাপাশি নাট্যসাহিত্য সমান জনপ্রিয় ও সমৃদ্ধ ছিল। বিশেষত সেইসব নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠ্য রূপেও পাঠক-পাঠিকাদের কাছে সমাদৃত হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে মঞ্চস্থ হওয়ার জন্য অসংখ্য বাংলা নাটক রচিত হলেও পাঠক-পাঠিকাদের কাছে কিন্তু তা পাঠ্য রূপে বিশেষ গৃহীত হচ্ছে না। এর  কারণ কি, তা সাহিত্য সমালোচকরা সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারবেন। আমরা সেই বিতর্কে আপাতত প্রবেশ করছি না। বরং আমরা শুধু চেয়েছি, বাংলা নাট্য সাহিত্যের ধারাটি আবার যেন সজীব হয়ে ওঠে। প্রেক্ষাগৃহে নাটক দেখে নাট্যরস উপভোগের পাশাপাশি যেন নাটক পাঠ করেও তার রস আহরণ করা যায়। কালিমাটি অনলাইনের পাঠক-পাঠিকারা জানেন যে, বেশ কয়েকটি সংখ্যায় 'অণুরঙ্গ' বিভাগে আমরা অনেকগুলি নাটক প্রকাশ করেছি এবং তাঁরা সেজন্য আমাদের অভিনন্দনও জানিয়েছেন। কিন্তু তাসত্ত্বেও আমরা স্বীকার করছি যে, সম্প্রতি কয়েকটি সংখ্যায় 'অণুরঙ্গ' বিভাগটি প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি, কেননা আমাদের হাতে প্রকাশযোগ্য কোনো নাটক ছিল না। আমরা তাই কালিমাটি অনলাইনের পাঠক-পাঠিকাদের কাছে বিনীত অনুরোধ জানাই, আপনারা যাঁরা বাংলা নাটকের সঙ্গে জড়িত আছেন, মঞ্চস্থ করার জন্য বাংলা নাটক রচনা করছেন, তাঁরা কালিমাটি অনলাইনের 'অণুরঙ্গ' বিভাগের  উপযোগী নাটক পাঠিয়ে এই বিভাগটিকে সজীব ও সমৃদ্ধ করে তুলুন। আমরা আশা করি, বাংলা ভাষার নাট্যকাররা আমাদের এই অনুরোধে সাড়া দেবেন ও সহযোগিতা করবেন। সেইসঙ্গে কালিমাটি অনলাইনের অন্যান্য বিভাগের জন্যও লেখা ও ছবি পাঠাতে অনুরোধ জানাই। আপনাদের ভালো লেখা প্রকাশের জন্য আমরা দায়বদ্ধ।

'কালিমাটি'(মুদ্রিত) পত্রিকার শততম সংখ্যা পেরিয়ে যাবার নেপথ্যে যে সব অসাধারণ ব্যক্তিত্ত্বের স্নেহ ভালোবাসা শুভেচ্ছা অনুপ্রেরণা সহযোগিতায় প্রতিনিয়ত ঋদ্ধ হয়েছি, তাঁদের মধ্যে অনেকেই আজ আর নেই। অবশ্য তাঁদের শরীরী অনুপস্থিতিই অনুভব করি; কিন্তু তাঁরা সবাই অত্যন্ত গভীর ভাবে ছড়িয়ে আছেন আমার অস্তিত্বে ও চেতনায়। সম্প্রতি আবার হারালাম আমার অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ও প্রণম্য ব্যক্তিত্ব প্রভাতরঞ্জন রায় মহাশয়কে। গত ১লা জুন সন্ধ্যায় তিনি প্রয়াত হয়েছেন। ১৯২৮ তাঁর জন্মসাল। প্রায় ৮৮ বছর বয়সে চিরবিদায় গ্রহণ। তাঁর মরদেহ দান করা হয়েছে চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষণার জন্য। 'কালিমাটি' পত্রিকার জন্য তাঁর যে কী বিশাল আন্তরিক অবদান, পত্রিকার সঙ্গে সম্পর্কিত সবাই সেসব কথা জানেন। তাঁকে আমি সম্বোধন করতাম 'প্রভাতদা' নামে। কিন্তু তিনি বয়সে ও মর্যাদায় ছিলেন আমার পিতৃতুল্য। কর্মজীবনে প্রথমে তিনি ছিলেন ত্রিপুরায়। পরবর্তীকালে পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যায় কিছুদিন। তারপর কর্ম জীবনের শেষদিন পর্যন্ত জামশেদপুরে। টাটানগর রেলওয়ে স্কুলে শিক্ষকতা  করতেন তিনি। আর তাই সবার কাছে পরিচিত 'মাস্টারমশাই' সম্বোধনে। অবসর  গ্রহণের পর তিনি কলকাতায় বসবাস করতেন। আদর্শ শিক্ষক ছিলেন তিনি, যা এযুগে একান্তই বিরল। আর ছিল সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। অসংখ্য সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ছিলেন। অসাধারণ সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল তাঁর। বাংলা ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই সমান দক্ষ ছিলেন। দুই ভাষাতেই অনেক কবিতা ও গদ্য লিখেছেন। আর সাহিত্য সংস্কৃতি ভাষা সমাজ শিক্ষা ও বিশ্বব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর ছিল অনন্য মৌলিক চিন্তা ভাবনা। যাঁরাই তাঁর সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য লাভ করেছেন, তাঁরাই তাঁর সেই চিন্তা ভাবনায় জারিত হয়েছেন, মুগ্ধ হয়েছেন। আজ এই অনন্যসাধারণ ও অনন্যসুন্দর ব্যক্তিত্বকে হারিয়ে খুব স্বাভাবিক কারণেই আমরা অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছি। আর আমি ব্যক্তিগত ভাবে হারিয়েছি আমার মাথার আরও একটি বটবৃক্ষ।

আপনারা সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, আনন্দে থাকুন।   

     
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

দূরভাষ যোগাযোগ :           
0657-2757506 / 09835544675
                                                         
অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India
     





**** কথনবিশ্ব ****


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

‘লুঠ’, সুশীল সমাজ ও রাজনীতি








লুঠ চলছে খোলাখুলি। আমাদের প্রাচীনা পৃথিবীর প্রাকৃতিক সম্পদের। উন্নয়নের নামে শিল্পের নামে। আর আমাদের! ‘হৃদিকমলে বড় ধুম লেগেছে’। চওড়া, মসৃণ রাস্তা; চতুর্দিকে কারখানা, মানে শিল্প আর কি; সবার (মানে মধ্য-উচ্চ-উচ্চতর-মধ্যবিত্তের ছানাপোনাদের) ‘কাজ’, তরতরিয়ে ওঠা জিডিপি, মোদির হিন্দুত্বের ডানা-ভর-করা উন্নয়ন, পাস হতে হতে আটকে যাওয়া ভূমি-সংস্কার; এই-সংসদের-পাতে-পড়লো-বলে’ শ্রম-সংস্কার (উফ্ঃ একবার পাশ হলে ৩০০ জনার নিয়োগের কম শিল্পে ইচ্ছে মতো  হায়ার-ফায়ার)রামরাজ্য এলো বলে (আর সেটা আনতে হবে বলেই তো ‘ধীরোদাত্তঃ নায়কঃ’ কেমন খেপে গিয়ে কংগ্রেসের কোল ছেড়ে ভাজপার ধনুতে শর-যোজনা করেছেন)! এর জন্য দরকার! সংস্কার!
     
এটাকে লুঠ বলছেন কেন? উন্নয়নের দরকার নেই? আছে তো! সেই জন্যই তো কর্পোরেট হাউসগুলো সব রঙের কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারগুলোর চোখ-টিপুনিকে ভর করে’ জমি-জল-অরণ্য-খনিজ নিঃশেষে ছিনিয়ে নিচ্ছে; রঙে ঢেকে এক পাহাড়ের গা কোক আর আরেক পাহাড়ের গা পেপসির বিজ্ঞাপনে ভরে দিচ্ছে, তার জৈব-বৈচিত্র্যের গোড়া মেরে’; নরম পানীয়ের নির্মাতারা ভূস্তরের নিচের জলের আদ্যশ্রাদ্ধ করে’, তাদের দূষক-প্রভাব ছড়িয়ে দিয়ে, আমাদের হাতে তুলে দিচ্ছে নাকের-বদলে-নরুন-পেলাম-টাকডুমাডুম-কোল্ড-ড্রিঙ্কস। ২০০৮ সালেই তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার যে কোস্টাল জোন ম্যানেজমেণ্ট নোটিফিকেশন চালু করেছিল, তা আইন হলে, অর্থনীতিবিদ অমিত ভাদুড়ী বলেছেন, উপকূলীয় ভারতের ৭৬০০ কিমি দীর্ঘ সমুদ্রতটভূমি জাতীয়-বিজাতীয় কর্পোরেট শ্রীহস্তে চলে যেত! আর জেলে-মৎস্যকর্মী-মৎস্যজীবী মিলে এককোটিরও বেশি অভাগা উচ্ছেদ হওয়া ছাড়াও প্রভূত উপকূলীয় সম্পদ নষ্ট হতো। তো! এই সব এনজিও মার্কা তাবলে উন্নয়ন হবে না। আর তার জন্যেই তো সাগর সামনে রেখে সৈকত চুরির আইন মাঠে মারা গেলেও তার পরের ‘গান্ধীপদবীবাহিনী’ নেত্রীর সরকার কত কষ্ট করে’ কর্পোরেট প্রতিনিধিপুষ্ট কোস্টাল জোন ম্যানেজমেণ্ট অথরিটি রেখে দিয়েছে। দেখা যাক, এবার কী হয়! জয়রামজীকি? লুঠ চলছে বিশ্বাস হচ্ছে না? তবে দেখুন ‘Plunder of India— Corporate Plunder: Myth or Reality’  (plunder.hpage.co.in/myth-or-reality_56246670.html) আমি দেখেছি এই ২৫শে মার্চে।

কী বললেন? এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হবে? সেটা করবে কে? সরকার বা রাষ্ট্র, যাই বলুন, সামিল। নইলে, অনন্যা  রায়ের লেখায় (‘Why India Cannot Plan Its Cities: Informality, Insurgence, and the Idiom of Urbanization’, Planning Theory, 8:1 (2009): 76-87) পড়ি কেমনে যে ব্যাঙ্গালোরে, জুরিখ এয়ারপোর্টের মডেলে তৈরি, ঝাঁচকচকে নতুন এয়ারপোর্টে ভারতের ঘনঘন-ওড়া (frequently-flying)  শ্রেণির দ্রুতধাবনের জন্য এক্সপ্রেসওয়ের স্বার্থে রাজনৈতিকভাবে ‘সুসংযুক্ত’ লোকদের সম্পত্তি বাঁচিয়ে, এক অবসরপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থার একজিকিউটিভ ডি.এম. দ্বারকানাথের বাংলো এবং একটি এইডস রোগীদের আশ্রয়স্থল সহ, আর সবই লেপেপুঁছে দেওয়া হচ্ছিল। এর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে’ দ্বারকানাথ রেগেমেগে এক সাংবাদিককে বললেন, ‘ওদের ধৈর্য নেই! ওরা কেবল তাড়াতাড়ি এয়ারপোর্টে পৌঁছতে চায়। তার জন্য সব্বাইকে সামনের পথ থেকে (নাকি পথের সামনে থেকে?) সরাতে চায়। আমরা কোথায় থাকব? আমাদের সমুদ্রে ঝেঁটিয়ে ফেলুক (S. Sengupta, (2008) ‘An Indian Airport Hurries to Make Its First Flight’, New York Times, 22 May 2008)!

হা ভগবান! বরিষ্ঠ আমলা বলছেন আমরা কোথায় বাঁচবো/থাকবো? তাহলে ওই ‘ওরা’, যাদের মামলা করার পথ বা পয়সা নেই, যারা ‘ইংরিজি’ জানে না, যাদের সাংবাদিক ধরার উপায় নেই, তারা? তারা তো এমনিই শহরের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়, ‘চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে’ (জীবনানন্দ, ‘রাত্রি’)। তাদের কথা বলবে কে? কেননা,
অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সব চেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই–প্রীতি নেই–করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া। (জীবনানন্দ, ‘অদ্ভুত আঁধার এক’)
  
এই ‘এঁদের’ হয়েই কাজ করছে সকলের অভিভাবক, কল্যাণময় রাষ্ট্র থেকে রাতারাতি বণিক বনে যাওয়া নিও-লিব্যারাল রাষ্ট্র। তার কাছে নিম্নবর্গের একমাত্র পরিচয় উপদ্রব হিসেবে। নইলে যে দিল্লীর প্রায় সব নাগরিক নির্মাণ এক সমাজতত্ত্ববিদের মতে (ঘার্টনার) প্রায় পুরোটাই বেআইনি, ‘unauthorized’, যেহেতু, শহরের মোট  নির্মাণের অনেকটাই কোনো প্ল্যান বা বাড়ি তৈরির কোনো না কোনো আইনকে লঙ্ঘন করেছে, সেখানে কোনো কোনো এলাকা  বেআইনি এবং ভূমিসাৎযোগ্য বিবেচিত হয়। বাকিগুলো হয় নাঘার্টনার প্রশ্ন করেন, এটা কেন হয় যে সাম্প্রতিক কয় বছরে  দিল্লির বস্তিগুলিকে ‘nuisance’ আর তাদের অধিবাসীদের ‘স্বাভাবিক’ সম্পত্তিমালিকানা বিশিষ্ট নাগরিকদের থেকে নিকৃষ্ট মনে করা হয়। অথচ যেসব নির্মাণ তথা উন্নয়নের চেহারা ‘বিশ্বমানের’, (world class) যেমন অক্ষরধাম মন্দির, তারা নির্মাণের হাজারো নিয়ম-নীতি-নির্দেশ ভাঙলেও ‘আধুনিকতার নিদর্শন’ হিসেবে ছাড় তো পায়ই, আদৃতও হয় (A. Ghertner, ‘Analysis of New Legal Discourse Behind Delhi’s Slum Demolitions’, Economic and Political Weekly, 17 May 2008, pp. 57–66)

মুম্বই শহরে আদর্শ হাউসিং স্ক্যাম-এর ‘হুইস্‌লব্লোয়ার’ সিম্প্রীত সিং যখন কারগিল যুদ্ধের শহীদদের জন্য আর্মির বরাদ্দ করা জমি কী করে আমলা, সাংবাদিক, এবং  অন্য গণ্যমান্যদের হাতে গেল তা ঢুঁড়ে বের করার পর, ‘ঘর বাঁচাও ঘর বনাও’ আন্দোলনের মাধ্যমে জমি-হাঙরদের বাজারী শক্তির হাতে কী করে’ বস্তিবাসীদের বাস্তুচ্যুত হওয়া ঠেকাচ্ছেন, তখনও আমরা দেখি রাষ্ট্র সামিল। একদিকে যখন গরিব ‘অনধিকারপ্রবেশকারীদের’ হটিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বেআইনী বস্তি থেকে, তখনই সাংলি পুর কমিশনারের এবং ফরেস্ট কনজারভেটর এবং অ্যাসিস্ট্যাণ্ট কলেকটরের নেতৃত্বে চল্লিশ আমলার— নাকি আলিবাবার চল্লিশ চোরের— হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে ৩৭,০০০ বর্গফুট জমি কোলাপুর শহরের সার্কিট হাউসের কাছে, ‘পশ’ এলাকায় ১৮ টাকা প্রতি বর্গফুট দরে, ওখানকার বস্তি লেপেপুঁছে, ভূমিসাৎ করে। কোথায়? না সেই মুম্বইতে, যেখানে বর্গফুটপ্রতি জমির দাম শস্তা এলাকায়(মুলুন্দ, গোরেগাঁও)-তে ৯০০০ টাকা থেকে মালাবার হিলে ১.৪ লক্ষ টাকা। সরকারি জমিলুঠ নয়?
             
এটা হচ্ছে কি করে? অনন্যা রায় বলছেন, হতে পারে এই কারণে যে, রাষ্ট্র এক ‘অনানুষ্ঠানিকতা’-র (informality)অন্তরালে ভূমির উপর নিজের সার্বভৌম অধিকারের ব্যবহাররীতিগুলির অনুশীলন করছে। যার ফলে বামশাসিত পশ্চিমবঙ্গেও আমরা দেখেছি রাষ্ট্রকে অনবরতঃ জমির অনানুষ্ঠানিক খাসকরণ তথা  ‘খাসীকরণ’— হ্যাঁ  ‘informal vesting’- এর এই বিকট বাংলাটা ভেবেচিন্তেই করা — করে যেতে। জমির এই অনানুষ্ঠানিক ‘খাসকরণ’ই বামফ্রণ্টের সমর্থনে বর্গাদারদের আইনের ফাঁকে জমির বাস্তব ব্যবহারের অধিকার (de facto use rights) দিয়েছিল। জমির এই অনানুষ্ঠানিক খাসকরণই তার ১০ বছর পর বামফ্রণ্টকে শহরের কেন্দ্রস্থলে  হকার ইত্যাকার দখলদারদের পুনর্বসতির জন্যে জমি জোগাড় করতে সাহায্য করেছিল। আর তারও দশ বছর পর জমির এই অনানুষ্ঠানিক খাসকরণই বামফ্রণ্টকে সাহায্য করেছিল  মূল শহরে এই দখলদারদের আর শহরের উপকণ্ঠে (সিঙ্গুরে) বর্গাদারদের হটিয়ে দিয়ে শিল্পটিল্প গড়ায় ব্যক্তিগত পুঁজিকে  সাহায্য করতে। বামফ্রণ্টের পক্ষে সহজ হয়েছিল বর্গাদারদের খেদিয়ে নন্দীগ্রামে কেমিক্যাল হাব তথা ‘সেজ’, ও মেদিনীপুরে ও অন্যান্য জেলায় প্রান্তীয়-নাগরিক শহর ও আবাসনপ্রকল্প গড়ায় বিদেশি পুঁজিকে আহ্বান করতে। এই প্রক্রিয়া বেআইনী নয়। আইনের বাইরে এর অবস্থান। বরং এর চরিত্র উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া অনানুষ্ঠানিকতা,  জমি-লুঠেরাদের সাহায্যার্থে ভূখণ্ড ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অনুশীলন। অনন্যা রায়ের কথায় এই ভূখণ্ডায়িত নমনীয়তাই রাষ্ট্রকে সুযোগ করে দেয় বর্তমান জমিকে ভবিষ্যতের নতুন নতুন ব্যবহারে কাজে লাগাতে; বর্তমান ব্যবহারের হীনায়ন বা মানহানি ঘটাতে; আর এক ভদ্রায়িত ভবিষ্যতের জন্য তাকে তুলে রাখতে। এতে কেবল আর স্থান থাকছে না গরিবের।

এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কই? এই সংগঠিত লুঠের বিরুদ্ধে কখনো কখনো বিচার ব্যবস্থা এগিয়ে এসেছে, যেমন আদর্শ হাউসিং স্ক্যাম-এর ক্ষেত্রে, বা যখন হিমাচল প্রদেশের হাই কোর্ট পারিবেশিক নিয়মনীতি লঙ্ঘনের কারণে জয়প্রকাশ অ্যাসোসিয়েটস-এর বাঘেরি  সিমেন্ট প্ল্যান্টের উপর ১০০ কোটি টাকার জরিমানা চাপিয়েছে। কিন্তু এই ‘extra-legal’ প্রক্রিয়ায় আইন অনেক সময়ই নিধিরাম। আমাদের ‘সুশীল সমাজের’ ভূমিকা কী? সে কখনও ২১শতকের মানবিক অধিকার, এলজিবিটিকিউদের অধিকার ইত্যাদির ব্যাপারে গলা খুললেও এই সব ব্যাপারে চুপ। কথা বলে মুষ্টিমেয় কয়েকটি লোকসামাজিক ভিত্তির সংগঠন (Community based organizations বা CBO) অথচ আমি সমর্থন করি রাজন  গুরুক্কলকে, যখন তিনি এই জমি লুঠেরাদের বিরুদ্ধে গরিবের আন্দোলনকেই বলেন, তাঁর বিখ্যাত কাপ্পেন মেমোরিয়াল লেকচারে:  প্রতিরোধ ও আশার, এখনকার স্বাধীনতা সংগ্রাম (‘Resistance and Hope: Freedom Struggles in India Today’)যে গরিবরা লড়ছে তারা জানে না যে তারাই, লক-টকভিলের ঢঙের সত্যকারের সিভিল সোসাইটি, বা পার্থ চ্যাটারজির ঢঙের ‘পলিটিক্যাল সোসাইটি’যে লড়াই তারা লড়ছে সেটার মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাবৎ রাজনীতি। আসুন একবার তাদের হয়ে লড়ি! আমাদের গ্যারি স্নাইডারের টারটল আইল্যান্ডকে বাঁচাতে! তাঁর মতোই বলি,  
I pledge allegiance
I pledge allegiance to the soil
of Turtle Island
and to the beings who thereon dwell
one ecosystem
in diversity  
under the sun
with joyful interpretation for all.   

কী বললেন এই কুতর্কের মধ্যে পরিবেশ কিম্বা গ্যারি স্নাইডারের এই ইকোসিস্টেম আসছে কেন? কেন নয়? মানুষদের বাদ দিয়ে পরিবেশ কিবা পরিবেশ-ফ্রেণ্ডলি-উন্নয়ন? আর! স্নাইডারের সেই সব ‘beings’দের মধ্যে ওই বোকাসোকা, কালোকুলো, ঘেমোগন্ধ মানুষগুলো আসে কী করে? সেই তো সাহেব! যদি এই না হতো আপনাদের বিচার তবে কি আর রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে বলতে হতো, ‘মন্দিরে তোর নেইকো মাধব,/ পোদো শাঁখ ফুঁকে তুই করলি গোল’! মানুষদের বাদ দিয়ে, প্রকৃতির লুঠের মধ্যে পরিবেশ হয়? বলুন!     

         

ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত

আমার স্বপ্ন




স্বপ্ন নিয়ে একটা দীর্ঘ কথনের অবকাশ কম। আমার স্বপ্ন কখনোই দীর্ঘ হয় না। কাটা কাটা স্বপ্ন দেখি। দেখি খণ্ড খণ্ড সংলাপ। আমার সমস্ত অপ্রাপ্তিগুলো যেন স্বপ্নের মধ্যেই সার্থকতা খুঁজে পায়। কত বিখ্যাত মানুষকে স্বপ্নে দেখি, গল্প করি। রাজনৈতিক নেতা খেলোয়াড় ইত্যাদি।
আমার একটা গল্পে স্বপ্ন এই রকম। গল্পটির নাম ‘হিরণ্ময়ী কৃষ্ণকলি’।

সেদিন রাতে বেশ দেরী করে ঘুম এলো। অনেক কাটা কাটা স্বপ্ন দেখলাম। আমি আর হিরণ্ময়ী জগার লম্বা কালো গাড়ি চেপে অনেক দূরে কোথাও চলে গেছি। বেশ খিদে পেল। ঝিং চ্যাক ঝিং চ্যাক বাজনা বাজছে, ডিস্ক লাইট জ্বলছে। সামনে একটা রেস্তোরাঁ। সেখানে কাচের জানালা। এসিটা এত জোরে চালানো যে বেশ ঠাণ্ডা লাগছে। পর পর প্লেটে প্লেটে খাবার আসছে। কী খাবার বুঝতে পারছি না। আবার চিনা  মাটির বিভিন্ন পাত্রতেও খাবার রাখা আছে। ঢাকনা দেওয়া। কোথা থেকে হঠাৎ কৃষ্ণকলি আমাকে ফোন করল। বলল তোমার মা কথা বলবে। মা খিল খিল করে হেসে বলল, ঢাকনা সরিয়ে দেখলেই হয় দামি দামি খাবারের রকম সকম। সরিয়ে দেখলাম 
প্রথম বাটিতে তেলে ভাজা।
দ্বিতীয় বাটিতে তেলে ভাজা।
তৃতীয় বাটিতে তেলে ভাজা।
হিরণ্ময়ী বলল, আজকাল তেলেভাজাও জাতে উঠে গেছে। বিল আসবে হাজার টাকার। ঘুম ভেঙ্গে গেল। গল গল করে ঘামছি। একটা ট্যারছা মতো রোদের ফলা মাথায় এমনভাবে পড়েছে ঠিক যেন মাথায় ড্রিল করে চাঁদি ফুটো করছে।

ভোরে স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে সারাটা দিন কেটে গেল।

বাস্তব আমাকে বড় সীমাবদ্ধ করে দেয়। বাস্তবে আমাকে চালায় আবেগ, বিশ্বাস আর যা কিছু প্রচলন, সেসব। জনমত আমাকে চালিত করে। অধিকাংশের মতো আমাকে  চালিত করে। আমার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি অনেক সময়েই ঢাকা পড়ে যায় অন্যের বিচারে আর নির্দেশিকায়। আমি এমন অনেক কাজ করি যা অর্থহীন এবং অপ্রয়োজনীয়। অনেকটা শিশুরা যেমন করে। রাস্তার ধারে লটকে থাকা কোনো  সাবধানবাণীকে লক্ষ্য করে ইটপাথর ছোঁড়ে। হয়তো সেখানে পথ শেষ, বা কো্নো  ব্রিজ ভেঙে গেছে। অবোধের মতো সেই সাবধানবানীকে নিশ্চিহ্ন করে দিলাম ঝোঁকের  মাথায়। কিন্তু পরবর্তীতে আশ্রয় খুঁজছি আবার স্বপ্নে। এ এক অদ্ভুত পরাবাস্তবতা।

“স্বপ্নের ভেলা / অনেকের সাথে আমিও সাবধানবাণী লক্ষ্য করে পাথর ছুঁড়লাম; / দিক নির্দেশ বেঁকে গেল ক্রমান্বয়ে আঘাতে / সব কিছু থাকল অস্তিত্ববিহীনতার আমন্ত্রণে

চড়াই উৎরাই খাড়া পাহাড় / একটু অসাবধানে কারও যাত্রার অকাল সমাপ্তি হতে পারে / ওদিকে পথ শেষ ধ্বস নেমে তলিয়ে গেছে।

এদিকে যানবাহন আসে না বড় / তবুও কেউ আসতে পারে! / কী করব আমাদের লক্ষ্যভেদ কি এতটাই জরুরী ছিল চিহ্নগুলোকে দুমড়ে মুচড়ে দিলাম কেন?

অনেক জাগরণের পরে / কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে সুদিনের / দেখে এক ভেজা নৌকো ছুটেছে জলে / জল থেকে নেমে যাচ্ছে অন্তঃসলিলার গহ্বরে / প্রবল ছুটেছে নৌকো যাতে কষ্টে সৃষ্টে একজন বসতে পারে, /নৌকো ছুটেছে গহ্বরে, / তুষার যুগের শেষে আন্তর্মহাদেশীয় হিমবাহ / সৃষ্টি করেছে গহ্বর, / স্বপ্নের ভেলা ছুটেছে সেদিকে।”

নিজের লেখা নিয়েই বলে চলেছি। গদ্যরচনায় অন্য কিছু নিয়েও বলা যেত। কিন্তু স্বপ্ন এতটাই ব্যক্তিগত বিষয় যে, রিপোর্টিংএর ভিত্তিতে কিছু লেখা যায় না। স্বপ্নের  সেকেন্ডারি ডেটা পাওয়া মুস্কিল। তাই আমার দৃষ্টিতে স্বপ্ন নিয়েই লিখে চলেছি।

স্বপ্ন নামের একটা গল্পও লিখেছিলাম। দ্রুত প্রেক্ষাপট পালটায় স্বপ্নে। কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম পালটে যায়, শরীর পালটে যায়, এমনকি লিঙ্গও পরিবর্তিত হতে পারে। প্রেক্ষাপট পাল্টে যায় গাণিতিক দ্রুততায়।





স্বপ্ন
  
"আমার কিছু করার নেই। অনেক চেষ্টা করেও শেষ ট্রেনটা ধরতে পারলাম না।  ষ্টেশনে পৌঁছেই ট্রেনটাকে দেখে ছিলাম। চুলোয় যাক টিকিট। ওভারব্রিজ ডিঙ্গিয়ে প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে কেবল ট্রেনের পেছনের লালবাতিটা দেখতে পেলাম। আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল।
প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা। দোকানগুলোর ডালা বন্ধ।
আপাদমস্তক চাদর ঢাকা ইতস্তত কিছু মানুষজন মৃতদেহের মতো শুয়ে আছে। 
কাঁধের ঝোলা ব্যাগটা খুলে জলের বোতলটায় ভালো করে জল ভরে নিলাম। কোথাও  রাতটা কাটাতে হবে। ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসছে। ওভারব্রিজের সিঁড়ি দিয়ে আবার উঠতে লাগলাম।
সিঁড়ির মাথায় দরজা।
আলো এসে পড়েছে সিঁড়িতে। ভোরের আলো। ঝকঝক করছে শহরটাবড় বড় দোকান। বিশাল বিশাল কাচের জানালা। সাজানো সব হোটেল রেস্তোরাঁ। দুদিকে চওড়া চওড়া রাস্তা। মাঝখান দিয়ে শব্দ করে ট্রাম যাচ্ছে। এক কামরার ট্রাম। দুরকম রঙ। লাল আর কালচে সবুজ। আমি প্রথমে লাল ট্রামে উঠব। সেন্ট চার্লস অ্যাভেন্যুতে যাব। সেখানে ট্রাম পালটে সবুজ ট্রামে উঠবওডুবর্ন পার্কে নামতে হবে। ঢং ঢং করতে করতে প্রথম ট্রামটা এলো। আমি ট্রামে উঠে বসার জায়গা খুঁজতে লাগলাম একদম পেছনে একটা ফাঁকা বেঞ্চি।
বসলাম।
দুএকটা গাছের পাতা টুপটাপ খসে পড়ছে। লাল লাল ম্যাপল পাতা। দুএক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছে। দুপুরের আকাশটা হঠাৎ অন্ধকার করে আসছে। ব্যাগ খুলে ছাতাটা বের করলাম। আরও একটু বৃষ্টি বাড়লে ছাতাটা মেলতে হবে। অন্ধকারের মাত্রাটা আরও বাড়ছে। পাখিগুলো তো সন্ধ্যে হয়ে গেছে ভেবে প্রচণ্ড চীৎকার চেঁচামেচি করতে  করতে ঘরে ফিরে আসছে। নাহ, আবার উঠতেই হচ্ছে। বিশাল গাছটা একটু দূরে। তার তলাতে দাঁড়াবার জায়গা খুঁজছি। দেখলাম অনেক লোক দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ছাঁট গায়ে লাগছে। শেডের ভেতর যাবার চেষ্টা করছি। ভীষণ হুড়োহুড়ি। একটু নিরাপদ জায়গা পেয়ে সেখানেই দাঁড়ালাম।
বৃষ্টিটা কখন থামবে বলুন তো!'
চেয়ে দেখলাম তপতী। তপতীই তো, না তাপসী? নাম মনে আসছে না। গোল ফরসা  মুখখানা। চুলগুলো কোঁকড়ানো। কোথায দেখেছি।
ওপরে একটা রেস্তোরাঁ আছে। চা খেলে মন্দ হতো না। তপতীর সঙ্গে আবার সিঁড়ি  দিয়ে উঠতে লাগলাম। সিঁড়ির মুখে দরজায় গেট কিপার। দুজনে টিকিট পাঞ্চ করে ভেতরে ঢুকলাম। তখনো সিনেমা শুরু হয়নি। ট্রেলার দেখাচ্ছে। রেজাউল আমাকে বলল, সিনেমা শেষ হলে পরোটা কাবাব খাব। একটা ভালো দোকান আছে নিউ মার্কেটের পাশে।
আমার পকেটে খুচরো পয়সা ঝন ঝন করছে। পকেটে হাত দিতেই রেজা বলল,  তোকে পয়সা দিতে হবে না। তারপর আরও কি ভেবে বলল, না রে তোকে বিফ খাওয়াব না।
সিনেমা শেষ করে আমরা রেস্তোরাঁতে ঢুকলাম। পয়সা দিতে হবে না, তাও পকেট হাতড়ে বেড়িয়ে এলো ঠিক আড়াই ডলার।
ধড়ে প্রাণ এলো। এতক্ষণ ধরে প্রবল তেষ্টা পাচ্ছিল, অথচ জল খেতে ইচ্ছে করছে না। একটা বড় ঝাঁঝালো কোকের গ্লাস নিয়ে বসে গেলাম। ঢাকা গ্লাস, যাতে কাত হয়ে চলকে না পড়ে। টুকটাক ছোটখাট তফাৎ আমাদের ব্যবস্থার সঙ্গে। আর তোমার প্রাইভেসি আর স্বাতন্ত্র্যকে এত মর্যাদা দেয় এরা। সব কিছুই ভালো, তবু!
তবুও অনেক কথাই থেকে যায়।
এতটা সময় ভালোই কেটে যায়। খিদে পেলে খাওয়া। সঙ্গী চাইলে সঙ্গী। তেষ্টা পেলে  পানীয়। সবই জুটে যায় তবু কেন চোখ ফেটে কান্না আসে! প্রেক্ষাপটগুলো ধরতে পারছি না। কুশীলবদেরও নয়। দ্রুত পালটে যাচ্ছে সব কিছু।
কাঁধের ঝোলাটা শক্ত করে ধরে রেস্তোরাঁর দরজা খুলে বাসে উঠলাম। দেখি, অসংখ্য  মানুষ টার্মিনালে। এত রাতেও দিনের আলোর মতো ঝকঝক করছে। ভেতরে বিশাল  বিশাল সোনালি খেজুর গাছ। ডিউটি ফ্রি শপ। সোনার দোকানে বেশ ভিড়। দুহাতে  পাঁজাকোলা করে সওদা সম্ভার নিয়ে যাচ্ছে অজস্র অচেনা মুখ। ট্রলি উপচে পড়ছে মদ সিগারেট আর পারফিউমের প্যাকেট।
একজনের সঙ্গে আলাপ হলোদোকান কর্মচারী। চেহারাতেই মালুম বাঙালিরাজশাহী  বাড়ি। আশ্বস্ত করলেন, কোনো কিছু কিনে ঠকব না। আরও দুচার কথা হলো।
কিছুক্ষণ মনে হলো দুটুকরো বাংলা যেন জুড়ে গেল। ছল ছল চোখে এগোলাম  এরোব্রিজের দিকে।
ওভারব্রিজ থেকে নামছি। সিঁড়ি বেয়ে আবার নামতে থাকি। এত খাড়া সিঁড়ি! এতগুলো ধাপ!
তবু ধীরে ধীরে নামি। শেষের ধাপগুলো বেড়ে যাচ্ছে। অসংখ্য মানুষ প্ল্যাটফর্মে। অজস্র অচেনা মুখ। সকালের লোকাল ট্রেন ধরবে বলে দাঁড়িয়ে আছে।

আমিও চোখ কচলাতে কচলাতে একটা জায়গা খুঁজি যেখানে একটু ভিড় কম। ট্রেন এলে অনায়াসেই বসার জায়গা পাব।”



সবচেয়ে আশ্চর্য আমার স্বপ্নে প্রচুর শিশুর কোলাহল শুনি। হ্যারি পটারের গল্পের মতো  হেঁটে যাই দেয়ালের ভেতরেকেউ জানে না এভাবে যাওয়া যায় তবু যাই। কার্পেট  পাতা আমন্ত্রণে আলাদা এক পৃথিবী ডাকেজানি না এ পৃথিবী কোথায় লুকিয়ে ছিল চল্লিশ চোরের গুহাময় সম্পদপাথরে ঢাকা। কম্পাস জিপিএস  লাগে না। খুঁজে নিতে হয়। অতল ঘুমের মধ্যে জেগে থাকে দেখবার চোখ

এদিকে আদিম গ্রন্থাগারে একে একে জ্বলে ওঠে নিবু সাঁঝবাতিলাইব্রেরিয়ান ভৌতিকপাঠকেরাও প্রেততাড়িতদেওয়াল বেয়ে আকাশে উঠে গেছে সারি সারি পুস্তক বৈদূর্য্যমণি ক্যাটস আই ও নানা সম্পদ, কোথাো কোনো গোপন চেম্বারে হীরক খণ্ডও লুকনো আছে।
লাইব্রেরিয়ান নিজেই এক গবলিন তার নাক কান চোখা চোখা চশমার স্প্রিং পেঁচানো কানে। সে সব বলে দেবে
আমি হ্যারি পটার হয়ে খুঁজি কোথা দিয়ে পৌঁছে যাব নাইন থ্রি ফোরথ প্ল্যাটফর্মেহাওড়া শেয়ালদা স্টেশন চত্বরে নাইন থ্রি ফোরথ প্ল্যাটফর্ম খুঁজে চলি। আমি একটা ঝকঝকে টুকটুকে লাল ট্রেন খুঁজি যার কামরাগুলোর কোণায় কোণায় সোনালি গিল্টি করা। এখনও রঙের গন্ধ যায় নি। ট্রেন ভর্তি একদল শিশু কিশোর। কুচকুচে কালো লোহার স্টিম ইঞ্জিন সাদা ধোঁয়া ছাড়েকু করে সিটি বাজিয়ে সে ট্রেন ছুটবে যাদুপুরীর উদ্দেশ্যে। আকাশে উঠবে। হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে পৌঁছে যাব প্রকৃতি ঘেরা রহস্য গন্তব্য হগওয়ার্টসের ইন্দ্রজাল শেখার ইস্কুলে।

এই সব শিশুদের তাড়া করবে না কোনো ভয়। এদের শৈশব কেড়ে নেবে না কো্নো  শয়তান। এদের মাথায় রাইফেল ঠেকাবে না কোনো মানুষ। ছুটে আসা কামানের গোলায় ভেঙে যাবে না কো্নো বিদ্যালয়ের দেয়াল। এদের পিঠে কেউ ঝুলিয়ে দেবে  না বন্দুক। শরীরে বেঁধে দেবে না বিস্ফোরক। এদের কেউ পণবন্দী করবে না।
পৃথিবী জয় করবে এরা। পৃথিবীর পথে হেঁটে যাবে হাত ধরাধরি করে। নানা রঙ নানা বিশ্বাসের বিশ্ব, শিশুরা নিয়ে আসবে উজ্জ্বল দিন আগামীতে। এই স্বপ্নটা সত্যি  হবে। আমি আশাবাদী। এটা সত্যি হওয়াই লাভজনক। আতঙ্ক নয়, বিশ্ব ব্যবসা করুক সহমর্মিতা নিয়ে, সাহিত্য নিয়ে, গান নিয়ে, কবিতা নিয়ে।