কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ১৪ জুন, ২০১৫

অর্ক চট্টোপাধ্যায়

রাস্তাচক্র 



রাস্তাই আমার অ্যাসাইলাম। যদিও তাকে আমি 'সিক' করিনি। অন্য সব কিছুর মতোই একদিন সেই জুটে গেল যেমন একদিন ভুলো এসেছিল, চামরের মতো ল্যাজ নাড়াতে  নাড়াতে। আমি কি এদেশে জলপথে এসেছিলাম? অবৈধ বোটে? নাকি আমি বাসাহীন? বাসা নেই বলে রাস্তায় ঘুমোই। আমি তো সেরকম ইংরেজি জানি না। কতদিন আছি এই ইংরেজি আর আরও কত কত ভাষা বলা দেশে? কতদিন এই আলো-জলের শহরেকিছু ভাঙা ভাঙা শব্দ, যেমন অ্যাসাইলাম, যেমন  সিকার কিম্বা হোমলেস এগুলো কিন্তু জানি। প্রায় রোজই কাউকে না কাউকে আমার এই ভাষাখানে কথা বলতেও শুনি। কী ভাষা? কেন এসেছিলাম এদেশে? কিছুই যে ছাই মনে  পড়ে না! আমার পরের মোড়টায় জ্যাসপার থাকে। - রাস্তার লোক। অন্যদের  মতো - একদিন জুটেছিল আমায় নাম শুধিয়েছিল হয়তো; অন্তত অঙ্গভঙ্গীতে তাই মনে হয়েছিলো। কিন্তু আমার নাম কী তা তো আর মনে ছিল না। তারপর দেখলাম  পরদিন সকালে জ্যাসপার এসে আমায় একটা বোর্ড দিয়ে গেল তাতে কি সব  হিজিবিজি লেখা। বলল গলায় পরে নাও। নিলাম। - পরিয়ে দিল তারপর একটা টিনের কৌটো দিল আমার সামনে বসিয়ে দিয়ে গেল অভিনয় করে দেখাল, মাথা নিচু করে বসে থাকতে আর কেউ আসলেই বোর্ডটার দিকে আঙুল দিয়ে দেখাতে। আজ অনেকদিনের চেষ্টায় জ্যাসপার আমায় ওই বোর্ডের বয়ান কি তা শিখিয়েছে। ওর নিজের নামখান বানান করে লিখতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে ইংরেজি বড় বড় সব বর্ণ না কী যেন! আমি বুঝতে পেরেছি আমার বোর্ডে লেখা আছে, আমার বাসা নেই, যা  পারবেন দিয়ে সাহায্য করবেন। মাঝে মাঝে আমি ঝিমুতে থাকলে, কেউ এলেই ভুলো দাঁতের ফাঁকে বোর্ডখান নিয়ে চাগিয়ে তোলে, যাতে সে পড়তে টড়তে পারে। একদিন একটা কম্বল, একদিন একটা চাদর, আরেকদিন আধা ছেঁড়া একটা বালিশ অন্য সব কিছুর মতোই জুটে গেল 

এটা বড়লোকেদের শহর। একটু পুরনো হলেই লোকে বাড়ির বাইরে অনেক জিনিসপত্র বার করে দেয় আর আমি গিয়ে গিয়ে নিয়ে আসি। সব না। বড় কিছু আনার মানে  নেই, কারণ রাখার জায়গা নেই। তবে ছোটখাটো টুকিটাকি কাজে লেগে যায়। একটা  ব্যাটারীর আলো পেয়েছি এমন করে। ভিক্কের টাকায় ব্যাটারী জুট গেলে রাতের দিকে সাদা কাগজে এমন সব খুদে খুদে কথা লিখে রাখি। কাগজ কলম জ্যাসপার এনে দেয়  মাঝে মাঝে। আমায় একটা নামও দিয়েছে। নেপচুন। আমি নেপচুন। জ্যাসপার আর ভুলো এরা আমার পরিবার। শহরে আমার মতো লোক নেহাৎ কম নেই যারা  রাস্তায় ঘুমোয়। টিনে যা জমা হয় তাতে খাবার জুটে যায়। অনেকসময় কেউ কেউ দান ধ্যান- করে টরে। আমি তো জানতামই না যে আমি যে ভাষায় কথা বলি বা কথা ভাবি -- বলা আর কতটাই বা হয় -- সেটা বাংলা। প্রথম যেদিন একজনকে বাংলায় কথা বলতে শুনলাম, ছুট্টে গিয়ে জিগোলাম, এটা কি ভাষা গো? সে বলল কিনা বাংলা। বলল ভারত আর বাংলাদেশ বলে দেশে এই ভাষা বলে লোকজন। প্রথম দেশটায় কম বলে কারণ তাদের অনেক ভাষা, দ্বিতীয়খানে বেশি লোকে বলে থাকে। এসব শুনে আমার মাথার ভেতর কেমন ঝিলিক ঝিলিক মারল বটে কিন্তু কিছুই মনে পড়ল না শেষ পর্যন্ত।  তাও ভাষাটার নাম জেনে খুব আনন্দ হলো আমার আনন্দে  ভুলোরও আনন্দ হলো জ্যাসপারকে কাগজে BANGLA লিখে দেখালাম। দেখলাম ওরও  ভারী আনন্দ হলো পাছে ভাষাটা ভুলে না যাই, রোজ লিখে লিখে এমন করে অভ্যেস  করতে লাগলাম রাতের দিকে যখন রাস্তা শুনশান, তখন। 

ঠান্ডা নেমে এলে কম্বলের মধ্যে ভুলোকে নিয়ে কাগজের ওপর ট্যারা ব্যাঁকা খুদে খুদে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং লিখে যাই, ব্যাটারী কমে আসা অব্দি। লিখতে লিখতে অনেক কাগজ জমে গেছে তবে তার জন্য একটা ছোট্ট দোতলা প্লাস্টিকের ড্রয়ারও  জুটে গেছে একটা বাড়ি থেকে ফেলা দেওয়া জিনিসের মধ্যে খুঁজে পেতে। আমি যখন  লিখিভুলো কিন্তু ঘুমোয় না। ড্যাবড্যাবিয়ে দেখে ওই খালি আমার লেখা পড়ে। আমি জানি বুঝতে পারে আমি কি লিখছি। এই লেখাটাই তো আমি। তার বাইরে  কে আমি কিছুই মনে পড়ে না। একদিন জেনেছিলাম নেপচুন একটা গ্রহের নাম। গ্রহ যারা আকাশে থাকে। আর মাথার ভেতর? মাথার ভেতর কী থাকে? আমার মাথার  ভেতর কি একটা পৃথিবী আছে? সূর্য, চাঁদ আর নেপচুন? আর কিছু না থাকলেও  বাংলা বলে এই ভাষাটা তো আছে। যেটা আমি মাথার ভেতর বলি, কাগজের ওপর লিখি আর ভুলো পড়ে রাত জেগে জেগে। এই ভাষাটা ভাবতে বলতে লিখতে না পারলে আমার চলবে না। তাই লিখে চলি দিনরাত। গরম ঠান্ডা আর বিশাল বিশাল সব উৎসব হয়ে চলে আর আমি একটু একটু করে লিখে যাই। বৃষ্টি হলে কাগজ  কলম বাঁচানোটা সব থেকে জরুরী হয়ে যায়। আমি যেখানে ঘুমোই সেখানে একটা শেড পাই। একটা বন্ধ হয়ে যাওয়া দোকানের এক চিলতে ছাদ বর্ষায় কাজে দেয়  খুব। ভয় হয়, দোকান খুলে গেলে? তবে ভয় আবার কেটেও যায়। জানি অন্য সব  কিছুর মতোই একদিন অন্য কিছু একটা ঠিক জুটে যাবে। 

এখন শহরে জলের ধারে আলোর খেলা হচ্ছে। কত কত লোক দেখতে আসছে। কত কত কথা বলছে। একদিন আমি, ভুলো আর জ্যাসপারও গেলাম। রাত করে। এগারোটা নাগাদ। তখন লোক কমে এসেছে। শীতের রাত। আমরা জলের ধার দিয়ে  হাঁটতে হাঁটতে আলোর কত খেলা দেখলাম। আলোর জঙ্গল, তাতে কত মানুষ আর অদ্ভূত প্রাণী, দূরের ওই বাড়িটা যেখানে নাচ গানের বিখ্যাত বিখ্যাত সব পোগ্রাম হয় তার ওপর কত রকম আলো ফেলেছে! কত রং, কত কত শব্দ। শহরের বাড়িগুলোর গায়ে আলোর ভেল্কিবাজি দেখতে দেখতে একটা ছোট্ট কোণে দেখলাম বাংলায় আলো দিয়ে লেখা। 'শব্দ' কথাটাই লেখা। দেখে তো আমার ভারি আনন্দ হলো  ভুলোকে দেখালাম ওরও খুব আনন্দ হলো জ্যাসপারকে দেখাতে ওরও। ওই বাংলা   আলোর মজা দেখে আমাদের রাস্তায় ফিরলাম যখন তখন রাত বারোটা পেরিয়ে গেছে এক আকাশ চাঁদ। জ্যাসপার শুতে চলে গেল আমি ভুলোকে নিয়ে কম্বল মুড়ি  দিতে দিতে দেখলাম দাঁতের ফাঁকে কাগজটা ধরে রয়েছে। কাগজটা হাতে নিতেই কলমটা বাড়িয়ে দিল হাতে হাতে। আমি ভেবেছিলাম আজ আর লিখব না। আলোর বাংলাতেই পেট ভরে গেছিল কিন্তু ভুলো ব্যাটা ছাড়বার বান্দা নয়। কুঁই কুঁই করতে লাগল আমি ভাবলাম কী মজার ব্যাপার! আমার সব কথা বোঝে যে দুজন তারা  কেউ আমার ভাষা জানে না আর আমিও তাদের ভাষা বুঝি কই? তাও এরাই আমার পরিবার। এদের অ্যাসাইলামই আমি সিক করে থাকে। আর আমার কাগজ কলমে বাংলা। আমি কি করে এসছিলাম এদেশে, এশহরে? কবে? কেন? মনে পড়ে না। কিন্তু আমার মনে হয় আমি কাগজের নৌকো চড়ে এসেছিলাম একদিন নিশুত রাতে। তাই প্রধানমন্ত্রী বা তার চরেরা আমায় দেখতে পায়নি। আমি জানি আমার কাগজের নৌকোর ভেতর-বাইরে বাংলা লেখা ছিল আর নৌকো থেকে নামতেই একদিন ভুলো জুটে গেছিল, তারপর আরেকদিন জ্যাসপার। আমি জানি অন্য সব কিছুর মতোই একদিন সব কিছু জুটে যাবে। ততদিন আমার একটাই কাজ।  বাংলা লিখে চলা 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন