কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

রোখশানা রফিক

পর্দাপ্রথা,  কিছু সংশয় ও প্রবাস






(১)

আমার দাদীর পরিবার ইরান থেকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচার করতে এসে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেখানকার ফকির বাড়িতে এখনো  তাঁদের বংশধরগণ বাস করেন। যতদূর জানি, বাংলাদেশের ধর্মসাধক ফকির  সম্প্রদায়ের মধ্যে মাদারী / মাদানি সম্প্রদায়ের উদ্ভব সেখান থেকেই। ইতিহাসে ফকির  বিদ্রোহের কথাও তো স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।

আমার পিতামহ কংগ্রেসি হলেও ধর্ম-কর্মে তাঁর নিষ্ঠা ছিল
আমাদের গ্রামের বাড়ির প্রাঙ্গনে মসজিদটিও তাঁরই স্থাপিত। আবার আমার মায়ের দাদা জনাব বশিরুদ্দিন মিয়াও জামালপুরের গুঠাইল-এর জমিদার হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। তাঁদের বাড়ির মেয়েরা ঘাট পর্যন্ত যেতে মশারীর নিচে হেঁটে যেতেন, শুনেছি।

এই ভূমিকার প্রয়োজন এজন্য হলো, কারণ সেই পরিবারের উত্তরাধীকারী হিসাবে জীবনে চলার মতো ইসলামিক ধারণা দিয়েই বড় করা হয়েছে আমাকে। ক্লাশ থ্রীতে  থাকতেই কোরআন শরীফ খতম করি আমি। তরজমাও পড়ে বোঝার চেষ্টা করেছি কয়েকবার। আমার মা'কে সবসময় দেখেছি বাসার বাইরে গেলেই মাথায় আঁচল টেনে  দিতে। ইদানীং বোরখাও ব্যবহার করেন। তবে সেটা অসুস্থতার কারণে শাড়ি সামলাতে অসুবিধা হবার কারণে। আমার পরবর্তী পরিবারে বোরখার প্রচলন দেখিনি তেমন। 

১৯৮৭ তে যখন কলেজে পড়ি, তখন থেকে লক্ষ্য করতে থাকি, পর্দাননশীন মহিলাগণ   আগে যেখানে বোরখা পড়তেন, এখন তার বদলে কিছু মহিলা 'হিজাব' নামক স্কার্ফে  মাথা ঢাকা শুরু করেছেন। সম্ভবত, হজ্ করে আসা ঢাকা মেডিকেলের গাইনীর ডাক্তার রাহেলা খাতুন, আমার বড় মামী, তাঁর বিয়ের সময় তাঁর পরনে প্রথম মাথার হিজাব ভালোভাবে খেয়াল করি। শাড়ির সাথে মাথায় স্কার্ফ।

এরপর থেকে এখন তো এটাই পর্দানশীনতার প্রধান প্রকাশ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে  দেখছি। আমার বিস্ময়, নিজে না পড়লেও ছোটবেলা থেকেই বোরখাকে আমরা যেখানে ইসলামিক শরিয়ত মোতাবেক পর্দানশীন পোশাক হিসাবে জেনে এসেছি, সেটা কখন  থেকে চড়া মেকআপ অথবা মেকআপ ছাড়া স্কার্ফে এসে ঠেকলো? যে চড়া মেকআপ এবং অলংকারাদি এই স্কার্ফের সাথে অনেক মহিলা ব্যবহার করেন, তা যেন পুরুষের  চোখে অধিক মোহনীয় হয়ে ওঠার প্রয়াস মাত্র! 





(২)

প্রথমত: একজন মানুষ এবং তারপর একজন নারী হিসাবে সাধারণ জ্ঞানের অংশ  স্বরূপ নারী-পুরুষ শারীরবৃত্তীয় আকর্ষণের ক্ষেত্রে স্তন, নিতম্ব, আঁখিযুগল, ক্ষীণকটিদেশ, সুডোল বাহু ইত্যাদির ভূমিকা একেবারে যে জানি না, তা তো নয়! একটি পত্রিকায়  প্রকাশিত নিবন্ধে একজন প্রশ্ন করেছেন দেখলাম, সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বাদ দিয়ে চুলের মতো মৃতকোষে গিয়ে নারীর সমস্ত শারীরবৃত্তীয় আকর্ষণ জমা হওয়ার কনসেপ্ট  কীভাবে যৌক্তিকতা পেলো, তিনি জানতে আগ্রহী। একেবারে কি ফেলে দেবার মতো  প্রশ্ন?

আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় কিছু অতি পরিচিত মহিলার হিজাব পরার কারণ আমাকে বিস্মিত করেছে। একজন পরিচিত বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার ও বর্তমানে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মহাপরিচালক মহিলা, তাঁর মাথার চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে বলে শাড়ি ছেড়ে  শার্ট-প্যান্টের সাথে হিজাব পরা শুরূ করেছেন, একথা নিজেই বলেছেন আমাকে। নিকটাত্মীয়া একজন সুগৃহিণীকেও দেখেছি, মাথার চুল উঠে প্রায় টাক পড়ার উপক্রম   হওয়ায় বাসায় সারাক্ষণ ওড়নায় মাথা ঢেকে রেখে অতি পর্দানশীন হিসাবে সুনাম কুড়োচ্ছেনতাঁর ৯ বছর বয়সী মেয়েও বাসায় সারাক্ষণ হিজাব পরে থাকে। অথচ  সেই বাসায় সারাদিন মা এবং দু'জন কাজের মেয়ে ছাড়া আর কোনো জনমানব নেই।  তাহলে পর্দা কার জন্যকার সামনে?... না, কোনো প্রশ্ন তুলে বিরাগভাজন আমি হইনি সেখানে।

এবার আসি আমার বর্তমান নিবাস নিউজিল্যান্ডের ডুনেডিন শহরে বাংলাদেশী মহলে  পর্দাপ্রথা প্রসঙ্গে। একজন হিজাবী মহিলা কয়েক মাস আগে বাংলাদেশ থেকে এসে মহিলাদের আসরে জ্ঞান বিতরণ করা শুরু করলেন, "স্বামী এবং স্ত্রীর পরস্পরের  সামনে ছাড়া কোনো উত্তম পোশাক পরিধান করা শরিয়ত বিরোধী। যতদূর সম্ভব মলিন বেশে তাই বাইরে যাওয়া উচিত। একজন পি এইচ ডি ডিগ্রীধারী হিজাবী  মহিলা আরো সম্যক জ্ঞানলাভের জন্য জিজ্ঞাসা করলেন, "কোরআন শরীফের ঠিক কোথায় এ ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যাবেপ্রথমোক্ত মহিলা উত্তর দিলেন, "কোরআন যথেষ্ট নয়, তাফসীর পড়তে হবে আমাদের"অথচ পোশাক পরিচ্ছদ সম্পর্কে কোরআনের কোথাও মলিন পোশাক পরার নির্দেশ আমি খুঁজে পাইনি। বরং পরিচ্ছন্ন পরিচ্ছদের পাশাপাশি সুগন্ধি, অলংকার এসবও পরা জায়েজ, মহিলাদের জন্য বলা   আছে। এমনকি পুরুষদের জন্যও উত্তম পরিচ্ছদ, সুগন্ধি, একটি সরু চেইন-এর মতো  অলংকার চাইলে ব্যবহার করতে পারবেন, বলা আছে। আমি কিছু না বলে নীরবে  শুনছিলাম কথোপকথন। হঠাৎ কী মনে হওয়ায় জিজ্ঞেস করলাম, "ভাবী, আপনি যে  এই লাল হলুদ উজ্জ্বল রঙের শাল পরে আছেন, সেটা তো অন্য পুরুষরাও দেখছেন!"  তিনি বললেন, "বাংলাদেশ থেকে আসার সময় একমাত্র এই শালটাই হাতের কাছে ছিল"। কিন্তু তাঁর বিবৃতির সাথে কি মিললো তাঁর পরিচ্ছদ? সম্ভবত  এই তাফসীরটি তাঁর স্বামীর বয়ান। কিন্তু, ইসলাম কারো ড্রইংরুমে উদ্ভাবিত  জীবনাচরণ নয়। আমার মা তাঁর ছেলেবেলার গ্রামের পাঠশালার এক শিক্ষকের কথা গল্প করতেন, যিনি বলতেন, "আমার নসীহত মানবা, আমার খাসিলত না" এটাও হয়তো সেইরকম বিষয় হবে!

মসজিদে এবং কিছু সামাজিক অনুষ্ঠানে আমি কখনো নামাজ পড়তে গেলে দেখি, কিছু দেশী-বিদেশী হিজাবী মহিলা আমার মাথা ঢাকার স্কার্ফ বা কাপড় এমন পুলিশী ভঙ্গীতে ঠিক করতে থাকেন, মোটামুটি দূরবীন লাগিয়ে খোঁজার চেষ্টা করেন, কোথাও কোনো চুল বের হয়ে আছে কিনাসেটা বিব্রতকর হলেও আমি নীরবতা অবলম্বন করি। এরকম ইসলাম রক্ষাকারী পাহারাদার হিসাবে উনারা কিছু বেশী মানসিক শান্তি অথবা সোয়াব যদি লাভ করেন, আমার তো ক্ষতি নেই তাতে। বরং পূন্যকাজে বাঁধা না দেওয়াই উত্তম।

কিন্তু, মোটামুটি শিক্ষিতা, একটি সংসার পরিচালনায় সক্ষম, দেশী-বিদেশী ৭/৮ টি প্রতিষ্ঠানে চাকরীর অভিজ্ঞতা সম্পন্ন আমি যে একটা স্কার্ফ, ( তাও অধিকাংশ সময়ে একেবারে মাথা ঢাকার তাৎক্ষণিক রেডিমেড ডিজাইন এ প্রস্তুত, মসজিদে এরকম স্কার্ফ মসজিদ থেকেই সরবরাহ করা হয় এখানে)তো সেই সহজসাধ্য পোশাকটি যে আমি নিজে ঠিকমতো পড়তে জানি না,এই ধারণা উনারা পান কোথা থেকে আল্লাহমালুম। কিংবা হতে পারে উনা দের মতো নিয়মিত স্কার্ফ পড়ি না বলে আমাকে খাটো অথবা বিব্রত করার একটা কৌশল উনাদের এবং এইসকল অতি উতসাহী আচরণ এভয়েড করার জন্য আমি বিব্রতবোধ করিও মসজিদে পা রাখতে। হায়, ভগিনীগন, উহাতে আপনাদের সোয়াবের পরিমাণ কমিয়া যাইবে না তো?







0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন