কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

সোমবার, ২৩ মে, ২০১৬

শ্যামশ্রী চাকী

জলছবি

বালি দিয়ে কড়াটা রগড়াতে রগড়াতে ঝিকিমিকি হাসি ফোটে যমুনার ঠোঁটে। হাঁসগুলো খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে চুলায় বাঁশপাতা আর ঘুঁটে সাজায়। বাপটা রিক্সা নিয়ে গেছে, ফিরেই ভাত চাইবে। আজও সেই মাছওয়ালাটা দেবের মতো পোজে মায়াধরা চোখে তাকিয়েছে যমুনার দিকে। চুলায় ধোঁয়া ওঠেধোঁয়া ঘুরে ঘুরে পাক খায় যমুনাদের খড়ের চালে। এই নদীর চরে তাদের সাতঘরের বাস, ধোঁয়া ওঠে সাত উঠোন থেকেই। নদীর ঢেউয়ে মিলিয়ে যায় ধোঁয়া, লোহার নলটা দিয়ে যমুনা আপ্রাণ ফুঁ দেয় চুলায়,  একসময় আগুন দাউদাউ করে জ্বলে। আমানি ভাত ফোটে পাড়াজুড়ে সাতটা চুলায়।
সেই সময় নদীটার পায়ে কেউ নূপুর পড়িয়ে দেয়, নদী নাচে, অবাধ্য তালে চিকণ কালো সাপের মতো জল। নাচ আর থামে না, একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে নদীটা।

বিকেলের পরেই শহরটা রঙ বদলায়। ফুটে ওঠে হীরের ফুল, সারা শহর স্বর্ণাভ। যে  শহর ধাতুর তার এক কোণে হাইরাইজের একুশতলায় থাকে বৃষ্টি। বৃষ্টি  এখন মেপে  চলে, বৃষ্টি এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, বৃষ্টি এখন মার্কেট সার্ভে করে, বৃষ্টি কম কথা বলে, বৃষ্টি এখন একলা থাকে। 
আজ অনেকদিন পরে  জানালা খোলে বৃষ্টি। ল্যাপটপ বন্ধ করে ডায়েরীটা টেনে নেয়।  আজ কলমটা যেন অনেক কিছু বলতে চায়! বৃষ্টি আজ ঘুমোবে না, ওই আকাশটাকে  ভাঙবে। তারপর ক্লান্ত হতে গলে গলে পড়বে ধাতুর শহরে। এই শহরে প্রতিটি ইঁট জানে ধাতুর মূল্য। তবুও তারা অকারণ ভেজে। বৃষ্টি আজ বব ডিলানের সুর হয়ে ঝরবে, বৃষ্টি আজ গৌরকিশোর ঘোষ হয়ে পাতা ভরবে। বৃষ্টি আজ খোয়াইয়ের সোনাঝুরি হবে, বৃষ্টি আজ স্বপ্ন বুনবে। 
স্মার্ট ফোনটা তুলে নিয়ে মেঘকে কল করে বৃষ্টি। ছিঁড়ে খুড়ে ফেলতে চায় অভিমানী মেঘকে। আবার সেই  রক্তাভ মেঘের বুকেই লুটিয়ে পড়বে ক্লান্ত বৃষ্টি। ওই দেখো ওই দূরে ভেসে আসছে শ্যামল বারিদ। কপাল থেকে চুলের গোছা সরিয়ে  প্রস্তুতি নেয় বৃষ্টি, ঝাঁপ দেয় একুশমহলা থেকে মাটির দিকে। বৃষ্টি ভেজা সোঁদা গন্ধে ভরে ওঠে শহর।
রডোড্রেনড্রনগুলো সবে বরফ থেকে মুখ তুলে পাহাড়ে আবির ছিটিয়েছে। নীল ফ্লাই ক্যাচারের ঝাঁকটা একটু নিচের যে এলাচ বনে পাতা খুঁটছে সেই পাকদণ্ডী বেয়ে নেমে আসে অষ্টাদশী মেঘলা। কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা নেই এই পাহাড়ী কন্যার। ছোটবেলায়  তুলোয় জড়িয়ে কে যেন মনেস্ট্রির নিচে রেখে গেছিল, কে জানে? তারপর থেকে পাহাড় বেয়ে ঘুরে বেড়ায় মেঘলা।
আসমানি আর ধুসর বাখু পড়া মেখলা হারায় পাইন বনে। প্রধান দাজুর হোম স্টে তে দু'বেলা বাসন মাজে, কাঠের জানালা দিয়ে তাকায় দূরে পাহাড়ের দিকে।
আসলে মেঘলা ভালোবেসেছিল পাহাড়কে। আর পাহাড়টা নুনে জারানো খুরসানির মতো  তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করত সেই ভালোলাগাটা। মেঘলা যখন চা-পাতা তুলত  পাহাড়টা কুলফিমালাই হয়ে রঙ বদলাত। মেঘলা আর পাহাড় লুকোচুরি খেলত পাইন বনে। মেঘলার মন খারাপের দুপুরে পাহাড়টা সাজিয়ে দিত সাতরঙা রঙধনু। 'মো  হিমাল মা যান্ছু ' বিড়বিড় করে মেঘলা। একদিন সত্যি সত্যি রওনা দেয় পাহাড়ের দিকে সেদিন টুপটাপ শিশির ঝরছিল আর বাতাসে রোদ উপচে পড়ছিল। দূরে কেউ  ডাক দেয় 'আকেলি কাহা গাকো' পেছনে ডাকে কেউ কেউ, উত্তর দেয় না মেঘলা।  পাহাড়টা নেচে ওঠে, মেঘলা আরো কাছে যায়। পাইন বন দুলে ওঠে, আকাশ ছোঁয় পাহাড় আর মেঘলা। তাকিয়ে দেখো, আজও পাহাড়কে জড়িয়ে আছে মেঘলা ভালোবাসা।




0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন