কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

‘ওগো বাঁশিওয়ালা, বাজাও তোমার বাঁশি’ 


                                                                                                             
  খুব ছোটবেলায় কালিদাস রায়ের একটি কবিতায় পড়েছিলুম এক অনাহারক্লিষ্ট ব্রাহ্মণ সাধকের কথা। নিজের দুর্দশায় তিতিবিরক্ত হয়ে, স্বহস্তে গীতার ‘যোগক্ষেমং বহাম্যহম্’ কথা দুটি (রায়ের ভাষায় ‘আমি নিজে বই’) কেটে দিয়েছিলেন। তাতে   অবশ্য দুটি দিব্যদর্শন বালক তাঁর গৃহিণীর হাতে চাল-ডাল-তরিতরকারির সিধে  পৌঁছে দেওয়ার সময় তাদের রক্তাক্ত পিঠ দেখিয়ে, মাতৃভাবস্পৃষ্ট গৃহিণীকে তাজ্জব আর পরে সাধুকে লজ্জিত করে দিয়েছিল! সাধককে যেমন, কেউ না কেউ তো বিশ্ববিদ্যালয়কেও বইবেই! তার জন্য ঘরের পাশে তৃতীয় পাণ্ডবের মতো কেউ  ‘আমি একা বই’, ‘আমি মাইনে দিই’ বলে’ হুহুঙ্কার  করবে! আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ‘আধো আইবুড়ো ভিখিরীর’ মতো অনুতাপান্তে উপলব্ধি করতে হবে—     
‘জলিফলি ছাড়া  
চেৎলার হাট থেকে টালার কলের জল আজ
এমন কি হ’তো জাঁহাবাজ?
ভিখিরীকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর ভাদ্র-বৌ সকলে নারাজ’

(লঘু মুহূর্ত, সাতটি তারার তিমির)

  আসলে সেই অযোধ্যাও নেই, সেই রামও নেই! অনেকে বলবেন (ক’নও বটে) সেই বহনকারীর কথা রাখেন মড়য়! সেই রামনাথীয় পণ্ডিতরা আছে! ফলে অনায়াসে এক প্রদেশখণ্ডে (একটু বঙ্কিমী, কিন্তু আমার প্রিয়) তৃতীয় পাণ্ডব, আর সারা দেশে আরেকজনা সাধুসম্মিলনের সুবাদে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিক্ষানির্ভর আইবুড়োত্বকে ‘ঘর ঘর কা কহানী’ করে দিচ্ছেন! কখনো দক্ষিণ-পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিবাদে ঢুকে পড়ছেন কেন্দ্রীয় সরকার! খুঁচিয়ে দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দমনপীড়নে  ব্যতিব্যস্ত হয়েও, আত্মহননের বার্তায় তাকে দায়ী না করেই আত্মঘাতী ছাত্রের ‘দলিত’ স্ট্যাটাস নিয়ে কাটাছেঁড়া চলছে। যেন মা তপশীলী হওয়া সত্ত্বেও ‘আমি নিজে বই’ বলতে নারাজ বাপ কেবল ওবিসি হওয়ায়, ছেলের প্রতিবাদটাও খাটো হয়ে গেল! আক্রমক, বৈষম্যকারী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দলিতের প্রতিবাদ কেন তপশীলীদের থেকেই আসতে হবে, ওবিসিদের থেকে নয়, তা বামুনের ভগাই জানে! কেউ পড়েও দেখেনি কীভাবে মহাত্মা জ্যোতিরাও গোবিন্দরাও ফুলে  চাতুর্বর্ণ্যকে দ্বান্দ্বিক যুক্তিতে, ‘ভাট/সাহুকার’ আর ‘শুদ্রাতিশুদ্রের’ দ্বৈবর্ণ্যে পরিণত হতে দেখান! আর কীভাবে বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসকদল তার প্রত্যক্ষ প্রতিনিধিতে  পরিণত হয়েছে! কখনও খোদ রাজধানীতেই বিখ্যাত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছেলে অবিমৃষ্যকারী ভাবে এক ঘোষিত, বিচারিত অপরাধীর ফাঁসির বিরুদ্ধে প্রতিবাদসভা করতে গিয়ে, agent provocateur–দের ফাঁদে পা দিয়ে, তাদের ভারতদ্বেষী স্লোগানে গলা দিয়ে, দেশের শিক্ষার স্বল্পশিক্ষিতা অভিভাবিকাকে সুযোগ দেওয়া মাত্র মানবসম্পদ মন্ত্রক ‘এমন মানবজমিন রইলো পতিত, আবাদ করলে লতো সোনা’ বলে’,  কেন্দ্রীয় গৃহমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে, ‘ঘর ঘর কা কহানী’-র  পরের স্টুডিও হিসেবে বেছে নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়কে! কর্পোরেট মহামিডিয়ার (কুজ্)ঝটিকা আর শাসকদলের সাঙ্গোপাঙ্গোদের ‘নাহোক কলরব’ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাতন্ত্র্যকে এমনভাবে ব্যঙ্গ করছে যে সেটা যেন ‘দিয়ে খায় না পেতে শোয়’ ধরনের এক আজব বস্তু!

  Agent provocateur–দের ফাঁদে পা দেওয়া, কোনো অপরাধীর ফাঁসিবিরোধী প্রতিবাদসভায় শ্লোগানে ভারতদ্বেষী কলরব  মিশে গেলে আমাদের পরিতাপের আর প্রতিবাদীদের পশ্চাত্তাপের বিষয় হতে পারে, কিন্তু তাতে দেশদ্রোহিতার অপরাধে বিচার দেশের আইন মোতাবেকই হয় না, এ কথা নিয়ে ফেসবুকে কয়েক আইনজ্ঞর বিচারবিমর্ষ শেয়ার করায় এক পরমাত্মীয়, উজ্জ্বল বৈজ্ঞানিকের কাছ থেকে শুনতে হলো, ‘people who live their life on public dole should be loyal to hand that feed them এবম্বিধ সদুক্তির কারণ হলো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে স্থান পাওয়া ছাত্ররা (কতকটা দেশের কোটিপতি সাংসদদের মতোই) কম  পয়সায় থাকে, খায়!  ডোলের ঢোলবাদকদের কী উত্তর দেবো, একথা ভাবতে  ভাবতেই মনে পড়ে গেল একটি ইংরিজি প্রবাদ: ‘He who pays the piper calls the tune’আর এই প্রবাদ সম্বন্ধে Margaret Atkins-এর প্রগাঢ় বিশ্লেষণ ‘Should He who pays the piper call the tune?’ লেখায় বিশ্ববিদ্যালয়েরই এক কোর্সের  প্রশাসন বিষয়ক ব্যাপারেই অ্যাটকিন্সের এক সমালোচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক পদাধিকারী তাঁকে শুনিয়েছিলেন এই মহাপ্রবাদ— ‘He who pays the piper calls the tune’প্রবাদটির ভাষাগত উৎপত্তির সাত সতেরোর পর, অ্যাটকিন্স ম্যা’ম প্রবাদটির সম্পর্কে  কয়েকটি ফাটাফাটি প্রশ্ন  তুলেছেন। যথা——
      
  ধরা যাক বেতনদাতা এই বাঁশিওয়ালাকে (নাম ধরুন পিটার) কেবল তাঁরই দেওয়া ‘সুর’ বাজাতে আদেশ করছে। কারণ পিটার ভালো বাঁশিওয়ালা হওয়া সত্ত্বেও যেহেতু তাঁর কাছ থেকেই বাঁশি বাজানোর মজুরি পাবে, ফলে তাকেই আবিষ্কার করতে হবে বেতনদাতা কী সুর চাইছে। বাঁশিওয়ালা আর কারুর কাছে দায়িত্বশীল নয় (যেমন এক্ষেত্রে পড়ুন নাগরিক অধিকার, ন্যায়বিচার, প্রতিবাদের জায়গা বা সুর)। পিটার বলতে পারবে না, ‘কি সুর বাজে আমার প্রাণে আমি জানি মনই জানে’। বলতে পারবে না ‘But everyone else loved the tune that I choseবেতনদাতাই খাওয়াচ্ছে যে!


      
  বলতে পারেন এসব কথার বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাসঙ্গিকতা কী! আছে স্যার! বিশ্ববিদ্যালয়েই একে প্রয়োগ করে অ্যাটকিন্স ম্যা’ম লিখছেন——
·     বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতনদাতা অনেক। উপকারী, আদি ফাণ্ডদাতা, কর্পোরেশন, সরকার, করদাতা, রাজনীতিক ইত্যাদি! তাঁদের নির্দেশ অনেক চোরা, অন্ধকার, জটিল গলি ঘুঁজির মধ্যে দিয়ে রাজনীতিক, আমলা, বিশ্ববিদ্যালয়ের  প্রশাসনিক আধিকারিক ইত্যাদিদের দ্বারা ঘোরানো-পেঁচানোর পর, আবার ছাত্র, মাতাপিতা, ভবিষ্যৎ  নিয়োগকর্তা ইত্যাদি  অনেকের সঙ্গে  পরামর্শ করার  প্রয়োজন মিটিয়ে, খুব অস্পষ্ট চেহারা নেয়! তা গৎবাঁধা, কিন্তু ভালো সুরের নয়!  কী বাজাবে পিটার?
·     ভালো বাজিয়ে পিটার অতএব দর্শন ভাবনায় স্পৃষ্ট হলে বেছে নেবে এদের মধ্যে, — (i) যারা বাজানোকে প্রভাবিত করে না; (ii) যারা বাজানোকে অনুপ্রেরিত করে না; (iii) যারা বাজানোকে দূষিত করে।
·     বেতনদাতা বুঝিয়ে দিয়েছে সে পিটারের কাছ থেকে কী চায়। বেতনদাতা বিশ্বাস করে যে পিটার বাজাবে তার দেওয়া টাকার জন্য, তার দেওয়া সুরে। বাঁশিবাদনের অন্তর্নিহিত কোনো মূল্য নেই! বাজানোর উদ্দেশ্য টাকা, উদ্দেশ্য গৌণ! পিটার কিন্তু বাজায় বাজানোর আনন্দে!  টাকা গৌণ! ফলে এই প্রবাদের অর্থেই লুকিয়ে আছে এই সম্ভাবনা যে বেতনদাতা ও পিটার বাজানোর উদ্দেশ্য বিষয়েই দ্বিমত প্রথম থেকেই! (Margaret Akkins, ‘Paying the piper’, https://www.royalholloway.ac.uk/classics/cucd/atkins.htm)

·     পিটার জানে যে গানের জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা বেতনদাতার কেজো জগৎ থেকে, যেমন আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় বাইরের জগৎ থেকে! বিতর্ক, দ্বিমত, অন্য সুর তার স্বভাবগত। বেতনদাতাকে ভাবতে হবে বাজনা চলবে কিনা। চললে তা তার সুরে বাজবে না! বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অটোনমির কথা বোধহয় সব চেয়ে প্রথম, সব চেয়ে ভালো বলেন বিশ্ববিশ্রুত জর্মান দার্শনিক উইলিয়াম ফন হুম্বোল্ড, এমনকি রাজতন্ত্রের অধীনেও।

  চরমতান্ত্রিক রাজতন্ত্রেও রাজা/ রাষ্ট্র কেন একটি নজিরবিহীন অটোনমির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিস্ক্রিয় গার্ডিয়ান এঞ্জেল হয়ে রাখবে তার পক্ষে হুম্বোল্ডের যুক্তি ছিল দ্বিবিধ— দার্শনিক/নৈতিক আর উপযোগিতাবাদী/ কেজো। প্রথমটায় বলা হয়েছিল যে নতুন এবং মৌলিক জ্ঞান প্রসূত হতে পারে কেবল ‘Einsamkeit und Freiheit’-এর (নির্জনে আর স্বাধীনতায়)আর দ্বিতীয়টায় বলা হয়েছিল যে যেহেতু কোনো আধুনিক ‘Kulturstaat’-এর (সংস্কৃতিবান রাষ্ট্রের) বৌদ্ধিক এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, এমনকি শারীরিক অস্তিত্বই  অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ও নির্ভরশীল  উচ্চ মানের জ্ঞানের কাম্য ও সর্বাধিক অনুসরণ  আর সৃজনের উপর, সে কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের অটোনমির নীতি কেবল এক বাঞ্ছিত, প্রাতিষ্ঠানিক সমাধান  নয়, কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নৈতিক দায়! এই কারণেই ম্যাক্স হ্বেবর বলেছিলেন জ্ঞান সৃজনের ক্ষেত্রে Wertfreiheit তথা  মূল্যবোধ নিরপেক্ষতার কথা, যাকে এমিল দুর্খেইম আবার বলেছেন সব সামাজিক ঘটনাকে ‘বস্তু’ (‘thing’) হিসেবে দেখতে বলে’আর সমাজতত্ত্ববিদ থর্স্টিন ভেবলেন তাঁর শিক্ষকদের চমকে দিয়েছিলেন লুথের‍্যান কার্ল্টন কলেজ অ্যাকাডেমিতে। সেখানে Oratory নামের এক শাস্ত্রঘেঁষা বক্তৃতা পরীক্ষায় নিয়মমাফিক ‘heathen’ কেন প্রভুর ধর্মে দীক্ষিত করা দরকার, সেই ধরণের কোনো বক্তৃতার স্থলে ভেবলেন মাস্টারমশাইদের চমকে দিলেন, ‘A Plea for Cannibalism’ আর ‘An Apology for a Toper’ নামের দুটি বক্তিমা দিয়ে। প্রথমটায় ছিল recycling-এর অর্থনীতি হিসেবে cannibalism তথা নরখাদকতার সমর্থন। আর দ্বিতীয়টায় ছিল মাতলামোর বৈধতা প্রতিষ্ঠা। তাজ্জব ফ্যাকাল্টি যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন এইসব খেলো পাপময় বিষয়ে বক্তৃতার হেতু, তখন ভেবলেন তাঁদের নীরস গলায় বলেন এগুলো তাঁর বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষণ! অসোয়াস্তির সঙ্গে ফ্যাকাল্টি বোঝেন তাঁর জিনিয়াস (Robert L. Heilbroner, The Worldly Philosophers: The Lives, Times, and Ideas of Great Economic Thinkers, New York: Touchstone/ Simon and Schuster, 1953/1999, pp. 222-23

  শুনছেন ‘ঘর ঘর কহানী’র  অমর উচ্চমাধ্যমিকার অহমিকা, আর তাঁর ঔপরিকের ৫৬ কমে’ ৪৮ ইঞ্চির প্রতাপ, আর ঘরের কাছে ওজনদার তৃতীয় পাণ্ডব? যে বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের সাধারণ, গড়পড়তা নীতির থেকে অন্যতর নীতির আলোচনার  জায়গা! সেখানে কোনো তথাকথিত অপরাধীর ফাঁসি রদের জন্য ছাত্ররা আওয়াজ তুলতেই পারে! ‘আমি একা বই’ বলে তাকে থামিয়ে দিলে গান বন্ধ হয়ে যাবে, জ্ঞানও!  বাঁশিওয়ালাদের বাঁশি বাজাতে দ্যান সায়েব/ম্যা’ম! ওর দমনের বিরুদ্ধে ছিলেন Atkins আর তার বহু আগে মহাদার্শনিক  Humboldt, Weber, Durkheim, Veblen!      
   
  কান্‌‌হাইয়া মোরা! বাজাতে রহো তেরা বাঁশরিয়া, শুনাতে রহো নয়া নাম ...  

   
    
        

     


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন