কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

নভেরা হোসেন

বৃক্ষ

এ শহর ধোঁয়ায় আকীর্ণ মেট্রোপলিটন কতকাল আর পাহারা দেবে যক্ষের ধনের মতো কীটের শরীর? বৃক্ষটি দীর্ঘদিন ধরে সাতমসজিদ রোডের মাঝখানে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। বৃক্ষটির শীর্ষদেশ একটু সূর্যের দিকে হেলানো। মনে হচ্ছে সবটুকু রোদকে শুষে নিতে চায় সে। এজন্য তাকে নানা কসরৎ করতে হয়েছে শরীরের অবিভাজিত  অংশটিকে চিরে বের করতে হয়েছে নরম শাখা-প্রশাখা। এই গজিয়ে ওঠা ডালপালা তাকে ক্রমশ এক পরিপূর্ণ বৃক্ষে পরিণত করেছে। শহরে প্রচণ্ড ঝড় উঠলে বৃক্ষটি তার সমস্ত শক্তি নিয়ে অবিচল দাঁড়িয়ে থাকে। কখনো কখনো বৃষ্টির অঝোর ধারায় ভেসে যায় তার পত্রমঞ্জরি। আকাশে যখন ঝকঝকে রোদ তলোয়ারের মতো ঝিলিক দিতে থাকে তখনও সে দাঁড়িয়ে থাকে উদ্ধত ভঙ্গিতে, যেন স্বয়ম্বরা। রোদরাস্তা পেরোতে  গিয়ে বহু পথিক আশ্রয় নেয় বৃক্ষের ছায়ায়। এই শহরে যত কাক আর চড়াই দেখা যায়, তাদের জ্ঞাতিজনরা এসে ঘর বেঁধেছে বৃক্ষটির শরীরে। পাখিদের কলতানে ভরে   ওঠে ভোরের বাতাস। তখনও শহরের মুদ্দাফরাশ জেগে ওঠেনি, তার আগেই কিচকিচ করতে করতে পাখিরা বেরিয়ে পড়ে খাদ্যের সন্ধানে। বাসন্তিক ঘূর্ণির সাথে উড়ে যায় শুকনো পাতারা। এভাবে দিন গড়িয়ে গড়িয়ে শহরের শান্ত রূপটি হঠাৎ করেই একদিন বদলে যায়। রাশি রাশি গাড়ির হর্ণে বৃক্ষটি হয়ে পড়ে স্পন্দনহীন, তার বুকের ভেতর শুরু হয় হৃদকম্পন, শহরের কোলাহল বাড়তে শুরু করলে বৃক্ষটি হয়ে পড়ে বন্ধুহীন। তার পত্রশাখায় বাসা বেঁধেছিল যে সকল বৃক্ষচর, ধোঁয়ার গন্ধে তাদের হৃদযন্ত্র ঝাঁজরা  হয়ে গেলে ক্রমশ তারা তাকে ছেড়ে চলে যেতে থাকে। গ্রীষ্মের গনগনে গরমে রাস্তার পিচ গলতে শুরু করলে বৃক্ষটি খুব নাজুক হয়ে পড়ে, তৃষ্ণায় তার বুকের ছাতি ফেটে যায়, তবু একবিন্দু জলের দেখা সে পায় না। শহরের মাংসাশী নাগরিকেরা শুষে  খেয়েছে মৃক্তিকায় সমস্ত জলকণা। এরকমভাবে চলতে চলতে বৃক্ষটি একদিন খুব বিষণ্ন  হয়ে পড়ে, তার চারপাশে যে সকল তৃণগুল্ম ছিল, তারা সব শুকিয়ে মরে যেতে  থাকে। শহরে দাবানলের মতো হল্কা দেখা দেয় এসময় শহরবাসীরা বলাবলি করতে থাকে, ভি আই পি রোডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বৃক্ষটি রাহুর মতো শহরটাকে গিলে খেতে চায়। আবার অনেকে বলাবলি করে এরকম একটা পয়মন্ত বৃক্ষ আছে বলেই শহরটি এখনও টিকে আছে, না হলে কবেই দম বন্ধ হয়ে মরে যেত।  এসব টানাপড়েনের মধ্যে বৃক্ষটি দিন দিন নুয়ে পড়ে তার শরীর থেকে খসে পড়ে ছাল-বাকল, পাতারাও শুকিয়ে যায়। শহরবাসী এসময় বৃক্ষটির পায়ের কাছে গোল চিহ্ন এঁকে দেয়, যেন সে আটকে থাকে গোলকের ভেতর, যেন তার দম্ বেরিয়ে না যায়। হার্বেরিয়াম থেকে উদ্ভিদ চিকিৎসক আসেন মোটা সিরিঞ্জ হাতে। তিনি এসেই সুঁই ফুটিয়ে দেন বৃক্ষের শরীরে। ফলে বৃক্ষটি বেঢপ ফুলে ওঠে, তার কাণ্ড চুঁইয়ে  পড়তে থাকে গলিত রস। ক্রমশ দিন যেতে যেতে বৃক্ষটি নির্জীব হয়ে পড়ে, এসময় তার বাঁচবার ক্ষীণ আশাও লোপ পায়। শহরবাসী প্রাচীন বৃক্ষটির জীর্ণ রূপ দেখে মুষড়ে পড়ে, বৃক্ষটি সম্বন্ধে তারা আর কোনো স্বপ্ন দেখে না। এভাবে ধীরে ধীরে সবাই তার কথা ভুলে যেতে থাকে। এমন কী সে নিজেও হাল ছেড়ে দেয়। একদিন সামান্য ঝড়ো বাতাস বয়ে গেলে বৃক্ষটি ভূপতিত হয়। তার পতনের শব্দে কম্পিত হয় ব্যস্ততম এভিনিউ সকলে কিছুক্ষণের জন্য থমকে দাঁড়ায়। শহরবাসীর মনে বৃক্ষটি র  প্রতি যে ভালোবাসা ছিল, তা যেন হঠাৎ প্রকাশিত হয়ে পড়ে, তারা বৃক্ষটির সৎকারের ব্যবস্থা করে। অতঃপর তারা বৃক্ষটির জন্মস্থানে একটি কারুকার্যময় মনুমেন্ট স্থাপন করে, যার শরীর ফুঁড়ে গজিয়ে ওঠে না আর কোনো সবুজ বৃক্ষ।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন