কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

রবিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০১৫

বারীন ঘোষাল

মাধবায় নমঃ, তারা ব্রক্ষ্মময়ী মাগো, জয় রামকৃষ্ণ





ঠাকুর করুন, যাহাতে আমরা অতীব গ্রাম্য -- আমাদের নিজস্ব মনোবাঞ্ছা অকপটে  ব্যক্ত করিতে পারি
বুঝতেই পারছেন দিব্য কমলকুমার মজুমদার যেভাবে তাঁর রচনা শুরু করতেন, তারই ভজনা করে আমি লেখাটা শুরু করলাম। ঠাকুর আমাকে কৃপা করুন। জয় রামকৃষ্ণ, গুরু হে।

১৯১৪ সালে জন্ম। তাঁর সহোদর ছিলেন নীরদ মজুমদার, শানু লাহিড়ীর মতো বিখ্যাত শিল্পীরা। তিনিও স্কুল ফাইনালের পর ঐ আঁকাজোকায় ডুবে গেলেন। সহজাত প্রবৃত্তিতে সিদ্ধহস্ত হয়ে উঠলেন অঙ্কন আর হস্তশিল্পে। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট স্কুলে আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্‌ট শিক্ষক হিসাবে যোগদান করে সেখানেই দীর্ঘকাল পরে অবসৃত হন। এতসব আমি পরে জেনেছি। লেখক হিসেবে প্রথম থেকেই আমি গল্প লিখতাম। ছোটবেলা থেকে দেশি বিদেশি গল্পকারদের বই গুলে খেতাম। কৌরব শুরু হলে  গল্পকার হিসাবে আমি যোগ দিই। কেসটা ঠিক চট্ট্যোপাধ্যায়ের শক্তির মতো। ১৯৬০-এ হাংরি বুলেটিন নং ১-এ সম্পাদক হিসাবে শক্তি চট্ট্যোপাধ্যায় যখন সই করছেন,  তখনো তিনি মূলত গল্পকার। আমিও গল্পকার হিসাবেই কৌরবের প্রথম সভাপতি হয়েছিলাম। তারপর শক্তিদার সাথে আমার ব্যবধান ক্রমশ দুস্তর হয়ে উঠল কবিতায়। কপাল

শুনেছি কমলকুমার নাটকে উৎসাহ দিতেন কৃত্তিবাসের কবিদলকে, নিজে নাটক লিখতেন, পরিচালনা করতেন, আরো – হি হি – মদ খেতেন খালাসিটোলায় – অরণ্যের প্রবাদ। আমি মুখ্যত তাঁর গল্প উপন্যাসে আগ্রহী ছিলাম। কিনে কমলকুমার মজুমদারের বইগুলো একে একে পড়ে ফেলি। কী যে অসামান্য লাগত তাঁর ধ্রূপদী ভাষার গ্রন্থনা! আমাদের কমলের সঙ্গে কলকাতায় গিয়ে নিম অন্নপূর্ণা, অন্তর্জলী যাত্রা গল্পদুটোর সিনেমা-রূপ দেখে মুগ্ধতখন জেনেছি, দুর্গাপুরের নিম-সাহিত্য   আন্দোলন এই নিম অন্নপূর্ণা থেকেই নাম পেয়েছিল। অথচ সেই ১৯৭১ থেকে আমার  পরিচয় ছিল নিম সাহিত্যের সাথে।

জানতাম না নামের নামতা ১৯৭৭ নাগাদ কৌরবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, এবার সাহিত্যিকদের আঁকা প্রচ্ছদ ব্যবহার করা হবে  পত্রিকায়। প্রথমেই কমল চক্রবর্তী চলে গেল কমলকুমার মজুমদারের বাড়ি। আবেদন করতেই, কী সৌভাগ্য, তিনি এককথায় রাজি হলেন। অবশ্য তার আগে ষাট দশকের কবি সুব্রত চক্রবর্তী, যিনি কৌরবকে বিশেষ ভালোবাসতেন এবং কমলকুমারের ঘনিষ্ঠ  স্নেহভাজন ছিলেন, অবহিত করে রেখেছিলেন আমাদের আগ্রহের কথা। কমলের অনুরোধে কমলকুমার এসো মা আনন্দময়ী নামে একটি স্কেচ এবং কৌরবের বর্তমান নামাঙ্কনটি এঁকে দেন। নামাঙ্কনটি সেই থেকে আজ ৩৯ বছর ধরে অপরিবর্তিত আছে। কৌরবের সেই প্রচ্ছদটি তাঁর করা সর্বপ্রথম। পরের বছর খেলার বিচার নামে  একটি বড় গল্প লিখে দেন। আমরা তো কৃতার্থ। লেখা দেবার সময় পরামর্শ দিতেন ছাপার ও কয়েকটি ফাইল কপি পাঠাবার জন্য। প্রচ্ছদটির মুদ্রণ তিনিই দেখাশোনা করেছিলেন। টাকা পয়সা খরচের হিসেব দিতেন ইন ডিটেল। ১৯৭৮-এও, যে বছরের শেষের দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন মারা যাবার আগে, চিঠি দিতেন প্রতি সপ্তাহে। সেসব ছাপা হয়েছিল কৌরব শততম সংখ্যায় আরো কিছুকাল বেঁচে থাকলে আমাদের সম্পর্ক গভীরতর হতো নিঃসন্দেহে হায়!

এতবড় লেখক, কিন্তু ১৯৫৫ সালে যখন ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘ছবি-ছড়া’ নামে একটি ছড়া এবং কমলকুমারের ‘কাঠখোদাই’ যুগ্ম বইটি প্রকাশিত হলে ভালো পরিবেশকের অভাবে বিক্রি হচ্ছিল না, তখন ভাগ্যক্রমে কলকাতার বৃহত্তম প্রকাশন সংস্থা বেঙ্গল  পাবলিশার্স সেটির দায়িত্ব নিয়ে বিক্রয় ব্যবস্থা করে। এর পরে বাণিজ্যিক সাহিত্য পত্রিকার পোঁ না ধরায় তাঁকে বই ছাপানোর জন্য অনেক বাধার সম্মুখীন হতে হয় দুর্বোধ্য জ্ঞানে তাঁর বইয়ের বিক্রয়ও ভালো ছিল না। সুবর্ণরেখার কর্ণধার ইন্দ্রনাথ  মজুমদার বন্ধুর মতো তাঁর অনেক বই ছেপেছিলেন। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ-এরও জীবদ্দশায় ছিল সেই অবস্থা। প্রায় বইই অবিক্রিত থেকে যেতরবীন্দ্রনাথ যেমন স্বশিক্ষিত ছিলেন, কমলকুমারও তাই। রবীন্দ্রনাথের গল্প উপন্যাসের চাইতে আমার  কমলকুমারেরটাই ছিল বেশি পছন্দের। সত্তর দশকে ভাবতাম, কমলকুমার হয়তো  ফ্রান্স-এ গিয়ে ফরাসী ভাষা শিখেছিলেন। তাঁর গদ্য রচনায় ফরাসী ভাষাবিন্যাসের ছক ছিলসত্য মিথ্যা জানি না। আমি ফরাসী ভাষাও জানি না। তবে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রমী গল্পকার। আমি সত্তর দশকে শেষের দিকে গল্পধারার মুক্তি শীর্ষক একটা  প্রবন্ধ লিখেছিলাম, যাতে পুরনো গল্পরীতি ছেড়ে নতুন ধারা সৃষ্টির কথা বলেছিলাম।  উদাহরণ হিসাবে কমলকুমার ছিলেন শীর্ষস্থানে। রবীন্দ্রনাথ যখন প্যারিস ল্যাটিন কোয়ার্টার ইত্যাদি ঘুরে শিল্পকলার সর্বাধুনিক হালচাল দেখে নিতে উদ্দীপ্ত করলেন ভাইপোকে, অবনীন্দ্রনাথের উত্তর গড়গড়ার নলের ধোঁয়া ছেড়ে, ‘আমি শিল্পী, মানসচক্ষে সব দেখতে পাই ওই ধোঁয়ার মধ্যে’কমলকুমারও কলকাতায় বসে হুবহু জানতেন পৃথিবীতে শিল্প কোথায় কি হয়েছে, হচ্ছে। প্রাপণে গোপন রাখতে চাইতেন  নিজের প্রজ্ঞা। আর একটা বিশেষত্ব ছিল তাঁর বাক্যগঠনে, ফরাসী সাহিত্যিক মিশেল প্রুস্ত-এর মতো দীর্ঘ বাক্য গঠনে। সাধারণত প্রুস্ত  দীর্ঘ বাক্য রচনায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। একটি বাক্যে তো ৬০০টি পর্যন্ত শব্দ ব্যবহার করেছিলেন। কমলকুমারের অভ্যাসও তদরূপ ছিল। একটি বাক্যে একটি উপন্যাস রচনা করতে পেরেছিলেন। আর কোথাও এমন উদাহরণ জানা নেই।



আসলে কমলকুমার মজুমদার ছিলেন ব্রাহ্মধর্মবিরোধী, রবীন্দ্রবিরোধী। রবীন্দ্রনাথের গদ্য রচনাকে বলতেন ‘খুকুগদ্য’। পঞ্চাশের দশকে ব্রাহ্মধর্মের প্রভাব এমনিতেই যথেষ্ট কম হয়ে আসে, কয়েকটি বিশেষ পরিবারের মধ্যে নিবদ্ধ থাকে। তার বিরোধিতা করা ছিল অর্থহীন। আর, বাঙালি পাঠক ততদিনে দুই প্রজন্ম ধরে রবীন্দ্ররচনা পড়তে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের গান গাইছে। নবীন সাহিত্যিকরা মুখের ভাষার কাছাকাছি গদ্য লিখতে সচেষ্ট হচ্ছেন। সমসায়িক কালের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, দৃষ্টিভিঙ্গীর বদল প্রতিফলিত হচ্ছে বাংলা গল্প-উপন্যাসে। এমন অবস্থায় তাকে পিছনপানে টেনে নিয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব। কিন্তু কমলকুমার তাই করেছেন। উপরন্তু তাঁর রচনায় হিন্দুত্বের গোঁড়ামি, শাক্ত ও বৈষ্ণব আদর্শের জীবন, উচ্চবর্গের শ্রেষ্ঠত্ব, বাঙালির জীবন থেকে মুছে যাওয়া আচার আচরণ প্রকাশ পেয়েছে। তার ফলে তিনি মূলধারা থেকে সরে গেলেন। তিনি ব্যতিক্রমী লেখক হতেই চেয়েছিলেন। অথচ ব্যক্তিগত অভ্যাসে তিনি গোপনেও হিন্দুধর্ম চর্চা করেননি।
‘সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত উদয়ন ঘোষের গবেষণাপত্র অনুযায়ী -- “দেশজ টোন  আনার জন্য, রবীন্দ্রনাথের নিরাকার ব্রহ্মের বিপরীতে ‘মা আনন্দময়ী’, আদিম দেবী কালী ইত্যাদি দেবতাকে দাঁড় করাবার জন্য কমলকুমার এসব করে থাকতে পারেন বলে আমার মনে হয়”। খেলার প্রতিভার প্রথম লাইন – মাধব হে, তুমি মহাপ্রভুতে, মা গো যে তুমি বর্গভীমা, ঠাকুর জয় রামকৃষ্ণ! বইয়ের শেষ লাইন – আঃ মাধবায় নম জয় রামকৃষ্ণ। তারা তারা ব্রহ্মময়ী মাগোমুসলমানদের কি এসব পড়তে ভালো লাগবে? বাঙালির সংস্কৃতি শুধুমাত্র হিন্দুর সংস্কৃতি নয়। মাধবায় নম নম মূল  উপন্যাসের জন্য প্রয়োজনীয়ও নয়। আমরা যে পৃথিবীটা হারিয়ে এসেছি তার রহস্য তাকে আকর্ষণ করততাই লোকসংস্কৃতির খোঁজ। ... তবে এমনও হতে পারে, সবাই যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির দিকে তাকাচ্ছে, যেদিকে ইওরোপিয় বাতাস বইছে বেগে, তিনি আলাদা হবার জন্য উল্টোদিকে হেঁটে রামকৃষ্ণকে পেলেন। যেদিকে দেশীয় ভাব প্রবল।

এদিকে আলো ক্রমে আসিতেছের মতো আমি যখন কবিতায় ঢুকছি, তখন জেনেছি কমলকুমারও এককালে কবিতা লিখতেন। ফরাসী ভাষায় তার অনুরাগের আর একটি উদাহরণ -- সপ্তদশ শতকের রোমান্টিক কবি পোল স্কারোঁর কবিতা ফরাসী উচ্চারণে বাংলা অক্ষরে ব্যবহার করেছিলেন তাঁর ‘গোলাপসুন্দরী’ উপন্যাসে। কমলকুমারের  গদ্যরীতি বদলাতে থাকে গদ্যকবিতার চলনে। ‘গোলাপসুন্দরী’ উপন্যাসটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ঐ উপন্যাসের একটি কবিতার উদাহরণ নেয়া যাক --

যে শবযাত্রীরা কেমন একটানা স্বরে দেহেলা ধরনের গান গাহিতেছিল
ঝিনকির ঝরনা এখন প্রমত্ত
তাহার গোলাপের কথা মনে হইলো

গোলাপ তো স্বল্পায়ু মানুষের অনন্ত সুপ্তি
স্থানসমূহকে আচ্ছন্ন করে
যে বস্তু সকলের অজর বাস্তবতা তাহাতে রুত্ন করে
আর সেই সমুদ্র বায়ু দ্বারা আনীত ক্রন্দন ধ্বনি
একাগ্রভাবে
এ কক্ষে প্রতিটি বস্তু অবলোকন করিল

২.........
............
                                                                                              ...... ......
গাড়ীখানি দাঁড়াইয়াছিল
মরুপথিপ্রাজ্ঞ উট    যে উট বৃদ্ধ    যে উট ক্লান্ত
যাহার সমক্ষে দৃশ্যমান জগতই পথ বৈ অন্য নহে

পোলকা ডট শার্ট
পকেটে ব্লু রুমালে স্থাপত্যের পরিচ্ছন্নতা
সমস্ত দেওয়াল আলোর তারতম্যে, কখন বা অতীব দীন,
এখানে চাপাগলার শব্দ, কোথাও অভিমান,
এমন কি করাঘাত কভু বা দীর্ঘশ্বাস
যখন দিন দিন রাত্র রাত্র -
আপনার সহজ রূপে এসেছে
যে কোন বাস্তবকে তুমি কল্পনা করে নিতে পারো এখন, এইমাত্র
ঝাড়ের কলমে লাগিয়া নিশ্চিহ্ন হইয়া গেল। 

                                                                                                          
৪ ... ...




কবিতাংশটি কমলকুমার মজুমদারের ‘গোলাপসুন্দরী’ উপন্যাসের গদ্যে লেখা কবিতা ভাবনা থেকে ইকেবানা সজ্জার মতো এক বিন্যাসকলার মাধ্যমে সমস্ত শব্দ, বাক্য, যতি টেনে নিয়ে পুনর্সজ্জা করেছেন আর্যনীল মুখোপাধ্যায়। ১৯৭৬ সালে আমরা তখনো কবিতার নবিশীকরণেই ব্যস্ত। তখন কমলকুমারের এই কাব্যধারা যে পঞ্চাশের আধুনিকতা থেকে অনেক দূরে, ধ্রূপদী ভাষায় সেটা বোঝার চেয়ে গদ্যকবিতার ভাস্কর্য চোখে পড়ে বেশি। আমরা যে তাঁর কঠিন দুর্বোধ্য গদ্যে (সাধারণের ধারণা অনুযায়ী) আকর্ষিত হতাম, তার রহস্য এইখানে।
মাধবায় হে, শক্তি হে, জয় রামকৃষ্ণ।




3 কমেন্টস্:

  1. অদ্ভূত রকমের জানা। অনবদ্য শব্দটি আজকের পুনরাধুনিকে যথেচ্ছ ক্লিশে হয়ে গেলেও না-বলা আটকাতে পারলাম না এ স্মৃতিচারণে। তবে সহোদর কথাটির অাক্ষরিক অর্থানুযায়ী শানু লাহিড়ী কিভাবে, জিগীষা রইলো।

    উত্তরমুছুন
  2. আপনি এই ছোট্ট লেখাটিতে কমলকুমার মজুমদারকে লইয়া যে মূল্যায়ন করিয়াছেন, তাহা অতীব সুশ্রী হইয়াছে । আমরা এযাবৎ কত মালিন্য জমা করিয়া রাখিয়াছি, কারণ রবীন্দ্রনাথকে শিরোধার্য করিয়া অন্যদের অনাদর করিবার সুযোগ পাইয়াছি । আপনি অতি সততার সাথে বলিতে পারিয়াছেন —রবীন্দ্রনাথ হইতে কমলকুমার আপনার বেশি পছন্দের ।আজ আমাদেরও চক্ষু খুলিয়া দিলেন । কমলকুমার সাহিত্যের ইতিহাসে, শিল্পের ইতিহাসে, নতুন প্রজন্মের ইতিহাসে এবং ব্যক্তিত্বের ইতিহাসে কতখানি বিস্ময়কর তাহা জানিলাম ।

    উত্তরমুছুন
  3. অসাধারণ লেখা।এর বেশি আর কিছু বলার নেই।এ রকম একটি লেখা উপহার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।



    উত্তরমুছুন