কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১৬

রঞ্জনা ব্যানার্জী

অভ্যাস



আমি খেয়াল করিনি, দীপই দেখাল আমাকে। স্বর্ণা!
ফিরছিলাম সীতাকুন্ড থেকে। চন্দ্রনাথ মন্দিরে গিয়েছিলাম। আমাদের সাথে অতিথি; দীপ-এর জ্যাঠামশাই আর জ্যাঠিমা। কলকাতা থেকে এসেছেন মাতৃভূমি দর্শনে। বাড়বকুন্ডে এসেই গাড়ির টায়ার বসে গেল। কী ঝক্কি! ড্রাইভার খবর নিয়ে জানাল,  কাছেই গ্যারাজ আছে একটা। মেকানিকের খোঁজে ওকেই পাঠানো হলোমাথার ওপর সূর্য, গরমে সেদ্ধ হওয়ার চাইতে সামনে কোনো দোকানে গিয়ে বসলেই হয়। দীপকে গাড়ির পাহারায় রেখে আমি জ্যাঠামশাই জ্যাঠিমাকে নিয়ে এগোলাম। একটু হাঁটতেই এই চায়ের স্টল। গাছের ছায়ায় কাঠের বেঞ্চে বসে গরমাগরম ডালপুরি আর চা খাচ্ছিলাম। একটু পরে দীপও যোগ দিল; মেকানিক পাওয়া গেছে, কাজ চলছে।
  
ঢাকা-চিটাগাং হাইওয়ে। হুশহাশ গাড়ি দু’দিকেই। সাদা করোলাটা থামল আমাদের সামনে। ড্রাইভারের দিকের কাচ নামিয়ে শুদ্ধ বাংলায় তরুণী জলের বোতল চাইল।  তখনই দীপের গুঁতো আমার পুরো মনোযোগ প্লেটের ডালপুরিতে, মাথা তুলতেই  দেখি স্বর্ণা! দোকানী ছেলেটার কাছ থেকে হাত বাড়িয়ে বোতল নিচ্ছে আর তক্ষুনি আমাদের চোখাচোখি। ভূত দেখল যেন, ‘আপা আপনি’! গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে কিছু  বলল সহযাত্রীকে। দরজা খুললেন তিনিও। ভদ্রলোকের হাতে সাদা ছড়ি। বিদেশী। কালো চশমায় চোখ ঢাকা। আমি তখনও পাথর। ক-ত খুঁজেছি! পুলিশে ডায়েরী করা  হয়েছিল। তিন বছর আগের কথা, তাও মনে হয় এই সেদিন!

আটবছর আগে ও ‘ছুটা বুয়া’ হিসেবে ঢুকেছিল আমার বাড়িতে। ওর মায়ের জায়গায়‘আমেনা বুয়া’ ওর মা আমাদের বিল্ডিঙের পাঁচ ফ্ল্যাটের ঠিকে ঝি। আমরা সবাই ওকে ভালোবাসতাম। চুকলি করত না। কাজে ফাঁকি দিত না। সেই আমেনা  বুয়া হঠাৎ ‘পেটে ব্যাদনা’ নিয়ে ভর্তি হলো হাসপাতা্লেগলব্লাডারে পাথর। সবাই  সাহায্য করলাম, কিন্তু হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে বুয়া আর কাজে ফিরল না।  বদলি হিসেবে দিয়ে গেল মেয়েকে

রোগা লিকলিকে। বয়স টেনেটুনে ষোল কি সতের; এক বাচ্চার মা। ফ্ল্যাটের অন্যেরা খুব একটা ভরসা পেল না, যে যার মতো ব্যবস্থা করে নিল। আমার তখন দিশেহারা  অবস্থা। রাতদিনের কাজের মেয়েটা সাতদিনের জন্যে বাড়ি গিয়ে আর ফেরেনি। ন’টা  পাঁচটা চাকরিশাশুড়ি আছেন, কিন্তু সকালে সব গোছগাছ করে বেরুতে আমার দম  বেরিয়ে যায়। ফিরতে একটু দেরি হলেই শাশুড়ির মুখ আঁধার। দীপ একটা শিপিং  কোম্পানিতে কাজ করে। বাড়ি ফিরেই ঘর অন্ধকার করে টিভি চালিয়ে হুইস্কি নিয়ে  বসে; কুটোটি নাড়ে না। কুট্টুসের তখন তিন চলছে। অসম্ভব চঞ্চল। পনের দিনের মাথায় স্বর্ণার কাজ দেখে আমি মুগ্ধ, টাকা বাড়িয়ে কাজের সময় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা করে নিলাম। একটানা পাঁচ বছর ছিল। কুট্টুসকে স্কুল বাসে তুলে দেয়া আবার বাড়ি আনা থেকে শুরু করে ঘর সামলানো, ছোটখাট বাজার-সদাই, কাপড়  কাচা সবই করত। কেবল রান্নাটা আমি। কুট্টুসকে দুপুরে ঘুম পাড়িয়ে সেলাই নিয়ে বসত। অর্ডারি কাজ।

বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু সেদিন কী যে হলো!

তিন দিনের কনফারেন্সে ঢাকা যাব। সকালে ট্রেন। স্বর্ণার দেখা নেই। এমন তো করে না কখনও! হয়তো বাচ্চার অসুখ! গজগজ করতে করতে কুট্টুসকে দীপ বাসে তুলে  দিয়ে এলোকিন্তু আনবে কে? আমার শাশুড়ি বাতের ব্যথায় কাহিল। দীপকে কামাই  দিতেই হলোঢাকায় নেমেই ব্যস্ত হয়ে গেলাম কনফারেন্সে। রাতে হোটেলে ফিরেই  শুনি রহিম মিয়া, স্বর্ণার বর, স্বর্ণার খোঁজে বাড়ি এসেছে। কী ঝামেলা! তিন দিন  নয় দু’দিনের মাথায় ফিরতে হলোতারপর থানা, পুলিশ - রাজ্যের ঝক্কি! স্বর্ণাকে আর পাওয়া গেল না।

কুট্টুস সেভেনে ছবি দেখাই ফোনে। ওর চোখ ছলছল। প্রচন্ড কৌতূহল সত্ত্বেও আমার  কিছুই জানা হয় না। যাওয়ার সময় সেধে আমার মোবাইল নম্বরটা সেইভ করে

চাকা ঠিক করে বাড়ি ফিরতে ফিরতে আমাদের প্রায় মাঝরাত। লম্বা দিন গেল একটা! সারা রাস্তা ভেবেছি ওকে। ফ্রেশ হয়ে ঘরে ঢুকে দেখি দীপ ওর হুইস্কি সাজাচ্ছেএস এম এস-টা আসে তখন - রহিম মিয়াকে স্টেফেন দোকান করে  দিয়েছে; নতুন বউবাচ্চা নিয়ে সে ভালোই আছে। ছেলেটা কক্সবাজারে ওর সাথেই,  স্টেফেন দত্তক নিয়েছেস্টেফেনের সাথে পরিচয় সেলাই দিদির বাড়িতেই। রহিম মিয়ার কাছে ও ডালভাতের মতোই একটা অভ্যাস ছিল। প্রতি রাতে মদ খেয়ে গায়ে  হাত তুলতো, তারপর সেই শরীর নিয়ম করে ভোগ করত। স্টেফেন ওকে ভালোবাসে,  মানুষ ভাবে।   
টেলিভিশন চলছে নীলচে আলোয় দীপকে ভীষণ অচেনা লাগেবরফের পর  সোনালি হুইস্কি আওয়াজ তোলেএকটু পরেই অভ্যাস মতো আমাকে নয়, আমার শরীর খুঁজবে ও।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন