কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

বিদ্যুৎলেখা ঘোষ

যে দেখায় চোখ ছিল না 

প্রথম দেখা হবে অরণ্যর সঙ্গে। আজ এই ভরা ভাদরের বিকেলে। কত রাত কেটে গেছে অরণ্যর নিজের গলায় অসাধারণ সব কবিতা নয়তো নিজের লেখা ময়ূরীকে শোনাতে শোনাতে এভাবে বিনিদ্র! এদিকে বাবা মা যাতে না শুনতে পায় ময়ূরী ফিসফিস আর ওদিকে নিঃসীম বনাঞ্চলের মতোই খোলা গলায় আবৃত্তিতে অরণ্য। এই ময়ূরীর সঙ্গে অরণ্যর প্রথম দেখা হবে বিকেল পাঁচটায় একাডেমিতে। আজ শাড়ির সঙ্গে মিলিয়ে কানে ছোট দুল পরেছে। হাতে গলায় কোনও জাঙ্ক বা অন্য জুয়েলারি কিছু পরেনি। পরেও না খুব জমকালো তেমন কিছুসকাল থেকে পেখম মেলতে চাইছে মনটা। অরণ্যে ময়ূরী পেখম মেলবে না তো আর কোথায়! রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনে নামবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছে, তখনও অরণ্য টেক্সট করে যাচ্ছে, আর কত দেরি করবে? এসে তো দেখবে ছেঁড়াশার্ট ছেঁড়াজুতো পরে অপেক্ষা করছি ভিখিরি একজন। কোনোমতে ময়ূরী রিপ্লাই দিয়ে নেমে এলো মেট্রো থেকে। ঊর্ধ্বশ্বাসে একরকম  দৌড়ে হাঁটা লাগালো নন্দনের দিকে। পাঁচটা বেজে গেছে। হলের ভিতরে সবাই। কী করে চিনবে ওকে? ফেসবুক প্রোফাইলের ছবিতে দু’ তিন বছর আগের অরণ্য। এখন  কেমন দেখতে? ময়ূরী ভাবছে, যা হোক গে, হলের ভিতরে তো যাই তারপর দেখা যাবে। 

হলে ঢুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ময়ূরী ভিতরে চারদিকে উৎসুক দৃষ্টি মেলে খুঁজতে থাকল। অরণ্যই ইশারায় ডেকে নিল ময়ূরীকে। এতদিনের কানে কানে অরণ্য আজ চোখের সামনে! প্রথম চাক্ষুষ হওয়ার সৌজন্যস্পর্শে অরণ্যর হাতের সবটুকু ওম উষ্ণ  করে দিল ময়ূরীর হাত, ক্রমশ সমস্ত শরীর... কিন্তু একটা অজানা ভয়... কেন এমন হচ্ছে! অরণ্য উপহার দিল ওর বই। নিজের লেখা। ময়ূরী কিছু কেনা উপহার দেওয়া যোগ্য মনে করেনি। নিজের চেয়ে উপযুক্ত আর কোনো উপহার অরণ্যর জন্য খুঁজে পায়নি। পাশাপাশি বসেও টেক্সটে অরণ্য বলছে, বাঃ কী মিষ্টি তুমি! এমনটাই থেকো।  অরণ্যর চোখ দুটো ছবির থেকে আরও সুন্দর। দুটো চোখ যেন মুখোমুখি দুটো বাবুই। তারপর নাক ঠোঁটের পর... দৃষ্টি রাখা যাচ্ছে না। হাসলে নিচের ঠোঁট পেরিয়ে কয়েকটা বড় বড় দাঁত বেরিয়ে পড়ছে... না, কিছুতেই রবীন্দ্রনাথের ‘রাজা’ নাটকটা  ময়ূরী ওর আর অরণ্যর মধ্যে আবার হতে দেবে না... ভুল করবে না রানী সুদর্শনার মতো। ময়ূরী অরণ্যকে ভালোবাসে। সে আর কিছু জানে না। অরণ্য যেমনই হোক... ময়ূরী অরণ্যের মাঝেই হারিয়ে থাকবে আমৃত্যু। অরণ্য বলা শুরু করল, তাকানো যাচ্ছে না আমার দিকে তাই না? কখনো দেখেছ এমন কুৎসিত মানুষ? ময়ূরী শাসনের সুরে বলল, না দেখিনিই তো!
কখ্খনো এমন করে বলবে না বলে দিলাম!  অরণ্য বলল, জানি তো ওই জন্য তাকাতে পারছ না। কিছু আনোনি আমার জন্য? ময়ূরী বলল, না কিছু কিনে নিয়ে আসিনি। আমি নিজেকে এনেছি। আমাকে নাও।  ছোট্ট বাচ্চার মতো  অরণ্য এবার বলল, বেশ নিলাম। ফেরত চেও না কিন্তু পরে!  পাবে না। কিন্তু ভাবছি সত্যি আর কিচ্ছু আনোনি! জল? আছে সঙ্গে? আমাকে পছন্দ হয়নি বলে জলও দেবে না! ময়ূরী ছদ্ম রাগ দেখাল, কী হচ্ছে কি! ওদিকে  কবিতা পড়ে গলাব্যথা করেছেন কবি আর তুমি আমার মাথাব্যথা করে দিচ্ছ!

এবার অরণ্যর আবৃত্তির জন্য ডাক এলো। মাইক্রোফোনের সামনে যথারীতি মজা করে কিছু কথা বলে শুরু করল পাঠ। ময়ূরীর মধ্যে একটা অস্থিরতা শুরু। অরণ্যর কন্ঠস্বর এতদিন কানে শুনেছে
আজ এই মূহূর্তে মাইক্রোফোনে যে পাঠ করছে, ও সেই অরণ্য! এত মাধুর্য ভরা ওর কন্ঠ! হলে একমাত্র ওর কন্ঠস্বর ভেসে বেড়াচ্ছেএতবড় একটা হল মায়ামুগ্ধ হয়ে শুনছে। যেন কান ছাড়া আর ওদের কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নেই। ময়ূরীর শরীরে বর্ণিল পালক আর পালক। চোখ বন্ধছুটে চলেছে মুক্ত অরণ্যের মাঝে মন্দ্রস্বর অনুসরণ করেবন্ধনহীন বর্নীল পেখম মেলে দিয়েছে ময়ূরী... এ মুক্ত অরণ্যের আরণ্যক...

একাডেমি থেকে বেরিয়ে কিছু নতুন পরিচিত হওয়া বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় ময়ূরী অরণ্য সম্পর্কে জানল, ও সত্যিই বিশাল অরণ্যের মতো। ওর ক্রিয়েশন  ওর মনোজগতের বিস্তৃতি অনেকটাই ধোঁয়াশা রেখে দেয়
ময়ূরী সোজাসুজি মানুষ। এত কিছু জানলে হয়তো দূরেই থেকে যেত। বলেও ফেলল, তোমার কথা কিন্তু  তোমার মুখ থেকে আগে শুনতে পছন্দ করি, মনে রেখো। অরণ্য শুধু বলল, অরণ্য তো মুখে কিছু বলে না। লিখে রাখে পাতায় পাতায় আগামী সংশ্লেষ। জেনে নিও। বাড়ি ফেরার পথে ও তারপর দু’দিন টেক্সট করে একই কথা বলে যাচ্ছে অরণ্য, জানি আমাকে তোমার পছন্দ হয়নি, কুৎসিত মানুষকে কেউ ভালোবাসে না। তুমিও ভালোবাসতে পারবে না জানতাম, তুমি পারলে না... ইত্যাদি। অনেক বোঝানোর পর  শেষে ময়ূরী ফোনে ধমক দিয়ে বলল, কী এমন হয়েছে দাঁতগুলো, এবড়ো খেবড়ো তো! ডেন্টিস্টের কাছে যাও, ফাইল করে দেবে। আমার যদি এরকম কিছু সমস্যা  থাকত আমাকে তুমি আর ভালোবাসতে না? ছেড়ে দিতে? আমিও তো নিখুঁত নই।  তাহলে? তোমার আমার শিল্পবোধ প্রথমে আমাদের এই বাঁধনে বেঁধেছে। তখন চেহারা কোথায় ছিল? প্রেমে কেবল সুন্দর চেহারার মানুষের একচেটিয়া অধিকার বুঝি!
তারপর যখন অরণ্যর সঙ্গে আবার দেখা হলো, বেশ নতুন লাগলো ওকে। প্রথম  দিনের চেয়ে কনফিডেন্ট। খোশ মেজাজে। দুষ্টুমি আরো বেড়েছে। দাঁত ফাইল করানোর পর টেস্টজোন ময়ূরীর ঠোঁট। তবুও অরণ্যর সমান হওয়া দাঁতগুলোর মধ্যে একটা দাঁতের কোণ ঠিক ফুটে যায় ময়ূরীর ঠোঁটে, একটু জোরে কামড় বসালে।


1 কমেন্টস্: