কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১৬

জিনাত রেহেনা ইসলাম

মেয়েখেলা (পর্ব ৩)






জীবনের যে সংগ্রামে আমাকে প্রায় হাত ধরে পথে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাতে আমি হঠাৎ ক্লান্ত বোধ করতে থাকি। মনে হতে থাকে আমি কেন এমন করে নিয়ন্ত্রিত হব? আমার কালো রঙের ঐতিহাসিক বঞ্চনা, সমাজ ভাবনা, আমার অনিশ্চিত বিবাহ না হবার সম্ভাবনাময় অদৃষ্টের গল্প কেন শুনব সকলের কাছে? এইবারে শুরু হয় দ্রোহ। আমার বিবেচনা, সততাকে আমি পথের পাশে ফেলে রেখে এগিয়ে যেতে থাকি সামনে আসা সব রাস্তাই আমার কাছে রাজপথ হয়ে ধরা দেয়। আমার সেই হাদিস খ্যাত দুধের স্বপ্নময় রাস্তা দিয়ে বেহেস্ত যাত্রার পথে আমি নিজে কাটা দিয়ে সেই চুলের রাস্তা ধরে এগোবার কথা অনায়াসেই হজম করে ফেলি। ধর্মীয় সব শিক্ষাই আমার কাছে খুব হাস্যকর হয়ে ওঠে। আল্লাহ পরমজ্ঞানী এক ও অদ্বিতীয় ও কোরান অভ্রান্ত, এমন  ইঞ্জেকেটেড আইডিয়া বা বিশ্বাস আমি পারিবারিক সুত্রে বহন করতে বিরক্ত বোধ করি। টুপি পরা প্রায় সব মানুষদেরই আমার এলিয়ন বা ছদ্মবেশী মনে হতে থাকে। গায়ে ওড়না জড়াতে আমি অস্বীকার করি। মাথার চুল ঢেকে রাখার বিধি আমার কাছের খুব অশ্লীল মনে হয়। আমার মামা-কাকা বা ধরিত্রীর যাবতীয় পুরুষ সব আত্মীয় বা অনাত্মীয় মহিলাদের চুল দেখে তাদের ইন্দ্রিয় জাগ্রত করে শরীরে শান দেয়, এটা ভেবে মাথা ঢেকে রাখার অসাড় তত্বে আমি ঘৃণায় সিটিয়ে যেতে থাকি। দাদুর কাছে শোনা ধর্মীয় সব গল্পই রূপকথার চেয়েও অবিশ্বাস এনে দেয় মনে। ইসলাম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান, এই কথা দাদু একদিন গর্বভরে শোনালে তার সঙ্গে এক অলিখিত দূরত্ব বেড়ে যায় আমার। পৃথিবী ধ্বংসের পরও ইসলাম থাকবে, এমন অবৈজ্ঞানিক ভাবনা আর গায়ের জোরে প্রতিষ্ঠার তর্ক আমাকে ধর্মবিমুখ করে তোলে। অবিশ্বাস্য কিছুকে বিশ্বাস বা প্রশ্রয়ের নাম যদি ইসলাম হয়, তবে সেই বিশ্বাস  জেনারেট করা আমার ক্ষমতার বাইরে। তাছাড়া শিক্ষা বা যুক্তির দর্শন যেখানে কোনো মূল্য রাখে না, সেখানে আর কতক্ষ মাথা নাড়া যায় পাগল বা অবিবেচকের  তো ইসলামের প্রচারক হজরত মহাম্মদের প্রতি সকলের অগাধ শ্রদ্ধা আমাকে বিস্মিত করে। নবীসাহেব আসলে একজন জ্যান্ত মানুষ ছিলেন এইটি জানার পর তো আমি আরও আশ্চর্য হয়ে উঠি। একজন মানুষের উপর এমন দেবত্ব আরোপ করা ও তাকে অভ্রান্ত বলে অসাধার বিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে তার একাধিক বিবাহের পক্ষে যুক্তি  খাড়া করা, আমার কাছে খুব বিরক্তিকর ঠেকতে থাকে। কোনো আদিমতম কারণে আধুনিক সভ্য মানুষ যে পলিগ্যামির স্বপক্ষে যুক্তির উপস্থাপনা করে, সে মূর্খ, নয় সে ধর্মান্ধ ছাড়া কিচ্ছু হতে পারে না। তবে একটি জাতি কত শতাব্দী মূর্খ বা ধর্মান্ধ থাকতে পা্রে ভেবে বিস্মিত হতে থাকি।



ইতিহাস নিয়ে পড়ার সুবাদে আমি বুঝি, বিশ্বাসের সঙ্গে ইতিহাসের তেমন কোনো  সম্পর্ক নেই। থাকলে একজন রামমোহন ইসলামের জগতে নিশ্চিত আবির্ভূত হতেন অন্ধত্ব বা গোঁড়ামির বিরুদ্ধে একমাত্র শিক্ষাই রুখে দাঁড়াতে পারে। কলেজের শুরুতে  আমি স্কার্ট পড়লে দেখি পাড়ার টুপিওয়ালা চোখ একটু বেঁকিয়ে দৃষ্টিপাত দেয়। ওড়না ছাড়া মুসলিম নারী বক্ষদেশ তথাকথিত ধার্মিকদের বিব্রত করে। প্রচার বাড়ে ইসলাম  সাহেবের মেয়ের পোশাক আশাক একদম ভালো নয় ধীরে ধীরে পোশাক শব্দটি উঠে যায়, ইসলাম জনশ্রুতির আকার নেয় ‘মেয়েটি ভালো নয়’ তখন আমার কোনো পুরুষবন্ধু বা বা প্রেমিক ছিল না নিরীহ ছিলাম একদম। মহল্লার হর্তাকর্তা, বকলমে মস্তানদের আস্তিনে বেড়ে ওঠা চামচারা মাঝে মাঝে আমায় দেখলে আফ্রিকা! আফ্রিকা! বলে চিৎকার করত। এক রকমের ইভটিজিমের শিকার ছিলাম আমারই মুসলিম মহল্লায়। বাবাকে সাহায্যের জন্য বিরক্ত করিনি। মেনে নিয়েছিলাম এটি অদৃষ্ট বলে কিন্তু সারাদিন দলবেঁধে যে মানুষগুলি ধর্ম প্রচার করেন ও আল্লাহর সততার জিকির করে বেড়াতেন, তারা কিন্তু কখনো জানেননি, একটি মেয়ে নিগৃহীত হচ্ছে সো কল্ড বিধর্মীদের হাতে, মদত করেছে ইসলামের বান্দারা তাদের বিরুদ্ধে জেহাদের গল্প শোনানো যায়, কিন্তু প্রকৃত যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াইয়ের বদলে বেশির ভাগ টুপি আড়ালই খোঁজে ইভটিজিংএর বিরুদ্ধে ইসলামে কোনো ব্যাখ্যা নেই, হাদিসে কোনো সুরা নেই;  থাকলে আমি কি সুবিচার পেতাম না?


পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অমুসলিমকে বিবাহ করলে আমি পাকাপাকিভাবে ‘খারাপ মেয়ে হয়ে  উঠি। প্রচার এবারে আরও সংহত হয়। মিলাদ বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আমরা কম নিমন্ত্রিত ছিলাম, এবারে একদম অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ি। আমার জিন্স পরা খারাপ শব্দটায় আরেকটি মাত্রা যোগ করে। আমার পোশাকের প্রাচুর্য হিজাব পরিহিত মহিলাদের মুখে ‘প্রস’ শব্দের আমদানি করে। শুনি একজন অর্ধশিক্ষিত কিন্তু নিজেকে বি.এ পাশ দাবী করা মহিলা বলছেন, একদম ‘প্রসের’ মতো ড্রেস করে। ইংরাজী এমন বাংলার রূপ নিয়েছে, সেদিন জানতে পারি। এই আমাদের সামাজিক জ্ঞান। পুরুষের একাধিক বিবাহ ও তালাককে ধর্মের নামে, হাদিসের নামে চালিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ নেই, যুক্তি আছে কিন্তু একটি মেয়ের পোশাকের সঙ্গে পুরুষের  অর্থের কাল্পনিক যোগসূত্র স্থাপনের মানসিক বিকৃতি বা ভাবনাকে মদত দেবার হাজার মানুষ আছে। পোশাক পুরুষের উদ্দেশ্যে নিবেদিত নৈবেদ্য, এই আস্বাভাবিক অসত্যকে কে প্রতিষ্ঠা করেছে, কে জানে! মেয়ে সাজলে সে প্রস, তার গাড়ি থাকলে তার প্রেমিকের দেওয়া, বাড়ি থাকলে সে কারো কাছে আদায় করেছে, এমনটা বলতে মানুষ খুব পছন্দ করে তার পর মুসলিম হলে তো সে পরেজগার নয় বলে নানা গঞ্জনা।

বাবা ছোটবেলায় বোঝাবার চেষ্টা করতেন, সন্ধ্যে মানে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে  ভালো মেয়েদের বাড়িতে প্রবেশ করতে হয় বহির্মুখি হলে চলবে না। সেই কারণে  বিকেলে মাঠে খেলতে যাওয়া বা যোগাসন প্রতিযোগিতায় নাইট ষ্টে করতে হবে বলে  যোগদান করা নিষেধ। তার এই শিক্ষা ধর্মীয় নাকি নৈতিক জানি না, কিন্তু এটা আমি নিতে পারিনি। মেয়েদের আদর্শস্থান রান্নাঘর, ছোট থেকে তাই জানানো হয়েছে। একটু বেশি কথা বললেই বাবা মাকে বলতেন যাও! রান্নাঘরে যাও!মা, বাবার বাবা মানে দাদু আমাদের বাড়ি এলে মাথায় কাপড় না দিলে রীতিমত বকা খেতেন দেখেছি। বাবা একজন শিক্ষিত মানুষ ছিলেন, কিন্তু ধর্মীয় সংস্কারের উর্ধে নিজেকে তুলতে পারেন নি। যদিও কখনো তিনি রোজা করতেন না, কেননা তিনি চেন স্মোকার ছিলেন। ইসলামে মদ হারাম, তাই নৈতিক কার ছাড়াও মদ্যপানকে তিনি ঘৃণা করতেন। তাছাড়া তেমন ধর্ম মানতে দেখিনি, কিন্তু বিধি থেকে মাকে মুক্তি দেন নি, এটি স্পষ্ট জানতাম। বাবা আমায় শেখানোর ছলে বলতেন, একাধিক পুরুষের সাথে শয্যা শেয়ার করা হারাম। আমি কখনো তাসও খেলিনি হস্টেলে, কেননা বাবা সেটা জানতেন না। বাবার সব আদর্শকে আমি জীবনে নিয়েছিলাম, কিন্তু বাবা মেয়েদের প্রতি উদার ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন, একজন মহিলার কাছে স্বামীই শেষ কথা। যেমন বিশ্বাস করে আমার স্বামী। পেশায় ডাক্তার হয়েও সে বিশ্বাস করে,  মহিলা মা হয়ে গেলে তার লিপষ্টিক বা লাইনার বা সাজগোজের প্রয়োজন নেই। তার উচিত সন্তান পালন করা। নিজের মেক ওভার নিয়ে ব্যস্ত থাকা, মানে তৃতীয় কিছুর সন্ধান করা।



সিনেমায়, রাস্তা-ঘাটে, পরিবারে হামেশাই একটু সাদামাটা চলনের বাইরের মেয়ে নিয়ে এক কথা। বস্তিতেও সেই এক ভাষা। আরে সেই মেয়েটা পাক্কা ষ্ট্রিট, হোড়, একদম খানকি! যে পেশারই মেয়ে হোক সে একটু বেশি কথা বললে বা বেশি হাসলে বা ডেস্পারেটলি তর্ক করলে বা পুরুষ সঙ্গী বদলালে, সেই এক ইঙ্গিত। অথচ পুরুষরা   হেসে বলে থাকে, এক পাতে কি খাবার খাওয়া যায় সারাজীবন? একটু বদলাতে তো   মন চায়!’ এটি একটি প্রচলিত জোক মানে সে স্ত্রীর বাইরে দূরে কোথাও হায়ার্ড  ওম্যান চায় এবং সেটা প্রকাশ্যে বলতে তার দ্বিধা নেই কেননা তাকে কোনোদিন হোড় বা বেশ্যা বলা হবে না। সেটা তার জন্য নট আপ্লিকেবল যুগ যুগ ধরে। আমি এর তীব্র বিরোধীতা করিপয়সার বিনিময়ে শরীর দেওয়া যদি বাধ্যতা হয়, তবে শরীরের কারণে পুরুষের বেশ্যা বিলাসিতাও একই ধরনের নোংরামি। আর এই শব্দটার প্রয়োগে একটি মেয়ের চূড়ান্ত অসম্মান ভেবে নারীদের দিকে তা ছুড়ে দেওয়া চরম নির্লজ্জতা। একজন অসহায় অপরাধীর কাঠগড়ায়; কিন্তু আরেকজন অপরাধী  অভিযুক্ত হবার বদলে অভিযোগের নিশানা খোঁজার ও শাস্তি দেবার নেতৃত্বের মাথায় অবলীলায়। বিপন্নতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কেউ নেই। কেননা মেয়েদের রেটিংএ সব মানুষ, অমানুষ সকলেই দর্শক নয়, বরং অভিনেতার ভূমিকায়।
                 



4 কমেন্টস্:

  1. তোমার সহসের বলিহারি। এত পরিষ্কার ভাবে মন উজাড় করা মেয়েদের দুঃখের কথা কাউকে বলতে দেখিনি। কিন্তু একই সাথে কোথাও চাপাতির শব্দ শুনতে পাচ্ছি। খুব খারাপ লাগছে। (Y)

    উত্তরমুছুন
  2. SALUTE জিনত!!
    শ্রাবণী...

    উত্তরমুছুন