কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

অমিতাভ প্রামাণিক

চারানা আটানা


৩৫)  টুকরো টাকরা


এবারের চারানা আটানা কয়েকটা টুকরো টাকরা পান-সুপুরি নিয়ে। এ পান সে পান না, জাপান থেকে আনতে হয় না। এমনিই চলে আসে কড়ায় গন্ডায়। তার থেকে গন্ডাখানেক আপনাদের জন্যে বেছে নিলাম।


(এক)

গাড়ি চালাতে চালাতে ফোন এলে আমি ফোন ধরি না। আনসেফ। দেখিও না ফোনের দিকে তাকিয়ে। যেই হও, ওয়েট করো, ফোনের বক্তব্য নিশ্চয় আমার বা আমার গাড়ির সামনে যারা আছে, তাদের জীবনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়!  

ফোন বাজছিল, আমার হাতে স্টিয়ারিং। আমি কল অগ্রাহ্য করলাম।

গাড়ি রেড সিগন্যালে দাঁড়াতে আবার ফোন। সামনে তাকিয়ে দেখলাম, এখনও বাষট্টি  সেকেন্ড লাল থাকবে। তাহলে ধরা যেতে পারে! ইঞ্জিন বন্ধ করে ফোনের দিকে  তাকিয়ে দেখি, জ্বলজ্বল করছে হোম মানে গিন্নীর কল।

ধরেই বললাম, কী ব্যাপার? গাড়িতে আমি। যা বলার জলদি বলো।

ভ্যানভ্যান করে বন্যার জলের মতো কী সব বলতে লাগল, কিছুই মাথায় ঢুকল না।  রাস্তার মোড়ে শব্দ তো কম না! প্লাস জলদি বলতে বলেছি বলে এমনভাবে বলছে,  যেন বিজ্ঞাপনের সেই - ইনভেস্টমেন্টস আর সাবজেক্টেড টু মার্কেট রিস্কস, প্লিজ রিড দ্য অফার ডকুমেন্টস কেয়ারফুলি বিফোর ইনভেস্টিং-এর মত হড়বড় করে বমি  করার মতো বলছে।

শুধু বুঝলাম, কী যেন কিনে নিয়ে যেতে বলছে। টিলুল না কী যেন!  

আমি বললাম, টিলুল আবার কী? বুঝতে পারছি না। হোয়াটস্যাপে লিখে দাও।

শুনলাম, উল, উল।

এই গরমে উল? তাছাড়া আমার বৌকে তো জীবনে সোয়েটার মাফলার বুনতে দেখিনি। আমিই বোধহয় ভালো পারি ও কাজটা। মা'র কাছে সোজা-উল্টো শিখেছিলাম একসময়।
 
সিগন্যালের টাইমার এক অঙ্কের হয়ে যেতেই আমি ফোন কেটে দিলাম। উল এখন কোথায় পাব? উলই তো? রান্নায় দেওয়ার গুল নয় তো? ধ্যেৎ, রান্না তো গ্যাসে  হয়, আর ওই যে কী যেন বলে, হ্যাঁ, ইন্ডাকশনে। ওতে গুল লাগবে কেন? আর কী হ'তে পারে? কুল, খুল, গুল, ঘুল ... সিগন্যাল সবুজ।  

যে দোকান থেকে মাসকাবারি জিনিসপত্র কেনা হয়, ঘ্যাঁচ করে তার সামনে দাঁড়ালাম, ইঞ্জিন বন্ধ করে ফোনে হোয়াটস্যাপ খুললাম। দেখি হ্যাঁ, মেসেজ এসে গেছে। তাতে লেখা– BMW নিয়ে এসো একটা!

বৌ এক ইয়ার্কির! বলছে যেতে নিয়ে কিনে থেকে বাজার! চাই ডব্লিউ এম বি এর-টা লিমিট আছে। নির্ঘাত শুনেছে মুনিয়া বা শুভ্রজিত মার্সিডিজ কিনেছে, সুতরাং তুমিও কিনে ফেল বি এম ডব্লিউ, এ আর এমন কী...
মেজাজ গরম হয়ে গেল। ফোন করলাম। ওপাশে রিং হচ্ছে, তুলছে নাতুলেছ? না তুলছে...

‘ইয়ার্কি মারো কেন? এক্ষুণি অ্যাকসিডেন্ট করছিলাম আর একটু হলেই’, ঝাঁঝিয়ে উঠলাম আমি।

‘কেন কী হয়েছে? ওপাশে নির্বিকার জবাব, ‘কী ইয়ার্কি করলাম? 

‘এসব কী লিখেছ? তখন তো ফোনে উল উল না কী বলছিলে, এখন মেসেজে লিখেছ BMW, এর মানে কী? BMW চাই তো তোমার শ্বশুরকে বলো গে যাও, আমাকে কেন?

শ্বশুর তো নেই, তাই তোমাকেই বললাম। অত চ্যাঁচামেচি করার কী আছে? তোমার মুরোদ কি আমার জানা নেই? উলই তো চেয়েছি। BMW হচ্ছে বাসন মাজার উল। স্টিল উল বললাম তখন, বুঝলে না, তো আর কী বললে বুঝবে?


(দুই)

- কীরে হাঁদু, পরীক্ষা কেমন দিলি?

-
ভালো।

-
কী এসেছিল কোশ্চেন?

-
ঐ তো, শেক্সপিয়ারের পাঁচটা নাটকের নাম লিখতে বলেছিল, আর সেগুলো কী নিয়ে লেখা, সেইটা বলতে বলেছিল।


-
পারলি?

-
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ও তো আমার মুখস্ত।

-
কী লিখলি?

-
লিখলাম, শেক্সপিয়ার খুব মামলেট খেতে ভালবাসত। একবার ডিমের মধ্যে হ্যাম পড়ে গেছিল বলে সেটা হয়ে গেল হ্যামলেট। তাই নিয়ে একটা নাটক।

-
বাহ। আর?

-
তারপর একদিন ওর মা রান্নাঘরে দুধ গরম করতে বসিয়ে বাথরুমে গেছিল, বলে গেছিল, বাবা, একটু খেয়াল রাখিস। সেই দুধ উথলে উঠে পুড়ে গেল। তাই নিয়ে লিখল - ওথেলো।

-
উরিব্বাস! তারপর? 


-
তারপর একবার ও আর ওর মা কোথায় যেন গেছিল, সেখানে গিয়ে ওর মার গলার চেনের ওপরে একটা সুন্দরমত কী ছিল, সেই অংশটা হারিয়ে গেল। তাই নিয়ে একটা নাটক লিখল-  মার চেন টপ ভ্যানিশ।

-
এক্সেলেন্ট। নেক্সট?

-
ইস্কুলে ওদের গো অ্যাজ ইউ লাইক নিয়েও কী একটা নাটক লিখেছিল। আমি লিখে এসেছি, নামটা এখন ঠিক মনে পড়ছে না। ঐ রকমই কিছু নাম।

-
আর? পাঁচ নম্বর?

-
আর একটা কী যেন? কী যেন, কী যেন? ও হ্যাঁ। শেক্সপিয়ারের মেয়ে হয়েছিল জুলাই মাসে, তার নাম দিয়েছিল জুলিয়া। তার একটা কাঁচি ছিল। সেই নিয়ে নাটক জুলিয়া’স সিজার।


(তিন)

সরকার নোটিশ দিয়েছে, মদের দোকান এখন থেকে দিবারাত্তির খোলা রাখা যাবে, বছরের সব দিনেই। ফলে ক্লাবের ছেলে ছোকরাদের মহাফূর্তি। সরকার থেকে এ বাবদ  ভাতাও আসছে আজকাল।

সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে পাড়ায় একটা নতুন মদের দোকান খুলে গেল। আগে যেটা ছিল, ওটাতে রাস্তার সাইডের দেয়ালে একটা ছোট্ট ফোকর দিয়ে টাকা গলিয়ে দিলে অন্ধকারে ঘরের মধ্যে থেকে আনন্দবাজারে জড়ানো একটা বোতল বেরিয়ে আসত। এটাতে সেসব না। রাখঢাক নেই। ইচ্ছে করলে ভেতরে বসেও খাওয়া যায়। তবে চিপস, বাদাম, পেঁয়াজি আলাদা করে কিনতে হবে। এখানে পেঁয়াজির দাম বেশি, এখন ওটা শিল্প তো, ওর ওপর ট্যাক্স, এডুকেশন সেস-ফেসও দিতে হয়।

জগাদা শোনা গেল সেই নতুন দোকানে সারারাত মাল টেনে পুরো আউট হয়ে গেছে। জগাদা ছেলে খারাপ না, উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলায় একটুর জন্যে ফার্স্ট ডিভিশন পায়নি। যাত্রায় বিবেকের রোলে দারুণ পার্ট করত, ওর গান শুনে নায়ক নায়িকা থেকে ভিলেন ফিলেন সব নাকেজ্জলে চোকেজ্জলে হয়ে যেত। জগাদা পুরনো মাতাল, একটু আধটু খেত বিশেষ করে যেদিন পাড়ার ডিফেন্স পার্টির ডিউটি থাকত। মাল ফাল না খেলে কি সারারাত জেগে থাকা যায়? হুঁ হুঁ বাওয়া, চোরেরাও সেয়ানা, একটু ঢুল  দিয়েছ কি পকেট কেটে নিয়ে যাবে।

পাড়ার মোড়ল ঘোষবাবু শুনে তো খচে ফায়ার। উনি আগে এই অঞ্চলের দাপুটে নেতা ছিলেন। আলিমুদ্দিনের পায়রা উড়ে এসে ওর বাড়ির কার্নিশে বসত। এখন অবশ্য সে দাপট নেই। তবে ওয়ান্স এ মোড়ল, অলোয়েজ এ মোড়ল।

সবাই মিলে জগাদাকে টানতে টানতে এনে ঘোষবাবুর উঠোনে ফেলল। পাড়ার ঠাকুমা দিদিমারা বলাবলি করতে লাগল, ও জগা, বাপ আমার, ক্ষমা চা, মোড়লমশাইয়ের পা ধরে ক্ষমা চা।


জগাদা রক্তবর্ণ চক্ষু তুলে আকাশের দিকে তাকাল। বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল, এটা কোন যাত্রার কত নম্বর সিন। তারপর হুঙ্কার ছেড়ে বলল, পাড়া-bar পার হয়ে এসে শেষে ডুবিব কি ঘোষ! পদে-


(চার)

পুঁটি - দাদা আগে যে নামের শেষে প্রথম, দ্বিতীয় লাগানোর সিস্টেম ছিল, যেমন রাজা পঞ্চম জর্জ, ষষ্ঠ এডওয়ার্ড, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, দ্বিতীয় শাহ আলম, এসব কখন উঠে গেল রে

হাঁদু - কে বলল উঠে গিয়েছে?

পুঁটি - এখনো আছে?

হাঁদু – আছে তো! কেন নাম শুনিসনি – অনিন-দো, অ-তিন, মি-তিন, সন-চারি, পোল-টু, ঘোন-টু, সোন-টু, কৃষ্ণচন্দ্র -

পুঁটি - অন্যগুলো বুঝলাম, ইন ফ্যাক্ট নিজের নামটাই বা বললি না কেন, হাঁ-দু? কিন্ত কৃষ্ণচন্দ্র! ওতে নাম্বার কোথায়?

হাঁদু - ওরে উজবুক, একে চন্দ্র দুয়ে পক্ষ জানিস না? কৃষ্ণচন্দ্র মানে প্রথম কৃষ্ণ।   দ্বিতীয় কৃষ্ণ হ’লে কৃষ্ণপক্ষ হ’ত

পুঁটি ও! এইরকম হয় তাহলে?

হাঁদু – ঈ বা আ অনেক সময় লাস্টে লেগে যায় মেয়েদের নাম হ'লে। সমীরা রেড্ডীর নাম শুনেছিস? সমীর মানে বাতাস, সমীরা মানে বাতাসা। তেমনি সাহিত্যিক বাণী বসু। পাঁচে পঞ্চবাণ মনে আছে? বাণ মানে পাঁচ, বাণী মানে পাঁচী। গৌতম ঘোষ না কার যেন একটা সিনেমায় ডায়লগ ছিল, একটা পুরুষ ভিখারি একটা মহিলা ভিখারিকে বলছে - পাঁচী নামটা বড়ই সুন্দর। তার নাম পাঁচী তো পটানোর ধান্দায়। যাকগে, তোর আজ রেজাল্ট বেরোনোর কথা ছিল না? কত পেলি


পুঁটি -  সমুদ্রচন্দ্র বসু।

হাঁদু - স্যারের নাম না? কিন্তু পরীক্ষায় কত পেলি?

পুঁটি ৭১৮। সাতে সমুদ্র, একে চন্দ্র, আটে অষ্টবসু। 

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন