কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

বৃহস্পতিবার, ২১ এপ্রিল, ২০১৬

শ্যামশ্রী চাকী

ভিগি চুনরিওয়ালি

সূর্য তখনো মধ্যগগন ছাড়ায়নি মার্চের হাঁসফাসানি গরমে পানের দোকানটা   ক্যাটকেটে সবুজ পর্দা ঝুলিয়ে ধুঁকছে রাস্তার পিচ গলা শুরু হয়েছে হপ্তাখানে আগেই এবছর ভালোই খেল দেখাবেন দিবাকর। রুদ্রপলাশ রঙ ছড়াচ্ছে রাস্তা জুড়েএকটা হলুদ পাখির তারস্বরে চ্যাঁচানি আর রেলিংভাঙ্গা পার্কের থেকে একচিলতে ঠান্ডা  হাওয়ার সাথে বয়ে আসা বেলফুলের সুগন্ধ যে কোনো অষ্টাদশীর ডায়েরীভরা কবিতাকে উসকে দেবার জন্য যথেষ্ট।

পিঙ্কি ওসব ভাবে না কাল রাতে বেধড়ক মার খেয়েছে রিক্সাওয়ালা সামিমের হাতে মাস আগের প্রেমের বিয়ে আজ শুকিয়ে চ্যালাকাঠ মাঝে মাঝে স্টেশন রোডের কানাউঁচু গামলায় রাখা জিয়লমাছের মতো প্রেমটা চিড়িক করে লাফিয়ে উঠলেও ক্ষিদেপেটে ওই ন্যা্তানো মুড়ির মতোই মিইয়ে যায়। হিন্দু মেয়েকে বিয়ে করে   ফুলবাড়ি বর্ডার পার করে ইন্ডিয়ায় এসে ঘর বেঁধেছিল সামিম পিঙ্কি জমানো টাকার  থেকে কড়কড়ে পাঁচহাজার কাঁটাতার মালিককে দিয়ে একটা টানারিক্সা কিনে হাতে আর কিছু ছিল না তাদের মতো ভোটারকার্ড রেশনকার্ডহীন মানুষদের পলে পলে বিপদ কোনোমতে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটিয়ে এঁদো বস্তিতে আনকোরা সংসার
আজকাল নেশা করে বস্তির আধভাঙা ঘরটাতে অনায়াসেই চড় চাপাটি চালায় সামিম মালাউন বা গনিমতের মাল এই শব্দগুলোতেও আজকাল স্বচ্ছন্দ সামিম বে-আব্রু বাসাটা থেকে থেকে মুখ ভেংচায়; হ্যাঁ, বাসাই তো, ঘর তো নয়

পিঙ্কি তিনবাড়িতে বাসনমাজা ছাড়াও একটা পাইস হোটেলে কাজ করে গতকাল  চুড়িদারটা পেরেকে টান লেগে ছিঁড়ে যাওয়ায় যত বিপত্তি হিন্দুর মেয়ে! পর্দার বালাই নে নেশায় টাল খাওয়া শরীরে এক বিরাশিসিক্কা বাগায় সামিম কঁকিয়ে কেঁদে ওঠে পিঙ্কি অভাবে ধর্মবোধ প্রবল হয়েছে উভয়েরই বাক্সের কোণ্‌ থেকে বেরোয় একচিলতে লাল রঙ আর মা কালীর ছবি একটা ওড়না... নাকি পর্দা...! ঠোঁটের পাশে গড়ানো রক্ত মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে পিঙ্কি।
বেলা বাড়লে বড্ড শীত করে পিঙ্কির। ছেঁড়া চুরিদারটা এক হাতে আঁকড়ে খদ্দেরদের জল দেয়, এঁটো বাসন সরায়, টেবিল মোছে, খাবার বাড়ে অন্য একজনের টেবিলের  অর্ডার নিয়ে প্লেট পৌঁছয় বছর দশেকের পটলা এক্সটা অর্ডারিগুলো সারে পিঙ্কি, সাথে বাসন মাজাও।

সকাল থেকেই আজ ভি উপচে ছে। হঠাৎ একটা গাড়ি এসে থামে স্বপ্নের মতো একটা মোমবরণ মেয়ে আর রাজপুত্রের মতো ছেলে, কোলে ফুলোফুলো গোলাপি রেউড়িপানা ছোট্ট গোপাল জ্বরের ঘোরে দমক লাগে পিঙ্কির। মাথাটা টলে ওঠে সামনের টেবিলে বসে ওরা। পটলা তাড়াতাড়ি ফ্যান চালিয়ে পিঙ্কিকে টেবিল মুছতে ইশারা করে

বাইরে তখন রঙখেলা জমে উঠেছে বাতাসে উড়ছে ফাগুন আবিরের গন্ধ পেঁয়াজ সুনের গন্ধ ছাড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দেয় পাইস হোটেলের অন্দরে রঙিন মানুষ আজ  রঙের বাড়বান্তে চেনা দায় একদল রংবাজ ছুটে আসে, তারা নেশায় মশগুলহোটেলের বাইরে আড্ডা জমায়
হঠাৎ ঝনঝন শব্দে কাউন্টার থেকে খুচরো পয়সার বাটিটা উল্টে ড়ে। আর চমকে উঠে পিঙ্কির হাতে জলের গ্লাস চলকায় ঘুমন্ত গোলাপি শিশুর মাথায় জলের ছিটে ঝাঁঝালো কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে মোমের পুতুল, এই জন্য বলেছিলাম দোলের দিন বেড়ি   না! দেখলে তো! মেয়েটাকে দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, নেশা করে আছেআর কী  ছিরিছাঁদ হোটেলের! এক্ষুনি  চলোচলো এখান থেকে...

স্বপ্নের গাড়ি চলে যায় বাইরে তখন রঙের ফোয়ারা আর উল্লাসী নেশার জমায়েত  কাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি পিঙ্কির। ম্যানেজারের গালমন্দ আর মদের ঘোরে  টলোমলো জান্তব দৃষ্টির সামনে কুঁকড়ে যেতে থাকে হঠাৎ তার শীতবোধ প্রবল হয় মাটিতে লুটিয়ে ড়া মুহূর্তে সেই হলুদ পাখিটার ডাক শুনতে পায় পিঙ্কি
ছড়ানো এঁটোকাঁটা আর তোবড়ানো জলের জগের পাশে ঘুম ভাঙে পিঙ্কির। পাশে পটলা বসে চারদিক শুনশানদূরে কোথাও মাইকে বাজছে... হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়’...

হুড়মুড়িয়ে উঠে বসে পিঙ্কির নিজেকে অসম্ভব  হালকা মনে হয় ছেঁড়া চুড়িদারটা  আরো ছিঁড়ে গেছে। টলমলে পায়ে এগোতেই সোনালি ঝিলিমিলিনরম সিল্কের জরীদার  লক্ষ তারা ঠিকরোনো রাজকন্যের ওড়না, সেই মোমের পুতুলের ভুলে ফেলে যাওয়া রূপকথার আবরণী। ধাঁধা লাগে চোখ জুড়ে আস্তে আস্তে তুলে নেয় পটলা ছেঁড়া চুড়িদারের ওপড়ে জড়িয়ে দেয় মায়াবুনোট দুর্বল দেহ জুড়ে নীল আকাশপট অথবা সমুদ্রভাঙা ঢেউ...
কালীবাড়ি যাবে? ওখানে দোলের ঙ্গ দিয়েছে, আমিও কিছু খাইনি সকাল থেকে’...  অধোবদনে ফিসফিস করে দশবছরী পটলা

সুগন্ধি আবির ওড়ে শেষবেলার বাতাসে রঙের নেশায় ভারী বাতাস কোত্থেকে একদল পিচকারী নিয়ে ভিজিয়ে দেয় পিঙ্কিকে। টুপটাপ রঙ ঝরে রাজকন্যে ওড়না বেয়ে দুএকটা বেলুন ভরা আসমানি রঙ বন্যা হয়ে ভেঙে পড়ে উষ্ণ শরীরে শীতল  হয় শরীর। পিঙ্কির মুখে হাসি ফুটে ওঠে জ্বরে তপ্ত মুখে জ্বলে হাজার রংমশাল 
কালীবাড়ির ঠিক সামনে গাড়িটা ঘ্যাচ করে ব্রেক কষে, এই তো... এই তো সেই  হোটেলের চোর মেয়েটা, আমার দামী ওড়নাটাকী সাংঘাতিক চোর রে বাবা!ছুটে আসে কিছু লোক, ভাগ্যিস এই মন্দিরটাতে প্রণা করতে এসেছিলাম! এই মেয়েটা তো মুসলমান! মন্দিরে কেন? এত চোর বেড়েছে চারদিকে!’ মারমুখী জনতাগা থেকে খুলে নেয় রঙিলা আকাশ... লজ্জা আবরণ...ভয়ে সিঁটিয়ে যায় পটলা। রঙের মুখোশ আঁটা একদল মানুষ আর সিক্ত ছেঁড়া চুড়িদারে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা পিঙ্কিকে পেছনে ফেলে রাজরথ এগিয়ে যায়

অজস্র লোকের পাশবিক দৃষ্টিতে আবার ভেজে পিঙ্কি। রক্তক্ষরণ হৃদয় জুড়ে অগোছালো ভাবে হাঁটে সর্পিল পথে ছুটে আসে পটলা কালীমন্দিরের পেছন থেকে  কুড়িয়ে পাওয়া লাল চুনরিতে ঢেকে দেয় পিঙ্কিকে। আবার কেউ ছোঁড়ে রঙের গুলাল ভিজে যায় রক্ত চুনরি হোলি হ্যায়এএএএএ...’ শহরটা বদলায় রংমহলে।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন