কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৫

তুষ্টি ভট্টাচার্য

গোপাল 





আপ সত্য, জগত মিথ্যা। তাই কি? আমিই একমাত্র সত্য আর সব, সবাই মিথ্যে? নাকি জগত সত্য, আমি মিথ্যে? বড্ড কনফিউসিং ব্যাপার। সেই যে ছোটবেলায় পড়েছিলাম, সদা সত্য কথা বলিবে, গোপাল সুবোধ বালক, গোপাল সর্বদা সত্যি বলে, গোপালকে আদর্শ করে পথ চলা উচিত। গোপালের খবর কেউ রাখে এখন? কোথায় আছে, কী করে, ভালো আছে তো গোপাল? আমি ওকে অনেকদিন দেখিনি,  খোঁজখবরও পাই না। নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে গায়ে-মাথায়। এখনও কি ও  সদাই সত্য কথা বলে? একটাও মিথ্যে বলতে হয়নি গা বাঁচানোর জন্য? ইতি গজর মতো মিথ্যে গোপাল বলেছে? তাহলে সেই ছোটছেলেটির আদর্শবোধের কী হবে! সেই  বোধ কি হারিয়ে যাবে, নাকি মাঝে মাঝে দেখা দিয়ে তলিয়ে যাবে, ধামাচাপা থাকবে  মনের ভেতরে আর কদাচিৎ উঁকি দিয়ে আমাদের খোঁচা দেবে? আমাদের বিবেকে সুড়সুড়ি দিয়ে বলবে, ওহে, তুমি উচ্ছন্নে গেছ, তোমার মরালিটি তলিয়ে গেছে, তুমি মুখোশ পরা একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু নও।

এসব শুনেটুনে আমাদের তীব্র প্রতিক্রিয়া হবে, আমরা হয় ফুঁসে উঠব, গর্জে উঠে বলব, কোন্‌ শালা বলে এসব! আমি এখনও দিব্যি মানুষই আছি, দিব্যকান্তি সূর্যের   সাক্ষী রেখে বলছি, যথেষ্ট ন্যায়ের পথে চলি, ঘুষটুস যেটুকু না খেলেই নয় তার বাইরে খাই না। যা দেয়, দরদাম না করে নিয়ে নিই। আমি অমুকের মতো কথায়  কথায় ব্যাংকক থাইল্যান্ড মারাই না, আমি কি ঘাসে মুখ দিয়ে চলি যে, অমুকের ক্যাদদারি বুঝব না! তবুও আমি অমুকের পথে হাঁটি না। আরে বাবা, ওটুকু না নিলে, আমার টিকে থাকাই মুশকিল হবে। আমাকে সরিয়ে দেবে আমার জায়গা থেকে। তখন খাব কী আর মাখব কী! আর আমাকেও তো বাবা, কাজ করাতে গেলে দিতে হয়! না দিলে কেউ কাজ করবে নাকি? বিনি পয়সার যুগ চলে গেছে এখন। আর মোটের ওপর আশি ভাগ সত্যি কথাই বলি। কুড়ি ভাগ মিথ্যে আমাকে বলতেই হয়। হয় নিজে বাঁচার জন্য, না হয় অন্যকে বাঁচানোর জন্য। এসব নিয়ে এখন আর কেউ মাথা ঘামায় না। ওই গোপালও এখন এটুকু টসকেছে, খোঁজ নিয়ে দেখ গিয়ে।

আর আমি যদি অমুক হই, তাহলে সত্যি কথা বলতে কি, আমি সত্যিটত্যি নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাই না। আরে সত্যি ধুয়ে কি জল খাব আমি? সত্যি বলতে থাকলে সেই তো তিরিশ হাজারে সংসার সামলাতে হবে, কাছা খুলে মাটিতে লুটোবে আর সেই কাছা তুলব যে, সেই ক্ষমতাও থাকবে না। এমন জীবন লইয়া তখন আমি কী করিব! অমন সত্যির বোঝা মাথায় নিয়ে আমি কি করব? এই যে আমি নির্বিচারে খাইটাই, তা আমি কি তোমাদের কাজ না করেই খাই? আমি কিছু করি বলেই না তুমি আমায় দাও! ঠিক এই যুক্তিটাই আমি কাউকে বুঝিয়ে উঠতে পারি না। আরে লোকে কি পাগল নাকি যে কিছু না পেলেও মাগনায় দেবে! আমি তো আর খুন জখম রেপটেপের মতো কেস খাই না। একটু ইধার কা মাল উধার, উধার  কা মাল ইধার - ব্যাস্‌, এতে যে কেন নীতিবাগীশদের এত গাত্রদাহ, বুঝি না বাবা!  আসলে হিংসে মশাই, স্রেফ হিংসে। এই যে আমি শপিং করতে সিঙ্গাপুর যাই, ফাইভস্টারে খানাপিনা করি, এসবে চোখ টাটাবে না তো কী হবে! আমি যদি ভাত রুটি বেগুনভাজায় থাকতাম, দুশো টাকার জামা গায়ে দিতাম, ধারে ধারে আমার চুল পড়ে টাক চকচক করত, তখন কিন্তু ওনাদের টিকিও দেখা যেত না। একবারও কেউ আহা বলতেও আসত না।

সেদিন ধর্মতলার গলিতে চায়ের দোকানে হঠাৎ গোপালের সাথে দেখা। আমাকে দেখেই ও মুখ ঘুড়িয়ে নিল না-চেনার ভা করে। আমি প্রথমে ভাবলাম, ভুল করছি  বোধহয়। তারপর খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বুঝলাম এই সেই গোপাল। এখন মধ্য তিরিশের হলেও আমার এক্সরে চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না। আগে গায়ের রঙটা সাদা দুধের মতো ছিল, এখন কেমন জল মেশানো দুধের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। লম্বায়  গড়পড়তা বাঙালি পুরুষের মতোই হয়েছে, চেহারাটাও ছিপছিপেই আছে। তবে পেটের  দিকটা একটু উঁচু হয়ে আছে। একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, ওই পাউচটুকু অ্যালকোহলের জন্য না। বদহজম আর গ্যাসে ওর পেট ফুলে আছে। তবুও চা খাওয়ার লোভটা ছাড়তে পারেনি। এইবার ওর গলা জ্বলবে, ঢক করে একটা টক ঢেঁকুর তুলবে, তারপর জোয়ান চিবোতে চিবোতে হাঁটা দেবে। জামাপ্যান্টের ছিরিও ভালো না ওর। কাছে গেলাম, ঘামের বদ গন্ধ ছাড়ছে ওর গা থেকে। ওসব উপেক্ষা করেই ডাকলাম, ‘আরে গোপাল না?’ প্রথমটায় একটু হকচকিয়ে গেল ও। আসলে আশা করেনি বোধহয় যে, আমি এমন গায়ে পড়ে আলাপ করতে আসবআবার ডাকলাম ওকে ওর নাম ধরে। এবার ও বলল, ‘আমি গোপাল নই বলে হনহন করে  হাঁটা দিল। আমিও ছাড়বার পাত্র না। সন্তর্পণে একটু দূরত্ব রেখে ওর পিছু নিলাম। ও  বাসের সামনের গেট দিয়ে উঠল আর আমি বাস ছেড়ে দেওয়ার পরে লাফ দিয়ে পেছনের গেটের পাদানিতে দাঁড়িয়ে রইলাম। গোপাল নামলে আমিও নামলাম। এই এলাকাটায় একটু গ্রাম্য ছাপ আছে। এখানে একটা ছোট মতো মিষ্টির দোকান থেকে  দেখলাম ও দানাদার আর গুজিয়া কিনল তারপর একটা গলি ধরে হাঁটতে লাগল। যে বাড়িটায় থামল, সেটা অন্তত বছর পঞ্চাশ বছরের পুরনো হবে। নোনাধরা দেওয়াল আর রঙচটা দরজার ভেতরে চলে গেল ও।

সেদিন ফিরে এলাম গোপালের ডেরা থেকে। পরের দিন ভোরবেলায় গিয়ে ওই বাড়ির কড়া নাড়লাম। কিছুক্ষণ পরে লুঙ্গি পরে মুখে ব্রাশ আর টুথপেস্টের ফেনা নিয়ে দরজা খুলল গোপাল নিজেই। আমাকে দেখে পিচিক করে থুতু ফেলে জিজ্ঞেস করল, ‘কী  ব্যাপার বলুন তো? আপনি কে? সিআইডি নাকি? আমি কিন্তু কোনো ঝামেলায় থাকি না, আমার বাড়ি অবধি ধাওয়া করে কী পাবেন আপনি!’  আমি বললাম,  ‘দেখো বাপু, আমি সিআইডি  নই, নেহাতই আম আদমি। আমার একটাই প্রশ্ন, তুমি কি গোপাল?’ ও বলল, ‘কালকেই তো আমি বললাম, আমি গোপাল নই। আর সত্যিই গোপাল হলে কি আমি অস্বীকার করতে পারতাম নিজের পরিচয়? গোপাল কখনও মিথ্যে বলেনি  আমি এবারেও কনফিডেন্সের সঙ্গে বলে গেলাম, ‘আমি জানি  তুমিই গোপাল। কিন্তু কালে কালে তোমার গোপালত্ব একটু কমেছে, এই যাতাই তুমি নিজেকে অস্বীকার করছ এবার যেন ফেটে পড়ল ও। ওইটুকু ক্ষয়া মানুষের যে  এমন তেজ থাকতে পারে, না দেখলে বোঝা যাবে না। বলল, ‘গোপাল সেই একজনই ছিল। সেই বালকটি। যেদিন কিশোর বয়সে হস্তমৈথুনের অভ্যেস রপ্ত করে মা’র কাছে ধরা পড়ে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছিল, অভিনয় করেছিল এমন যেন এরকম ঘৃণ্য ঘটনা ওর দ্বারা ঘটতেই পারে না, সেদিনই গোপাল মরে গেছিল। লজ্জায় আধমরা হয়েছিল  প্রথমে, তারপর মরেছিল মিথ্যে বলার অপরাধে। গোপাল আর নেই। সেদিন থেকে কতবার যে গোপাল মরেছে, তার খবর রাখেন? আজ এদ্দিন বাদে আপনি গোপালকে খুঁজতে এসেছেন! আপনার সাহস তো কম নয়!’




সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে বেরিয়ে আসি গোপালের বাড়ি থেকে। সত্যি আর গোপাল সমার্থক কিনা বুঝতে পারছি না এখন। গোপালের গোপালত্ব কি সত্যি কমতে বাড়তে পারে? নাকি গোপালত্ব একটা স্ট্যাটিক কিছু? আমিও কি সত্যি গোপালের ধারে কাছে ঘেঁতে পারব কখনও? পারব ওকে অনুসরণ করতে? কেউ কি পারে! অল্প মিথ্যের স্বীকৃতি যদি পাওয়া যায়, তাহলে বেশি মিথ্যেরই বা নয় কেন? মিথ্যে তো মিথ্যেই। তার বেশি কমের মাপকাঠি কে ঠিক করে দেবে? আর সত্যি? সে তো একাই এক ধ্রুবক। তার নড়ন চড়ন নেই, তার হেলদোল নেই, তার মৃত্যু নেই। ঠিক যেভাবে হাজার চেষ্টাতেও আমাদের মন-গোপালের মৃত্যু হয়নি, হবেও না। মনের প্রত্যেকটা ভাবই সেই মনের মালিকের কাছে সত্যি হয়ে ধরা দেয়, যদিও প্রকৃত বিচারে হয়তো  তার অনেকটাই ভুল। এভাবেই বারবার সত্যি-মিথ্যের তফাতটা আমার কাছে গুলিয়ে যেতে থাকে। গোপালকে একবার হারাই, আর একবার ফিরে পাই। চিরকালের মতো  হারাবে না, এই বিশ্বাস থেকে যায়, জানি ও আসবেই আবার ফিরে। 

2 কমেন্টস্:

  1. শরত্‍চন্দ্র বলেছেন, মিথ্যা বলি না, প্রয়োজনে সত্যি তৈরি করি।
    (স্মৃতি থেকে)

    উত্তরমুছুন