কালিমাটি অনলাইন

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

একাদশ বর্ষ / দশম সংখ্যা / ১২০

শুক্রবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৬

শিবাংশু দে

কখন কী রঙ্গে থাকো মা




বিষয় হিসেবে দেবী কালী বেশ অভিনিবেশ আকর্ষণ করেন। নানা কারণে দেবতাকুলে তাঁর প্রতাপ প্রশ্নহীন। ভক্তসংখ্যার বিচারেও তিনি বঙ্গদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আসলে এই দেবীকল্পনাটি এদেশে অপ্রতিহতভাবে পুনর্জীবিত হয়ে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন যুগধর্মকে আত্মস্থ করে। ফলত বারবার তাঁর রূপান্তর ঘটলেও ‘মহাদেবী’ হিসেবে তাঁর মর্যাদার ক্ষয় হয়নি কখনও। শক্তিপূজার ঐতিহাসিক পরম্পরাকে তিনি প্রায় একাই ধরে রেখেছেন। তাঁরা আগে বা পরে কল্পিত দেবীমহিমাগুলি কালের নিয়মে হয়তো ম্লান হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাকি সব দেবীসত্ত্বাকে দেবী কালী নিজের মধ্যে আত্তীকরণ করে নিতে  পেরেছিলেন অনায়াসে। আমাদের সমন্বয়ের সংস্কৃতিতে এটা একটা আবশ্যিক শর্ত। সিন্ধুসভ্যতা থেকে আজকের আন্তর্জাল যুগ পর্যন্ত তাঁর ক্রমবিকাশের ধারা যদি অনুসরণ করি, তবে নানা কৌতুহল জাগানো তথ্য উঠে আসে।

হরপ্পার বিভিন্ন উপজাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব উপাস্যা দেবীর মূর্তি দেখে তাদের বিভিন্নতা অনুমান করা যায়। কল্লি উপজাতির দেবী (২৫০০-২০০০ খ্রী পূ), ঝব উপজাতির দেবী(২৫০০-২০০০ খ্রী পূ) বা সামগ্রিকভাবে হরপ্পা সংস্কৃতির দেবী (২০০০ খ্রী পূ), এঁদের মূর্তি প্রজননতন্ত্রী মাতৃদেবীর লক্ষণাক্রান্ত লক্ষ্যনীয়, এই সব প্রাকৃতিক প্রজননশীলতার প্রতীক দেবীমূর্তি শুধু অনার্য জনগোষ্ঠীর উপনিবেশ থেকেই পাওয়া গেছেঅবশ্য ঝব সংস্কৃতিতে লিঙ্গপ্রতীকের উপস্থিতিও রয়েছেএই সব দেবীমূর্তির সঙ্গে পৌরুষের প্রতীক হিসেবে শুধু বৃষভ অবয়বের সংযোজন করা হয়েছিল, নতুবা এঁদের কোনো পুরুষ দেবতার সঙ্গিনী হিসেবে কল্পনা করা হয়নিঅস্তিত্বের বিচারে  তাঁরা সম্পূর্ণা ও স্বাধীনাআর্য প্যান্থিয়নে কিন্তু এমনটি ভাবা যায় না


অনার্যদের মধ্যে অনেকক্ষেত্রে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থাকলেও সেটাই যে মাতৃপূজা বা শক্তিপূজার প্রধান কারণ, তা নয়। অনেক পিতৃতান্ত্রিক সমাজেও শক্তিপূজার প্রচলন  দেখা যায়। যেমন আমাদের দেশের মহিষমর্দিনী দেবীর পূজা প্রচলিত হবার বহু আগে ভূমধ্যসাগরীয় বিভিন্ন দ্বীপে, বিশেষতঃ ক্রিট দ্বীপে এক সিংহবাহিনী পর্বতবাসী (পার্বতী) দেবীর পূজা প্রচলিত ছিলরপ্পাযুগ থেকে গুপ্তযুগ পর্যন্ত ভারতীয় কুলীন সমাজে মাতৃদেবীরা পাত্তা পান'নি। সরস্বতী ব্যতিরেকে (অবশ্যই অন্য কারণে) সমস্ত দেবীমূর্তিই অনেক পরের সংযোজন, আর সবাই এসেছেন বিভিন্ন পুরুষ দেবতার  সঙ্গিনী হিসেবেউল্লেখযোগ্য, আর্যচিন্তায় যেসব দেবী কল্পনায় মাতৃভাবের অনুষঙ্গ রয়েছে, অর্থাৎ প্রকৃতির প্রজয়িতাসত্ত্বা যে সব ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছে, সেই সব দেবীই মূলতঃ অনার্য কল্পনার ফসল। নারীর প্রজনন ক্ষমতাকেই ‘শক্তি’ আখ্যা দিয়ে  দেবীরূপে কল্পনা করা হতো। কিন্তু আর্য দেবতাদের সঙ্গিনী দেবীরা নিজ পরিচয়ে স্বনির্ভর ছিলেন নাতাঁরা সবাই সঙ্গী পুরুষ দেবতার শক্তিরূপিণী হয়ে পূজিতা হতেন মূলতঃ অনার্য দেবতা, পরে আর্যস্বীকৃত, শিবের সঙ্গিনী হিসেবে যে সব দেবী কল্পিত হয়েছিলেন তাঁরা পার্বতী, মহাদেবী, সতী, গৌরী, অন্নপূর্ণা, দুর্গা, কালী এবং চন্ডীঅর্থাৎ ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থায় স্বাধীনা অনার্য দেবীদের ক্ষমতা খর্ব করে তাঁদের শুধু পুরুষ দেবতাদের শক্তির আধার হিসেবে গণ্য করা শুরু হলো। অবশ্য শুধু ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থাতে কেন, মন্ত্রযান, বজ্রযান, কালযান, সহজযান এ সব বৌদ্ধ ব্যবস্থাতেও দেবীরা সমান্তরালভাবে পুরুষদেবতার ‘সঙ্গিনী’ হিসেবেই পর্যবসিত হয়ে ছিলেন।  


ঘটনাক্রমের এমত বিকাশে শেষ পর্যন্ত সমস্ত শাক্ত শাস্ত্রেই দেখি শক্তির কোনও একক গরিমা নেই। তিনি ‘শিব’রহিত হতে পারেন না, তাঁর যাবতীয় মহিমা শিবসহিত।  আবার শুধু শিব নয়, বহু স্থানে দেখা যাচ্ছে তিনি বিষ্ণুরও সঙ্গিনী। অর্থাৎ কোনও  পুরুষমাত্রা ছাড়া শক্তি পূর্ণ মর্যাদা লাভ করতে পারছেন না। আসলে প্রকৃতিবাদী প্রাক ও মূল বৈদিক ধর্মে যাবতীয় ঐশীশক্তি (অর্থাৎ ভৌত প্রাকৃতিক শক্তিগুলি, যেমন অগ্নি, মরুৎ, বরুণ প্রভৃতি) পুরুষ দেবতা হিসেবেই কল্পিত হয়েছিলকিন্তু অনার্য সংস্কৃতিতে শক্তিকে ‘ভগবতী’ অর্থাৎ ‘ভগবানে’র নারী সংস্করণ রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হতো। পরবর্তীকালে আর্যরা যখন উপলব্ধি করেছিল এদেশে ‘অনার্য’দের, অর্থাৎ মূল  কৌম অধিবাসীদের অধ্যাত্ম ঐতিহ্য তাদের থেকে কোনও অংশে ন্যূন তো নয়ই, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তার প্রভূত ব্যপ্তি রয়েছে, তখন চতুর আর্যব্যব্স্থা সঙ্গতভাবেই ‘অবহেলিত’ ও ‘উপেক্ষিত’ অনার্যমননের সঙ্গে অধ্যাত্মস্তরে সমন্বয়ের প্রয়োজনের প্রতি  মনোযোগী হয়আর্য দেবতার প্যান্থিয়নে রুদ্রের পরিবর্তে শিবের অভিষেক এবং তাঁর অর্ধাঙ্গিনী হিসেবে বিভিন্ন প্রচলিত ও নতুন শক্তি দেবীরা আর্য মূলস্রোতের মধ্যে এভাবেই আত্তীকৃত হয়েছিলেনএই সময় ভারতভূখন্ডে যে যে সামাজিক তোলপাড় ঘটেছিল, সেখানে কৌম জনতার ভিতরে বৈদিক ভাবধারা এবং ব্রাহ্মণ্য আভিজাত্যের দুর্গে মাতৃতান্ত্রিক অনার্য উপাসনা পদ্ধতি, মসৃণভাবে প্রবিষ্ট হয়ে যায়। এই দুই সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী স্রোতের সঙ্গম থেকে উঠে এসেছিল একটি অধ্যাত্মব্যবস্থা, যাকে সামগ্রিকভাবে সংক্ষেপে তন্ত্রসাধনা বলা হয়।

দেবী কালী অন্য সব দেবতাদের থেকে যে লক্ষণে প্রকটভাবে পৃথক হয়ে যান, তা হলো তাঁর সামগ্রিক রূপকল্পনা


সব সভ্যতাতেই মানুষ দেববিগ্রহের রূপরেখা নিজের আদলেই নির্মাণ করেবিভিন্ন অনার্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে নানা বিষয়ে বহু পার্থক্য থাকলেও ত্বকের বর্ণ অনুযায়ী তাঁরা সবাই ছিলেন মেঘবর্ণ। তাই তাঁদের কল্পিত দেবদেবীরাও তাঁদের নিজেদের মতো শ্যামলবর্ণ হবেন, এটাই স্বাভাবিক। অসংখ্য অকুলীন বা অমুখ্য ইতরযানী দেবদেবীদের কথা যদি ছেড়েও দিই, নীলাচলের নিষাদজাতির আরাধ্য দেবতা জগন্নাথ এবং মূলতঃ বাংলা ও অসমের কৌমজনতার আরাধ্যা দেবী কালী তাঁর নানা অবতারে বিবিধ রূপে থাকলেও বর্ণবিচারে ঘোর কৃষ্ণই থেকে গিয়েছেন। ইতিহাসের দিকে তাকালে বেদের রাত্রিসূক্তকে কেন্দ্র করে যে রাত্রিদেবীর কল্পনা পরবর্তীকালে দেখা যায়, তিনিই এই  কালিকারূপিণী দেবীর পূর্বসূরি। শতপথ ব্রাহ্মণ ও ঐতরেয় ব্রাহ্মণে কৃষ্ণা ভয়ঙ্করী যে নৈঋতি দেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় পরবর্তীকালের কালী দেবীর সঙ্গে তার বিশেষ মিল রয়েছে। শতপথ ও ঐতরেয়তে এই দেবীকে কৃষ্ণা, ঘোরা ও পাশহস্তা বলা হয়েছে। ত্রয়োদশ শতকের প্রথমভাগে সংস্কৃত গ্রন্থ ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’তে ভাসোক নামে এক কবি  কালীর বর্ণনায় লিখেছেন,

‘ক্ষুৎক্ষামহকান্ডচন্ডী চিরমবতুতরাং ভৈরবী কালরাত্রি’।।

সম্ভবত পঞ্চদশ শতকে (এই সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে) বাঙালি কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ‘তন্ত্রসার’ গ্রন্থে কালীধারণার যে রূপ ও প্রকৃতিকে লিপিবদ্ধ করেন, সেটাই  বাংলাদেশে কালীদেবীর স্বীকৃত মডেল। এই দেবীই পরবর্তীকালে বাংলাদেশের তন্ত্রসাধনা ও মাতৃপূজার আরাধ্যা হয়ে যান। তন্ত্রসারের বর্ণনা অনুযায়ী এই দেবী করালবদনা, ঘোরা, মুক্তকেশী, চতুর্ভুজা, দক্ষিণা, দিব্যা, মুন্ডমালাবিভূষিতা। অধো বাম-হস্তে সদ্যচ্ছিন্ন শির ও ঊর্দ্ধহস্তে খড়্গ। অধো দক্ষিণহস্তে অভয় ও ঊর্দ্ধহস্তে বর। দেবী মহামেঘের মতো শ্যামবর্ণা। তাই বাংলাদেশে এই দেবীর নাম ‘কালী’ নয়, ‘শ্যামা’ ইনি দিগম্বরী, ঘোরদ্রংষ্টা, করালাস্যা, পীনোন্নতপয়োধরা, ঘোরনাদিনী, মহারৌদ্রী, শ্মশানগৃহবাসিনী। তিনি শবরূপ মহাদেবের হৃদয়োপরি সংস্থিতা, শিবাকূল দ্বারা চতুর্দিকে সমন্বিতা। তিনি মহাকালের সঙ্গে বিপরীতরতাতুরা, সুখপ্রসন্নবদনা ও স্মেরাননসরোরূহা।


মহানির্বানতন্ত্রে দেবী কালীর (বা শ্যামার) উল্লেখিত রূপের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। ‘ব্রহ্মযামলে’র আদ্যাস্তোত্রে আদ্যাদেবী কোন কোন দেশে কী রূপে পূজিতা হন তার  বিবরণ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ‘কালিকা বঙ্গদেশে চ’ অর্থাৎ বঙ্গদেশে দেবী  কালিকারূপেই পূজিতা হন। যদিও তন্ত্র আরাধনা ষোড়শ শতক পর্যন্ত এক গুহ্যসাধনপদ্ধতি ছিল, কিন্তু সপ্তদশ শতক থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে এই শ্যামামূর্তির, প্রকাশ্যে, অর্থাৎ জনগণের সমক্ষে মন্দিরে ও ব্যক্তিগত গৃহস্থ পরিসরে নিত্যপূজা প্রচলিত হয়েছে। এই নিত্যপূজা ছাড়াও বাৎসরিক দীপাবলী উৎসবের রাত্রে যে শ্যামাপূজা আজ আমরা দেখতে পাই, তার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭৬৮ সালে  রচিত কাশীনাথের ‘কালীসপর্যাবিধি’ গ্রন্থে। এই গ্রন্থটিতে বাংলাদেশে কালীপূজা করার  পক্ষে মানুষকে বিশেষভাবে অনুপ্রেরিত করা হয়েছিলএর থেকে বোঝা যায় সেই সময়ের আগে এদেশে কালীপূজা তেমন প্রচলিত ছিল না। আর একটি কিম্বদন্তী আছে, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রই বাধ্যতামূলকভাবে প্রজাদের কালীপূজা করতে আদেশ করেছিলেন। এর ফলেই বাংলাদেশে কার্তিকের কৃষ্ণাচতুর্দশীর রাতে শ্যামা ও মাঘের কৃষ্ণাচতুর্দশীতে রটন্তী নামে কালীপূজার প্রচলন হয়েছিল


এভাবেই ক্রমপর্যায়ে অনার্য রমণীর রূপকল্পে নির্মিত শক্তিরূপা মাতৃদেবী নিশ্ছিদ্র ব্রাহ্মণ্য অধ্যাত্মদুর্গে নিজের স্থান শুধু করে নিলেন তাই নয়, এক বিস্তীর্ণ ভূভাগে ব্রাহ্মণ্য পুরুষ দেবতাদের প্রভাব খর্ব করে নিজের রাজত্বও স্থাপন করলেন। মহানির্বাণতন্ত্র ও ব্রহ্মযামলে দেবীর কৃষ্ণবর্ণকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য নানা দার্শনিক রূপকের আয়োজন করা হয়েছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই বর্ণ কৃষ্ণা অনার্যমাতৃকার স্বীকৃতিমাত্র।

ইতিহাসের কোন সময়কাল থেকে দেবী কালী শক্তি আরাধনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করলেন, সে বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে। যদি দেবীপুরাণ (সপ্তম-অষ্টম শতক) মানি, তবে জানা যাচ্ছে, রাঢ়া-বরেন্দ্র-কামরূপ-কামাখ্যা-ভোট্ট দেশে (তিব্বত) বামাচারী শাক্তমতে দেবীর পুজো হতো। তাহলে এর সঙ্গে এটাও মানতে হবে যে, সপ্তম-অষ্টম শতকের আগেই বাংলাদেশে শক্তিপূজার প্রচলন হয়ে গেছিল। এর  কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তোত্তর যুগে উজ্জয়িনী কেন্দ্রিক মধ্য-ভারতের ইতিহাসে। যেখানে জয়দ্রথ-যামল গ্রন্থে ঈশান-কালী, রক্ষা-কালী, বীর্যকালী, প্রজ্ঞাকালী প্রভৃতি নানা রূপের কালীর বর্ণনা আছে। এছাড়া ঘোরতারা, যোগিনীচক্র, চক্রেশ্বরী প্রভৃতিরও উল্লেখ আছে। অতএব বোঝা যাচ্ছে আমাদের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী শাক্ত আরাধনার উৎসভূমি শুধুমাত্র বাংলা নয়। তা গুপ্ত বা গুপ্তোত্তর যুগে পশ্চিম ও মধ্য ভারত থেকে এসেছিল যার প্রমাণ, আগম ও যামল গ্রন্থগুলি। তবে এটা স্বীকৃত ঐ আগম বা যামল গ্রন্থের ধ্যান ও অন্যান্য কল্পনার থেকেই বাংলা দেশে বিস্তৃত তন্ত্রসাহিত্য ও ধর্মের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটেছিলযদিও দ্বাদশ শতকের আগে কোনও তন্ত্র-গ্রন্থের প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। পাল-চন্দ্র-কাম্বোজ লিপিমালা বা সেন-বর্মণ লিপিমালাতে গুহ্য তন্ত্র সাধনার স্পষ্ট উল্লেখ যদিও নেই, কিন্তু তৎকালীন শাক্ত ধ্যান  ধারণায় তান্ত্রিক ব্যঞ্জনা পাওয়া যায়। পালযুগের অসংখ্য শক্তিরূপা দেবীমূর্তি কিন্তু তন্ত্রোক্ত দেবী নয়, সেগুলি শৈবধর্মের আগম ও যামল অনুসারে কল্পিত শিবশক্তি মূর্তি। শৈব ধর্মের শক্তি ও শাক্তধর্মের দেবী পাল যুগ থেকেই পৃথক। বঙ্গদেশে পরবর্তীকালের কালীধারণা কিন্তু অতীতের বিচ্ছিন্ন দেবীকল্পনার বিবিধতাকে সমন্বিত করে এক ‘মহাদেবী’ রূপকল্পকে স্পষ্ট করে তোলার প্রচেষ্টায় প্রয়াসী হয়েছিল


তাঁকে মানুষ নানারূপে কল্পনা করেছে নিজস্ব মনের মাধুরী মিশিয়ে। সাধক কমলাকান্ত বলেছিলেন, “তুমি কখন কী রঙ্গে থাকো মা, শ্যামাসুধাতরঙ্গিনী / এই রঙ্গভঙ্গে অনঙ্গ অপাঙ্গে ভঙ্গ দাও মা জননী”।। যাবতীয় বিচিত্রমুখী ক্রমবিকাশকে আত্মস্থ করে ‘মহাদেবী’ হিসেবে এই মুহূর্তে দেবী কালীর স্বীকৃতি শুধু যে সর্বসম্মত তাই নয়,  প্রকৃতিপূজার সর্বাধিক প্রভাবী বিগ্রহ হিসেবে তাঁর ভাবমূর্তি আজ এদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন