কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১৫

সোনালী মিত্র

মুদ্রারাক্ষস





একচালা টালির ঘর, প্লাস্টারহীন ইটের ঘের দেওয়া চৌখুপিটির সামনের সকালে উনুনের আঁচের গলগল মুক্তধোঁয়া হাওয়ায় ভেসে ক্রমশ সাদা থেকে ধূসর হয়ে মিলিয়ে  যাচ্ছে। হাতে ঘূর্ণায়মান ভাঙা তালপাখা দোকানির শরীরের ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে সকালের জগিংবাবুরা এখুনি এসে পড়ল বলে, আর খবরের কাগজের পাতা ওল্টাতে না ওল্টাতেই শোরগোল তুলবেন, "কই হে চরণ দাশ, তোমার চায়ের রঙ কি গভীর  হলো !" বেশ লাগে শুনতে বাবুদের এই হাঁকডাক কলরোল। সামনের শেড বলতে  দরমার ঝাপযেটা দুটি পাকা বাঁশের অস্থায়ী খুঁটির ওপর ফেলে দিলে রোদ-জল কিছুটা মানিয়ে নেয়। অন্দর মহলের ভিতরের দিকে চরণের শোবার ও খাবার স্থায়ী ঠিকানা। ওই ১০ বাই ১০ চৌখুপির বারমহলের দিকেই টাকা জমিয়ে বছর দুয়েক আগে সিমেন্টের তাক দিয়ে নিয়েছে সে। কাচের লাল, নীল মুখওয়ালা বয়ামগুলিতে সাজানো সস্তা আটার নানা সাইজের বিস্কুট। এ তল্লাটের দাদা-ভাইরা এগুলোই সকালে-সন্ধ্যায় চায়ের সাথে সোনাতুল্য মনে করে করে খেয়ে ফেলএকজোড়া লোভী  চকচকে ইস্পাতের মতো চোখ বয়ামের বিস্কুটের দিকে চোখ লাগিয়ে জিভ দিয়ে চেটে নেয় তামাম খিদে "দাদা খুব খিদে পেয়েছে, ওই লাল ডিবেটার উপরে রাখা পাউরুটি কিনে দে না রে" সত্য, এ গ্রামেরই ছেলে। বয়স তেরো ছুঁই ছুঁই। ছোট বোনটি সবে আট পেরলো। মা কিডনির রোগে মরেছিল বছর দুই আগে ডাক্তারকাকু সত্যর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ''গরীর মানুষ ছোটলোকের রোগে মরবি, তা নয় বড়লোকের রোগ বাধিয়ে আনলি?'' সত্য সেদিন প্রথম শুনেছিল রোগেরও ধনী গরীব সমাজ ভাগ থাকেকিন্তু ভেবে দেখল, সত্যি কি তাই? নাকি রোগ সেঁধিয়ে যায় ফাঁকা শরীর পেলেই, সে রাজা হোক বা উজির হোক, কাউকেই কি মানে? কিন্তু পৃথিবীতে সুস্থতা নির্ভর করে অবশ্যই পকেটের অবস্থানের উপর। মায়ের দিনদিন পেচ্ছাপ-পায়খানা বন্ধ হয়ে পেট ফুলে ঢোল হয়ে চলে যাওয়ার সময় চলে এলোবাপের মদের শরীরে কাঠ-কাশিও সমান বেড়ে চলল। মা চলে যেতেই এক মাসের মাথায় বাপও নিজের ছাতা বন্ধ করে ঈশ্বরের বাড়ি ছুটল সব দায়িত্ব ছেড়ে অনাথ করে দিয়ে। কুঞ্জপিসীর মুখেই অনাথ শব্দ সত্য প্রথম শুনেছিল। সত্য একা একা মাঝে মধ্যে ভাবে, যাদের পকেটের দুটো বড় বড় ফুটো দিয়ে পৃথিবী দেখা যায়, যাদের পেটের আগুন বুক পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে যায়, আর আকাশের পানে তারা দেখতে  দেখতে ঘুমিয়ে যাওয়া শেখায় যে শব্দ, সেই তাদেরকেই কি অনাথ বলে? এসমস্ত তখন ভাবতো সত্য, এখন আর ভাবে না। জগেন বারুইয়ের ইটভাটায় পাতাইয়ের কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল বিজুকাকা। বলেছিল, বোনকে তো দেখতে হবে! লেগে যা মায়ের নাম নিয়ে। মায়ের নামে বুঝি ঈশ্বরী থাকেন! ঈশ্বরী যে কোথাও নেই, তা একসময় বুঝেছিল সত্য। প্রতিমাসে জগাই বারুই অতলান্তপরিশ্রমের উপার্জিত অর্থের তিনভাগ কেটে নিত, প্রতিবাদ করতে গেলে 'খানকির পো' বলে খিস্তি শুনতে হতো তখন প্রথম বুঝেছিল, ঈশ্বরী কোথাও থাকেন নাসত্য বুঝেছিল, পয়সার সাথে জন্ম নেয় ভাগ্য ও আয়ু। পয়সার সাথে গাঁট বেঁধে বেঁচে থাকে নিমকহারাম সমাজ। একসময় বোনের পেট ভরাতে পারার মধ্যবর্তী মাধ্যম খুঁজে দিয়েছিল হাতকাটা ইসমাইল। ভরদুপুরে এক কেষ্টবিষ্টু বাবুকে ষ্টেশন চত্বরে ঘুরতে দেখে সময় সুযোগ মতো আপ ট্রেন প্লাটফর্ম ছাড়ার মুহূর্তে এক হ্যাঁচকা টানে তার হাত থেকে ঘড়ি খুলে নিয়ে দৌড়ে উঠেছিল ট্রেনে। সেই শুরু। তারপরে আর তাকাতে হয়নিএর চেয়ে সহজ কোনও পথ সত্য সেই সময় দেখতে পায়নি কত সহজে টাকা 'ইনকাম' করা যায়, সত্য প্রথম সেদিন শিখেছিলএকেকটা ব্যাগে থাকে তাদের গোটা দিনের খিদের  উপকরণ। কিন্তু ভাগ দিতে হয় ইসমাইলকে। সত্য এখন তুখোর সৈনিক এসব লাইনে।  গাঁটের কড়ি জমিয়ে যারা রাস্তাঘাটে, ট্রেনে, বাসে ঘোরে, তাদের থেকে বেঁচে থাকার  রসদ ছোঁ মেরে তুলে নিয়ে বাঁচতে শিখে নিয়েছে সত্যপ্রচণ্ড ঘৃণায় যারা তাকে দেখলে 'যাহ্‌ ভাগ' বলে, তাদের পকেট থেকে ভরন্ত পেট তুলে নিয়ে খালি মানিব্যাগ থুতু দিয়ে আকাশের দিকে ছুঁড়ে দেয় সত্য একদলা ঘৃণার সাথে

এসমস্ত কত দৃশ্য আমাদের চোখের সাম্রাজ্যে যে থাকে, তার কোনো হালখতিয়ান নেই অর্থই অনর্থের মূলে... জীবনের দিক পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কতখানি যে জরুরি, তা  সকলেই বেশ জানি। আজ তবে এই টাকা নিয়েই কিছু গল্প করা যাক। মলয়কাকুর  (মলয় রায়চৌধুরী)সাথে গল্পের ছলে জেনেছিলাম, তিনি ব্যাঙ্কের পরিত্যক্ত তেলচিটে  নোট পোড়াবার চাকরি করতেন। দারুণ ব্যাপার বটে! যে টাকার জন্য খেয়োখেয়িতে ভাই ভাইয়ের বুকে ছুড়ি বসিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দেয়, যে টাকার জন্য ১২৮ নং বেডের পেসেন্টের সদ্য বিবাহিত বউটি ঠোঁটে রঙ মেখে কারখানার মালিকের ধবধবে সাদা বিছানায় চড়ে আঁচল ভর্তি কয়েকটা একশ টাকার নোটের প্রত্যাশায় পুইয়ে দেয় রাত, সেই নোট পোড়াবার চাকরি! কত আজব ব্যাপার যে আছে পৃথিবীতে! টাকা  নিয়ে ভাবতে ভাবতে টাকার নাড়ি নক্ষত্র মানে মা-বাপ অর্থাৎ সৃষ্টির গল্প জানার লোভ হলো বটে!



পিছিয়ে গেলাম কয়েক হাজার বছর। বিনিময়ের মাধ্যম হলো মুদ্রাকিন্তু যখন মুদ্রা আবিষ্কার হয়নি, সেই সময়ে বিনিময়ের মাধ্যম ছিল গরু, ছাগল, ভেড়া। কোথাও বা মাছও নাকি ব্যবহৃত হতো এখন কথা হচ্ছে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবেই বা কিছু চাই কেন!  ধারাযাক আমার কাছে চাল উদ্বৃত্ত, আমার দুধের দরকার। আবার অন্য একজনের চাল বাড়ন্ত, দুধ পর্যাপ্ত। তখনই বিনিময় বিষয়টি চলে আসে। প্রাচীন কোনো কোনো এলাকায় লবণকে টাকা হিসেবে গণ্য করা হতো। নিউগিনিতে টাকার কাজ চলত কুড়ালে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ ইয়াপে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হতো পাথরের চাকতিনাইজেরিয়ায় টাকার মর্যাদা পেয়েছিল হাতে পরার বালা। তখন দেশভেদে এমন অনেক বিচিত্র জিনিসের মাধ্যমে টাকার কাজ চলত

কড়ি, মাছের দাঁত, পালক, মাদুর - এসবে লেনদেন আগের চেয়ে একটু সহজ হলো ঠিকই, কিন্তু পুরো স্বাচ্ছন্দ্য এলো না এতেওএর পেছনে ছিল অনেক কারণ। কড়ি, মাছের দাঁত, পালক ইত্যাদি বহন করা সহজসাধ্য নয়। আবার একেক দেশে একেক রকম রীতিনীতি বলে এক এলাকার মাধ্যম অন্য এলাকায় অচল। এমন অবস্থায় মানুষ নতুন করে ভাবতে শুরু করল। আর সেখান থেকেই তাদের মাথায় এলো তামা, রূপা ও সোনার মুদ্রার ভাবনা।

ব্যবসা-   বাণিজ্যের উৎপত্তি হওয়ার পরপরই বিভিন্ন দেশে মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। অতীতে বিভিন্ন মাধ্যমের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। তবে কাগজের টাকার প্রচলন চালু হয় প্রথম সং রাজার শাসনকালে পশ্চিম চীনের জিচুয়ান প্রদেশের হেংছুতে। তখন চীনের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন মাধ্যমের টাকার বিনিময় হতো। ১২০৬ থেকে ১৩৬৭ খ্রিস্টাব্দে চীনের য়ুন রাজার শাসনকালেও একই ধরনের মুদ্রার প্রচলন ছিল। কাগজের মুদ্রা থাকার ফলে তখনও কোনো ধাতব মুদ্রা তৈরি হয়নি।

মধ্যযুগে জার্মানি ও বোহেমিয়ায় রূপার খনি আবিষ্কার হওয়ায় সেখানে অর্থের    বিনিময় মাধ্যম হিসেবে রূপার টাকার প্রচলন ঘটে। তবে অন্তর্দেশীয় মুদ্রা হিসেবে  ১২৫১ সালে ফ্লোরেন্টাইনের ফ্লোরিন ও ভেনিসিয়ান ড্র-কাই হিসেবে সোনার মুদ্রা চালু ছিল। ১৫১২ সালে বোহেমিয়ায় রুপার খনি আবিষ্কারের পরপরই সেখানে রূপার মুদ্রা   চালু হয়। সেটির নাম ছিল জেয়াচিম থেলারস। এরপর জেয়াচিম বাদ দিয়ে নতুন নাম রাখা হয় শুধু থেলারস। আরও বেশ পরে থেলারস রূপান্তরিত হয়ে বাজারে  আসে আধুনিক মুদ্রা ডলার। মধ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকায় রূপা ও সোনার খনি আবিষ্কৃত  হয় ১৫ ও ১৬ শতকে। তখন সেখানে সোনা ও রূপার বিভিন্ন জিনিস তৈরি হতো।  আর মুদ্রা হিসেবে চালু ছিল স্প্যানিশ মুদ্রা। ১৬৩৯ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের মুদ্রা হিসেবে চালু ছিল মিল ও কয়েন। এগুলোর চারপাশ ছিল ছাঁটা। ১৬৫০ সালে সুইডেনের মুদ্রার নাম ছিল স্লেট মানি বা চাকতি মুদ্রা। এগুলোকে তৈরি করা হতো তামার পাত কেটে। অবিশ্বাস্য হলেও এদের একেকটির ওজন ছিল ৩০ পাউন্ড বা ১৪ কেজি আর আয়তন ছিল ২৮৬৫ সেন্টিমিটার। বিশ্বের প্রথম ব্যাংক নোট চালু হয় ১৬৬১ সালে স্টকহোমের বানকোতে। অন্যদিকে স্প্যানিশ ডলারের প্রচলন ছিল ম্যাসাচুসেটসের সমুদ্রের ধারের কিছু বসতি অঞ্চলে। সময় তখন ১৬৯০ সাল। ১৬৯৪ সালে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর তারা তাদের প্রথম নোট চালু করে।

প্রথম ট্রাভেলারস চেক চালু হয় ১৮৯১ সালে। এটি চালু করে আমেরিকান এক্সপ্রেস। এরই পথ ধরে প্রথম ক্রেডিট কার্ড চালু হয় ১৯০০ সালে। মুদ্রা বহনের মাধ্যম হিসেবে ধীরে ধীরে আরও অনেক কিছুর উদ্ভাবন হতে থাকে। এ সময় প্রযুক্তির উৎকর্ষতা এ ব্যাপারে বেশ সাহায্য করেছে। প্রথম ডাইনারস ক্লাব কার্ড চালু হয় আমেরিকার নিউইয়র্কে। রেলফ প্লাইডারের চালুকৃত কার্ডধারী মেম্বাররা ওই কার্ডটির মাধ্যমে প্রথমদিকে নিউইয়র্কের যে কোনো রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া করতে পারত।  আধুনিক মানসম্পন্ন ক্রেডিট কার্ড প্রথম চালু করে ব্যাংক অব আমেরিকা ১৯৫৮ সালে। ইন্টারনেটে ক্রেডিট কার্ডের সুবিধা চালু হয় ১৯৯০ সালে।

স্বর্ণমুদ্রার পুঁটুলিটা মাটির নিচে ভালো করে পুঁতে দিয়েও স্বস্তি পাচ্ছে না বিপ্রদাশ কেলোই। মাঝরাতে বউ ঘুমিয়েছে কি না নাকের কাছে হাত রেখে নিশ্চিন্ত হয়েই ছুটে গেছে গড়পাড়ের খালের জমিতে। দ্বাদশীর আলোয় ঠিক ঠাউর হয় না নরম মাটির স্থান। নিরুনী হাতে ভেজা মাটি পেলেই খানিক খুবলে নিচ্ছে। এই তো, এই তো লাল পোঁটলা! নাহ, তবে ঠিকই আছে মনে ভেবে বাড়ির দিকে ফিরতি পথে নিশ্চিন্তে যাত্রা করলেও জানতে পারলো না সে, নিরুদা বিবি হঠাৎ তলপেটের চাপ সামলাতে ছুটে এসেছিল গড়পাড়ের খালের ধারেই। নিভু আলোয় বেশ দেখা যায় একটা ছায়ার মতো শরীর। পাগলের মতো মাটি খুঁড়ে চলেছে। নিরুদা বিবির তলপেটের চাপ তখন মাথায়। প্রথমে ভয়, জিন হুরী পরীরা রাতের বেলায় ঘোরে। কিন্তু না, তা তো নয়! এ জলজ্যান্ত মানুষ, মাটির থেকে কী সব টেনে বের করল। ওই তো হাতে চকচকে ওটা কি? নিরুদার বুঝতে বাকি রইল না, তার ভাগ্য এই মুহূর্ত থেকে খুলে  গেল।

কতই না যুদ্ধ রক্তক্ষয় এই অর্থর জন্যই। এবার ফিরে দেখা যাক মুদ্রার বিভিন্ন রূপ। যা প্রাচ্য সভ্যতার এক জীবন্ত দলিল হয়ে আছে



                                                     প্রথম চিনা কাগুজে নোট


কর্ষাপণ

সময়টা তখন ষষ্ঠ পূর্বাব্দভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ষোড়শ মহাজনপদ। বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে উদ্ভব হয়েছে কর্ষাপণের গতিপ্রকৃতি অনুসারে ভারতীয় মুদ্রার যাত্রা শুরু বলা যায় সেই সময়কেই। এই কর্ষাপণ রূপার তৈরি হলেও নির্দিষ্ট  ওজন বা আকারের ছিল না এবং মুদ্রার গায়ে খোদাই করা ছিল বিভিন্ন প্রতীক। অবশ্য ভিন্ন ভিন্ন মহাজনপদের প্রতীক ছিল ভিন্ন। তখন মগধ উন্নতির যাত্রায় মশালবাহীশুরু হয় পাঞ্চ মার্কড মুদ্রার প্রচলন। কৌটিল্যর অর্থশাস্ত্র অনুযায়ী সেই সময়ের মুদ্রার গায়ে সূর্য, চন্দ্র, হাতি, ছয়টি হাতের অতিমানবীয় আকার, জীবজন্তুর ছবি থেকে শুরু করে মানুষের ধ্যানমূর্তি পর্যন্ত খোদাইয়ের নমুনা মিলেছিলমুদ্রাগুলির সে সময় ওজন ছিল তিন থেকে চার গ্রামের মধ্যে। মগধকে কেন্দ্র করে মৌর্য সাম্রাজ্য বিস্তার লাভ করলেও কর্ষাপণ ছাড়া ভিন্ন কোনো মুদ্রার প্রচলন সে সময় দেখা যায় না।



                                   নাইজেরিয়ায় হাতের কড়াকে বিনিময়ের মাধ্যম ধরা হতো 


ইন্দো-গ্রিক মুদ্রা

ধরা যায় ৫৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ সময়ের আশেপাশে রূপার তৈরি ইন্দো-গ্রিক মুদ্রার দেখা মেলে। চার গ্রামের গোল এই মুদ্রাগুলিই সেই সময়ের ইতিহাস জানার পক্ষে অত্যন্ত জরুরী একটি মাধ্যম, কারণ মুদ্রার গায়ে খোদিত ব্রাহ্মী এবং খরোষ্ঠী লিপির  প্রতিলিপিসহ তৎকালীন বিভিন্ন রাজাদের প্রতিকৃতি থাকত, যা কিনা অমূল্য নিদর্শন বলা চলে।


পরিবর্তনের চাকায়

ইন্দো-গ্রিক মুদ্রার সাথে সাথেই সাতবাহন রাজাদের অনন্য কৃতিত্ব হলো মুদ্রার প্রচলন। তামা এবং সীসার এই সমস্ত মুদ্রার গায়ে নিজস্ব প্রতিকৃতি খোদাইয়ের পাশাপাশি জীবজন্তুর ছবি এবং দক্ষিণের তেলেগু ভাষার ব্যবহার পাওয়া যায়। কোনো আচার অনুষ্ঠানে কিংবা রাজ্যজয়ের খুশিতেও এরা মুদ্রার প্রচলন করত,  তবে সে ক্ষেত্রে সেগুলি হতো রূপার।



                                                        পাথরের মুদ্রা


কুষাণকাল

সময়টা তখন ৪৫ খ্রিষ্টাব্দকুষাণ রাজা কুজুলকদফিস সিংহাসনে বসেই মুদ্রার প্রচলন করেন। তবে ভারতীয় মুদ্রাযুগের এক নতুন যুগের সূচনা করেন রাজা বিমকদফিস, স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করে। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন রাজা বাণিজ্যের সুবিধার জন্য রোমান মুদ্রার সাথে সাযুজ্য রেখেই দিনার, হাফ দিনার, ডবল দিনার মুদ্রার প্রয়োগ করেন। এই সমস্ত মুদ্রার গায়ে ব্রাহ্মী খরোষ্ঠী লিপির পাশাপাশি রাজার প্রতিকৃতি খোদাই করা থাকত। তবে মহান রাজা কণিষ্ক রাজ্যলাভের পর সাধারণ মানুষদের জন্য স্বর্ণমুদ্রা প্রচলন শুরু হলেও এতে গ্রিক, ইরানের প্রভাব অত্যাধিক হলে পরবর্তীতে ছবির  পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। কণিষ্কর জীবনযাত্রার প্রভাব খানিকটা পরিলক্ষিত হয় তার মুদ্রার পরিবর্তন লক্ষ্য করলেই। প্রথমদিকে হিন্দুধর্মীয় দেবদেবীর প্রতিকৃতি মুদ্রায় প্রাধান্য পেলেও পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধের ছবি খোদাই করা হয়। এর থেকে বোঝা  যায় বৌদ্ধধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ায় ধর্ম সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিকোণ।



                                                 কড়ি বিপনণের মাধ্যম


স্বর্ণমুদ্রার মহাযুগ

ভারতীয় ইতিহাসে বিপুল পট পরিবর্তন ঘটে গুপ্তযুগেবিভিন্ন কারণে গুপ্তযুগকে স্বর্ণযুগ বলা হয়। মুদ্রার চালচিত্রেও সময়োপযোগী আধুনিকতার এক পরিবর্তন আসে। গুপ্তরাজারাই প্রথম, যাঁরা মুদ্রায় বিসর্গ চিহ্নের ব্যবহার করেছিলেন। এই সময়ই  ভারতবর্ষে প্রথমে তামার মুদ্রার প্রচলন হয়। মনে করা হয়, ২ হাজার ৪শ বছর আগে সম্রাট চন্দ্রগুপ্তের শাসনামলে এ মুদ্রার প্রচলন হয়। তখন ধাতু গলিয়ে পাতলা পাত বানিয়ে সেটি কেটে মুদ্রা বানানো হতো। মুদ্রার উভয় পিঠে থাকতো নানা ধরনের ছাপ। ধাতু গলিয়ে সবাই মুদ্রা বানালে কেউ কারোরটা গ্রহণ করবে না, এই  কারণে ছাপ দিয়ে সরকারি মুদ্রা বানানো হতো। যাতে এগুলো নকল করা না যায়। রাজাদের পত্নী প্রেমের বিভিন্ন নিদর্শনের মধ্যে মুদ্রার প্রচলনের উপহারও ছিল এক অনন্য পন্থা। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী লিচ্ছবি বাঈকে খুশি করতে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন। তবে তাঁর পুত্র সমুদ্রগুপ্তের আমলকে সেরা সময় বলা যায়। মোট আট ধরনের স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন তিনি। মুদ্রায় খোদাই বীণা বাজানোয় মগ্ন সম্রাটের ছবি দেখে আমরা তাঁর সম্পর্কে ধারণা করতে পারি, তিনি সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। তখন উপকথা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, পশুপাখির জন্ম দিনেও রাজারা একটি করে স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করতেন। পরবর্তীতে যে অর্থনৈতিক ভাঙন দেখা দিয়েছিল তা বোঝা যায় সম্রাট স্কন্ধ গুপ্তের রাজত্বকালেসেসময় স্বর্ণমুদ্রায় খাদের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল। সংস্কৃত লিপি ব্যবহার এবং দেবতা বিষ্ণুর ও লক্ষ্মীর প্রতিকৃতি খোদাই থেকে সহজের ধারণা করা যায়, অধিকাংশ গুপ্ত রাজারাই ছিলেন দেবতা বিষ্ণুর উপাসক।


বাংলার মুদ্রাকাল

সমগ্র ভারতবর্ষে যখন মুদ্রার প্রচলন চলছে, বঙ্গদেশীয় ও তখনকার গুপ্তদের অনুসরণে  সপ্তম খ্রিষ্টাব্দে গৌড়েশ্বর শশাঙ্ক স্বর্ণ মুদ্রার প্রচলন করেন। তিনি ছিলেন পরম শৈবিক তাঁর স্বর্ণমুদ্রায় ষাঁড়ের পিঠে এক ব্যক্তির খোদিত চিত্র দেখে আন্দাজ করা যায় এটা। শশাঙ্কর শাসনকাল সমাপ্ত হবার পর বাংলা অধিগ্রহণ করেন পালবংশ। রাজা ধর্মপাল ব্রাহ্মী লিপিতে স্বনাম খোদাই মুদ্রা্র প্রচলন করে্ন, যার ওজন ছিল প্রায় সাত গ্রাম মতো
মুদ্রার যাত্রাপথে অনেক সাম্রাজ্যের সমাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি থেকে শুরু করে সেই সময়ের ইতিহাসের জীবন্ত নিদর্শন বহু শতাব্দী জুড়ে বর্তমান থেকে যাবে তার মধ্যে যতটুকু সম্ভব তুলে ধরার প্রয়াস করেছি। বাকিটা আপাতত বাকিই থেকে গেল।

















0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন