কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২২ জুলাই, ২০১৬

অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

লেখার বয়স





ফেসবুকে এক ঘনিষ্ঠ কবি পোস্ট দিলেন, ‘...লেখার জগতেও এই নিয়ম চালু করা হোক। সত্তর বছরের পরে লেখালেখি বন্ধ। অন্তত প্রকাশ করা যেন না হয়। নিজের খাতায় যত খুশি লিখুন। কেমন হয়?’ সেই পোস্টের উত্তরে আমি কিছু কমেন্ট করেছিলাম। কোনো কোনো প্রিয় বন্ধুকবির এবং স্বয়ং পোস্টকারিনীর তা পছন্দও হয়েছিলকিন্তু তাতে আমার কথাটাও ফুরোয়নি, আর নটে গাছটিও মুড়োয়নি। সেই ‘না বলা বাণীর ঘনযামিনীর’ জন্যে আমার কালিমাটিকথনবিশ্বের আশ্রয় নিতে হলো। সেটাই এবারের বিষয় আমরা যারা অল্পবিস্তর  সমাজবিজ্ঞান ঘাঁটাঘাঁটি করি, মানে ভালো কথায় চর্চা করতে করতে খর্চা হয়ে যাই, তারা অবশ্য প্রথমেই প্রশ্ন করবে ‘লেখালেখি’ বলতে কী বলা হচ্ছে! মানে  কোন ‘জনরা’-র লেখালেখি! কেবল কবিতা, গপ্প, উপন্যাস; নাকি তার সঙ্গে   প্রবন্ধ, বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন ধরনের? তা ছাড়া কোন কিসিমের লেখকের কথা  ভাবা হচ্ছে! তা নিয়ে একটু ভাবা যাক।


প্রথমেই ভাবা যাক এই ধরনের চিন্তা বাঙালির মাথায় এত আসে কেন! আদ্যন্ত  রোম্যান্টিক বাঙালি যাকে রবীন্দ্রনাথ ‘প্রতিভার গৃহিণীপনা’ বলতেন, আর সেটা দীর্ঘজীবী প্রতিভাদেরই হয়, সেটা পছন্দ করেন না। মানে কোনো সৃষ্টিশীল মানুষ, লেখক, বিশেষ কবি, বহুদিন বাঁচবেন, বিকশিত হবেন, বিষ্ণু দের ভাষায়  ‘সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো’ ছড়িয়ে দেবেন, তাঁদের অত পছন্দ নয় বাঙালির। তাদের অনেকের মডেল আমাদের বাল্যকালে দেখেছি রবীন্দ্রনাথের থেকে মাইকেল, ম্যয় নজরুল। পরে বেশ কিছুর মনে দেখেছি সত্যজিতের চেয়ে ঋত্বিকের আসন উঁচু। কবিদের ক্ষেত্রে মাইকেল ছাড়াও সুকান্ত, সমর সেন, এমন কী সাগর  পারের র‍্যাঁবো ম’রে বা না ম’রে যৌবনে লেখা থামিয়ে দিয়ে বাঙালির মনে লেখার বয়স এক জায়গায় বেঁধে দিয়ে গেছেন। সমর সেনের লেখা বন্ধ করার আগের দুটি লাইন, ‘যৌবনের প্রেম শেষ প্রবীণের কামে, / বছর দশেক পরে যাবো কাশীধামে’, তাই এত বাঙালির এত প্রিয়। এর সঙ্গেই আরো একটা ব্যাপার গেঁথে আছে তাঁদের মনে। সেটা হলো — বেশি লেখা ভালো নয়।


কিন্তু এসব কথা না তুলে, এতশত না জিগিয়ে আমি ভেবেছিলাম এই সত্তর বছর হওয়ার আগে লেখা বন্ধ হওয়ার নিয়ম চালু হ’লে পৃথিবীর কী, মানে কতখানি ক্ষতি হতো! লেখক কবি তো একরকমের নয়! কেউ কেউ ছিলেন যাঁরা তাঁদের  জাতীয় সভ্যতার প্রতীক ছিলেন, যাঁদের আগেকার দিনের মাস্টারমশাইরা কেলাসে শেখাতেন ‘যুগন্ধর’ — ইংলণ্ডের শেক্সপীয়ার, ইতালির দান্তে, জর্মানির গ্যয়টে, ফ্রাঁসের বিত্তর উগো, রাসাঁ-মলিয়ে (Racine, Molière সত্ত্বেও), রাশিয়ার টলস্টয়, কেউ বলবেন ডস্টয়েভস্কি, আর বাংলায়-ভারতে আমি বলব রবীন্দ্রনাথ। এঁদের আবার লেখার বয়স কী? দুঃখের কথা দান্তে (১২৬৫-১৩২১), শেক্সপীয়ার (১৫৬৪-১৬১৬), রাসাঁ (১৬৩৯-৯৯), মলিয়ে (১৬২২-১৬৭৩), ডস্টয়েভস্কি (১৮২১-১৮৮১) সত্তর পেরোননি, আগেই কেটেছিলেন। কিন্তু উগো (১৮০২-১৮৮৫), টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০), আর আমাদের ‘ঘরের জামাই মেধো’ রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) তো তিরাশি, বিরাশি আর আশি অবধি ব্যাট করেছিলেন। তাঁদের ক্ষেত্রে লেখা বন্ধ করলে কী হতো? সাতষট্টি বছরে ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত হয় L'Homme Qui Rit (যে লোকটা হাসে), যাতে উগো ফরাসি অভিজাত শ্রেণিকে ব্যঙ্গ করেছিলেন, কিন্তু ১৮৭৪-এ বেরোয় তাঁর Quatre-vingt-treize(তিরানব্বই), যাতে তিনি একটা বিষয় নিয়ে লেখেন, যাকে তিনি অদ্যাবধি  এড়িয়ে চলেছেন। সেটা হলো ফরাসি বিপ্লবের সময় ‘রেইন অভ টেরর’-এর জীবন্ত বর্ণনা। তখন উগোর জনপ্রিয়তা ‘কমতি’-র দিকে। কিন্তু এই দুটি উপন্যাস পরস্পরের পরিপূরক, আর অনেকের মতেই শেষ-কুড়ুন্তি লেখাটি তাঁর আগের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলির এক পদের, যেটা তাঁর খ্যাতিকে আবার ‘বাড়তি’-র দিকে নিয়ে যায়। সত্তরের আগে দাঁড়ি টানলে গ্যয়টের Marienbad Elegy (১৮২৩-কবিতা) আর Faust Part Two ( ১৮৩২ নাটক) ছাড়াও আরো খান চারেক বই বাদ  যেত। টলস্টয়ের অবশ্য Resurrection (১৮৯৮) ছাড়া বেশি কিছু বাদ যেত না শ্বেতদ্বীপের  বেশি বাঁচা জর্জ বার্নার্ড শ-র (১৮৫৬-১৯২৬) বাদ যেত The Intelligent Woman’s Guide to Socialism (প্রবন্ধ), ছাড়াও Apple Cart (১৯২৮), The Millionairess (১৯৩১-৩৪ ), Village Wooing (1933),  On the Rocks (১৯৩৩), The Simpleton of Unexpected Ideas (১৯৩৪), The Six of Calais (১৯৩৪), Arthurand the Acetone (১৯৩৬), Cymbeline Refinished (১৯৩৬), Short Stories, Scraps, and Shavings (ছোটগল্প ও নাটিকা), Geneva (১৯৩৬), Pygmalion (পর্দার জন্য লেখা নাটক, ১৯৩৭-৩৮) In Good King Charles’s Golden Days (১৯৩৮-৩৯), Buoyant Billions (১৯৩৬-৪৭), Farfetched Fables (১৯৪৮), Shakes versus Shav (পুতুল নাটক ১৯৪৯), Why She Would Not (১৯৫০ নাটক),   প্রবন্ধ ইত্যাদি সব মিলিয়ে একতিরিশখানা বই কেননা অশ্বের গতিতে লিখতেন শ। দীর্ঘজীবী বারট্রাণ্ড রাসেল (১৮৭২-১৯৭০) সাহিত্যে নোবেল প্রাইজ পেলেন তাঁর আটাত্তর বছর বয়সে, ‘in recognition of his varied and significant writings in which he champions humanitarian ideals and freedom of thoughtতবে তিনি প্রথম গল্পগ্রন্থ ছাপালেন একাশি বছর বয়েসে, Satan in the Suburbs and Other Stories(১৯৫৩) পরের বছর বেরোল, Nightmares of Eminent Persons and Other Stories তিয়াত্তর থেকে সাতানব্বই পর্যন্ত তাঁর প্রবন্ধ বইয়ের সংখ্যা সংখ্যা এই দুটিকে নিয়ে মাত্র ঊনত্রিশ। তাদের অনেকগুলোই বিখ্যাত, পৃথিবীর মানুষের সম্পদ। 


বিদেশে শ আর রাসেল-এর পর সবচেয়ে বেশি খাঁড়া পড়ত অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের উপর। বাংলা এম.এ., বাংলার অনার্সছাত্রদের হতো পোয়াবারোবুড়ো কিছুতেই ছাড়বে না। সত্তরের পর বেরোল শাপমোচন, রাশিয়ার চিঠি, নবীন, বনবাণী (১৯৩১); পরিশেষ, পুনশ্চ, কালের যাত্রা (১৯৩২); চণ্ডালিকা, তাসের দেশ, বাঁশরী (১৯৩৩); মালঞ্চ, চার অধ্যায়, শ্রাবণ গাথা (১৯৩৪); বীথিকা, শেষ সপ্তক(১৯৩৫); শ্যামলী, পত্রপুট, ছন্দ (১৯৩৬); বিশ্বপরিচয়, খাপছাড়া, কালান্তর, সে, ছড়ারছবি (১৯৩৭); সেঁজুতি, বাংলা ভাষা পরিচয়, প্রান্তিক ((১৯৩৮); শ্যামা, প্রহাসিনী, আকাশ প্রদীপ (১৯৩৯); নবজাতক, সানাই, রোগ শয্যায়, তিন সঙ্গী, ছেলেবেলা (১৯৪০); সভ্যতার সংকট, জন্মদিনে, আরোগ্য, গল্পসল্প(১৯৪১)। এঁর লেখা সত্যি সত্যি বন্ধ করলে এই জঞ্জালগুলো থাকতো না।
আর কী ভালোই যে হতো পৃথিবীর সত্তরে লেখা বন্ধ হলে তা আরেক অত্যুৎকৃষ্ট উদাহরণ বোধহয় পরশুরাম। বুড়ো পঞ্চাশে লেখা শুরু করেছিলেন বলে বাহাত্তরেও থামতে চাননি। উনি সত্তরে থামলে আমরা পেতাম কেবল চলন্তিকা (১৯৩৭),  গড্ডালিকা (১৯২২), কজ্জলী (১৯২৭) আর হনুমানের স্বপ্ন (১৯৩৭)নইলে গল্পকল্প (১৯৫০), ধুস্তুরী মায়া, কৃষ্ণকলি (১৯৫৩), নীল তারা, বিচিন্তা (১৯৫৫) আনন্দীবাই (১৯৫৭), চমৎকুমারী, মহেশের মহাযাত্রা, এই সব গল্পগ্রন্থই তো সত্তরে বা পরে, সত্বরে নয়। এমনকি মহাভারতের সারানুবাদ বেইরেচে সত্তরের একোণ বৎসরে!


আমার অতিপরিচিত খ্যাতনাম্নী কবি যশোধরা রায়চৌধুরী এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন। প্রসঙ্গ যোগ ক’রে সেটি এরকম।   ‘বালিগঞ্জের এক সাহিত্যসভায় রবিঠাকুরের কবিতা’ নিয়ে এক আলোচনাসভায় সভাপতি হিসেবে অমিত রায় বলেছিল
“কবিমাত্রের উচিত পাঁচ-বছর মেয়াদে কবিত্ব করা, পঁচিশ থেকে ত্রিশ পর্যন্ত। এ কথা বলব না যে, পরবর্তীদের কাছ থেকে আরো ভালো কিছু চাই, বলব অন্য কিছু চাই। ফজলি আম ফুরোলে বলব না, ‘আনো ফজলিতর আম।’ বলব, ‘নতুন বাজার থেকে বড়ো দেখে আতা নিয়ে এসো তো হে।’ ডাব-নারকেলের মেয়াদ অল্প, সে রসের মেয়াদ; ঝুনো নারকেলের মেয়াদ বেশি, সে শাঁসের মেয়াদ। কবিরা হল ক্ষণজীবী, ফিলজফরের বয়সের গাছপাথর নেই।... রবি ঠাকুরের বিরুদ্ধে সব  চেয়ে বড় নালিশ এই যে, বুড়ো ওঅর্ড্‌স্‌ওঅর্থের নকল করে ভদ্রলোক অতি অন্যায়রকম বেঁচে আছে। যম বাতি নিবিয়ে দেবার জন্যে থেকে থেকে ফরাশ  পাঠায়, তবু লোকটা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েও চৌকির হাতা আঁকড়িয়ে থাকে। ও যদি মানে মানে নিজেই সরে না পড়ে, আমাদের কর্তব্য ওর সভা ছেড়ে দল বেঁধে উঠে আসা। পরবর্তী যিনি আসবেন তিনিও তাল ঠুকেই গর্জাতে গর্জাতে আসবেন যে, তাঁর রাজত্বের অবসান নেই। অমরাবতী বাঁধা থাকবে মর্তে তাঁরই দরজায়। কিছুকাল ভক্তরা দেবে মাল্যচন্দন, খাওয়াবে পেট ভরিয়ে, সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করবে, তার পরে আসবে তাঁকে বলি দেবার পুণ্য দিনভক্তিবন্ধন থেকে ভক্তদের পরিত্রাণের শুভ লগ্ন। আফ্রিকায় চতুষ্পদ দেবতার পুজোর প্রণালী এইরকমই। দ্বিপদী ত্রিপদী চতুষ্পদী চতুর্দশপদী দেবতাদের পুজোও এই নিয়মে। পূজা জিনিসটাকে একঘেয়ে করে তোলার মতো অপবিত্র অধার্মিকতা আর কিছু হতে পারে না।... ভালো লাগার এভোল্যুশন আছে। পাঁচ বছর পূর্বেকার ভালো-লাগা পাঁচ বছর পরেও যদি একই জায়গায় খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে, বেচারা জানতে পারে নি যে, সে মরে গেছে। একটু ঠেলা মারলেই তার নিজের কাছে প্রমাণ হবে যে, সেণ্টিমেণ্টাল আত্মীয়েরা তার অন্ত্যেষ্টি-সৎকার করতে বিলম্ব করেছিল, বোধ করি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীকে চিরকাল ফাঁকি দেবার মতলবে। রবি ঠাকুরের দলের এই অবৈধ ষড়যন্ত্র আমি পাব্লিকের কাছে প্রকাশ করব বলে প্রতিজ্ঞা করেছি

যশোধরার উদ্ধৃতিতে আরো ছিলরবি ঠাকুরের ভক্ত আরক্তমুখে বলে উঠল, ‘ভালো জিনিস যত বেশি হয় ততই ভালো।’


অমিত বললে, ‘ঠিক তার উলটো। বিধাতার রাজ্যে ভালো জিনিস অল্প হয় বলেই তা ভালো, নইলে সে নিজেরই ভিড়ের ঠেলায় হয়ে যেত মাঝারি।... যে-সব কবি ষাট-সত্তর পর্যন্ত বাঁচতে একটুও লজ্জা করে না তারা নিজেকে শাস্তি দেয় নিজেকে সস্তা করে দিয়ে। শেষকালটায় অনুকরণের দল চারি দিকে ব্যূহ বেঁধে তাদেরকে মুখ ভ্যাংচাতে থাকে। তাদের লেখার চরিত্র বিগড়ে যায়, পূর্বের লেখা থেকে চুরি শুরু করে হয়ে পড়ে পূর্বের লেখার রিসীভর্স্ অফ স্টোল্‌ন্‌ প্রপার্টি। সে স্থলে লোকহিতের  খাতিরে পাঠকদের কর্তব্য হচ্ছে কিছুতেই এই-সব অতিপ্রবীণ কবিদের বাঁচতে না দেওয়া শারীরিক বাঁচার কথা বলছি নে, কাব্যিক বাঁচা। এদের পরমায়ু নিয়ে বেঁচে থাক্‌ প্রবীণ অধ্যাপক, প্রবীণ পোলিটিশন, প্রবীণ সমালোচক


আমি এটা জানতাম না তা নয়। কিন্তু এটা কোট করিনি কেবল ওর ফাঁদে  পড়ব না বলেই। নিবারণ চক্কোত্তি কিন্তু আসলে ওঁর অল্টার ইগো! ওকে দিয়েই বলিয়ে নিয়েছেন নিজের আরো লেখার দাবি শেষের কবিতা বইটিই তো এই দাবির প্রতিষ্ঠাপ্রয়াস! নিবারণ ওঁর নিজের গড়া ‘আদার’নইলে শেষের কবিতায়, তিনসঙ্গী-তে কল্লোল গোষ্ঠির, সবুজ পত্রের গুষ্টির তুষ্টি করারর পরও ওঁর নিজের গড়া আদার। নইলে শেষের কবিতায়, তিনসঙ্গী-তে কল্লোল গোষ্ঠির গুষ্টির তুষ্টিকী করুণ তা আর্তি! মৃত্যুর মাত্র তিন মাস চার দিন আগে, ৩রা মে ১৯৪১- শেষ লেখা বইতে এই কবিতাটিতে বলছেন

বাণীর মুরতি গড়ি
একমনে
নির্জন প্রাঙ্গণে
পিণ্ড পিণ্ড মাটি তার
যায় ছড়াছড়ি
অসমাপ্ত মূক
শূন্যে চেয়ে থাকে
নিরুৎসুক।
গর্বিত মূর্তির পদানত
মাথা ক'রে থাকে নিচু,
কেন আছে উত্তর না দিতে পারে কিছু
বহুগুণে শোচনীয় হায় তার চেয়ে
এক কালে যাহা রূপ পেয়ে
কালে কালে অর্থহীনতায়
ক্রমশ মিলায়।
নিমন্ত্রণ ছিল কোথা, শুধাইলে তারে
উত্তর কিছু না দিতে পারে
কোন্‌ স্বপ্ন বাঁধিবারে
বহিয়া ধূলির ঋণ
দেখা দিল
মানবের দ্বারে।
বিস্মৃত স্বর্গের কোন্‌
উর্বশীর ছবি
ধরণীর চিত্তপটে
বাঁধিতে চাহিয়াছিল
কবি
তোমারে বাহনরূপে
ডেকেছিল,
চিত্রশালে যত্নে রেখেছিল,
কখন সে অন্যমনে গেছে ভুলি
আদিম আত্মীয় তব ধূলি,
অসীম বৈরাগ্যে তার দিক্‌বিহীন পথে
তুলি নিল বাণীহীন রথে।
এই ভালো,
বিশ্বব্যাপী ধূসর সম্মানে
আজ পঙ্গু আবর্জনা
নিয়ত গঞ্জনা
কালের চরণক্ষেপে পদে পদে
বাধা দিতে জানে,
পদাঘাতে পদাঘাতে জীর্ণ অপমানে
শান্তি পায় শেষে
আবার ধূলিতে যবে মেশে

কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়ে ‘নবজাতক’ কবিতায় আবার বলছেন

আমারে বলে যে ওরা রোম্যাণ্টিক
সে কথা মানিয়া লই
রসতীর্থ-পথের পথিক
মোর উত্তরীয়ে
রঙ লাগায়েছি, প্রিয়ে  ...
আমারে শুধাও যবে এরে কভু বলে বাস্তবিক?
আমি বলি, ‘কখনো না, আমি রোম্যাণ্টিক।


কবি, লেখক পুরনো হন না কি? হন! শম্ভু মিত্র শুনেছি বলতেন— অভিনেতার  আয়ু বারো বৎসর। কারণ তার পরেই দেশের লোকের সাজগোজের, কথাবার্তার ধর, কেতাকৈতব সব পাল্টে যায়। কিন্তু তার কথা স্বীকার করেও ভাবতে হবে না কবি, লেখক যখন ভাবছেন তাঁর সব কিছু বলা শেষ হওয়ার আগে, কথা ফুরোনর আগে সময় ফুরোনর কথা। কিট্‌সের যে ভয় ছিল যৌবনে, সেই একই ভয় রবীন্দ্রনাথের বার্ধক্যে। কিট্‌স লিখছেন—
When I have fears that I may cease to be
   Before my pen has gleaned my teeming brain,
Before high-pilèd books, in charactery,
   Hold like rich garners the full ripened grain;
When I behold, upon the night’s starred face,
   Huge cloudy symbols of a high romance,
And think that I may never live to trace
   Their shadows with the magic hand of chance;
And when I feel, fair creature of an hour,
   That I shall never look upon thee more,
Never have relish in the faery power
   Of unreflecting love—then on the shore
Of the wide world I stand alone, and think
Till love and fame to nothingness do sink.

রবীন্দ্রনাথও আশিতে এসেও ভাবছেন

‘নির্জন প্রাঙ্গণে
পিণ্ড পিণ্ড মাটি তার
যায় ছড়াছড়ি
অসমাপ্ত মূক
শূন্যে চেয়ে থাকে
নিরুৎসুক।
গর্বিত মূর্তির পদানত ...’

জর্মান মহাদার্শনিক ম্যাক্স হ্বেবর তাঁর ‘teeming brain’-এর ফসল তোলা আগে সময় ফুরোবার ভয়ে অস্থির হয়ে, সব ভাবনা পাণ্ডুলিপি-বন্দী করার সিদ্ধান্তে সঅঅব লিখে কিন্তু ‘পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন’ অবস্থায় রেখে ৪৬-এ চলে  গেলেন। হায়!


এর পরেও সত্তরে লেখা থামাবার কথা? কিট্‌সের, হ্বেবরের, রবীন্দ্রনাথের খেদে কোথায় মুছে গেছে ‘রসের মেয়াদ’ আর শাঁসের মেয়াদ’-এর পার্থক্য। দাঁড়িয়ে  আছে কেবল রাজশেখরের প্রবন্ধে ভীমরতি কথাটির এই অসাধারণ বংশলতিকা যে তার আদি অর্থ মহাজ্ঞান। উৎস ভীমরথী, যেটা হয় সাতাত্তর বছর সাত মাস সাত দিনে, যেদিন মানুষের দৃষ্টি হয় দিব্যদৃষ্টি, বচন হয় বেদবাক্য। লেখার বয়স আরো সাত মাস সাত দিন বাড়াতেই হবে! উপায় নেই! আমি নাচারকবি নই, সাহিত্যিক নই, নিতান্ত প্রাবন্ধিক। ‘সাহিত্যের আনন্দের ভোজে’, বাঘ-সিংহের বরাত আমার নয়। কবিঙ্ককণের ভাষায়, ‘নিয়োগী চৌধুরী নহি, না ধরি তালুকউচ্চিংড়া ধরে খাই আমি সে ভালুক’সংস্কৃত অল্পংকারশাস্ত্রী ভামহ যাকে বলেছিলেন ‘শব্দপাক’ তা আমার হয়েছে বহু বিলম্বে। কিন্তু ছেষট্টি আগতে আমি পরশুরামের কথাই স্মরণ করি, ‘বম মহাদেব ধুস্তুরস্বামী, দস্তুর মত প্রস্তুত আমি’। 






0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন