কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৬

মেঘ অদিতি

রণ অথবা রণিত


(১)

এ ফ্ল্যাটটার কোথায় যে কী লুকিয়ে থাকে, খুঁজে পাওয়াই মুশকিল একুশশ স্কোয়ার ফুটের লম্বা ফ্ল্যাটের দক্ষিণ দিকে বাপির ঘর, মাঝে পড়েছে কিচেন, ডাইনিং স্পেস, ড্রয়িং রুম তারপর ছোট একটা প্যাসেজ পেরিয়ে অন্যদিকে অর্থাৎ উত্তরে রণ মানে রণিতের ঘর রণিতের পাশের ঘরটায় দিদুন থাকতেন বছর দুই হলো ঘরটা ফাঁকা পড়ে আছে 

রণর আজ স্কুল ছুটি রণ খুঁজে বেড়াচ্ছে ওর কম্পিউটার পরিষ্কার করার ডাস্ট ব্লোয়ার বাপির ঘর, দিদুনের ঘর, বারান্দা - নাহ কোত্থাও নেই! মাকে জিগ্যেস  করে লাভ নেই, রণ জানে জিগ্যেস করতে গেলে অফিসে সবার সামনেই মা  হয়তো পড়া ছেড়ে এসব কেন বলে রেগে বকে শেষ করবে ফোনের এপাশে তারা  না থাকলেই বা কী, সে ভারি লজ্জ্বার কথা হবে কবে যে আসবে বাপি! বাপিকে ‘মিস’ করতে করতে বছর ষোলর রণ এবার টেক্সট করল, Hello Bapi, how  are you? Miss you badly. Please come back soon. BTW, do you know where my dust blower is? রণ জানে বাপি এমেলবোর্নে একটা সেমিনারে আছে হয়তো উত্তর করার সময় পাবে না এখন কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে  মোবাইল ফোনের আলো নেভার আগেই দেখল, বাপি ঢুকে পড়েছে ফোনে ইনবক্স খুলে দেখল, বাপি জানিয়েছে ডাস্ট ব্লোয়ারটা কোথায় চাবিটা কোথায় রাখা এবং ব্লোয়ার যেন সাবধানে ব্যবহার করে জায়গামতো রেখে দেয় বাপির কথামতো রণ  চাবিটা খুঁজে নিয়ে বাপির ঘরে ঢুকে দু’ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকল কী একটা ভাবছে  ও তারপর চাবি দিয়ে বাপির ওয়ারড্রোব খুলল বাদিকের তাকে তার ডাস্ট ব্লোয়ার, চুপচাপ ঘুমিয়ে আর রাজ্যের কাগজপত্রের মাঝে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে একটা পুরনো লাল ডায়েরি কী মনে করে রণ ডায়েরিটা আগে হাতে নিল  উল্টেপাল্টে দেখছে প্রথম পাতাটা ওকেই লেখা ডায়েরির ভেতর থেকে একটা ছবি আর দুটো কাগজ হঠাৎ পড়ে গেল মেঝেতে রণ হাতে তুলে নিয়ে দেখে, বাপি ওরই মতো প্রায় দেখতে সাদাকালো বাপি ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে বাপির ছবির  সাথে বাকি দুটো কাগজ প্রায় হলদেটে, একটা ক্লাস টেনের মার্কশীট এমা! বাপি তো ইংলিশ আর অঙ্কে ভীষণই পুওর মার্কস পেয়েছিল! অন্য কাগজটার ভেতরের দিকটা নীলচে ওটা একটা চিঠি

(২)

ব্লোয়ার আপাতত পড়ে আছে ঘরের মেঝেতে একটা পুরনো ডায়েরির ভেতর নাক ডুবিয়ে রণ এখন আচ্ছন্ন  হয়ে আছে পুরনো বলেই ন্যাপথলের গন্ধ ছড়াচ্ছে  বাইরে বৃষ্টি নেমেছে আকাশ ভেঙেচুরে ডায়েরি থেকে মুখ তুলে রণ একবার  মেলবোর্নের সন্ধে পেরিয়ে রাত নামল কি না সে কথা ভাবল ভাবল, বাপি এখন কী করছে এই ডায়েরিতে বাপির কত বন্ধুর কথা লেখা অথচ রণ কেমন একা, সারাদিন যেন ঘড়ির কাঁটায় মেপে চলা তার জীবন বাপির ঠিক উল্টোদিকের ভিন্ন এক গ্রহে তার বাস তার বন্ধু নেই, আউটডোর গেমসে নেই, বই পড়া নেই আছে এক কম্পিউটার আর সেটাতেও কেন সে পড়ে থাকে এসব তাকে শুনতে হয়ে হরদম মার কাছে কিন্তু মা যে সবসময় পড় পড় পড় বলতে থাকে,  সেটাতে বাপি তো কই তেমন কিছু বলে না! হয়তো দু’ একবার বলে, তারপর  চুপ হয়ে যায় থাকার মধ্যে বন্ধু ওই কম্পিউটার আর বাকিটা বাপি কিন্তু বাপিও খুব ব্যস্ত থাকে ফলে একমাত্র সঙ্গী সেই কম্পিউটার বিকেল হয়ে এসেছে রণ আবার ডায়েরি খুলল প্রথম পাতায় বিকেলের বৃষ্টি ভেজা আলো পড়ল কিছু মনোযোগ দিয়ে বাপির লেখাটা বেশ কবার সে পড়ল

আমার যা কিছু বন্যতা যতটুকু আলো সবটুকু দিয়ে যাবো তোকে
                                                                                    - বাপি

তারিখটা দু’ বছর আগের রণ ভেতরের পাতা উলটে গেল পড়াশোনায় বাপি   খুব ভালো ছিল না তা বাপির লেখা থেকে মনে হচ্ছে কখনও হতাশ, কখনও ভবিষ্যতে ভালো করার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞ কিন্তু দারুণ ছবি আঁকত বাপি তা বারবার লেখা আছে আর ঘুরে ফিরে যার কথা লেখা, তিনি ঠাম্মা মানে রণর  বাবা শৌমিকের মা মা শিখিয়েছিলেন গান, মা শিখিয়েছিলন বইপড়া আরো কত কী লেখা এই অবধি পড়ে রণ ডায়েরি উল্টে রেখে উঠে দাঁড়াল ঠাম্মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে ডাইনিং স্পেসে উঠে এলো সে দেওয়ালে মালা জড়ানো ঠাম্মার ছবি তাকিয়ে থাকতে থাকতে শুনতে পেল ফোন বাজছে 

-   হ্যালো... বাপি!
-   একটা অন্যরকম কিছু পড়ছি বাপি 
-   উঁহু এখন বলব না, আগে তুমি ফেরো কবে ফিরছ?
-   খেয়েছি হুম পড়া শেষ মা ফেরেনি এখনও
-   ওকে গুড নাইট বাপি  টেক কেয়ার

ফোন ছেড়ে ঘরে আলো জ্বাললো রণ বুকশেল্ফে বাপির দেওয়া চে’র বইটা হাতে  নিল জুল ভার্ন, ভিক্টোর হুগো, আলেক্সান্দার দুমো পর পর সাজানো বাপি খুব বই পড়ত রণর বয়সে ডায়েরির পাতায় পাতায় নোটসের মতো এক একটা বই  নিয়ে লেখা রণর বইগুলো শেল্ফে সাজানো ওর বই পড়তে কেন যে ভালো লাগে না! অথচ বাপির ডায়েরি পড়ে আজ খুব আপশোস হচ্ছে, কেন এতদিন সে  পড়েনি!  

(৩)

রণিত আধশোয়া এখন কী দুর্দান্ত ছিল তার বাপি! খেলা, ডিবেটিং, হাইকিং,  এঙ্করিং কত কী করেছে আর কত বন্ধুদের নাম লেখা ধুসস... ওর যে কেন বন্ধু নেই একটাও! নিজে থেকে ও মিশতে পারে না কারো সাথে বাপির মতো একটা জীবন তারও হতে পারত...  

ডায়েরির শেষ দিকে চলে এসেছে ও শেষের দুটো পাতায় একটা মেয়ের কথা লেখা রুমু শেষ পাতায় বাপিরই হাতের লেখা, একজন ক্যাপ্টেনের দিক  নির্দেশনার সাথে সাথে সময় জ্ঞান থাকাও খুব জরুরিডায়েরি শেষ মা ফিরল এসেই পড়ার খোঁজ খবর নিয়ে, বাপি ফোন করেছিল কি না জেনে, চা খেয়ে মা নিজের ঘরে ঢুকে গেল

রণ সেই চিঠিটা এবার হাতে নিল

*******

অনেকটা সময় হয়তো পেরিয়ে গেছে তারপর রণদের এপার্টমেন্টে রাত নেমেছে  অনেকক্ষণ মা দু’বার এসে খেতে ডেকে গেছে রণর খেতে ইচ্ছে করছে না  আয়নায় দ্বিতীয় রণকে দেখা যাচ্ছে, যে একটা চিঠি হাতে নিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে আছে, যাতে রুমু নামের একটা মেয়ে লিখেছে, ‘আজ থেকে রুমু নামের কারো অস্তিত্ব তোমার জীবন থেকে মুছে গেল কেননা, একজন ক্যাপ্টেনের দিক  নির্দেশনার সাথে সাথে তার সময় জ্ঞান থাকাটা খুব জরুরি

বৃষ্টিটা ধরে আসতে গিয়েও আবার তুমুল শুরু হলো
আয়নায় রণকে এই রাতে অনেকটা বড়  দেখাচ্ছে



0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন